নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ মানুষের জন্য

চাই সুন্দর ভাবে বাঁচতে...তাই চাই একটি সুন্দর পৃথিবী......

মাহবুবুল হক ওসমানী রাজু

সময় টেলিভিশন..

মাহবুবুল হক ওসমানী রাজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের মূল ধারার চলচ্চিত্রের জেন্ডার সংবেদনশীলতা যাচাই- পর্ব-১

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৫৫

ভূমিকা:



“তোমাদের উপার্জন করতে দেওয়া হয়নি।

পুরুষেরা নিয়েছে সেই ভার। তারা উপার্জন করে আনবে।

তোমরা থাকবে পরম নিশ্চিন্তে, ঘরকন্না করবে, গোরব ছিটাবে,

ইতুপূজো করবে মূঢ়তার চুড়ান্ত করে সংসারে তলিয়ে যাবে।

অথচ ঠিক সময়ে লুচি ভেজে আনছ, কোন লুচি যে ভাজছ

সে খবর কেউ জানে না। জানবার প্রয়োজনও মনে করে না।...”

(আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ -রানী চন্দ ১৩৪৮, ২০ এপ্রিল ১৯৪১)



বছর চারেক আগে অধুুনা জনপ্রিয় পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত একটি টেলিফিল্ম

‘চড়–ইভাতি’ আলোড়িত করেছিল বাংলাদেশের মিডিয়া জগত। বলতে আপত্তি নেই টেলিফিল্মটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলো এবং তা থেকে উৎসাহিত হয়ে ফারুকী পরবর্তীতে এ টেলিফিল্মের রেশ ধরে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘ব্যাচেলর’। মিডিয়াতে প্রায় জোর করেই বলা হয় ‘সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র ফিরে এসেছে। এবার দর্শকদের হলমুখী হওয়া উচিত।’ সত্যিই কি সুস্থতা এসেছে?



গণমাধ্যমের সুস্থতার সাথেই নারীর অবস্থানের সম্পর্ক জড়িত। নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে অশ্লীল, কুরুচির বিশাল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যা আসলে শুধু বাংলাদেশে নয়; সারাবিশ্ব জুড়েই। গণমাধ্যমের এই জোয়ারে বাংলাদেশও একই পথে গা ভাসিয়েছে; গণমাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিশাল অসুস্থ পরিবেশ। যেখানে ‘অসুস্থ’ পুরুষের নিমিত্তে নারীকে পণ্য হয়ে থাকতে হয়। বর্তমানে ‘সংস্কার’ জোয়ারে বলা হচ্ছে গণমাধ্যমে ফিরে এসেছে সুস্থতা। কিন্তু এই তথাকথিত সুসাথ চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান ঠিক আগের মতই। পার্থক্য নেই মানসিকতায় এবং আচরণে; কেবল পরিবেশন আঙ্গিক বদলেছে। নারীর এই অবস্থান মিডিয়ার সর্বক্ষেত্রে। নারী এখানে কেবল দৃশ্য বস্তু (পণ্য); কখনোই প্রধানতম ভূমিকায় আসেনি, বা আসতে দেয়া হয়নি বা সার্বিকভাবে নারীর মধ্যে এমন একটি ইমেজ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে একজন নারী ভাবতে বাধ্য হয়, সে পুরুষের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত মাত্র; তার নিজের কিছু করার নেই। সে উপকরণ, কখনোই কারিগর নয়; সে সুদৃশ্য, কিন্তু চালক নয়। মিডিয়াতে; হোক তা চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, অধুনা ইন্টারনেট সবখানেই নারী দৃশ্যমান পণ্য; কখনোই নেপথ্যের কারিগর নয়।



নারীকে সুযোগ দিলে বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞায় এমনকি শারীরিক শক্তিতেও ন্যায় শাসনকার্য চালাতে পারে এমন চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন আজ থেকে পৌণে দুই’শ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের প্রধান নারীচরিত্র প্রফুল্লমুখীকে ঘিরে। নারীর ইতিবাচক দিকগুলো তুরে ধরে বঙ্কিমচন্দ্র বাহবা পেতে পারতেন আজকে জেন্ডার সচেতন সমাজের কাছে। কিন্তু উপন্যাসের শেষ অংশে পরাক্রমশালী এই নারীটিও পুরুষের তৈরী করা মূল্যবোধ ও পুরুষতন্ত্রের রক্ষক শাস্ত্রের প্রতি অনুগত হয়ে ফিরে আসে নিষ্ঠুর, শঠ ও বিশ্বাসঘাতক শ্বশুর ও স্বামীর বাড়িতে যেখানে স্বামীর আরও দু’টি স্ত্রী রয়েছে। সেকালের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের নায়িকা দেবী চৌধুরাণী নয় বঙ্কিমচন্দ্রও পুরুষতন্ত্রের অনিবার্য শিকার হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “খাতা” গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন-নারীর সৃজনশীলতা কত নিষ্ঠুরভাবে দমিত হয়েছে পুরুষের হাতে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালীতে খুব স্পষ্ট করে মেয়ে শিশু ও ছেল শিশুর বেড়ে উঠায় পারিবারিক যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা ফুটে উঠেছে। উপন্যাসে যে কিশোরীর জীবন চিত্রায়িত তার নাম দূর্গা, তারই ছোটভাই অপু। পড়ালেখার বয়স হলে অপুকে পাঠশালায় ভর্তি করা হয়, কিন্তু দূর্গার কোন শিক্ষাজীবন নেই। তার শিক্ষা নেয়ার পাঠশালা প্রকৃতি- মাঠে, প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় সে। একসময় প্রতিবেশী খুড়িমার দেবরের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসে। বয়সের বিস্তর ব্যবধান কোন বিবেচনায় না এনে মন্তব্য করা হয়, ‘ঠাকুরপোর সঙ্গে বিয়ে হলে তোকে মানাবে ভাল।’ জ্বরের ঘোরে দূর্গা প্রায় অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছোট্ট ভাইয়ের কাছে এভাবে প্রকাশ করে- ‘আমায় একদিন তুই রেলগাড়ি দেখাবি?’ চার দেয়ালে আবদ্ধ এক কিশোরীর জীবনে বাইরের জগৎ অজানা ছিল- যা অপুর জন্য ছিল উন্মুক্ত। বিভূতিভূষণের লেখায় ছেলে এবং মেয়ে শিশুর প্রতি পরিবারের, সমাজের যে দৃষ্টিভিন্নতা উঠে এসেছে তা অবশ্যই সে সময়ের প্রচলিত আচরণে আঘাত করেছে।





বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বিকাশের ঐতিহাসিক পটভূমি:



চলচ্চিত্রের ইতিহাস খুব পুরানো নয়। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮ ডিসেম্বর প্যারিস নগরীতে অগাস্ট লূমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই বায়োস্কোপের প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করেন। এর ছয় মাস পরেই লুমিয়ের ভাতৃদ্বযের একজন প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের একটি হোটেলে ১৮৯৬ খিস্টাব্দে ৭ জুলাই উপমহাদেশের প্রথম বাযোস্কোপের প্রদর্শনী করেন। ১৮৯৮ খিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ঢাকার সদরঘাটস্থ পটুয়াখালির ক্রাউন থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখানো হয়।



১৯২৭-১৯২৮ সালের দিকে ঢাকার নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুর চলচ্চিত্র নির্মানের উদ্যোগ নেন। তারা সুকুমারী নামে অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্তের পরিচালনায় চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হয় সাঙস্কৃতিক কর্মকান্ড। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা এবং স্টুডিও নির্মানের উদ্যোগ নেন। ১৯৫২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে বাংলা ভাষা আন্দোলন এ অঞ্চলের সচেতন বাঙ্গালিদের স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রশাসনিক শোষণের সাথে চলছিল সাংস্কৃতিক শোষণও। ভাষা আন্দোলনের বছর দুয়েকের মধ্যেই চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য শহীদুল আলম, আব্দু জব্বার খান, কাজী নুরুজ্জামান প্রমূখের নেতৃত্বে ইকবাল ফিল্মস এবং ড. আব্দুস সাদেক, দলিল আহমদ, আজিজুল হক, দুদু মিয়া, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী কালক প্রমূখকে নিয়ে গঠিত হয় কো অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। ১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর কাজ শুরু হয় আব্দুল জব্বার খানের পরিচালনায়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক বাংরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট।



১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে বিল পাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এফডিসি প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরের মধ্যে (১৯৫৭-১৯৯৭) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রারম্ভে নির্মিত চলচ্চিত্র গুলোতে জীবনবোধ, শিল্পশোভনতা ও পচ্ছিন্নতার ছাপ ছিল। কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতে বাণিজ্যিক কারণে চলচ্চিত্রে যোগ হয় মারপিট, সংঘাত, অতি আবেগ, সস্তা রোমান্স, নাঁচ, গান, যৌনতা এবং বিদেশী ভাবধারা ও কাহিনীর নকল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চলচিত্রের বিকাশ যেমন হয়েছে তেমনি ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অশ্লীলতা।



সমকালে চলচ্চিত্র খুবই শক্তিশালী এক গণমাধ্যম। তুলনামূলক আধুনিক, বলিষ্ঠ এবং মানবমনে ও সমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম এই গণমাধ্যমের রয়েছে বহুমুখী ও জটিল চরিত্র। দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্র এক আবেগময় অভিজ্ঞতা। (সিরাজ ও মাহমুদ, ২০০১:১১) অথচ দর্শক মনের খোরাক জোগানোর এ মাধ্যমটি টিকিয়ে রাখার রসদ হিসেবে প্রতি বছর এফডিসি থেকে যতসংখ্যক ছবি নির্মিত হচ্ছে তাতে নারী ও পুরুষ চরিত্রগুলো রূপায়িত হচ্ছে গৎবাঁধা ধারণা থেকে। যে কারণে নির্মিত ছবিগুলোতে পুরুষকে দেখানো হচ্ছে সর্বশক্তিমান হিসেবে। আর নারীদেরকে দেখানো হচ্ছে অবলা, অপাঙক্তেয়, অক্রিয়, অত্যাচারিত, দুর্বল হিসেবে। অর্থাৎ নারীর যে আলাদা ব্যক্তিসত্তা, মননশীলতা, বোধ, বিবেক, স্বকীয়তা আছে-সর্বোপরি স্বীয় নারীর প্রতিভায় স্বনির্বাচিত পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবার যে সামর্থ্য আছে, হয় তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে নতুবা সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।



মূলত আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, মানসিকতা এর অন্যতম নিয়ামক এবং চালিকা শক্তি; এককথায় লা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কর্তৃক আরোপিত। আর এই সমাজব্যভস্থা একশ্রেণীর মুনাফালোভী চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ীদের পর্দার-নারী-চরিত্রকে পুঁজি করে মুনাফা লুটতে সাহায্য করছে। যেজন্য অতীতে এদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে নারেিক তার মা, বোন, ভাবী, প্রেসিকা-এ ধরনের গৎবাঁধা চরিত্রের বাইরে যেমনটি দেখা যায়নি, তেমনটি বর্তমানেও খুব বেশি একটা দেখা যাচ্ছে না। কারণ পুরুষের চোখে নারীর ভূমিকা চারটি: মাতা, কন্যা, বধূ; এ তিনটির কোনোটি না হলে নারী হয় উর্বশী অর্থাৎ পতিতা। শুধু নারীরূপে নারীর কোনো মর্যাদা নেই। (আজাদ, ১৯৯৮:২২) এ ধারণার ব্যতিক্রম হয় না বড়-পর্দার নারী-চরিত্র রূপায়নেও।





প্রত্যয়সমূহের কার্যকর ব্যাখ্যা:



চলচ্চিত্র মাধ্যম:



“ঋৎড়স হড়ি ড়হ ভরষস রিষষ নব ঃযব সড়ংঃ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ভড়ৎস ড়ভ অৎঃ.”

-ঝবৎমবু ঊরমবহংঃবরহ



চলচ্চিত্র বর্তমান বিশ্বের এক বিস্ময়কর শিল্প ও গণমাধ্যম। আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে আধুনিক, বলিষ্ঠ এবং মানব মনে ও সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী অসাধারণ এই গণমাধ্যমটি সমাজ, সভ্যতা, সংষ্কৃতির ধারক ও বাহক। পৃথিবীর সকল দেশে, সকল প্রান্তে সমভাবে জনপ্রিয় এই শিল্প মাধ্যম ক্রমবিকাশের ধারায় বহু বৈশিষ্ট্য ও বর্ণে বর্ণাঢ্য হয়েছে- স্বীকৃতি পেয়েছে গণযোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। আন্তর্জাতিক ভাব বিনিময় এবং মানব সমাজের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের রয়েছে অসামান্য অবদান। দর্শন শ্রবনেন্দ্রিয়ের সাহায্যে রূপালী পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্য প্রতিমা (ওসধমব) ও ধ্বনি (ঝড়ঁহফ) এর সঙ্গে নিরক্ষর শ্রেনীও অনায়াসে একাত্ব হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া একত্রে প্রচুর লোক ছবি দেখতে পারে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের উপর চলচিত্রে প্রভাবও প্রচুর। কার্যত: তথ্য, সংযোগ, শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য সিনেমার ভূমিকা অদ্বিতীয়। চলচ্চিত্রে এই অপরিসীম ক্ষমতা লক্ষ্য করেই ১৯১৭ সালে লেনিন বলেছিলে- ‘ঙভ ধষষ ধৎঃ পরহবসধ রং ঃযব সড়ংঃ রসঢ়ড়ৎঃবহঃ’. লেনিনের এই মন্তব্য নিছক কথার কথা ছিলনা । পরবর্তীতে বিপ্লোবেত্তার রাশিয়ার নির্মিত ‘স্ট্রাইক’, ‘ব্যাটলশীপ পটেমকীন’, ‘অক্টোবর’, ‘মাদার’ ‘আর্থ’ ইত্যাদি ছবিগুলোর সফলতাই এর উপযুক্ত উদাহরণ।



সেক্স ও জেন্ডার:

‘জেন্ডার’ শব্দটি আভিধানিক অর্থ লিঙ্গ(ঝবী)। সাধারণ ব্যাকরণেও জেন্ডার শব্দটি ব্যবহৃত হয় লিঙ্গ(ঝবী) চিহ্নিত করার জন্য। কিন্তু এভাবে জেন্ডার এবং সেক্স একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসলেও সাম্প্রতিক উন্নয়ন সাহিত্যে জেন্ডার ভিন্ন ও ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাই আজ জেন্ডার এবং সেক্স-এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য টানা হয়। সাধারণভাবে ‘সেক্স’ হচ্ছে জৈবিকভাবে নির্ধারিত বিষয়। আর জেন্ডার হচ্ছে, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক। এর মাধ্যমে শরীরের বিশেষ কোন প্রত্যঙ্গ বুঝায় না। এটি সমাজসৃষ্ট, সমাজের মতাদর্র্শ সৃষ্ট। কাজেই যখন বলবো, ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ তখন জৈব লিঙ্গ (ঝবী) বোঝানোই মূল উদ্দেশ্য; কিন্তু যখন বলবো, ‘মেয়েলি’ কিংবা ‘পুরুষালি’ তখন জেন্ডারকে নির্দেশ করে যা একজন নারী বা পুরুষের লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে আরো অনেক কিছুর প্রকাশ ঘটায়, যা শারীরিক নয় বরং স্বভাব বা আচরণগত। ‘জেন্ডার’ শব্দটি প্রখম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ নারীবাদী অহহব ঙধশষবু।



অহহ ডযরঃবযবধফ জেন্ডার ধারণার একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, যার দ্বারা আমরা সমাজে নারী, পুরুষের জেন্ডারভিত্তিক অবস্থা ও অবস্থানকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। তাঁর মতে, “ঞযব ৎবষধঃরড়হং নবঃবিবহ সবহ ধহফ ড়িসবহ ধৎব ংড়পরধষষু পড়হংঃরঃঁঃবফ ধহফ ফবৎরাবফ ভৎড়স নরড়ষড়মু. ঞযবৎবভড়ৎব ঃযব ঃবৎস মবহফবৎ ৎবষধঃরড়হং ংযড়ঁষফ ফরংঃরহমঁরংয ংঁপয ংড়পরধষ ৎবষধঃরড়হং নবঃবিবহ সবহ ধহফ ড়িসবহ ভৎড়স ঃযড়ংব পযধৎধপঃবৎরংঃরপং, যিরপয পধহ নব ফবৎরাবফ ভৎড়স নরড়ষড়মরপধষ ফরভভবৎবহপব. ওহ ঃযরং পড়হহবপঃরড়হ ংবী রং ঃযব ঢ়ৎড়ারহপব ড়ভ নরড়ষড়মু. ও.ব. ভরীবফ ধহফ ঁহপযধহমবধনষব য়ঁধষরঃরবং, যিরষব মবহফবৎ রং ঃযব মবহফবৎ ধৎব ঃযব ঢ়ৎড়ারহপব ড়ভ ংড়পরধষ ংপরবহপব, র.ব. য়ঁধষরঃরবং যিরপয ধৎব ংযধঢ়বফ ঃযৎড়ঁময ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ংড়পরধষ ৎবষধঃরড়হং ধহফ রহঃবৎধপঃরড়হং.”



অন্যদিকে, জেন্ডার সম্পর্কে ঝুঁধহহব ডরষষরধসং- এর ভাষ্য:

“এবহফবৎ রং ধহ ড়ষফ ড়িৎফ যিরপয যধং ঃধশবহ ড়হ ধ হবি সবধহরহম. ওঃ রং ধ ঢ়ড়ৎঃসধহঃবধঁ ড়িৎফ, পড়হঃধরহরহম ধ ংবঃ ড়ভ রহঃবৎ-ৎবষধঃবফ রফবধং. ইবপধঁংব ঃযরং ঁংব ড়ভ ঃযব ড়িৎফ রং হব,ি ধ শরহফ ড়ভ ংযড়ৎঃযধহফ, রঃ রং ফরভভরপঁষঃ ঃড় ঃৎধহংষধঃব.”



ডরশরঢ়বফরধ, ঃযব ভৎবব বহপুপষড়ঢ়বফরধ-তে জেন্ডারকে এভাবে সঙ্গায়িত করা হয়েছে-

ঞযব ড়িৎফ "মবহফবৎ" যধং ংবাবৎধষ ফবভরহরঃরড়হং. ঈড়ষষড়য়ঁরধষষু, রঃ রং ঁংবফ রহঃবৎপযধহমবধনষু রিঃয "ংবী" ঃড় ফবহড়ঃব ঃযব পড়হফরঃরড়হ ড়ভ নবরহম সধষব ড়ৎ ভবসধষব, নঁঃ রহ ঃযব ংড়পরধষ ংপরবহপবং রঃ ৎবভবৎং ঃড় ংঢ়বপরভরপধষষু ংড়পরধষ ফরভভবৎবহপবং, ংঁপয ধং নঁঃ হড়ঃ ষরসরঃবফ ঃড় মবহফবৎ রফবহঃরঃু. গড়ৎব ৎবপবহঃষু, রঃ যধং নববহ বয়ঁধঃবফ রিঃয রিঃয "ংবীঁধষ ড়ৎরবহঃধঃরড়হ" ধহফ "রফবহঃরঃু" (বংঢ়বপরধষষু খএইঞ ংবীঁধষরঃু). চবড়ঢ়ষব যিড়ংব মবহফবৎ রফবহঃরঃু ভববষং রহপড়হমৎঁবহঃ রিঃয ঃযবরৎ নরড়ষড়মরপধষ ংবী সধু ৎবভবৎ ঃড় ঃযবসংবষাবং ধং "রহঃবৎমবহফবৎ".

বাংলা ভাষায় তাই এই জেন্ডার এর ধারণাগত অর্থ প্রকাশ করার কোন সঠিক প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষ সাধারণত লিঙ্গ বা নারীদের সাথে জেন্ডারকে এক করে দেখে। এজন্য বিষয়টিতে কিছুটা দুবোর্ধ্যতা বা অস্পষ্টতা রয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে: সেক্স হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট নারী, পুরুষের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্য যা অপরিবর্তনীয়। আর, জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গড়ে উঠা নারী-পুরুষের পরিচয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক, সমাজ কর্তৃক আরোপিত নারী-পুরুষের ভূমিকা যা অপরিবর্তনীয়।



জেন্ডার সংবেদনশীলতা :

সংবেদনশীলতা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ঝবহংরঃরারঃু’ । এর অর্থ হচ্ছে ‘অনুভূতিপ্রবণতা’। মূলত সমাজে নারীর প্রান্তিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারীর অধঃস্তন অবস্থার জন্য দায়ী মনোভাব ও আচরণকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করতে উদ্বুদ্ধ করে, বলা চলে পুরুষতান্ত্রিকতার ছাঁচে গড়া নারীর ইমেজকে দূরীভূত করার লক্ষ্যে বিবেক, সত্য, বস্তুনিষ্ঠতা প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠে জেন্ডার সংবেদনশীলতা। নারী পুরুষ সম্পর্কে বৈষম্যসুলভ মনোভাব থেকে মুক্ত হওয়াকেই বলা হয় জেন্ডার সংবেদনশীলতা।



অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পারিবারিক এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি স্তরে নারীকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জেন্ডার সংবেদনশীলতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে Ñ

“ঐধারহম ধহ ঁহফবৎংঃধহফরহম ঃযব সধৎমরহধষরুবফ ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ড়িসবহ ধহফ পড়হপরড়ঁংষু পযধষষবহমরহম যঃব ধঃঃরঃঁফব ধহফ নবযধারড়ৎ ঃযধঃ ড়িসবহ’ং ংঁনড়ৎফরহধঃব ংঃধঃঁং”.



জেন্ডার পক্ষপাত:

পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রের, কিংবা ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি স্তরে নারী কিংবা পুরুষের বিবেচনা না করে শুধু নারী পুরুষ হিসেবে দেখার প্রবণতাকেই জেন্ডার পক্ষপাত বলে অভিহিত করা হয়।



গবেষণা পদ্ধতি:



আমার এই গবেষণার গবেষণা করার ক্ষেত্রে আমি ‘গুণগত আধেয় বিশ্লেষণ’ পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। মূলত আমার বিষয় হচ্ছে চলচ্চিত্রের জেন্ডার সংবেদনশীলতা যাচাই করা তাই এক্ষেত্রে আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনেক কার্যকর। তবে এখানে পরিমাণগত আলোচনা করা থেকে বিরত থেকে বর্ণনাত্মক আলোচনায় জোড় দিয়েছি । আর এভাবে কোন ভিজুয়াল বিষয়ের গুণগত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করাকে বলা হয় ‘ডিসকোর্স অ্যানালাইসিস’। আবার আমি বিশ্লেষণের সুবিধার্থে ‘কেস স্টাডি’ পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। আর এসব পদ্ধতির মাধ্যমে আমি বিভিন্ন দিক থেকে চলচ্চিত্রের জেন্ডার সংবেদনশীলতা যাচাই করার প্রয়াস চালিয়েছি।



নমুনা নির্বাচন:



আমি দুটি চলচ্চিত্রের উপর জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ ও যাচাই করেছি। এই চলচ্চিত্রদ্বয়কে আমি ‘উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন’ এর ভিত্তিতে নির্বাচন করেছি। কেননা, আমি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্রগুলোতে ‘জেন্ডার অসংবেদশীলতা’ সম্পর্কিত কিছূ উপাদান খুঁজে পেয়েছি যা আমার গবেষণার মূল বিষয়। তাছাড়া এগুলো আমার কাছে আগে থেকেই সংগৃহীত থাকায় এগুলোকে বার বার দেখার সুযোগ হয়েছে। ফলে জেন্ডার সম্পর্কিত গবেষণার খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস থেকেই আমি এই দুটি চলচ্চিত্র নির্বাচন করেছি।



গবেষণার উদ্দেশ্য:



সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, যে সমাজে নারী-পুরুষের সমতা নেই, সে সমাজ উন্নয়ন কখনো সম্ভব হয় না। যেহেতু আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, তাই এখানে পরিপূর্ণ উন্নয়ন আশা করা মানে বাতুলতা। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সমাজে উন্নয়ন ঘটানো। আর নারী ও পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা সমাজ উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশের চলচ্চিত্র মাধ্যম যেখানে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক আধেয় নির্মানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের পর্দায় সমাজে নারীর অধীনতার চিত্র ফুটে উঠে, যা সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত। তাই, এই পর্দা বা স্ক্রিন থেকে পুরুষতান্ত্রিকতাকে বিদায় জানাতে হবে, নারীর অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই রকম একটি মূখ্য উদ্দেশ্য থেকেই আমার এই গবেষণা। এছাড়া আরো যে সব উদ্দেশ্যে এ গবেষণা কর্মটি পরিচালিত হয়েছে, তা নিম্নরূপ:



আমার গবেষণার বিষয়বস্তু হলো, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জেন্ডার সংবেদনশীলতা যাচাই করা’। তাই যেসকল উদ্দেশ্য গুলো নিয়ে আমি এই গবেষণা কর্মটি সম্পাদন করেছি সেগুলো হলো :



ক্স বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থাপন এবং চরিত্রায়ন বিশ্লেষণ করা

ক্স নারী-পুরুষের দৃশ্যায়ন, চরিত্র বিন্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি, মন মানসিকতার তুলনামূলক পর্যলোচনা

ক্স চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত বোধে নারীর অবস্থান দেখা

ক্স শব্দ, ভাষা, বাক্য বিন্যাস, ডায়ালগ, ক্যামেরার কাজ প্রভৃতিতে জেন্ডার সংবেদনশলিতা যাচাই

ক্স সিনেমার পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং নেপথ্যের কর্মী কারা এবং তাদের অবদান কতটা জেন্ডার সংবেদনশীল তা যাচাই করে দেখা

ক্স সমাজের বাস্তবতা চলচ্চিত্রে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে কিংবা আদৌ হচ্ছে কিনা এবং হলে সমাজে এর প্রভাব কেমন তা দেখা

ক্স চরিত্রে নারী কতটা স্বক্রিয় কিংবা নিস্ক্রিয় তা যাচাই করে দেখা।

ক্স চলচ্চিত্রের নারী ইমেজ বাস্তব নারী ইমেজের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা দেখা।



সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা:



একদিকে আমার মনস্তত্ত্ব অন্যদিকে বাস্তবতা-এই বিষয়টিই আমার গবেষণার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। আমি নিজেই একজন পুরুষ। আবার বাস্তবতা হচ্ছে পুরুষরাই নির্মান করে চলেছে নারী সম্পর্কিত কিছু মিথ। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকেই মূলত আমার এই গবেষণার হাতেখড়ি। একদিকে আমার ভেতরে গড়ে উঠা নারীবাদী চিন্তা অন্যদিকে পুরুষালি বাস্তবতা এই দুটোর গ্যাঁড়াকল কিছুটা হলেও আমার গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। চলচ্চিত্র নিয়ে জেন্ডার সম্পর্কিত গবেষণা হিসেবে এটি আমার প্রথম গবেষণা। তাই , অপরিপক্ব লিখনী, অপরিপক্ব চিন্তাধারা আর অপরিপক্ব গবেষণা - এই সবকিছুকে আমার গবেষণার জন্য অন্যতম সমস্যা বলে বিবেচনা করেছি। তারপরও যেহেতু আমি এই গবেষণার প্রতি আন্তরিক তাই আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি একটি বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে মূল তথ্যটি উদঘাটন করার মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ের পদক্ষেপকে স্বার্থক করে তুলতে।



গবেষণার পূর্বানুমান:



 চলচ্চিত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর উপস্থাপন অনেক বেশি পক্ষপাতদুষ্ট এবং জেন্ডার অসচেতন।

 চলচ্চিত্রে নারীকে শুধুমাত্র সেক্স সিম্বল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

 সংলাপে, ক্যামেরার কাজে এবং ইঙ্গিতপূর্নভাবে নারীর প্রতি নানা ধরণের জেন্ডার অসংবেদনশীল বিষয় উপস্থাপন করা হয়

 নারীকে অবলা, রূপবিলাসী, ভোগ্য, নিস্ক্রীয়. সাংসারিক, অন্তপুরবাসিনী, নির্যাতিত এবং ভাল মা হিসেবে গতানুগতিক ও সনাতনী ইমেজেই ফুটিয়ে তোলা হয়।



তথ্য উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ:



১. সিনেমা পরিচিতি:



সিনেমার নাম ঢাকাইয়া পোলা বরিশালের মাইয়া

কাহিনী মোহাম্মদ আযাদ

চিত্রনাট্য সংলাপ

ও পরিচালনা উত্তম আকাশ

স্থির চিত্র মনির উদ্দিন মনির

পরিবেশনা নাদিম নাফিম ফিল্মস

সঙ্গীত শিল্পী

এনড্রু কিশোর, কমল, সুইটি, রূমা, ইয়াসিন, শাহীন

সঙ্গীত পরিচালনা কাজী জামাল

সম্পাদনা নাজির হাসান

অঙ্গসজ্জা শাহ আলম

রূপ সজ্জা সেলিম, বিল্লাল হাওলাদার

আবহ সঙ্গীত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

চিত্র গ্রহণ মুজিবুল হক ভূঁইয়া

অভিনয়ে শাকিব খান, শাবনুর, কাবিলা, নাসরিন, নাসির খান, রেহানা জলি, ডন, সুচরিতা ও হুমায়ুন ফরিদি



কাহিনী সংক্ষেপ:

পুরোনো ঢাকার ছেলে আর বরিশালের মেয়ের ভালোবাসার দ্বন্দ্ব নিয়ে তৈরি এই সিনেমাটি। পুরোনো ঢাকার ব্যবসায়ীর জুলফিকার আলী মোল্লার (হুমায়ুন ফরিদি) ছেলে মগবুল (শাকিব খান)। ছেলের বিয়ের জন্য ব্যাতিব্যস্ত ছেলের বাবা। পাংকু আবুল (কাবিলা) মগবুলের বন্ধু। সে আবার পছন্দ করে নাসরিনকে। বরিশালের মগবুলের বাবার বন্ধু সাঈদ আলীর মেয়ে সুইটির সাথে মগবুলের বিয়ে ঠিক করে। মগবুলের মা মগবুলকে এই কথা জানাতেই তার সুইটির কথা মনে পড়ে যায়। কল্পনায় সে তখন সুইটিকে দেখতে পায়। আর দর্শক পর্দায় দেখে অশ্লীল ও আটসাঁট পোশাকের মডার্ণ সুইটিকে। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলও পা থেকে বুক পর্যন্ত নিয়ে এই সুইটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করে। দর্শককে একটু সুরসুরি দিতেই এই আয়োজন। মগবুলের মায়ের সাজ-পোশাকেও দেখানো হয় চকচকে শাড়ি আর সারা শরীর গহনায় আবৃত। বিয়ের আয়োজন উপলক্ষ্যে মগবুলের বাবা মেয়ের বাড়িতে মাছ পাঠাতে চায়। আর এজন্য পাংকু আবুলকে দায়িত্ব দেয়। আবুল তখন বরিশালের এক মাছের ব্যবসায়ী মহাজনের (নাসির খান) সাথে যোগাযোগ করে। এসময় ঢাকায় এই মহাজন তার মেয়ের জন্য গহনা কিনতে আসে। আবুলের ফোন পেয়ে মগবুলদের বাড়িতে আসে এই মহাজন। কিন্তু মহাজনকে বসতে না দেয়া এবং আভিজাত্যের দম্ভে দুজনের সাথেই অল্প-বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় লিফটে দেখা হয় মগবুলের সাথে মহাজনের মেয়ে রানীর (শাবনূর)। তাদের সাথে এ সময় কথাবার্তা হয়। আর মগবুলের ভালো লেগে যায় তাকে। সব বন্ধু বান্ধব মিলে আবুলের বরিশালের বাড়িতে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করে মগবুল। এক সময় বরিশালে এসে পৌঁছায় মগবুল তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে। বরিশালে পৌঁছেই মগবুলের দেখা হয় রানীর সাথে। এক সময় নদীর পাড়ে ঘুরতে বেড়িয়ে মগবুল নদীর পাড়ের চোরা বালিতে আটকা পড়ে। তখন রানী এসে বাঁচায় তাকে। রানীর বাবার কানে গেলে তার বাবা এতে ভীষণ ক্ষেপে যায়। এক সময় মগবুলের সাথে রানীর প্রেম হয়ে যায়। রানীর বাবা তা জেনে ফেলে। রানীর বাবা তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে বিল্লুর (ডন) সাথে। বিল্লু তখন মগবুলকে বেদম প্রহার করে। এ অবস্থায় মগবুল ঢাকায় চলে আসে। মগবুল ভুলতে পারে না রানীকে। রানীও ভুলতে পারে না মগবুলকে। দুজনেই নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেয়। রানীর বাবা ঢাকা আসে মগবুলের বাবার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু মগবুলের বাবা তা মানতে চায় না। রানীর বাবাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মগবুল তখন বরিশালে পৌঁছায় রানীর কাছে। রানীকে নিয়ে পালায় মগবুল। তাদের পিছু নেয় বিল্লু ও তার দলবল। আবুল এসে মগবুল আর রানীকে সবার আড়াল করতে নিঝুম দ্বীপে নিয়ে যায়। সারা গ্রাম তন্য তন্য করে খুঁজেও তাদের পায় না বিল্লুর লোকজন। মগবুলের বাবা চলে আসে বরিশালে। রানীর বাবার সাথে ঝগড়া লেগে যায় তার। একসময় আবুলকে ধরে ফেলে বিল্লুর লোকজন। আবুল তখন বলে দেয় মগবুলদের খবর। বিল্লু তার লোকজন নিয়ে এসে মগবুলকে মেরে রানীকে নিয়ে যায়। বিয়ের জন্য আয়োজন করে বিল্লু। মগবুল এসে বিল্লুকে মেরে রানীকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় বিল্লু আর তার লোকেরা মগবুল আর রানীকে ধরতে ধাওয়া করে। রানী আর মগবুল তখন নদীতে ঝাপ দেয়। নদীর জেলেরা তাদের খুঁজে পায়। দু’জনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যেহেতু বাংলাদেশের সিনেমা তাই এক সময় দু’জনেই বেঁচে ওঠে। এ সময় দুই পরিবারের লোকজনই তাদের মেনে নেয়। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো।



সংলাপ নাকি পাগলের প্রলাপ:



চাপা মাইরা একেবারে হোয়াইয়া ফালা

আবুল নাসরিনের সাথে তার বাড়ির গল্প করছে। এর সবই ভুয়া। তখন মগবুল এসে আবুলকে বলে এই কথা। মগবুলের একথা শুনে হাসে নাসরিন ।



আমমেহ কেমন বেশরম মানুষ, মোরে একলা পাইয়া কেমনে চাইয়া রইছে

মগবুলকে উদ্দেশ্য করে রানীর বক্তব্য এটি। লিফটের মধ্যে রানীকে দেখে তাকিয়ে থাকে মগবুল। এ সময় রানী এ কথা বলে। পুরুষের কাজ শুধু নারীর দিকে তাকিয়ে থাকা। নারীর রূপ যৌবন অবলোকন করা।



আন্দাজে টিপাটিপি কইরো না

রানী লিফটের সুইচ খুঁজে না পাওয়ায় তাকে এ কথা বলছে মগবুল। তবে তার বক্তব্যে স্পষ্টতই অশ্লীলতার ছোঁয়া রয়েছে। দর্শককে একটু নড়েচড়ে বসাতেই কাহিনীকার এমন একটি বাক্য নায়কের মুখ থেকে বলালেন।





তোমার সরলতা দেইখা হাসবার লাগছি

মগবুল রানীকে বলে এ কথা। কারণ রানী লিফট চেনে না। লিফটে কিভাবে উঠতে হয় তাও জানেনা। আর তার দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকা মগবুলকে দেখে কিছুটা ভয় পায় সে। তখন রানীর এই সরলতা দেখে হাসে মগবুল।



বাপটা বড় ভেজাইল্লা, কিন্তু মাইয়াডা জোস

রানীর তার বাবার সাথে চলে গেলে মগবুল একাকী এ কথা বলে। নারীরা যেন কোন দর্শনীয় বস্তু। তাই তাকে দেখে জোস শব্দ উচ্চারণ করে পুরুষ।



মগবুলকে দেখলে যে কোন মেয়েই ওর প্রেমে পড়ে যাবে

মগবুলের জন্য ঠিক করা পাত্রী সুইটি এ কথা বলে তার বাবাকে। চলচ্চিত্রটিতে বোঝানো হচ্ছে যে মেয়েদের কাজ যেন শুধু পুরুষের প্রেমে পড়া। তার অন্য কোন কাজ নেই।



আরেকটা জিনিস দেখমু, এক নজর দেখছি এহোনো চোক্ষে আগুন জ্বইল্লা রইছে

মগবুল রানীর সম্পর্কে এ কথা বলে আবুলকে। নারীরা যেন জিনিস। বাজারের পণ্য। টাকা পয়সার বিনিময়ে পাওয়া যায়। নারীর রূপ সৌন্দর্য চোখে লেগে থাকে পুরুষের।



নাসরিন যদি মোর লগে যায় তয় মোর দিলটা ফাইপ্পা ফুইল্লা ওডবে

আবুল এ কথা বলে মগবুলকে। নারী যদি পুরুষের সাথে থাকে তবে পুরুষের দিলটা ভরে উঠবে। পুরুষ যেন নারীর সান্নিধ্যে আসতে পারলে শান্তি লাভ করে।



আমারো কি কম মজা লাগদে আছে, আসো একটু চাপ দেই

আবুল নাসরিনকে জড়িয়ে ধরে এ কথা বলে। পুরুষ নারীকে দেখলেই কাছে টানতে চায়। জড়িয়ে ধরতে চায়। যৌন ক্ষুধা মেটাতে চায়।





দুইদিন পর তোমার বিয়া, যাও ঘরে যাও

রানীর বাবা রানীকে এ কথা বলে। বিয়ের বয়স হলে নারীকে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। নারী তখন বদ্ধ খাঁচার পাখি। বিয়ে যেন নারীকে দেয় এক বন্দী দশা।



নারীর ‘অপস্থাপন’



ভালোবাসা মানে জরাজরি:

এই ছবিটি নির্মান করা হয়েছে দর্শকদের ভালোবাসার মাহাত্ম্য শেখাতে। আর তাই এই ছবির নায়ক-নায়িকার জরাজরি আর চুম্বন দৃশ্য দেখে অনেকেরই ভালবাসার উত্তাপ চলে আসবে। নারীকে এখানে সৌন্দর্যের প্রতীক, ভালবাসার কাঙ্গাল, শরীর প্রদর্শনকারী, শরীর দেখিয়ে অর্থ উপার্জনকারী প্রভৃতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রযোজকদের নারীতত্ত্ব অনুযায়ী, নারীর গুণকে নয়; বরং সমাজের মানুষেরা নারীর শরীর দেখতেই বেশি পছন্দ করে এবং টাকার বিনিময়ে তারা নারীর শরীর দেখে। এমন একটি ধারণা থেকেই মূলত তারা নারীকে এমন আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করে, আর তাদের ব্যবসার স্বার্থসিদ্ধি লাভ করে।



সেক্সসিম্বল নারী:

সুইটি নামের এক মেয়েকে দেখানো হয় যার স্বল্প বসন। সে মডেলিং করে। কোন মেয়ে মডেলিং করলেই তার পোশাক এমন হবে এটাই শিক্ষা দেয় সিনেমাটিতে। পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্র যেন নারীর শরীর। আর এই শরীরকেই পুঁজি করে টাকা রোজগার করছেন সিনেমা কর্তৃপক্ষরা। পরিচালক উত্তম আকাশ একটি ভাল সিনেমা প্রদর্শন করার চিন্তা করতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে নারীর এই যৌন সিম্বলকেই উপস্থাপন করেছেন।



নারী কেবল বিয়ের পাত্রী:

এই সিনেমায় তিনজন মেয়েকে দেখানো হয়েছে বিয়ের পাত্রী হিসেবে। যেন বিয়েই তাদের সব। আর রানীর বাবাতো বলেই ফেলেছেন যে দুদিন বাদে তার মেয়ের বিয়ে তাই সে যেন ঘরের বাইরে বের না হয়। তাই এখানে নারী যেন কেবল বিয়ের পাত্রী।



কর্মহীন নারী:

নারীর কোন কাজ নেই, সে হয় ঘরে আবদ্ধ থাকে, না হয় সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। এমন একটি চিত্র পাওয়া যায় এই ছবিতে। এখানে একজন নারীকে দেখা যায় যে সারাক্ষণ সেজেগুঁজে থাকে। কিন্তু এখানে তার কর্মের ওপর জোর না দিয়ে তার সাজ-সজ্জার ওপর ক্যামেরা-ফোকাস বেশি করা হয়। নারীর পেশা যেন শুধুই মডেলিং করা। কেননা এমনটা দেখালে পুরুষের একটু আধটু সুরসুরিতো দেয়া যায়।



নারীর কাজ শুধু কান্না করা:

এই ছবির অন্যতম শিক্ষা নারী শুধু কাঁদে। তাই দেখা যায়, মগবুল আর রানীর মা ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে শুধু কাঁদে। আর পুরুষ হচ্ছে বলিষ্ঠ হৃদয়ের অধিকারি, পরিবারের সর্বেসর্বা -এমন একটি প্রোপাগান্ডা চালানো হয় এই চলচ্চিত্রে।



নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল:

এই চলচ্চিত্রের অন্যতম একটি ইঙ্গিত হচ্ছে, নারী পুরুষের উপর নির্ভরশীল। রানী এবং মগবুলের মা তাদের স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। স্বামীর কথার ওপর কোন কথা তারা বলতে পারে না। আবার বিল্লুর হাত থেকে রানীকে বাঁচানোর দায়িত্বও যেন মগবুলের। কারণ পুরুষ শক্তিশালী। আর নারীর সুখ যেন পুরুষের উপর নির্ভরশীল।





নির্বোধ নারী:

নারীকে দেখানো হয় নির্বোধ হিসেবে। রানী যখন লিফটে ওঠে তখন সে আশ্চর্য হয়ে ওঠে লিফট দেখে। যেন নারীর জ্ঞান নেই। তার বুদ্ধি নেই।



(চলবে)

Click This Link

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৫৮

জাফর সািদক রুমী বলেছেন: (আর মাত্র ১ দিন বাকি) Click This Link

২| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:০৩

জসিম বলেছেন: ভালো পোস্ট। ++

৩| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:১২

কাজিম কামাল বলেছেন: ++++

৪| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:৪৪

আবিল (দ্যা লিরিক বয়) বলেছেন: ধন্যবাদ, আমার আগামী বিতর্কর জন্য পোষ্টটী খুব কাজে লেগেছে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.