নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

০৬ ই জুন, ২০২২ রাত ৮:২০




সূচক শব্দ: বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি, বিশ্বায়ন, বিদেশি ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নয়ন

১. পূর্বকথা
চলছে বিশ্ব জুড়ে পরিব্যপ্ত বিশ্বায়ন, যার কবলে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হচ্ছে। এই বিশ্বায়ন বিশ্বের অপরাপর দেশসমূহের জন্য সুযোগ হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশের ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পশ্চাৎপদ জ্ঞানীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে এই প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব নয়। সেজন্য দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে [বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা] শীর্ষক নিবন্ধটি রচনা করা হয়েছে। নিবন্ধের শিরোনাম থেকে লক্ষ্যণীয় যে, এই নিবন্ধটিতে কয়েকটি সূচক শব্দ রয়েছে, যা হলো— বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি, বিশ্বায়ন, বিদেশি ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নয়ন। প্রথম পর্যায়ে এই সূচক শব্দগুলো সম্পর্কে বর্ণনা তুলে ধরা হবে। পরবর্তীতে এ সূচক শব্দগুলোর আলোকে বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি তুলে ধরা হবে।

২. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, বিশ্বায়ন বলতে কী বুঝায়। বিশ্বায়ন হলো— দেশাভ্যন্তরীণ গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি আন্ত:দেশীয় প্রক্রিয়া, যাতে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে আন্ত:দেশীয় বিনিময় সম্পন্ন হয় বলে, এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া পূঁজিবাদের কবলে নিপতিত হওয়ায়, পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থনৈতিক শোষণের সুযোগ হিসাবে নিয়েছে। পূঁজিবাদী আদর্শের খপ্পরে পড়ে, বিশ্বায়ন কেবলমাত্র বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি দৈশিক গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তঃদেশীয় পরিসরে পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে। এর ফলে সারা বিশ্ব একটি নিরবিচ্ছিন্ন সমাজে পরিণত হয়েছে এবং অভিন্ন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ যুগপৎ অংশ গ্রহণ করছে, যার চালিকা শক্তি হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে পূঁজিবাদী শক্তি।
এই বিশ্বায়নের ঘূর্ণাবর্তে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন সূচীত হচ্ছে, যার নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি রয়েছে পূঁজিবাদী শক্তির হাতে। সেজন্য বাংলাদেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে যতো না সুবিধা পাচ্ছে, তার চেয়েও বেশী অর্থ পাচার ও অপসংস্কৃতির প্রসার ইত্যাদি নানা অনাকাঙ্খিত বিষয়ের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এর কারণ, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটিতে পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ থাবা বিস্তার করে আছে। এই পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডিঙ্গিয়ে দেশ ও জাতির জন্য সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সুবিধা আহরণ করতে হলে, বাঙ্গালি জাতিকে কৌশলগতভাবে প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু বর্তমান কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কোমল অবকাঠামোতে বিশ্বায়নের পূর্ণ সুবিধা আহরণের মতো কৌশলগত প্রস্তুতি সম্ভব নয়। সেজন্য বিদেশবিদ্যা ও বিদেশি ভাষায় পারদর্শী অঞ্চলভিত্তিক চিন্তকবর্গ (Think Tank) গড়ে তোলা প্রয়োজন।

৩. বিদেশি ভাষা এবং সাধারণ্যে তার উপলব্ধি

সাধারণ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ভাষা হলো নিছক সংজ্ঞাপনের মাধ্যম। কিন্তু আদতে ভাষা কেবলমাত্র সংজ্ঞাপনের মাধ্যম নয় বরং ভাষা হলো একটি সংযুতিপ্রসূত সংজ্ঞাপনের মাধ্যম, যা প্রেক্ষাপটভেদে নানারকম প্রভাবক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। বিষয়টি বোধগম্য করার জন্য নিম্নে ভিন্ন দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার স্বরূপ, উপযোগিতা ও প্র্রায়োগিকতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো:

জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম,
খ) সামাজিকীকরণের মাধ্যম,
গ) জাতীয়তাবাদের প্রতীক,
ঘ) সভ্যতার বাহন,
ঙ) সামাজিক সম্পদ ও
চ) সাংস্কৃতিক সম্পদ।

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার,
খ) অন্যের সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার ও
গ) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার।

ভাষার উক্ত স্বরূপ ও প্রায়োগিকতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভাষা কোনো জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ামক বিশেষ। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশসমূহের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়াসী হয়। অনেক দেশ তাতে সুফল পায়।
বিদেশি ভাষা হলো মাতৃ ভাষা ব্যতীত অন্য যে কোনো ভাষা, যা অন্যদেশের রাষ্ট্র ভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা। তবে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে তার দেশের ভাষাটি বিদেশি ভাষা হতে পারে, যেমন— কানাডায় বসবাসকারী কোনও বাঙ্গালির মাতৃভাষা হলো-বাংলা। কিন্তু ইংরেজি ও ফরাসি হলো তার কাছে দেশ ভাষা। তদ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী কোনো জাপানীর কাছে ইংরেজি হলো একটি বিদেশি ভাষা। বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষা নিম্নলিখিত তিন প্রকার:
ক) দেশীয় বিদেশি ভাষা: ত্রিপুরা, গারো ও মারমা ইত্যাদি
খ) প্রতিবেশী দেশীয় বিদেশি ভাষা: বর্মী, হিন্দি, উর্দু, হিন্দি ও নেপালী ইত্যাদি
গ) দূরদেশীয় বিদেশি ভাষা: চীনা, জাপানি, জার্মান, তুর্কী, রুশ ও ইতালীয় ইত্যাদি।
শিশু জন্ম থেকে বা খুব অল্প বয়সেই মাতৃভাষা আয়ত্ত্ব করে থাকে। দেশের ভাষা পরিস্থিতিভেদে একজন শিশুর একাধিক ভাষা শিখতে হতে পারে। ভারত বা বার্মার মতো বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দেশে শিশু অনেকগুলো ভাষা শিখলেও, সেগুলোর কোনোটিই বিদেশি ভাষা হিসাবে ধরা হয় না। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা বা কানাডার মতো দেশে একাধিক দাপ্তরিক ভাষা কথিত ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যার কোনটিই বিদেশি ভাষা নয়। বাঙ্গালিরা কিছু ব্যতিক্রম বাদে একটি সমসত্ত্ব ও প্রতিসম জাতি। বাঙ্গালিদের ভাষা হলো মাতৃভাষা বাংলা। আর গারো, ত্রিপুরা ও সাঁওতালদের মাতৃভাষা হলো যথাক্রমে গারো, টিপেরা ও সাঁওতালি; কিন্তু বংলা তাঁদের কাছে দ্বিতীয় ভাষা, বিদেশি ভাষা নয়। বাঙ্গালি ও উক্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য আমাদের ভাষাসমূহ, যেমন—চীনা, জাপানি ও ফরাসি ইত্যাদি বিদেশি ভাষা। তবে সংস্কৃত ও পালি ভাষা বিদেশি ভাষা নয়। এগুলো দেশীয় ধ্রুপদী ভাষা।
এ পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে এ দু’টো ভাষা বিদেশি কি-না তার উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাংলা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা, জাতীয় ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে এই ভাষাকে বিদেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা হিসাবে পরিগণিত হয়। বিশ্বের নানাদেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও গবেষণা চলছে। তার মধ্যে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো চীনস্থ গুয়াংঝু বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানস্থ টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন চলছে। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষাকে বিদেশি ভাষা মনে করা হলেও, এটি বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষা কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ এই ভাষা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করেছে, যা এখন বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে দেশীয়করণ ঘটছে।

৪. বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা ও প্রায়োগিকতা

গত অর্ধ শতকে সাংজ্ঞাপনিক ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিস্তৃতির ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা ও প্রায়োগিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাষা বিজ্ঞানী কাই চান (২০১৬) তাঁর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বিদেশি ভাষার এই উপযোগিতা ও প্রায়োগিকতা নির্ণায়ক কতকগুলো সূচক রয়েছে। সে সূচকগুলো হলো— কোনো নির্দিষ্ট ভাষার আঞ্চলিক বিস্তৃতি, সে অঞ্চলের অর্থনীতি, সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে কার্যকারিতা, জ্ঞান ও গণমাধ্যমে ভাষা হিসাবে ব্যবহারের বিস্তৃতি ও সেই ভাষা সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা ইত্যাদি। এই সূচক অনুসারে চীনা, জাপানি, জার্মান, তুর্কী, রুশ ও ইতালীয় ইত্যাদি ভাষা শক্তিশালী ভাষা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। বেশ কতকগুলো ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশেষ করে আরবি, ইংরেজি, চীনা, স্পেনীয়, রুশ ও ফরাসি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় এগুলো আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্ক ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনিভাবে ব্যক্তি পর্যায়েও এর উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশের মানুষ এখন কাজ ও শিক্ষার সন্ধানে উন্নত বিশ্বে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ দেশের মায়া ত্যাগ করে উন্নত জীবনের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হচ্ছে। যে যে উদ্দেশ্যেই বিদেশে গমন করুক না কেন, তার সে দেশের ভাষা জানা প্রয়োজন। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকলে কোনো দেশেই আশানুরূপ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না।
চলমান এ বিশ্বায়নের সঙ্গে যুগপৎভাবে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে নানা ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নিম্নে তুলে ধরা হলো—

ক. জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসাবে
বাংলাদেশের মানুষ অন্য দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা, যেমন— চীনা, ফরাসি ও জাপানি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশে শিক্ষা ও গবেষণা কর্মে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এজমালি মাধ্যম হিসেবে একটি বিদেশি ভাষা, যেমন— ইংরেজি ও আরবি ব্যবহার করছে। এভাবে এ দেশে জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও আরবিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খ. কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যম মাধ্যম হিসাবে
এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক সবসময় স্বাভাবিক থাকে না। দুটি ভিন্ন দেশ অথবা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, আবার সময়ে সময়ে তা শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কে পরিণত হতে পারে। দু’টি ভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ সম্পর্ক নির্ভর করে মূলত আধিপত্য ও অর্থনৈতিক লাভালাভের হিসাবের ওপর। এ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হলেও, কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা ইংরেজি ভাষার চেয়ে অধিকতর কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সে বিবেচনায় জাপান, চীন, রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় যথাক্রমে জাপানি, চীনা, রুশ, হিন্দি, বর্মি ও থাই ভাষা ইংরেজি ভাষার চেয়ে অধিকতর কার্যকর বিদেশি ভাষা হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

গ. বাণিজ্যিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে
সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম গত প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অব্যাহত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উঠেপড়ে লেগেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বাণিজ্যিক বিনিময়ে সাধারণত ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হলেও, বাণিজ্যিক বিনিময়ে ব্যপৃত বিপ্রতীপ দেশের ভাষা বাণিজ্যিক সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে অর্থাৎ চীন, জাপান ও ফ্রান্সের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে চীনা, জাপানি ও ফরাসি ভাষা অধিকতর কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে দেশে ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঘ. সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে
বিভিন্ন দেশে জনমানুষের লৌকিক পর্যায়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়। দেশে দেশে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকগণ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কোনো না কোনো বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রয়োজনে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা, যেমন জাপানি, কোরীয়, মালয়, আরবি, পালি, লাতিন ও সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করেন। এভাবে সীমিত পর্যায়ে হলেও, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু অপ্রচলিত বিদেশি ভাষার উপযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে।

ঙ. চাকরি বাজারে প্রবেশের মাধ্যম হিসাবে
বিশ্বায়নের যুগে এক দেশের জনশক্তি অন্য দেশের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্বে বিদেশি জনশক্তির চাহিদা রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। এসব দেশ তৃতীয় বিশ্ব থেকে সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি আমদানি করে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে এসব দেশে দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি রফতানি হয়। এসব দেশের চাকরির বাজারে প্রবেশ ও সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ সম্পাদনের জন্য সেসব দেশের ভাষা জানার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এভাবে দেশে আরবি, মালয়, জাপানি ও ইতালীয় ইত্যাদি বিদেশি ভাষা বিদেশে চাকরির বাজারে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে উপযোগিতা প্রমাণিত হয়েছে।

৫. বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে অনিয়ন্ত্রিত বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম

বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা ও প্রায়োগিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই শিক্ষার অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত বিস্তার ঘটছে। ইতোমধ্যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে। এই বিশ্বায়নের প্রভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রয়োজন অনুসারে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তুত না হলেও, বিকল্প অনেক বিদেশি ও দেশি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশে এখন একটি অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। বর্তমানে যে সব প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে, তার অন্যতম হলো:
১) বিভিন্ন গণবিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট বা অনুরূপ নামের প্রতিষ্ঠান।
২) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়াধীন একাডেমীসমূহ
৩) শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ
৪) জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ
৫) বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ
৬) English Medium School সমূহ
৭) বিভিন্ন শহরে বা বাজারে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

৬. বাংলাদেশের ভাষা-রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ, ভাষানীতি ও ভাষা-পরিকল্পনা

প্রত্যেক দেশেরই একটি ভাষানীতি থাকে, যাতে জাতীয়, ধ্রুপদী, নৃগোষ্ঠীগত ও বিদেশি ভাষার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। যে কারণে দেশে জাতীয়, ধ্রুপদী, নৃগোষ্ঠীগত এবং বিদেশি ভাষার পরস্পর মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে বিচ্ছিন্নভাবে এখান থেকে বা ওখান থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা শুনা যায়, যেমন— কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলছেন- ‘তরুণদের কেবল বাংলা বা ইংরেজি জানলে হবে না। সঙ্গে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ এবং চাইনিজ ভাষা শিখতে হবে। তাহলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ বেশি বেশি পেতে সুবিধা হবে। তাছাড়া শুধু ফ্রিল্যান্সিংয়ে নয়, বিদেশে আমাদের দেশের শ্রমিকদের চাহিদা বাড়বে (দৈনিক যুগান্তর ২৫শে আগস্ট ২০২০)’। এ ধরণের কথাবার্তা থেকে মনে হয় যে, দেশের নীতি-নির্ধারকগণ বিদেশি ভাষাকে শ্রমিকের ভাষা ব্যতীত আর কিছু মনে করেন না। অর্থ্যাৎ বিদেশি ভাষা সম্পর্কে এ ধরণের খণ্ড খণ্ড কথাবার্তা নীতি-নির্ধারকগণের বিশ্বায়ন সম্পর্কিত চিন্তাধারার দেউলিয়াত্বকেই প্রকাশ করে।
তবে বাংলাদেশের অভ্যূদয়কালীন সময়ে ভাষানীতির প্রতি এমন ঔদাসীন্য ছিলো না। কারণ সে সময়কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাকিস্তান আমলে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে যে চেতনা লাভ করে, তা তখনও বহমান ছিলো। কাজেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পূর্ণাঙ্গ বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার একটি রূপকল্প তৈরি করে। ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার এই রূপকল্পটি হলো ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন। উল্লেখ্য যে, এই শিক্ষা কমিশনের প্র্রধান ছিলেন বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা।
অবগতির জন্য এ পর্যায়ে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে বিধৃত বিদেশি ভাষা সংক্রান্ত অংশটির অনুলিপি তুলে ধরা হলো। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনটিতে বিদেশি ভাষা সম্পর্কিত বিষয়টি ৪.৬, ৪.৯ এবং ৪.১১ অনুচ্ছেদে বিধৃত রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

এই শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়ে একে শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। অন্যদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর থেকে উপরের স্তর পর্যন্ত ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রবর্তনের সুযোগ রাখা হয়।
এই প্রতিবেদনে বিধৃত উপরের অনুচ্ছেদ থেকে যেমনটি দৃষ্ট হচ্ছে যে, এর উদ্দেশ্য ছিলো বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত তৈরি করা এবং এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জনশক্তি সৃষ্টি করতে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট সৃষ্টির কথা বলা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফলশ্রুতিতে বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রসারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা প্রত্যাহৃত হয়। পরিণামে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম গতিহীন হয়ে পড়ে। যার ফলে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়।
এদিকে বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনেকগুলো বিদেশি ভাষার প্রায়োগিকতা ও উপযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও উপযুক্ত ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিদেশি ভাষাসমূহকে ব্যবহার না করে, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাকে বিশ্বায়নের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ধরণের তৎপরতাকে হালাল করতে গত ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে সরকার নিয়োজিত শিক্ষা কমিশন শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। এই পরিবর্তনের ফলে কার্যত ইংরেজি ভাষাকে জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার চেয়েও অধিকতর মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা আরোপ করা হয়েছে। অধিকন্তু এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের বিধৃত বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কিত মূলনীতির বিপরীতে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষা চালু করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ দু’টি শিক্ষানীতিতে বিদেশি ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার কথা কিছু বলা হয়নি। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। সেজন্য এখন বাংলা ভাষা দাপ্তরিক কার্যক্রম, শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে উপেক্ষিত হচ্ছে। এভাবে ইংরেজি ভাষাই এখন দেশি ভাষায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। এর ফলাফল স্বরূপ বাংলা ভাষা ও বিদেশি ভাষা— এই উভয় প্রকার ভাষার উপরই ইংরেজি ভাষা আধিপত্যবাদী ভাষা হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে।

৭. বিশ্বায়ন আদর্শের নিরিখে বাংলাদেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনা

দেশে বিদেশি ভাষানীতির অনুপস্থিতিতে বিশ্বায়নকে মোকাবেলা করার মতো বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এর কারণ একটি বিদেশি ভাষানীতির অনুপস্থিতি। কিন্তু আমাদের কাছে পাথেয় হিসাবে রয়েছে বাংলাদেশে গঠিত প্রথম আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন।
এই শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মত দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুসরণে একটি বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়ন করা হলে, তার নিরিখে বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা সম্পর্কিত অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এ পর্যায়ে আমাদের জানা প্রয়োজন যে, অবকাঠামো বলতে কী বুঝায়। অবকাঠামো হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাবর ও সংবিধি সম্পর্কিত ব্যবস্থা বিশেষ। অবকাঠামো সমূহকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: ভৌত অবকাঠামো ও কোমল অবকাঠামো। বিশ্বায়ন সম্পর্কিত শিক্ষা ও গবেষণামূলক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হলে, প্রয়োজন হবে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সহায়ক শিক্ষা ভবন, মিলনায়তন, গ্রন্থাগার, সম্মেলন কক্ষ, বৈদ্যুত্যিক ও বৈদ্যুতিন সুবিধা সম্পর্কিত ভৌত অবকাঠামো, এবং নির্মিত এই ভৌত অবকাঠামোতে শিক্ষা ও গবেষণা কর্ম সম্পাদন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংবিধি, নীতিমালা ও আইন মিলে গঠিত হয় কোমল অবকাঠামো।
প্রস্তাবিত এই শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামোর ধরণ হবে স্তর ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে। এই শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসাবে এক বা একাধিক বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
পাঠ্যক্রম শিক্ষা কার্যক্রমের খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ দিক। এই পাঠ্যক্রমে যে সব বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সেগুলো হলো--বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক বিদ্যা বা বিদেশ বিদ্যা বিষয়ক শাস্ত্র এবং সে সব অঞ্চলে কথিত ভাষাসমূহ। আঞ্চলিক বিদ্যা বা বিদেশ বিদ্যা হলো— কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সামরিক শক্তি ও সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞান। তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিষয় তিনটি হলো— ১) পাঠ্যক্রম সংশ্লিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চল, ২) পাঠ্যক্রমের জ্ঞানীয়, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উপযোগিতা এবং ৩) পাঠ্যক্রমের পরিধি। এ তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের নানা দেশ ও তার ভাষাসমূহ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে, বাংলাদেশের উপযোগী চিন্তকবর্গ সৃজনে সহায়ক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভবপর হবে।

৮. বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে লক্ষণীয় যে, এই দলিলে স্পষ্টতই বিদ্যালয় পর্যায় থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের বিধান রাখা হয়েছিলো। কিন্তু এই দলিল প্রণয়ন কাল থেকে দেশ অর্ধ শতাব্দীকাল অতিক্রম করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বায়ানের ফলশ্রুতিতে বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি বদলিয়েছে। কিন্তু চলমান এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ধরণ হবে ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় পর্যায় থেকে অনেকগুলো বিদেশি ভাষা ও ধ্রুপদী ভাষা থেকে পছন্দমত ১টি অথবা ২টি বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য বাছাই করতে পারবে অথবা শিক্ষার জন্য কোনো বিদেশি ভাষাকে বাছাই করা থেকে বিরত থাকতে পারবে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্য বিষয় হিসাবে ইংরেজি ভাষা ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা বিষয়ে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলে জাপানি ও ফার্সি— এ দু’টি ভাষাকে যেমন শিক্ষার জন্য গ্রহণ করতে পারবে, তেমনিভাবে আরেকজন হয়তো সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার জন্য গ্রহণ করতে পারবে।
এখনে উল্লেখযোগ্য যে, প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো নিম্নরূপ:
ক) প্রস্তাব অনুযায়ী দক্ষতা ভিত্তিক উক্ত বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হলে প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থীর এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উত্তীর্ণের সুযোগ থাকলেও, বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ নির্ভর করবে দক্ষতা অনুযায়ী। অর্থ্যাৎ এখনকার মতো বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের উত্তীর্ণের সুযোগ থাকলেও, বিদেশি ভাষায় (ইংরেজি সহ) এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উত্তীর্ণের ভিত্তি হবে দক্ষতার ভিত্তিতে। এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে একই ভাষাগত দক্ষতা ক্লাসে বার্ষিক ভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থী একই দক্ষতা ভিত্তিক ভাষা ক্লাসের শিক্ষার্থী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
খ) এই শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা ঐচ্ছিকভাবে নিজেকে ঐ ভাষা কোর্স থেকে প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে। এই প্রত্যাহার বিদ্যালয়ে ঐ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাক্রমকে প্রভাবিত করবে না।
গ) ভাষাগত দক্ষতার ভিত্তিতে বিদেশি ভাষা (ইংরেজি ভাষা সহ) শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম চালু হবে।

বিদ্যালয় পর্যায় থেকে প্রস্তাবিত এই ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে, চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে কূটনৈতিক, বৈদশিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হতে পারবে। অন্যদিকে এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে সমসাময়িককালে সূচীত নেতিবাচক পরিবর্তনসমূহ রোধ হবে এবং দেশ একটি অনভিপ্রেত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট থেকে রক্ষা পাবে।
কাজেই ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়ানের মাধ্যমে বিদ্যালয় পর্যায় থেকে ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

৯. প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতাসমূহ

প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণে প্রয়োজন হলো শিক্ষক, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন। কিন্তু আরবি ও ইংরেজি ভাষা ব্যাতীত অন্যান্য বিদেশি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণে প্রয়োজনীয় সংস্থানের স্বল্পতা বা অনুপস্থিতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্থানের এই স্বল্পতা ও অনুপস্থিতি থেকে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থাটিকে অনেকেই অবাস্তব বলে বর্ণনা করে থাকবেন। কিন্তু স্মর্তব্য যে, আজ থেকে তিন দশক আগে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থারও প্রয়োজনীয় সংস্থানে অনুরূপ স্বল্পতা ও অনুপস্থিতি ছিলো। সে যুগে দেখা গেছে কলেজসমূহে ইংরেজি পড়ানোর মত শিক্ষক ছিলো না। সে অবস্থায় ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস নিতেন বাংলা, আরবি অথবা পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষকগণ। বিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও ইংরেজি পাঠদানের মত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন মোতাবেক সেই ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন শুরু হলে, বর্তমানে দেশব্যাপী সমস্ত বিদেশি ভাষার শিক্ষাব্যবস্থা সমানভাবে গড়ে উঠতো ও বিস্তৃত হতো এবং বিদেশি ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার একক বিস্তৃতির কোনও সুযোগ থাকতো না। কাজেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংস্থানের স্বল্পতা বা অনুপস্থিতির দোহাই দিয়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগে ক্ষান্ত দেওয়া এবং একক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার যৌক্তিকতা নেই। কাজেই জাতীয় স্বার্থে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষানীতি প্রণয়ন পূর্বক দেশব্যাপী বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১০. উপসংহার

বিশ্বায়ন চলমান রয়েছে এবং এই বিশ্বায়ন পক্রিয়ায় আবর্তিত বাংলাদেশ হচ্ছে। এই বিশ্বায়ন জাতির কাছে সুযোগ হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। চলমান এই বিশ্বায়ন থেকে অধিকতর সুযোগ লাভ করতে হলে, দেশে একটি বিদেশি ভাষায় দক্ষ বিদেশবিদ্যা সম্পর্কিত চিন্তকবর্গ গড়ে তোলা প্রয়োজন। কাজেই দেশে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আর দেশব্যাপী ব্যপ্ত এই শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জনশক্তি গড়তে দেশে এক বা একাধিক বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেহেতু ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে এই শিক্ষাব্যবস্থা বিধৃত রয়েছে, তার আলোকেই একটি বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়ন করে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.