নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

যুদ্ধ উম্মাদনা এবং সম্ভাব্য যুদ্ধব্যয় ও অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়

০১ লা অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৩



ভূমিকা
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আরাকান, যেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মানবিক কারণে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। যদি ভবিষ্যতে আরাকানে সহিংসতা বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশ সেখানে একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করে। তাহলে মিয়ানমার এই বিষয়টিকে তার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সামরিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। মিয়ানমার এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে। ফলশ্রুতিতে তা একটি প্রকৃত যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। আর যদি যুদ্ধ বেধেই যায়, তাহলে এই যুদ্ধের আর্থিক ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই বিশাল হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটি বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে—বাংলাদেশ কিভাবে এই যুদ্ধ ব্যয় বহন করবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সম্ভাব্য ব্যয় কাঠামো, অর্থ সংগ্রহের কৌশল এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির প্রভাব একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।

যুদ্ধ ব্যয়ের ধরন ও সম্ভাব্য পরিমাণ
একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের অর্থনৈতিক ব্যয় কেবল অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে রয়েছে:
১. সামরিক খরচ: সেনা মোতায়েন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ, জ্বালানি, যানবাহন, ড্রোন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি।
২. লজিস্টিক ও রসদ: সৈন্যদের খাদ্য, চিকিৎসা, পোশাক ও আশ্রয়।
৩. বেসামরিক ব্যয়: সীমান্ত এলাকার জনগণকে সরিয়ে নেওয়া, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও মানবিক সহায়তা।
৪. সাইবার ও তথ্য যুদ্ধ: সাইবার নিরাপত্তা ও প্রপাগান্ডা মোকাবিলা।
৫. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য মজুদ ও আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনা।
৬. পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন: যুদ্ধশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো ও জনগণের পুনর্বাসন।

আনুমানিকভাবে ৩ থেকে ৬ মাস স্থায়ী একটি মধ্যম মানের যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশকে ৮ থেকে ১০ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে, যা জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতি হলেও যুদ্ধব্যয়ের মত সংকটে দেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বার্ষিক জাতীয় বাজেট প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা ছিল, যার মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে সীমিত (প্রায় ৪-৫%)।

দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমমানের ২৫-২৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রয়েছে, যা দিয়ে প্রায় ৪-৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই রিজার্ভ দ্রুত কমে যেতে পারে। তাই একমাত্র জাতীয় রিজার্ভ বা বাজেট ব্যবহার করে যুদ্ধ ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন বহুমুখী কৌশল।

যুদ্ধ ব্যয় মেটাতে সম্ভাব্য কৌশলসমূহ
১. বাজেট পুনর্বিন্যাস ও রিজার্ভ ব্যবহার: সরকার যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য অন্যান্য খাত, যেমন অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যয়, এবং বড় প্রকল্প থেকে অর্থ কেটে প্রতিরক্ষা ও জরুরি খাতে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে অস্থায়ীভাবে কিছু অর্থনৈতিক প্রকল্পকে স্থগিত হলেও, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত হতে পারে। তাছাড়া বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে ২-৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. যুদ্ধকালীন বন্ড ও অভ্যন্তরীণ ঋণ: সরকার “ যুদ্ধ বন্ধকপত্র (War Bonds)” ইস্যু করতে পারে, যা সাধারণ জনগণ, প্রবাসী বাংলাদেশি, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহযোগ্য হবে। দেশের জন্য বিপদের মুহূর্তে এই প্রকল্পে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অর্থ সংগ্রহের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থন: যদি যুদ্ধ মানবিক করিডোর রক্ষার জন্য হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ওআইসি-এর মধ্যে কোনও কোনও পক্ষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে সামরিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বজনমতের চাপ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্থিক সাহায্য পেতে পারে। মানবিক সহযোগিতার আওতায় বিশ্বব্যাংক ও IMF থেকে জরুরি ঋণও পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৪. কর ও রাজস্ব ব্যবস্থার সাময়িক সংস্কার: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্থায়ীভাবে কিছু বিলাসবহুল পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ও উচ্চ আয়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে কিছু কর বাড়ানো যেতে পারে। ঐচ্ছিক “জননিরাপত্তা কর” বা স্বদেশি চাঁদার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
৫. আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় হ্রাস: যুদ্ধকালীন সময় বিলাসপণ্য ও অনাবশ্যক আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে রিজার্ভ সাশ্রয় করা যেতে পারে। সরকারি ব্যয় হ্রাস, বিদেশ ভ্রমণ সীমিতকরণ ও বিভিন্ন ফান্ডের মিতব্যয়িতা অবলম্বন করে যুদ্ধব্যয় মিটানো যেতে পারে।

৬. প্রবাসী আয় ও রেমিট্যান্স উৎসাহ: বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স যুদ্ধব্যয় মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। “জাতির প্রয়োজনে প্রবাসী ভাই-বোনদের সহায়তা”—এই ধরণের আপ্তবাক্য সম্বলিত প্রচারাভিযান যুদ্ধব্যয়ে প্রয়োজনীয় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে।

মানসিক প্রস্তুতি ও জনসম্পৃক্ততা
যুদ্ধ কেবল সামরিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং এটি একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। তাই এ সময়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা জরুরি। প্রচারমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— সব জায়গায় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সচেতনতার বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে।

যুদ্ধকালীন চাঁদা, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ও জাতীয় ঐক্য— সবকিছু মিলেই করিডোর প্রদান থেকে উদ্ভূত যুদ্ধব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন “এক মুঠো চাল” সংগ্রহ করতেন, ঠিক তেমনই আজকের ডিজিটাল যুগেও জাতীয় বিপদের সময় অনুরূপ কায়দায় দেশের সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে যুদ্ধব্যয় মিটানোর অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে।

সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সতর্কতা
যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে একাধিক ঝুঁকি রয়েছে, যেমন: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও বেকারত্ব, রিজার্ভের ওপর চাপ, বৈদেশিক ঋণের বোঝা, ব্যাংকিং খাতে চাপ ও বাজারে অনাস্থা। যুদ্ধের সময় উদ্ভূত সম্ভাব্য এই ঝুঁকিগুলো দ্রুত ও সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।


উপসংহার
বাংলাদেশ যদি আরাকানে মানবিক করিডোর দানের জন্য যুদ্ধে জড়ায় এবং মিয়ানমার যদি আগ্রাসন চালায়, তবে তা একটি ন্যায্য ও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচিত হতে পারে। যুদ্ধের ব্যয় হবে ব্যাপক, কিন্তু সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক সহায়তা, জনসম্পৃক্ততা এবং মিতব্যয়ী বাজেট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই যুদ্ধব্যয় সামলানো সম্ভব। যুদ্ধ কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়, তবে যদি তা অবধারিত হয়, তবে সামরিক কৌশলের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও ঐক্যবদ্ধ জনগণই হবে যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.