নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

নব্যউদরতাবাদী “ন্যায়বোধ” ও জ্ঞানকাণ্ডের নব্যউপনিবেশ: উন্নয়নবাদের আড়াল-আবডাল

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ ভোর ৬:৩১


১. ভূমিকা
আজকের বিশ্বে কিছু রাষ্ট্র নিজেদের নাগরিকদের “শিক্ষিত, বিজ্ঞ ও সংস্কৃতিবান” পরিচয়ে উজ্জ্বল করে তোলে, কিন্তু আড়ালে তাদের রাষ্ট্রীয়-বেসরকারি নীতিচিন্তা কেন্দ্র (থিঙ্কট্যাংক) অন্য দেশের সম্পদ, বাজার ও নীতিনির্ভরতা দখলের ছক আঁকে। এই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আগ্রাসনকে তারা “নব্যউদরতাবাদী বৈশ্বিক ন্যায়বোধ” ও “মানবিক হস্তক্ষেপ” নামে পরিচ্ছন্ন করে—যার অন্তরে থাকে শুধু প্রভাববিস্তার ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে, আক্রান্ত দেশের শিক্ষিত অভিজাত অংশ এই মতলবী তত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে নিজের বৌদ্ধিক স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেয়; ফলে মেধা, পুঁজি ও মূল্যবোধ দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক নব্য উপনিবেশায়নকে টেকসই করে তোলে। এই প্রবন্ধে এই প্রক্রিয়ার গঠন, সমাজ-অর্থনীতিতে অভিঘাত ও মুক্তির পথরেখা বিশ্লেষণ করা হলো—সম্পূর্ণ বাংলা পরিভাষায়।

২.ভাববাদ থেকে কৌশল: “বৈশ্বিক ন্যায়” কীভাবে নীতি-অস্ত্র
নব্যউদরতাবাদ নিজেকে মুক্তবাজার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও দক্ষতার মতবাদ হিসেবে হাজির করে, কিন্তু বাস্তবে কাজ করে তিন স্তরে—
1. বয়ানের স্তর (নীতিভাষার মোহ): “আইনের শাসন”, “সুশাসন”, “গণতান্ত্রিক সংস্কার”—এ সব নৈতিক শব্দাবলীকে ঢাল বানানো।
2. প্রাতিষ্ঠানিক স্তর (নীতির অবকাঠামো): নীতিচিন্তা কেন্দ্র, পরামর্শদাতা সংস্থা, মান-রেটিং সংস্থা, দাতা-এনজিও ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি জোটবদ্ধ নীতিনির্মাণ ইঞ্জিন।
3. নীতির স্তর (রাজনৈতিক অর্থনীতি): বেসরকারিকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পণ্যায়ন, বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা-চুক্তি, এবং প্রাকৃতিক সম্পদে বহুজাতিক নিয়ন্ত্রণ সহজ করা।
এই তিন স্তরের সমন্বয়ে “ন্যায়বোধের ভাষা” আসলে বাজার-দখলের কৌশলগত নীতিভাষা হয়ে ওঠে।

৩. নীতিচিন্তা কেন্দ্রের ভূগোল: নীরব প্রভাব, দৃশ্যমান ফল
নিজেদের “স্বাধীন গবেষণা” বলে দাবি করলেও অধিকাংশ কেন্দ্র কর্পোরেট-ফাউন্ডেশন-রাষ্ট্রের অর্থে চালিত। তাদের কর্মপদ্ধতি—
• দেশ-নির্দিষ্ট নীতিসংক্ষিপ্ত ও পরিস্থিতি-বিবরণী তৈরি করে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসকে “তথ্যনির্ভর” সুপারিশ দেওয়া;
• স্থানীয় গণমাধ্যম ও সেমিনার জুড়ে “বিশেষজ্ঞ মত” হিসেবে নীতিভাষা ছড়িয়ে দেওয়া;
• ফেলোশিপ/ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তরুণ নীতিকর্মী তৈরী করে বৌদ্ধিক যোগান শৃঙ্খল গড়া।
ফলে আক্রান্ত দেশে জন্ম নেয় ছাঁচনির্ভর নীতিবাদ—নিজস্ব ইতিহাস-অর্থনীতি-সংস্কৃতির বদলে “সেরা চর্চা” নামের জেনেরিক নকশা কপি-পেস্ট।

৪. দেশীয় অভিজাতের আত্মসমর্পণ: দালাল-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব
রাজনীতিক, আমলা, কর্পোরেট-নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক—এই দালাল-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী নব্যউদরতাবাদী তত্ত্বে আকৃষ্ট হয় কারণ—
• সামাজিক পুঁজি: বিদেশি নেটওয়ার্ক, সম্মেলন, পুরস্কার;
• অর্থনৈতিক প্রণোদনা: পরামর্শ-ফি, প্রকল্প-আনুদান, বোর্ড-পদ;
• সাংস্কৃতিক মর্যাদা: “বিশ্বনাগরিক” পরিচয়, বাহ্যিক সম্মান।
তারা “শিক্ষা”, “উন্নয়ন”, “আধুনিকতা”কে পশ্চিমকেন্দ্রিক আচরণ-রীতি ও ভোগ-দর্শনের অন্ধ অনুকরণে সীমাবদ্ধ করে। স্বদেশি জ্ঞান ও জননীতি তাদের চোখে “পিছিয়েপড়া”—এভাবেই আধিপত্যবাদ (হেজেমনি) স্থায়ী হয়।

৫. লুণ্ঠনের কৌশল: পুঁজি-পাচার থেকে নীতি-পাচার
দালাল-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর তৎপরতায় রাষ্ট্র ও বাজারে দেখা যায়—
1. নীতির দখল: জনস্বার্থ খাতে বেসরকারিকরণ; জনগণের অধিকারভিত্তিক সেবাকে ফি-নির্ভর পণ্যে রূপান্তর।
2. সম্পদের হস্তান্তর: খনিজ, বন, নদী, উপকূল—দীর্ঘ লিজে বহুজাতিক দখল; রপ্তানিমুখী কাঁচামাল নির্ভরতা।
3. কর-শিথিলতা ও বেআইনি স্রোত: কর-ছাড়, কৃত্রিম মূল্য নির্ধারণ, শেল-প্রতিষ্ঠান—শেষত পুঁজি পাচার।
4. মেধার ক্ষয়: উচ্চশিক্ষাকে কেবল দক্ষতা-প্রশিক্ষণে নামিয়ে সমালোচনামূলক জ্ঞান উৎপাদন কমানো।
5. নীতি-পাচার: দেশীয় বাস্তবতাহীন “রেডিমেড সংস্কার” আইনে গেঁথে দেওয়া।
ফলে অর্থনীতি হয় উত্তোলনমূলক (এক্সট্র্যাকটিভ), রাজনীতি কব্জাবন্দি, সমাজ অতি-ভোক্তাবাদী, সংস্কৃতি অনুকরণনির্ভর—এটাই নবউপনিবেশায়ন।

৬. জ্ঞানের উপনিবেশ: পাঠ্যক্রম, গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে সূক্ষ্ম দখল ঘটে জ্ঞানক্ষেত্রে—
• পাঠ্যক্রমে স্থানীয় ইতিহাস-অর্থনীতি-দর্শনের জায়গা সঙ্কুচিত; উদাহরণ ও কেস বিদেশকেন্দ্রিক;
• গবেষণা-অনুদানের শর্তে গবেষণা-প্রশ্ন নির্ধারিত হয়ে বৌদ্ধিক নিজস্বতা হারায়;
• গণমাধ্যম “উন্নয়ন/সংস্কার”কে সংকুচিত অর্থে প্রচার করে;
• ভাষানীতি মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা-গবেষণার পরিসর কমিয়ে ধারণাগত চিন্তাকে বিদেশিভাষার খাঁচায় বন্দী করে।
এভাবেই আধিপত্যবাদী মতাদর্শ মানুষকে বিশ্বাস করায়—“এই পথই স্বাভাবিক”, বিকল্পকে দেখায় “জনতাবাদ” বা “রক্ষণশীলতা”।

৭. সামাজিক অভিঘাত: বৈষম্য, অনিরাপত্তা, আস্থাহীনতা
• মধ্যবিত্ত ভোগসুবিধা পেলেও চাকরি-আয় অনিশ্চিত, ঋণনির্ভর জীবন;
• নিম্নআয় জনগোষ্ঠী পণ্যায়িত জনসেবায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত;
• প্রত্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে উচ্ছেদঝুঁকিতে;
• তরুণসমাজ বিদেশপ্রীতি/প্রবাস-নির্ভর কৌশলে দেশত্যাগে প্রলুব্ধ;
• রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ক আস্থা কমে—নীতি মনে হয় “কয়েকজনের জন্য বানানো চুক্তি”।

৮. প্রতিরোধের ব্যূহ: মুক্তির সাত সোপান
1. বৌদ্ধিক সার্বভৌমত্ব: মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা-গবেষণার অবকাঠামো; দেশীয় ইতিহাস-অর্থনীতি-দর্শনের বাধ্যতামূলক সংযোজন।
2. নীতি-স্বাধীনতা: ছাঁচনির্ভর সংস্কার প্রত্যাখ্যান করে তথ্যভিত্তিক স্বদেশি নীতি-নকশা।
3. সম্পদ-সার্বভৌমত্ব: খনিজ-জল-জ্বালানি-ডেটায় জননিয়ন্ত্রণ, সামাজিক হিসাব-নিকাশে স্বচ্ছতা।
4. পুঁজি-শাসন: বেনামি মালিকানা রোধ, কর-স্বর্গের লেনদেনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পাচারবিরোধী আইন।
5. উন্মুক্ত তথ্য ও নাগরিক নিরীক্ষা: তথ্যপ্রকাশ, গণমাধ্যম-সাক্ষরতা, নাগরিক জুরি/অডিট।
6. স্থানীয় অর্থনীতি ও সমবায়: কৃষি-খাদ্য-স্বাস্থ্য-শিক্ষায় কমিউনিটি-সমবায় মডেল; ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প ক্লাস্টার।
7. আঞ্চলিক সংহতি: এককেন্দ্রিক বিশ্বনির্ভরতা কমিয়ে প্রতিবেশী সহযোগিতা—ন্যায্য বাণিজ্য ও জ্ঞান আদান-প্রদান।

৯. সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার: অনুকরণ নয়, সৃজন
• ভাষার মর্যাদা: জটিল জ্ঞানকে মাতৃভাষায় নির্মাণ; নিজস্ব পরিভাষা-উদ্ভাবন।
• লোকজ্ঞান-বিজ্ঞান সংলাপ: কৃষি, পানি, চিকিৎসা, স্থাপত্যে স্থানীয় অভিজ্ঞতার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত মেলবন্ধন।
• শিল্প-সাহিত্য: উন্নয়নের বিকল্প কল্পনা ও ন্যায়পূর্ণ আধুনিকতার বয়ান।
• নগর-পরিকল্পনা: জলবায়ু-ভূপ্রকৃতি-সমাজসংস্কৃতিসম্মত নকশা।
এতে “আধুনিকতা”র সংজ্ঞা হয় সমন্বিত স্বকীয়তা—ঋণী নয়, অংশীদার।

১০. নীতি-রূপরেখা (কার্যকর প্রস্তাব)
• জাতীয় জ্ঞাননীতি: গবেষণা-অনুদানে দেশীয় সমস্যার অগ্রাধিকার; উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার।
• জনপ্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ: শিক্ষা-স্বাস্থ্য-গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগ।
• শিল্পকৌশল: কাঁচামাল রপ্তানি থেকে মূল্যসংযোজনমুখী শিল্পায়নে রূপান্তর; এসএমই-ভিত্তিক উৎপাদনচক্র।
• ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব: ডেটার স্থানীয় সংরক্ষণ, উন্মুক্ত মানদণ্ড, সাইবার সুরক্ষা।
• দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো: সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা, স্বচ্ছ ক্রয়ব্যবস্থা, তথ্যফাঁসকারীর সুরক্ষা।
• প্রবাসী-সম্পৃক্ততা: “মেধা-প্রবাহ”কে “মেধা-পরিক্রমায়” বদলে যুগ্ম গবেষণা-শিল্প ল্যাব।

১১. উপসংহার
নব্যউদরতাবাদী “বৈশ্বিক ন্যায়বোধ” মানবতার পোশাকে বাজারের স্বার্থ বয়ে আনে—এটা অনুধাবন করা প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ হলো, আক্রান্ত দেশের অভিজাত অংশ অনুকরণ নয়, উদ্ভাবনে আস্থা ফিরিয়ে স্বাধীন নীতি-ভাষা গড়ে তোলে। তৃতীয় ধাপ, জনগণের ওপর দায়বদ্ধ জ্ঞান-উৎপাদন ও সম্পদ-সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। তবেই মেধা, পুঁজি ও মূল্যবোধের বহিঃপ্রবাহ থামবে; অর্থনীতি ন্যায়পূর্ণ হবে; সংস্কৃতি ফিরে পাবে আত্মমর্যাদা। মুক্তির অন্য নাম—বৌদ্ধিক সার্বভৌমত্ব, ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি ও স্বকীয় আধুনিকতা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.