![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব: ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এক অশুভ যাত্রা
১. ভূমিকা
রাষ্ট্র হলো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসরত জনগণের উপর সার্বভৌম কর্তৃত্ব পরিচালনাকারী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত রূপ। এটি কাঠামোগতভাবে এমন এক সংগঠন যা সমাজের উপর তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু যখন এই একক ও সার্বভৌম সত্তার ভেতরেই একাধিক ক্ষমতার কেন্দ্র, তথা 'সমান্তরাল রাষ্ট্র' ও 'রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র'-এর সৃষ্টি হয়, তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান ডীপস্ট্যাট ষড়যন্ত্র নামে আলোচিত প্রপাগন্ডা হোক বা বাস্তবতা, এই ধারণাগুলোই নির্দেশ করে যে দেশটি একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার গভীর এক সংকটে নিপতিত। এই প্রবন্ধে রাষ্ট্রের ধারণা, সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের গঠনপ্রক্রিয়া এবং তা কীভাবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে— তা বিশ্লেষণ করা হবে।
২. রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য: আদর্শ বনাম বাস্তবতা
রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র হলো একটি সার্বভৌম রাজনৈতিক সংগঠন, যা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড ও জনগোষ্ঠীর উপর আইনগত ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। আদর্শগতভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হওয়া উচিত কেন্দ্রীভূত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। কিন্তু বাস্তবে, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্র পরিচালিত হয় নানামুখী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা, যেখানে ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রসমূহ প্রায়শই দৃশ্যমান সরকারি কাঠামোর বাইরে অবস্থান করে।
৩. সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র: ধারণার উৎপত্তি ও প্রয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ রবার্ট প্যাক্সটন প্রবর্তিত 'সমান্তরাল রাষ্ট্র' ধারণাটি এমন একটি ছায়াসংগঠনকে বোঝায় যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমান্তরালে কাজ করে, যদিও এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এটি বাহ্যত রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও অন্তরালে তার সম্পূর্ণ বিপরীত কার্যক্রম চালায়। অন্যদিকে, 'রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র' বলতে বোঝায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে লুকায়িত এমন একটি প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা কাঠামো, যা দাপ্তরিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল甚至 উৎখাত করার সামর্থ্য রাখে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি— প্রত্যেকেই ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের স্বার্থ রক্ষায় সমান্তরাল রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একইসাথে, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন (যেমন: হিজবুত তাহরীর, আল-কায়েদা) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এই সমান্তরাল ও প্রচ্ছন্ন কাঠামোগুলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে কর্তিত করে এবং সরকারের কার্যকারিতা ব্যাহত করে।
৪. বাংলাদেশে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়া
একটি রাষ্ট্র তখনই 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এ পরিণত হয় যখন তা তার নাগরিকদের জন্য মৌলিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন, মৌলিক সেবা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশে সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিম্নলিখিত উপায়ে দেশটিকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে:
১. সার্বভৌমত্বের ক্ষয়: রাষ্ট্র যখন তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারায়, তখন তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক লবি গ্রুপগুলোর প্রভাব, পাশাপাশি সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা— রাষ্ট্রের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করছে।
২. আইনের শাসনের অবক্ষয়: সমান্তরাল ক্ষমতা কাঠামোগুলি প্রায়শই প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে। এর ফলে দুর্নীতি, স্বৈরাচার ও অনিয়ম ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হ্রাস এবং প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আইনের শাসনকে দুর্বল করে তুলছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন: নির্বাচন কমিশন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংসদ— যখন দলীয়করণ ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবলে পড়ে, তখন তাদের কার্যকারিতা হারায়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের অভাব প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে তোলে।
৪. অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: অর্থ পাচার, বৈধ ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ, এবং সম্পদের অসম বন্টন— সমান্তরাল রাষ্ট্রের কার্যক্রম থেকে সৃষ্টি হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়, এবং সাধারণ মানুষের আস্থা রাষ্ট্রের প্রতি হ্রাস পায়।
৫. সামাজিক অস্থিতিশীলতা: সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের উপস্থিতি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিভাজনকে তীব্র করে। এতে সহিংসতা, হত্যা, গুম ও সন্ত্রাসের ঘটনা বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে।
৫. উপসংহার: প্রতিকার ও ভবিষ্যৎ গতিপথ
বাংলাদেশে সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেবল একটি 'তত্ত্ব' বা 'ষড়যন্ত্র' নয়, বরং একটি বাস্তব ও জটিল রাজনৈতিক সমস্যা যা রাষ্ট্রকে তার মৌলিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে। এটি দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সবচেয়ে বড় হুমকি। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ জরুরি:
• ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্বাহী, আইন ও বিচার— এই তিন স্তরে সুষমভাবে বণ্টন করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে হবে।
• প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
• আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: সকল নাগরিক ও প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্র自身কে আইনের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে।
• সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ: রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হতে হবে, এবং তাদেরকে নাগরিক সরকারের অধীনস্থ থাকতে হবে।
• নাগরিক সচেতনতা: জনগণকে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় অপকর্ম ও সমান্তরাল ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু সমান্তরাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে না পারলে এই সম্ভাবনা ক্রমশই ম্লান হয়ে যাবে। একটি জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও সকলের জন্য কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
©somewhere in net ltd.