নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

৫ আগস্ট ২০২৪: বাঙ্গালাবর্তের নতুন ক্রান্তিকা সহস্র বছরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ২০২৪-এর উত্তরণ

১৩ ই অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৬

৫ আগস্ট ২০২৪: বাঙ্গালাবর্তের নতুন ক্রান্তিকাল
সহস্র বছরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ২০২৪-এর উত্তরণ


অংশ-১: ক্রান্তিকালের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
ক্রান্তিকালের ধরণ: জনঅভ্যুত্থানজাত সাংবিধানিক শূন্যতা ও পুনর্গঠনের প্রয়াস
৫ আগস্ট ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করেন এবং ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার সাংবিধানিকভাবে অস্বাভাবিক, কারণ ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, তবে সুপ্রিম কোর্ট 'প্রয়োজনীয়তার তত্ত্ব' প্রয়োগ করে এর বৈধতা স্বীকার করে।

প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. আন্দোলনের প্রকৃতি: "আকস্মিক বিপ্লব"
জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ সহিংস দমনের মুখে স্বৈরাচার-বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। প্রায় ৮৭৫-১৪০০ জনের মৃত্যু এবং ৩০,০০০-এর বেশি আহত হওয়ার পর "জুলাই ৩৬" তারিখটি (৫ আগস্টকে বোঝায়) বাংলাদেশের "দ্বিতীয় স্বাধীনতা" হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে।
ঐতিহাসিক তুলনা: দলিলে বর্ণিত মাৎস্যন্যায় → পাল বা ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ-এর মতো এটিও "জনসম্মতিতে পুনর্গঠনের" ধারা। তবে এবার প্রধানত ছাত্র-যুব নেতৃত্ব—প্রথাগত দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে আসা এক নতুন শক্তি।
২. সাংবিধানিক সংকট: বিপ্লব নাকি সংস্কার?
সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান নেই, তাই গঠনতান্ত্রিক সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক বুদ্ধিজীবী একটি 'গণপরিষদ' গঠনের দাবি করছেন নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য। সুপ্রিম কোর্ট 'প্রয়োজনীয়তার মতবাদ' ব্যবহার করে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা দিয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক সমাধানের প্রশ্ন উন্মুক্ত।

ঐতিহাসিক তুলনা: সেন → খিলজি (১২০৪-০৬) বা ১৭৫৭ প্লাসি → ১৭৬৫ দেওয়ানি—যেখানে আকস্মিক পরিবর্তনের পর প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনে দীর্ঘ সময় লেগেছিল।

৩. রাজনৈতিক-সামরিক জ্যামিতি: ত্রিমুখী টানাপোড়েন
বর্তমান ক্রান্তিকালে তিনটি প্রধান শক্তিকেন্দ্র:
ক) অন্তর্বর্তী সরকার (ইউনূস): ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে—নির্বাচন, বিচার, পুলিশ, দুর্নীতি, প্রশাসন, সংবিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তাদের লক্ষ্য ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ রমজানের আগে নির্বাচন।
খ) সেনাবাহিনী: সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বর ২০২৫-এ নির্বাচনের দাবি করেছেন, বলেছেন "সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরতে চায়" এবং "রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু নির্বাচিত সরকার দিতে পারে"। এটি ইউনূস সরকারের সাথে "শীতল যুদ্ধ" হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে।
গ) রাজনৈতিক দলসমূহ:
• বিএনপি একাই নির্বাচনে অংশ নেবে (১৯৯১ পর প্রথমবার জামাত ছাড়া)
• জামাত-ই-ইসলামীর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে (আগস্ট ২০২৪)
• আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ (এপ্রিল ২০২৫), বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত
• ছাত্র নেতারা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (NCP) গঠন করেছে
ঐতিহাসিক তুলনা: দিল্লি-অধীন → স্বাধীন সুলতানি (১৪শ শতক)—যেখানে স্থানীয় শক্তি ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব চলেছিল।

৪. ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
হাসিনার ভারত পলায়নের পর হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ এবং হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ভারতে ক্রোধের জন্ম দিয়েছে, যা ডিসেম্বর ২০২৪-এ আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে হামলা পর্যন্ত গড়ায়।
ঐতিহাসিক তুলনা: ১৯৪৭ দেশভাগ বা ১৬৬৬ চট্টগ্রাম পুনর্দখল-এর পর বৌদ্ধ-রখাইন-বারুয়া সম্প্রদায়ের সংকট—ক্রান্তিকালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময় চাপে থাকে।

৫. অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫.৭% থেকে ৪%-এ নামিয়েছে, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ১৪% এবং সাধারণ মুদ্রাস্ফীতি ১১% ছুঁয়েছে। তবে রেমিট্যান্স ৫৮% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের উপর ৩৭% "পারস্পরিক" শুল্ক আরোপ করেছে (এপ্রিল ২০২৫), যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
ঐতিহাসিক তুলনা: ১৭৭০ দুর্ভিক্ষ বা ১৯৪৩ মন্বন্তর—ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় অর্থনৈতিক সংকট প্রায়ই তীব্র হয়।

অংশ-২: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—বহুদৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ

দৃশ্যকল্প ১: "সংস্কারমুখী রূপান্তর" (আশাবাদী)
পূর্বশর্ত:
• ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়
• সংস্কার কমিশনগুলো কার্যকর সুপারিশ দেয় এবং আংশিক বাস্তবায়ন হয়
• "জুলাই ঘোষণাপত্র" (২৮ দফা দলিল) সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়
• বিএনপি, জামাত, এনসিপি-সহ বিভিন্ন শক্তির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন
ফলাফল:
• নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা—দলীয় একাধিপত্য ভাঙা
• প্রথমবার প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবে; আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) ব্যবস্থার আলোচনা
• ছাত্র-যুব নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (NCP) টিকে যায়
ঐতিহাসিক সমান্তরাল: পাল যুগের সূচনা (৮ম শতক)—অরাজকতার পর জনসম্মতিতে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা।

দৃশ্যকল্প ২: "প্রথাগত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা" (বাস্তববাদী)
সম্ভাবনা:
• সেনাবাহিনী চাপ বাড়াতে থাকে; ইউনূস পদত্যাগ করেন বা দ্রুত নির্বাচনে বাধ্য হন
• বিএনপি ক্ষমতায় আসে, কিন্তু গভীর সংস্কার না করে পুরনো কাঠামোই চালু রাখে
• আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়ে ক্রমশ রাজনীতিতে ফিরে আসে
• ছাত্র-আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে যায়
ফলাফল:
• "বিপ্লব" থেকে "সংস্কার"—মৌলিক পরিবর্তন নয়, প্রশাসনিক সমন্বয়
• অনেক আন্দোলনকারী হতাশ: "আমাদের সন্তানরা ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের জন্য রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু আমরা সেটা পাচ্ছি না"
ঐতিহাসিক সমান্তরাল: ১৮শ শতকে নবাবি → ব্রিটিশ দখল—প্রথাগত অভিজাতরা নতুন প্রভুর অধীনে নিজেদের টিকিয়ে রাখে; ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক হস্তক্ষেপের ধারা।


দৃশ্যকল্প ৩: "দীর্ঘায়িত অস্থিরতা" (হতাশাবাদী)
ঝুঁকিসমূহ:
• রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম মেরুকরণ; বিএনপি ও জামাতসহ অন্যান্য দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত
• সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ—অতীতের মতো সামরিক-সমর্থিত শাসন
• ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান: আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে
• ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে তীব্র উত্তেজনা
ফলাফল:
• নির্বাচন বারবার স্থগিত; বৈধতার সংকট
• অর্থনৈতিক পতন ত্বরান্বিত হয়
• বহিরাগত শক্তির (ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র) হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি
ঐতিহাসিক সমান্তরাল: "মাৎস্যন্যায়" (৭-৮ম শতক) বা ১৩শ শতকের দিল্লি-অধীন বিদ্রোহ-স্বায়ত্ততার দ্বন্দ্ব—দীর্ঘ অনিশ্চয়তা যতক্ষণ না কোনো শক্তিশালী কেন্দ্র আবির্ভূত হয়।

দৃশ্যকল্প ৪: "হাইব্রিড মডেল" (সর্বাধিক সম্ভাব্য)
বাস্তবতা:
• ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচন হয়, কিন্তু আংশিক সংস্কার সহ
• সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে প্রভাব রাখে ("গাইডেড ডেমোক্রেসি")
• বিএনপি-জামাত-এনসিপির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; জোটবদ্ধ সরকার
• আওয়ামী লীগ প্রান্তিক কিন্তু নিশ্চিহ্ন নয়
• "জুলাই ঘোষণাপত্র" আংশিক বাস্তবায়িত—প্রতীকী স্বীকৃতি কিন্তু গভীর পরিবর্তন নয়
ফলাফল:
• "বিপ্লব" ক্রমশ "বন্দোবস্ত"-এ রূপান্তরিত হয়
• কিছু নতুন মুখ, কিছু পুরনো কাঠামো
• ছাত্র-যুব শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত কিন্তু সম্পূর্ণ নিভে যায় না
ঐতিহাসিক সমান্তরাল: ১৬শ শতকে বারো ভুঁইয়া → মুঘল সংহতি—স্থানীয় শক্তির প্রতিরোধ ও নতুন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের মধ্যে ধীরে ধীরে সমঝোতা; বা ১৯৯১-পরবর্তী "গণতন্ত্র"—রূপে গণতন্ত্র, বাস্তবে অলিগার্কি।

অংশ-৩: ক্রান্তিকালের স্থায়িত্ব ও রূপান্তরের গতি
সময়সীমা অনুমান:
স্বল্পমেয়াদ (২০২৪-২০২৬):
• বর্তমান অন্তর্বর্তী পর্যায় অত্যন্ত ভঙ্গুর
• ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে
• এই সময়ে রাজনৈতিক সংঘাত, অর্থনৈতিক চাপ, সামরিক অস্থিরতা সর্বোচ্চ
মধ্যমেয়াদ (২০২৬-২০৩০):
• নির্বাচিত সরকার (যদি হয়) স্থিতিশীলতা আনতে পারবে কি না তার পরীক্ষা
• সংস্কারগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয় সেটি নির্ধারক
• ছাত্র-যুব রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বা বিলুপ্তি
দীর্ঘমেয়াদ (২০৩০+):
• এই রূপান্তর "বিপ্লব" নাকি "পর্ব" হিসেবে ইতিহাসে লেখা হবে
• নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় নাকি পুরনো ধারা ফিরে আসে


ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের সাথে তুলনা:
বাঙ্গালাবর্তের দীর্ঘ ইতিহাসে রাষ্ট্র-উত্তরণের বিভিন্ন ক্রান্তিকালের দিকে তাকালে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যাটার্ন দেখতে পাই—প্রতিটি রূপান্তরের নিজস্ব সময়কাল এবং স্বতন্ত্র ফলাফল রয়েছে।
১. মাৎস্যন্যায় থেকে পাল যুগে উত্তরণ
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর যে "মাৎস্যন্যায়" বা অরাজকতার সূচনা হয়, তা থেকে পালদের প্রাতিষ্ঠানিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগেছিল। এই দীর্ঘ ক্রান্তিকালের শেষে যা অর্জিত হয়েছিল তা ছিল নতুন প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা—জনগণের সমর্থনে গোপালের নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ধর্মপাল-দেবপালের হাতে সাম্রাজ্যের সুসংহতকরণ। এই উত্তরণ দেখায় যে গভীর অরাজকতা থেকে স্থায়ী কাঠামো গড়তে কয়েক প্রজন্মের পরিশ্রম লাগে।
২. সেন থেকে তুর্কি-খিলজি শাসনে রূপান্তর
এর বিপরীতে, বখতিয়ার খলজির ১২০৪-০৬ সালের আকস্মিক আক্রমণে সেন কেন্দ্র ভেঙে পড়ার পর থেকে তুর্কি-সুলতানি প্রশাসন কিছুটা স্থিতি পেতে মাত্র প্রায় ২৫ বছর লেগেছিল। তবে এই দ্রুত সামরিক জয় সত্ত্বেও, রূপান্তরটি ছিল আকস্মিক কিন্তু অসম্পূর্ণ। প্রশাসনিক কাঠামো বদলালেও স্থানীয় সমাজ-সংস্কৃতির গভীর স্তরে পরিবর্তন আরও ধীরে এসেছে। পরবর্তী এক শতক ধরে দিল্লির সাথে স্বায়ত্ততার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, যা প্রমাণ করে যে সামরিক দখল এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন—দুটি ভিন্ন গতির প্রক্রিয়া।
৩. মুঘল থেকে ব্রিটিশ আধিপত্যে ক্রমান্বয়
মুঘল কর্তৃত্ব থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্যে উত্তরণ হয়েছিল প্রায় ৫০ বছরের (১৭৫৭-১৮০০) দীর্ঘ ক্রমিক প্রক্রিয়ায়। প্লাসির যুদ্ধ (১৭৫৭), বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪), দেওয়ানি লাভ (১৭৬৫), এবং স্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩)—এই মাইলফলকগুলোর মধ্য দিয়ে ঘটে ক্রমিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দখল। এখানে কোনো একক আঘাত বা বিপ্লব নয়, বরং ধীরে ধীরে রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক একচেটিয়া অধিকার এবং শেষে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক কর্তৃত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব ঔপনিবেশিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এই ধীর কিন্তু পদ্ধতিগত রূপান্তর বাঙালির সমাজ-অর্থনীতির প্রতিটি স্তরকে পুনর্গঠিত করে ফেলে।

৪. দেশভাগ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম
১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা—এই প্রায় ২৫ বছরের ক্রান্তিকালে ঘটে নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম। পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে শুরু, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, এবং ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ—এই ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি ভাষাভিত্তিক, বহুধর্মীয় জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এই ক্রান্তিকাল দেখায় যে সাংস্কৃতিক-ভাষিক পরিচয় থেকে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বে উত্তরণ এক প্রজন্মের সংগ্রামের ফসল।

৫. ২০২৪ আগস্টের বর্তমান ক্রান্তিকাল
এবং এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি ২০২৪ সালের আগস্টে শুরু হওয়া এক নতুন ক্রান্তিকালের মুখোমুখি, যার গতিপথ এখনও চলমান এবং ফলাফল অনির্ধারিত। শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, সংস্কার কমিশনের কাজ, নির্বাচনের প্রস্তুতি—এসব এখনও প্রক্রিয়াধীন। ইতিহাসের আয়নায় দেখলে, এই ক্রান্তিকাল কি মাৎস্যন্যায়ের মতো দীর্ঘ হবে, নাকি খিলজির মতো দ্রুত কিন্তু অসম্পূর্ণ থাকবে, নাকি ব্রিটিশ দখলের মতো ক্রমিক কিন্তু গভীর পুনর্গঠন ঘটাবে, নাকি ১৯৭১-এর মতো নতুন সংজ্ঞায়ন আনবে—তা কেবল সময়ই বলে দেবে।

উপসংহার: সংযোগ-সভ্যতার নতুন বাঁক
ঐতিহাসিক দলিলের ভাষায় বললে, ২০২৪-এর ৫ আগস্ট বাঙ্গালাবর্তের **"সংযোগ-সভ্যতা"**র আরেকটি পরীক্ষার সময়। অতীতের প্রতিটি ক্রান্তিকালে দেখা গেছে:
১. কোনো একক শক্তি একক দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে পারেনি—বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান, তিব্বতী, বর্মী, ব্রিটিশ—সবাই শেষপর্যন্ত সংমিশ্রণে বাধ্য হয়েছে।
২. বন্দর-নদী-রাজস্ব অর্থনীতি টিকে থেকেছে—যে শক্তিই আসুক, সোনারগাঁ-চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতার বাণিজ্যিক যুক্তি অক্ষুণ্ণ।
৩. বাংলা ভাষা ও জনজীবন শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে—১৯৫২, ১৯৭১-এর পথ ধরে ২০২৪-ও সেই ধারারই আরেক অধ্যায়।
বর্তমান ক্রান্তিকালের অনন্যতা:
• প্রথমবার ছাত্র-যুব প্রজন্ম সরাসরি রাষ্ট্র-পুনর্গঠনের নেতৃত্বে
• ডিজিটাল যুগের আন্দোলন—সোশ্যাল মিডিয়া, তথ্যপ্রবাহ, বৈশ্বিক সংযোগ
• বহুমেরু বিশ্বে ভূরাজনৈতিক চাপ—ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র—সবার স্বার্থ জড়িত

চূড়ান্ত পূর্বাভাস:
সবচেয়ে সম্ভাব্য: হাইব্রিড মডেল—কিছু নতুন, কিছু পুরনো। ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচন হবে, কিন্তু গভীর সাংবিধানিক-প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ধীরে ধীরে আসবে (বা আসবে না)। ছাত্র-যুব শক্তি প্রান্তিক হবে কিন্তু নিশ্চিহ্ন হবে না; তারা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে চাপের গোষ্ঠী হিসেবে থাকবে।
আশাবাদী সম্ভাবনা: যদি সংস্কার কমিশনগুলো কার্যকর হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, এবং নতুন সরকার বৈধতা পায়—তাহলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য "যুব-নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক রূপান্তর"-এর উদাহরণ হতে পারে।
হতাশাবাদী ঝুঁকি: সামরিক হস্তক্ষেপ, দলীয় সংঘাত, অর্থনৈতিক পতন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা—যেকোনোটি এই ক্রান্তিকালকে দীর্ঘায়িত অস্থিরতায় নিয়ে যেতে পারে।


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.