নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

লোভ (সমসাময়িক গল্প)

১৩ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৭



: ‘বল, কেন খুন করলি তাকে?’
চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদে সারাবেলা হালচাষ করে এসে কই একটু খাবে, তা না। এখন আসামী নকিবকে জেরা করতে বসেছে, কেন খুন করল সে?
নকিব থ মেরে বসে আছে। কোনো উত্তর দিচ্ছে না। পাথরের মতো মুখ তার। গ্রাফাইটের চোখে হীরক আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এখনো খুনের নেশা কাটে নি। আরো দশেক খুনের শরাব গিললে তবেই ঘোর কাটবে। এ নেশা বন্ধ করলে কমে না; চালিয়ে গেলে কমে। এ যে মরণনেশা!

: ‘কিরে চুপ করে আছিস কেন, বল কেন খুন করলি ওকে?’ মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমীনের রাগসুয়ালে সম্বিৎ ফিরে পায় নকিব। সে একবার হীরক আগুন চোখ তুলে তাকায়। দেখে, মুক্তিযোদ্ধার গলায় স্পষ্ট একটা দাঁ বসানো দাগ। মোটে আটখানা সেলাই দেয়া। একাত্তরে রাজাকার আমজাদের ছুরিকাঘাতের পরেও কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল। সেই রুহুল আমীন এখন জমি-জিরেত ও হালমজুরি করেই দিনমান করে। সংসারের অবস্থা, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবুও মানবেতর জীবনযাপন করা এ মুক্তিযোদ্ধা কখনো কারোর দোরগোড়ায় আসে নি। তার কথায়, ‘বাঘের দাঁত পরে গেলেও ক্ষিদের তারাশে সে কখনো মাংস ছেড়ে ঘাস খায় না।’
: ‘হ্যাঁ, আমি খুন করেছি। লোভে খুন করেছি।’ অপরাধী অথচ দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেয় নকিব।
: ‘লোভ! কিসের লোভ?’
: ‘মুক্তির লোভ, নিস্তারের লোভ। আমারও যে স্বাধীনভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে।’
: ‘ভুলে যাস না, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। জগতে এই একটি লোভই পাপ নয়—মুক্তির লোভ। তাবাদে সকল লোভই পাপ; আর পাপেই ডাকে মৃত্যু। মনে রাখিস, পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না।’

আবার নকিব চুপ মেরে যায়। এতক্ষণ তার চোখে শেষ বিকেলের রোদ চকমকি খাচ্ছিল। সে একটু ছায়া পাকড়ে নিয়ে বিরাট পাকুড় গাছটার ছায়ায় গিয়ে বসে। একেবারে বাপের ভিটের মতো দখল করে নেয় ছায়াটা। হাত-পাও ছড়িয়ে দেয় ছায়াতে। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাসের উত্তাপে তখন ভক করে একগাদা পেঁয়াজপঁচা গন্ধ বের যায় মুখ থেকে। ক্ষণে ক্ষণেই এ দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়ছে নকিব। বোঝাই যায়, তার ভেতরে অগ্নিদহন হচ্ছে আর সেই কলিজা পোড়ার গন্ধ এসে আছড়ে পড়ছে রুহুলের নাকে। একমাথা চুলে হাত চালিয়ে সন্যাসীর মতো নির্বিকার নকিব কিছুই বলছে না; শুধুই চুপ করে আছে।
রুহুলের সাথে নকিবের পরিচয়টা একাত্তরে। সেই তখন থেকে লাউডগার মতো তরতরিয়ে সময় বেড়ে উঠে ৪৪টা বছর। সেই যে রাজাকার আমজাদের দেয়া চোট, তারপর বেহুশ হয়ে তিনদিন। এরপর ফেরেশতার মতো হাজির হয়েছিল নকিব। কত শত তাবিজ-তুমার, ঝাড়-ফুঁক আর বনেদী ওষুধের পরিচর্যায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে রুহুল। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল একাত্তরের গাজী সৈনিক; শহীদ হলেও হতে পারত। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে ছিল হয়ত অন্য রকম। তখন থেকেই নকিবকে সহযোদ্ধা হিসেবে নিয়ে যুদ্ধ করেছে আরো দুই মাস। বিনিময়ে দিয়েছে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ—বাংলাদেশ।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে বহুতল ফ্ল্যাট বরাদ্দ আছে, সেটাও গ্রহণ করে নি এই রুহুল আমীন। সরকারি অনেক সুবিধা থেকেও বরাবরই বঞ্ছিত সে। এ নিয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের পিণ্ডি চটকানো কথা তার কান সয়ে গেছে। কিন্তু তাদেরকে সবসময় সে যুক্তিসমেত বলেই গেছে, ‘মায়ের জন্য কিছু করলে তার জন্য কেউ কি কোনো পুরুস্কার নেয়? দেশ তো আমাদের মা।’

: ‘করেছিস খুন আর বলছিস মুক্তি পেলি! আরে, তুই তো এখন হাজত খেটে মরবি। এখানে মুক্তি পেলি কোথায়?’। প্রচণ্ড সংশয় আর রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে নকিবের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে রুহুল আমীন। কোনো উত্তর না পেয়ে বাঘের হুংকার ছেড়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘সত্যি করে বল, তাকে তুই কেন খুন করলি?’
: ‘একবার বলেছি না, লোভে খুন করেছি। বার বার ঘ্যান ঘ্যান করছো কেন?’ বিরক্তগলায় উত্তর দেয় নকিব।
: ‘কিসের লোভ? তুই জানিস না, লোভে পাপ; পাপে মৃত্যু! তোর তো এবার মরণ হওয়া দরকার।’
: ‘একটা গল্প শোনাই। শুনবে?’ দোর্দণ্ড ক্ষোভে সুয়ালের বিপরীতে এমন নমনীয় জওয়াব হতবাক করে রুহুলকে। চেহারাটাকে কালসিটে, শীর্ণকায় করে বলে- ‘সংক্ষিপ্ত করে বল।’
: ‘তোমার মতো এক হালমজুর একবার মাটি খুঁড়ে একটা সোনার থালি পেল, খানিকটা বাদে একটা কলসি।’ এতটুকু বলে নকিব পাতিশিয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করে উঠে। রুহুল বিরক্তগলায় বলে, ‘ভানভণিতা ছাড়া সংক্ষিপ্ত করে বললে বল, না বললে চুপ থাক, সেটাই ভালো।’
: ‘কথাপ্রসঙ্গে হাসি পেলে আমি কী করব? ঠিক আছে, ঠিক আছে! শোনো- সোনার থালি, কলসি পেয়ে টিমটিমে প্রদীপের মতো হালমজুরের মুখখানা তখন মেঘগলানো চাঁদের মতো ফুটি ফুটি করে উঠল। সমস্ত দিনের ক্লান্তি নিমেষেই শেষ। সহাস্য বদনে সে ওগুলো নিয়ে দিলো সোজা বাড়ি হাঁটা। খানিকটা পথ গেলে সে ভাবল, আরেকটু মাটি খুঁড়লে হয়ত আরো মিলত। যেই ভাবা সেই কাজ। চন্দ্রবলয়ের মতো উজ্জ্বল মুখখানা তার পাংশুটে হয়ে ওঠল; লোভী কুৎসিত চেহারা হয়ে গেল একটা। পায়ে আগুনের ঘুঙুর অথচ সোনার খাঁচাটির স্বপ্নে বিভোর! বেচারা হালমজুর মাটি খুঁড়তেই থাকল আর সোনা পেতেই থাকল। একপর্যায়ে মাটির এতটাই গভীরে চলে গেল যে, সেখান থেকে উঠে আসার পথ বাকি রইল না। সেখানেই মৃত্যু ঘটলো।’ এই বলে নতুন পানির ব্যাঙের মতো সুখদ লজ্জায় হাসতে হাসতে গোঙাতে থাকে নকিব।
: ‘তুই কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস। বল, কিসের লোভে ধরেছিলো তোকে?’ অনুসন্ধিৎসু হয়ে বলে রুহুল।
: ‘কী, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে? আন্দাজ করতে পারলে না, আমি কী বলছি?’
: ‘না। আমি তোর মতো দার্শনিক নই। তবে যাই হোস এখন তুই একটা খুনী।’
: ‘লোভ জিনিসটা হলো একটা পুতুল খেলার মতো। ছোট ছেলেমেয়েরা যখন মাটি দিয়ে ঘর-বাড়ি, রান্নাবান্না করে তখন তারাও বোঝে- এখানে থাকা যাবে না, ওগুলো খাওয়া যাবে না। তবুও তারা করে। কারণ সেটা করতে তারা ভালোবাসে। ধরো, টিকিট কেটে একজন সিনেমাহলে ছবি দেখতে গেল। ছবিতে নাওয়া-খাওয়া, মারপিট, হাসি-কান্না দেখে অনেকে দুঃখ-সুখের জোয়ারে ভাসে। ওসব মিছেমিছি হাসি-কান্না দেখে তারা অযথা কেন টাকা খোয়ায় জানো? কারণ তারা ঠকতেই ভালোবাসে। তারা প্রহসন লোভের শিকার। আর এসব লোভের ফায়দা লুটছে পেটুকদলেরা, যারা ঘটনা রটিয়ে খবরের হেডলাইন বানাতেও সিদ্ধহস্ত। এই তার কথাই ভাবো। সে তোমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই কিছু একটা করতে চেয়েছিল, দক্ষিণ জেলায় ইউনিট কমান্ড করবে। কিন্তু একটি মাত্র স্বাক্ষরের জন্য তা পারল না। তবুও সে সিনেমাহলের বোকা দর্শকই বনেছিল।’
: ‘কী! একটি স্বাক্ষরেই কি মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বদলে যায়?’
: ‘তা বদলায় না। তবে এতটুকু তো প্রমাণ হয় যে, সে রাষ্ট্রদোহী ছিলো না। তোমার গলায় ছুরি চাপানো আমজাদ যদি স্বাক্ষরের মাধ্যমেই একজন মুক্তিযোদ্ধা বনে যায় এবং তার মৃত্যুতে যদি প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তা জানায় কিংবা প্রতিমন্ত্রী ফেসবুকে যদি তার কর্মময় জীবনের ফিরিস্তি দিয়ে পোস্ট দেয়, তবে তোমার কী বা করার আছে?’
: ‘তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাক্ষর দিলো না কেন?’
: ‘লোভ। টাকার লোভ। শুটকি মাছের লোভ। না দিলে স্বাক্ষর জোটে না; গলাধাক্কা জোটে।’
: ‘তুই কি খুনের বিষয়টা ফাইলদাবা করতে চাইছিস?’
: ‘না। মোটেই না।’
: ‘তাহলে বল, তুই তাকে কিভাবে খুন করলি?’
: ‘বিষ গুলিয়ে পেটে পুরে দিয়েছি। সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না।’
: ‘কেন? কী দোষ ছিল তার?’
: ‘ওই যে বললাম লোভে। সে একটু মুক্তির লোভ করেছিল।’
: ‘তাহলে তোর লোভটা কিসের? তুই যে বললি, তোরও নাকি স্বাধীনভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে!’

নকিবের মনে অস্থিরতার দানা পাকিয়ে উঠতে থাকে। হঠাৎ কোথা হতে যেন লিরলিরা বাতাস এসে দোলা দিয়ে যায় তার চুলে। মুহূর্তে কৃত্রিম জলজে ঘেরা অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছের মতো ভাবে নিজেকে। রুহুলের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করে না তার। খুব ভীষণ একটা সাঁইসিট পরিবেশ। বিকেলের ক্লান্ত রবিটা দিগন্তজুড়ে মুড়ে দিয়েছে সোনা। নীল আকাশে সোনার এ বিস্তার আজ অন্য দিনের মতো নয়। ধীরে ধীরে কমে আসছে রোদের উত্তাপ। সোনায় মোড়া এ নীলাভ প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। যেন কোনো অদৃশ্য শিল্পীর তুলির আঁচড়। এরই মধ্যে অদূরে কোথায় যেন রাখালের বাঁশি সুর তুলে হারিয়ে যায় শ্রবণশক্তির আড়ালে। প্রকৃতির এ ইন্দ্রজাল রুহুলকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে, সময়কাল যখন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ যোদ্ধাদের ‘শহীদ’ হওয়ার তখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির শাসনামলে প্রথম মুক্তিযোদ্ধার হত্যা বড়ই লজ্জাজনক।

: ‘তুই কেন খুন করলি তাকে বল?’ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে রুহুল।
: ‘বাবা, কে কাকে খুন করেছে?’ মুক্তিযোদ্ধা রুহুলের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করে তার ছোট ছেলে রিয়াজুল।
: ‘তোর নকিব চাচা মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুবকে খুন করেছে।’

রিয়াজুল জানে, তার বাবার এ নকিব চাচার রোগ বহুদিনের। যে কোনো বিষয়ে নায়ক-খলনায়ক চরিত্রে থাকে এই নকিব চাচা। ডাক্তার বলেছেন, এটা হ্যালুসিনেশন। মনে পড়ে, রিয়াজুল একবার রাগ করে তার হাত কেটেছিল। কিন্তু দোষ চেপেছে এ নকিব চাচার ওপর। এরই মধ্যে আবারও চেঁচিয়ে উঠে রুহুল, ‘বল কেন খুন করলি তাকে?’
নকিব শুধু বলে, ‘লোভে, মুক্তির লোভে। হরহামেশা দুর্নীতিবাজদের কবলে তিলেতিলে মৃত্যুর চাইতে একবার চিরতরে মৃত্যু যাওয়াটাই হলো আমার মুক্তি।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.