নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ট্র্যাভেল করতে ভালো লাগে আর ভালো লাগে ট্যুর থেকে এসে রিভিউ করতে আর মাঝে মাঝে টুকটাক লেখালেখি করি ।

রিংকু সি বিশ্বাস

রিংকু সি বিশ্বাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

এভারেস্ট

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৩

স্বপ্নটা অনেকদিন থেকেই দেখছি যে , এভারেস্টের শৃঙ্গে আমার নাম লেখা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আসবো । কয়েকবার খুব কাছাকাছি গিয়েও ফেরত এসেছি , শৃঙ্গে আর উঠা হয়নি ।
এবার আর মিস হবে না , এবার জয় করে আসবোই । বেস ক্যাম্পে আসাটা আমার সবসময় ভালো লাগে। বেস ক্যাম্পটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৭০০ফুট উচুতে । এখানে আগে যতবারই এসেছি ,সবসময়ই , আমার গরম খাবারগুলো আগুন থেকে নামানোর পর আমার প্লেটে আসতে না আসতেই ঠাণ্ডা হয়ে যায় । আমার টুথপেস্ট এবং মাথার চুল , জমে সোজা হয়ে থাকে । বেস ক্যাম্পে এসে আমাদের টীম লিডারের সাথে পরিচয় হল , টমাস হাজেনবিন্স , খুবই হাসিখুশি মানুষ । এবারের শেরপা জিং সাই অম্রু । আমাদের গ্রুপে মোট আটজন , শেরপাসহ এগারোজন । আমরা পরিচিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে , আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের এভারেস্ট যাত্রা শুরু করলাম । এর পরের যাত্রাটাই অনিশ্চিত , কে ফেরত আসবে আর কে যে আসবে না , তাই জানি না ।
বেস ক্যাম্পের পরের গন্তব্য হচ্ছে , Icefall ক্যাম্প , যা প্রায় ১৮৫০০ফুট উচু । ভয়ঙ্কর সুন্দর এই জায়গা । চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ । থিম পার্কে ,এমনটা কৃত্তিমভাবে বানানো হয় । চারিদিকে অনেক বরফের টিলা । মাঝে মাঝে মনে হয়, যে কোন সময় মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে । এখানে একটি জায়গা আছে , যেখানে , পারাপার করতে হয় , শোয়ানো একটি সেতু দিয়ে , যা মুলত একটি স্টিলের মই । এটি পার হবার সময় খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় , নিচের দিকে তাকালে প্রায় সবারই মাথা ঘোরে । নিচের ফাটলের শেষ কোথায় ,এটা চিন্তা করলে এতো ঠাণ্ডাতেও শরীরের লোম দাড়িয়ে যায় । সিঁড়িটা আমি খুব সাবধানে পার হই কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আমার দলের এক জার্মান সদস্যের সাথে । এটা ছিল ওর প্রথম যাত্রা , বেচারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে তাকাতেই ওর মাথা ঘুরে ভারসাম্য হারিয়ে সিঁড়ির উপরেই পড়ে যায় । নিরাপত্তার জন্য শরীরের সাথে বাধা জ্যামারটা ,যা সিঁড়ির রশির সাথে আটকানো থাকে , তাই ও নিচে পড়ে যায়নি । টমাস আদর্শ দলপতির মত , উৎসাহ দিয়ে , ওকে সিঁড়িটা পার করে দেয় । বেচারা দেখলাম , এই বরফের মধ্যেও ঘামছে । এভারেস্টে প্রতিটা পদক্ষেপেই মৃত্যু হতে পারে একটু অসতর্ক হলেই । আমরা সবাই মোটামুটি নিরাপদেই পার হলাম । এর পরের ক্যাম্পকে বলা হয় “Camp 1, Valley of Silence ” , যা প্রায় , ২০০০০ফুট উচুতে ।
এখানে এসে , টমাস সবাইকে বলল যে , আমরা এখানে ক্যাম্পিং করবো । আমরা যখন এখানে আসলাম , তখন এখানে প্রচণ্ড বাতাস । চারিদিকে শুধু বাতাসের শো শো শব্দ । এর মধ্যে অনেক কষ্টে তাবু টাঙালাম , সিদ্ধান্ত হল যে, বাতাসের বেগ না কমে আসা পর্যন্ত আমারা তাবুর ভিতর থাকবো । তাবুর ভিতর থাকা আসলে , খুবই কষ্টকর । খুব অল্প জায়গায় শুয়ে থাকতে হয় , তারমধ্যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা । অনেকের মত , আমারও মাথা ব্যাথা শুরু হল । এটা অবশ্য খুব স্বাভাবিক কারন , এখানে বাতাসের বেগ বেশি থাকায় , অক্সিজেনের অভাব থাকে ।
বাতাসের বেগ কমে আসার পর , আমরা রওয়ানা দিলাম । তখনো সূর্য উঠেনি । সামনে অনেক চিড় ধরা পাহাড় । এই পাহাড়গুলো খুবই ভয়ঙ্কর , যদিও এখানে পাহাড়ের গায়ে , রশি বাধা থাকে কিন্তু প্রতিটা চিড় পার হতে অমানুষিক শ্রম লাগে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যেতে হয় যে , পায়ের নিচের বরফগুলো , আলগা নয়তো । এগুলো পার হয়ে যেতে হবে ক্যাম্প-২ , যা প্রায় ২১০০ ফুট উঁচু ।
ক্যাম্প-২’তে এসে এভারেস্টের চুড়াটা দেখা যায় । আমাদের সবাইর গন্তব্য ওখানে । আমি তো কতবার , ওই চুড়ার খুব কাছে এসে ফিরে গিয়েছি । আমরা আজ রাতের জন্য , এখানেই তাবু টাঙাবো । এই জায়গাটা খুবই সুন্দর । এখান থেকে , অনেক নিচে মেঘ দেখা যায় , হিমালয় ঘেরা মেঘ । আমি আমার ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে , তাবু টানিয়ে নিলাম । তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে , আশেপাশের চারিদিক দেখতে গেলাম । এখানে অনেক সময় আংশিক ব্যাবহার করা অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যায় । আমি পেয়েও গেলাম একটা । এমনকি এক জায়গায় পেলাম , আধা খাওয়া চুরুট । ভাবা যায় , এতো উপরে আমি চুরুট টানছি । শেরপারা এখানে আমাদের জন্য বয়ে আনা , ভারি খাবারগুলো রান্না করে ফেলল কারন এর পর আর ভারি কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না । এরপর সামনে আরও অনেক বিপদসংকুল জায়গা , যেখানে কোনমতে নিজেকে নিয়ে পার হওয়া যায় । আমাকে ঘুরতে দেখে , এক শেরপা , একটি আধা খাওয়া বিয়ারের ক্যান এগিয়ে দিলো । এখানে সবাই সবকিছু ভাগ করে খায় । আমি খুবই আরাম করে, চুরুট আর বিয়ার খাচ্ছি কারন জানি , এরপর শুধু স্বপ্ন পুরন করার পালা ।
রওয়ানা হলাম , রাত প্রায় তিনটা বাজে , এর পরের ক্যাম্পিঙের জায়গার নাম “Camp 3, Lhotse wall” , যা প্রায় , ২৪০০০ ফুট উচুতে । এতো ভোরে শুরু করতে হয় কারন , সূর্যের আলো বেশি হয়ে গেলে , তা প্রতিফলিত হয় ,যাতে অনেকেরই চোখে দেখার সমস্যা হয় , যদিও আমাদের চোখে বিশেষ ধরনের চশমা থাকে কিন্তু তাতেও মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হতে হয় , আর একটু খানি বিভ্রান্তি মানেই , মৃত্যু । ক্যাম্প-৩’এ যেতে হলে , একটা জায়গা আছে , যেখানে দেয়ালের সাথে বাধা রশিতে নিজেকে বেধে , আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে ঝুলে যেতে হয় । এই জায়গাটাই আমার সবথেকে ভয় লাগে । আমি নিজের জ্যামারটা ভালো ভাবে হুকের সাথে আটকে নিলাম । বার কয়েক টেনে দেখলাম যে, শূন্যে আমার ভার নিতে পারে কিনা । নিশ্চিত হয়ে , পায়ের স্পাইক শু’টা খাড়া দেয়ালে গেথে নিলাম । দু’কদম এগুতেই নিজেকে শূন্যে আবিস্কার করলাম । এখান থেকে একটি পদক্ষেপ নড়চড় হলেই , একদম নিচে , কেউ খুজে পাবে না আমায় । খাড়া দেয়াল পার হয়ে যে , জায়গাতে আসলাম , এই জায়গাটার নাম , “Ice bulge ” , এই জায়গাটি খুবই পিচ্ছিল , এবং কোন এক কারনে , এই জায়গার বরফগুলোকে নীল রঙ মনে হয় । আমরা খুব ধীরে ধীরে , লাইন বেঁধে এগুচ্ছি । এখানে , খাড়া দেয়াল থেকে একটু সাবধানে থাকতে হয় কেননা অনেক সময় দেয়াল থেকে বরফের গুড়া পরতে পারে, যা পড়বে , নিচে উঠতে থাকা অন্য আরোহীদের উপরে । আমরা একটা খাড়া দেয়ালের পাশে ক্যাম্পিং করলাম । প্রচণ্ড বাতাস থেকে বাচার একটাই উপায় , তাবুর ভিতর বসে থাকা । আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । এখানে আসলে ঘুম হয় না , তন্দ্রা হয় । আমাদেরও এভাবেই অভ্যস্ত হতে হয় । আমার সাথে , তাবু শেয়ার করছে , অস্ট্রিয়া থেকে আসা এক মেয়ে । এই মেয়ের অসম্ভব প্রান শক্তি । কিছুতেই হার মানতে চায় না । রাত দু’টায় রওয়ানা হলাম । এর পরের ক্যাম্প হবে , ২৬০০০ ফুট উচুতে , আর ওই জায়গার নাম “the Deathzone” ।
আমরা সবাই এক লাইনে আবার উঠতে লাগলাম । আমাদের সবার সামনে আছে , টমাস । প্রতিটি পদক্ষেপ দেবার আগে , হাতের লাঠিটি বরফের গায়ে ঢুকিয়ে দেখছে , কোথাও যেন আলগা বরফ না থাকে , যাতে পা পড়লে , মুহূর্তেই বরফধস নামতে পারে । এই চলার পথটি এমন , যেখানে নিজে থেকে কেউ কথা বলে না , মনের মধ্যে থাকে শুধু ভয় । কারন , এখানে ভুল জায়গায় পা পড়লে , পুরো দলটি পড়ে যাতে পারে আবার সবাই বরফ ধসে তলিয়েও যেতে পারে । এভারেস্টে নির্দিষ্ট রাস্তা বলে কিছু নেই কারন বরফ পড়ে পড়ে নতুন রাস্তা তৈরি হয় , আমরা সবাই শুধু ধারনার উপর চলি আর মনের ভিতর থাকে , এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন । যখন আমাদের ক্যাম্পিং করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় উঠলাম , মনের ভিতরটা শান্তিতে ভরে গেল কারন আগামীকালই আমার সেই স্বপ্নের শেষ দিন , আমার স্বপ্ন পুরনের দিন । ক্যাম্পিঙের জায়গায় তাবু টানিয়ে আমি একটু সামনে এগুলাম । এখান থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় , তিব্বতের বিস্তীর্ণ সবুজ সমভূমি , দূরে দেখা যায় , কাঞ্চনজঙ্ঘা আর মাকালু । এগুলো দেখলে , চোখের আয়ু বেড়ে যায় বহুগুণ আর মনে হয় যে , পুরো ব্যাপারটাই একটা অপার্থিব । ক্যাম্পে ফিরে এসে , বরফ গলিয়ে গরম গরম চা খেয়ে নিলাম , সাথে নিয়ে আসা বিস্কুট । কাল ভোঁরে রওয়ানা দিবো , কালই এভারেস্ট জয়ের দিন । এখানের দিনগুলো সুন্দর হয় কিন্তু রাতগুলো ভয়ঙ্কর , শো শো করে পাহাড়ি দমকা হওয়াগুলো উড়িয়ে নিতে চায় তাবুটাকে । ছোটবেলার ঠাকুরমায়ের কাছে শোনা, রাক্ষসের গর্জনকে বাস্তব মনে হয় । আমি প্রচুর পানি খেয়ে নিলাম । কাল কখন আবার পানি গরম করে খেতে পারবো ,জানিনা । আমি শুয়ে পরলাম কিন্তু ঘুম আসে না , মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে ডাকছে ।
আমার খুব বিরক্ত লাগছে ,কেন আমাকে ডাকা হচ্ছে , আমি আজ প্রস্তুতি নিচ্ছি , এভারেস্ট জয় করার । আগেও কয়েকবার , আমি এখানে এসে ফিরে গেছি ।
ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলে দেখি , মীরা ডাকছে , “ ওঠো, আর কত ঘুমাবে, লেপের মধ্যে থেকে বের হও , বাজারে যেতে হবে । টেবিলে লিস্ট করা আছে , তাড়াতাড়ি ওঠো ” ।
আমিও আড়মোড়া ভাঙ্গার চেস্টা করলাম , এবারও এভারেস্টের শৃঙ্গে উঠা হল না ।



মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৫৩

মানিক মীর বলেছেন: আপনার সাথে আমিও ছিলাম। প্রত্যেক শব্দে, বাক্যে, গল্পে, থ্রিলিংএ, চিত্রকল্পে।

শেষে মন খারাপ করে দিলেন!!!

২| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:০০

রাখালছেলে বলেছেন: অসম্ভব ভাল হইছে । ভাল লাগল। সামনে এগিয়ে যান ।

৩| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:৩৯

মোঃ আক্তারুজ্জামান ভূঞা বলেছেন: সত্যি ভাবছিলাম! স্বপ্ন হলেও চমৎকার লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.