নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ট্র্যাভেল করতে ভালো লাগে আর ভালো লাগে ট্যুর থেকে এসে রিভিউ করতে আর মাঝে মাঝে টুকটাক লেখালেখি করি ।

রিংকু সি বিশ্বাস

রিংকু সি বিশ্বাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধূসর সকাল ।

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৪৫



স্টেশনে নেমে যা মনে হল , তা হচ্ছে এখানে নামবার মত যাত্রী সম্ভবত আমি একাই । চারিদিকে ভালমত তাকালাম , দু-চারজন লোক আছে অবশ্য তবে এত নির্জন ট্রেন স্টেশন আমি এর আগে কখনো দেখিনি । ট্রেন স্টেশন মানেই , কোলাহল , হকারদের চিৎকার , যাত্রীদের ছোটাছুটি । কিন্তু এই স্টেশনটাই কেমন জানি । ভালমত তাকিয়ে বুঝলাম যে , স্টেশনে সম্ভবত লোডশেডিং চলছে ।
গ্রামে ঘুরবো বলে , বন্ধুকে বলেছিলাম , তাই রাসেল আমাকে তার গ্রামের বাড়িতে আসতে বলেছিল । আমাদের একসাথেই আসার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহুরতে ওর জমি সংক্রান্ত কাজ পড়ে যাওয়ায় , আমার দুদিন আগে ও চলে আসে । কিন্তু বলেছিল যে , আমার জন্য স্টেশনে ও অপেক্ষা করবে । স্টেশন থেকে ওর বাড়ি আরও দুঘণ্টার রাস্তা , ভ্যানে করে যেতে হয় । আমার ট্রেন ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা লেট । তাই আমার মনে হচ্ছে যে , ও হয়ত মনে করেছে যে , আমি আর আসবো না । তবে , এটা আশা করি তেমন সমস্যা না , ও ভালমতই ওর বাড়ি যাবার রাস্তা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে । তারপরও আমি স্টেশনের আশেপাশে খুজে দেখলাম কিন্তু ওকে দেখলাম না । ঘড়িতে দেখলাম যে , রাত দু’টা বাজে ।
ভালমত খেয়াল করে দেখলাম যে , এখন মাত্র একটিই দোকান খোলা আছে । আমি দোকানে গিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ,
 এখান থেকে মুরাকিপুর কতদুরে ?
 মুরাকিপুর তো ম্যালা দূর , ভ্যানে গেলিও দুইঘণ্টা লাগপে । আর এখন তো ভ্যান পাইবেন না , আযানের পর পাইবেন ।
 ওহ! কি আর করা । অপেক্ষা করি এখানে ।
 দেহেন , আমার লগে আমার বাড়ি যাইতে পারেন , যদি কিছু মনে না নেন । একা কতক্ষণ বইয়া থাকবেন ?
 না থাক । সকাল হতেও বেশি দেরি নাই । আশা করি সময় কেটে যাবে । কারেন্ট আসবে কখন ?
 ঠিক নাই । আইবার পারে আবার নাও পারে । ঠিক আছে , ভাইজান । দোকান বন্ধ করুম । আপনি থাকেন তাইলে ।

লোকটি চলে যাবার পরেই মনে হল যে , তার সাথে গেলে ভালো হত । আমি ছাড়া এই স্টেশনে মনে হয় আর কেউ নেই এখন । ব্যাপারটা খারাপ লাগছে না । চারিদিকে অন্ধকার , ঝিঝি পোকা ডাকছে , শেয়ালের ডাকও শুনতে পারছি । আশেপাশে কোন মানুষ নেই । একদম নিজের মধ্যেই আমি একা । অনেকদিন পর এমনটা লাগছে । ঢাকায় চারিদিকে কৃত্রিমতা , নিজেকে একা পাবার মত সুযোগ হয় না । নিজেকে একা করার মধ্যে দিয়ে অনেককিছু পাওয়া যায় । নিজেকে মূল্যায়ন করা যায় ।
রাসেল নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করেছে , তারপর ট্রেন দেরি দেখে হয়ত বাড়িতে চলে গেছে অথবা মনে করেছে যে , আমি হয়ত আর আসবোই না । কাল রাসেলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে, নিশ্চয় ও খুব অবাক হবে । আর আশা করি আমার গ্রামে থাকাটা আনন্দের হবে ।
 ভাইজানকে তো এই এলাকায় আগে দেখিনি ।
আমি চমকে পিছনে তাকালাম । আমি মনে করেছিলাম যে ,স্টেশনে মনে হয় আমিই একা । যাক ভালোই হল যে , আমি এখানে একা না ।
 হ্যাঁ , আমি যাবো মুরাকিপুর কিন্তু আজ ট্রেন লেট থাকায় এই মধ্যরাতে এখানে বসে আছি । আপনি ?
 আমি আবদুল বারেক , এই স্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার । এখানেই থাকি । আপনাকে একা বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলাম ।
আমি ভালোমত লোকটির দিকে তাকালাম । অন্ধকারে যদিও ভালমত দেখা যায় না কিন্তু মনে হল যে , একটু মলিন কাপড় আর অগোছালো চেহারা ।
 আমার চেহারা বা কাপড় দেখে বিভ্রান্ত হবেন না , জনাব । আমি স্টেশনেই থাকি , তাই কাপড়চোপড়ের তেমন যত্ন করতে পারি না । তাছাড়া পরিবার বলতেও আমি একা । তাই ... । আর এই স্টেশনে আপনাদের মত ভদ্র লোকেরা তেমন আসে না , যারা আসে তারা সবাই চাষাভূষা মানুষ ।
 না, আমি তা বলছি না কিন্তু আপনাকে তো এর আগে দেখলাম না । আমি তো অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি ।
 পাশেই ছিলাম । দেখলাম যে , ট্রেন থেকে আপনি একা নামলেন , সিগারেট খেলেন । কোন ব্র্যান্ড খান আপনি ? আমি আবার বেনসন ছাড়া কিছু খেতে পারি না ।
আমি কিছুটা বিরক্তিবোধ করলাম কিন্তু কিছু না বলে , প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম । প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে লোকটা পকেটে রেখে দিলো ।
 আপনাকে একটা কথা বলি জনাব । যদি আপনি বিরক্তিবোধ না করেন ।
 বলেন , বসেই তো আছি ।
 আমি এখানকার ষ্টেশন মাস্টার প্রায় বাইশ বছর ধরে । প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে , তবে বেশিরভাগই গ্রামের লোকজন । তাদের গুরুত্ব না দিলেও চলে । তবে তাদের জন্যই আমার চাকরি টিকে আছে । আমি বিয়ে করিনি । তাই ষ্টেশন লাগোয়া একটা ছোট রুমে আমি থাকি । এখানকার প্রায় সব মানুষ আমি চিনি । আপনার যে বন্ধু , রাসেল , তাকেও আমি চিনি ।
 রাসেল ? আমি যে রাসেলের বন্ধু , আমি তো এটা আপনাকে বলিনি কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে ?
 বেয়াদবি নেবেন না , জনাব । রাসেল অনেকক্ষণ বসে ছিল কিন্তু একা চলে যায় , তাই মনে হল যে , নিশ্চয় কারো জন্য অপেক্ষা করেছে । আপনাকে এখন দেখে আমি মিলিয়ে নিলাম ।
যাক , রাসেল তাহলে এসেছিল । আমি জানতাম ও আসবেই । আমাকে না পেয়ে নিশ্চয় চলে গেছে । ভালো লাগলো জেনে । আমি আবার বারেক সাহেবের কথায় মন দিলাম ।
 আমি আমার মত থাকি । তেমন কাজও নেই । সারাদিনে মাত্র দুটা ট্রেন আসে । তো , গত পরশুদিন হল কি , আমি সিগন্যাল ক্লিয়ার করে দিয়েছি । ট্রেন আসবে যথাসময়ে । ঠিক এমন সময়ে দেখলাম যে , একটি ছোট মেয়ে দৌড় দিয়ে রেললাইন পার হচ্ছে । আমি মেয়েটির দিকে দৌড় দিলাম আর মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ।
 কি বলেন !! মেয়েটির কোন ক্ষতি হয়নি তো ?
 না , মেয়েটির কিছু হয়নি কিন্তু ট্রেনটা আমার উপর দিয়ে চলে গেল ।
আমি চমকে উঠলাম কিন্তু বুঝতে না দিয়ে ভালোমত আবার লোকটির দিকে তাকালাম । এবার আমার কিছুটা ভয় করতে লাগলো কিন্তু সাহস করে বললাম ঃ
 আপনার উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেল কিন্তু আপনার কিছু হয়নি ?
 ট্রেনটা যখন ধাক্কা দিলো তখন প্রচন্ড ব্যাথা লেগেছিল , মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম কিন্তু তারপর যখন জ্ঞান ফিরল , তখন দেখলাম যে , অনেক মানুষ ট্রেনলাইনের উপর কি যেন দেখছে । যেহুতু ট্রেন চলে গিয়েছিলো তাই আমি আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
আমার এবার বিরক্তি লাগছিল । হয় লোকটা আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে , এই মধ্যরাতে নির্জন স্টেশনে অথবা আমাকে একা পেয়ে চাপা মারছে । আমার প্রথম ভয় লাগলেও , এখন লোকটাকে বিরক্তি লাগছে । আমাকে অযথা ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে ।
 ভাইজান মনে হয় , আমার কথা বিশ্বাস করলেন না , তাই না ? শুধু আপনি না , অন্য কেউ তো আমাকে ঐদিনের পর থেকে পাত্তাও দিচ্ছে না । এই যে আমি , সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি অথচ সবাই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছে , চিনেও না চেনার ভান করছে । যাই হোক ভাইজান , আমি যাই , ঘুম পাচ্ছে । ভোরও হয়ে যাচ্ছে , আপনি এবার ভ্যান পাবেন । আশা করি আবার দেখা হবে ।
আমার উত্তরের আশা না করেই , লোকটা হাটা দিলো । আমিও আর ডাকলাম না । চাপামারা লোকজন আমার খুব বিরক্ত লাগে ।
ভোর হয়েছে , ষ্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম যে , ভ্যান দাড়িয়ে আছে । আমি দামাদামি করে উঠে বসলাম । ভোরের আলোয় গ্রাম দেখার শান্তিই আলাদা । আমি ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম ঃ
 আচ্ছা , আপনাদের ষ্টেশন মাস্টার কি মিথ্যা কথা বলে অনেক ?
 না , খুব ভালো মানুষ আছিলেন । কেন , আপনি কি তারে চেনেন ?
 না , চিনিনা । যখন বসে ছিলাম , তখন কথা হল উনার সাথে ।
 কি বলেন ভাই ? ক্যামনে কথা কইলেন ? হেয় তো পরশুদিন ট্রেনে কাটা পরছে । শইল একবারে দুইভাগ । আমরাই তো মরা শইলটারে নিয়া কবর দিলাম ।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি । গ্রামের ভোরের শীতের বাতাসেও মনে হয় ঘেমে যাচ্ছি । কোথায় যেন কোকিল ডাকছে , কুহু , কুহু , কুহু ।



মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:১২

কানিজ রিনা বলেছেন: বেশ ভাল লাগল গল্পটা। ধন্যবাদ,

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.