নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতারিত সরকারী ব্যাংকার

অপমানিত,নিপীড়িত,মানসিকভাবে নির্যাতিত,অবহেলিত,প্রপঞ্চিত।

সাঈদ রহমান ০০৭

উচ্চশিক্ষিত

সাঈদ রহমান ০০৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

খসে পরা তারা (বিদগ্ধ সময়-04)ঃ

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৪৪

খসে পরা তারা (বিদগ্ধ সময়-04)ঃ
মসজিদের মিনার থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে। আযানের সুর কানে আসা মাত্র তনুজার ঘুম ভেঙে গেলো। তনুজা চোখ খুলে পাশে শুয়ে থাকা ইশান এর দিকে খানিক তাকিয়ে দেখলো ইশান এর নিষ্পাপ মুখ। ইশানের নিষ্পাপ মুখ দেখে একটা অন্যরকম ভালোলাগা খেলে গেলো তনুজার মনে। আলসেমি ধরায় আরো খানিক্ষণ ইশানের পাশে শুয়ে থাকলো্।একটু পরে ঘড়ির এলাম বেজে উঠলে তনুজা উঠে পড়লো।বিছানা ছাড়লো।ওয়াশেরুমে গিযে ফ্রেশ হয়ে আসলো।একটু পরেই কলিংবেল বেজে উঠলো । এই বুজি কাজের বুয়া আসমার মা চলে আসলো। তনুজা ছুটে গিযে দরজা খুললো। তনুজা কিছু বলার আগেই আসমা মা বললো আফা কাইল আসতে পারিনি। কারণ ছোট মেয়েটার রাইতে কাপন দিয়া জ্বর আসছিলো তাই।তনুজা আর কিছু জানতে চাইলোনা। তনুজা শুধু বললো বুয়া তাড়াতাড়ি নাস্তা বানিয়ে ফেলো।অফিসে যেতে হবে আর সন্ধ্যায় একটু বাসায় এসো কারণ আজ রাতের খাবারটা আমি নিজ হাতে তৈরী করবো।বুয়া জানতে চাইলো আফা আজ কি কোন বিশেষ দিন? তনুজা বললো হ্যাঁ আজ আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী তাই রাতে নিজ হাতে খাবার তৈরী করবো। তুমি সন্ধ্যায় তোমার ছোট মেয়েকে নিয়ে একটু এসে হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিও। একথা বলে তনুজা বাথরুমে গরম পানি নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো। তনুজা গোসল শেষে চুলে টাওয়াল দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এসে ইশানকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। ইশান আবার ঘুম থেকে উঠেই পূণরায় তনুজার চোয়াল ছুঁয়ে বিবাহ বার্ষিকী উইশ করলো।তনুজা বললো কতবার উইশ করতে হয়। ইশান বললো সারাদিন উইশ করতে হয়। উইশ কি গুনে গুনে করতে হয়। একথা বলে তনুজার চুলের মধ্যে হাত নেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।এদিকে বুয়া নাস্তা রেডি করে খাবার টেবিলে দিয়ে দিলো।তনুজা অফিসের জন্য প্রস্তুতী নিতে লাগলো। অফিসের পোষাক পড়ে তনুজা রেডি। এর মধ্যে ইশান গোসল শেষ করে আসলো। তনুজা ডাকলো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাস্তা করতে আসো। ইশান অফিসের জন্য প্রস্তুত হয়ে খাবার টিবিলে গেলো। দুজন মিলে নাস্তা করতে লাগলো। এদিকে বুয়া বাসার অন্যান্য কাজ শেষ করে নিলো এবং সন্ধ্যায় আসবে বলে বিদায় নিলো।তনুজা এবং ইশান দুজনেই অফিসের জন্য বের হলো।তনুজা এবং ইশান দুজনেই প্রাইভেট ফার্মে জব করে। ইশান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর তনুজা একটি প্রাইভেট ফার্মের এইচ আর ডিপাটমেন্ট এ জব করে । ইশান এর অফিস গুলশান গোলচক্করের কাছে আর তনুজার অফিস মতিঝিল এলাকায়।তনুজা এবং ইশানার বাসা মিরপুর কাজিপাড়ায়। তাই দুজনেই বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা করে কাজিপাড়া ফ্লাই ওভারের নিচের বাস কাউন্টারে চলে আসলো। তারপর দুজন দুই রুটের বাসে উঠে পড়লো পরষ্পরকে বিদায় জানিয়ে। দুজনাই বলাবলি করে নিলো মাঝখানে অফিসের বসকে বলে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য। দুজনেই বের হয়ে মিট করবে রাইফেলস স্কোয়ারে। ওখান থেকে দুজনেই কিছু একটা গিফট কিনবে দুজন দুজনার জন্য। তারপর ধানমন্ডি লেকে কিছুটা সময় কাটিয়ে একসাথে বাসায় যাবে।এভাবেই দুজনেই প্রোগ্রাম মনে মনে সেট করে ফেললো।তনুজা এবং ইশান দুজনেই অফিসে চলে গেলো।মাথার ভিতর সারাদিন আকু-পাকু কখোন ছুটি হবে এটা ভেবে।দুপুর এর পর জানাতে পারলো আগামিকাল সকাল সন্ধ্যা হরতাল আহবান করা বিরোধীদল এর পক্ষ থেকে।তনুজার মাথা খারাপ হয়ে গেলো । কারণ আজকাল হরতাল এর আগের বোম্বিং করা হয়,গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় এই সব ভেবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কারণ আজ একটু আগে আগে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাইরে বের হবে দুজন দুজনাকে একটু অন্যভাবে আবিষ্কার করবে। যেটা চাকরী এবং এক ঘেয়েমী সংসার জীবনে করার সুযোগ মেলেনা। অথচ আচমকা বৃহস্পতিবার হরতাল আহবান করা হলো। এখন নিরাপদে দুজন কিভাবে বাসায় ফিরবে আবার কিভাবে আগামিকাল অফিসে আসবে বাড়তি চিন্তার যোগ হলো। আনন্দের মুহূর্তুগুলো যেন বিষাদে রূপ নিলো।এটা ভাবতে ভাবতে ইশানকে একটা ফোন দিলো। ইশান ফোন রিসিভ করলোনা। কয়েকবার চেষ্টা করলো ফোনে ইশানকে ইশান তবুও ফোন রিসিভ করলোনা। চিন্তা যেন আরো বেশি জেকে বসলো তনুজার মাথায়। অবশেষে চারটা বাজার কিছুটা আগে ইশান ফোন ব্যাক করলো তনুজাকে। তনুজা ফোন রিসিভ করেই কিছুটা অভিমানের সুরে ইশানকে বললো কেন সে ফোন রিসিভ করেনি? যাই হোক ইশান তাকে বোঝানোর পর তনুজার অভিমান কিছুটা কমে গেলো।এবার দুজনেই আলোচনা করলো হরতালের মতো আতঙ্কজনক বিষয়টা নিয়ে।তারপর সিদ্ধান্ত হলো এখনই দুজন অফিসের বসকে বলে রাইফেলস স্কয়ারের উদ্দেশ্যে বের হবে।এই কথা বলে ফোন কেটে দিলো ইশান।তনুজা বসকে সকালে অফিসে গিয়েই বলে রেখেছিলো আজ চারটার দিকে বের হয়ে যাবে। তাই বের হওয়ার আগে বস এর রুমে গিয়ে বলে রাইফেলস স্কয়ারের উদ্দেশ্যে বের হলো। অফিস থেকে নেমে শাপলা চত্বর পায়ে হেটে চলে আসলো।এখানে এসে মহম্মদপুর শিয়া মসজিদ যাওয়া রুটের বাসে তনুজা উঠে পড়লো।অন্যদিকে ইশানও বাসে উঠে পড়েছে বলে ফোনে দুজনের সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো।তনুজার বাস গুলিস্থান এসে জ্যামে পড়লো। গাড়িটা কিছুতেই সামনে এগোচ্ছেনা।এছাড়া জৈষ্ট্য মাসের প্রচন্ড গরম আর রাজনৈতিক উত্তাপ মিলে যাচ্ছেতাই অবস্থা বাস থেমে আছে হরতালের পক্ষে বিপক্ষে মিছিলের স্লোগানে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।একটু পড়ে ট্রাফিক সিগনালের সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো বাসটা এক টানে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে আবার দাঁড়ালো। বাস স্টপজে যাত্রীদের দীঘ লাইন। হেলপার কিছু যাত্রী বাসে তুলে নিলো।বাসটা আবার একটানে হাইকোট এর পাশ দিয়ে মৎসভবন হয়ে শিশু পার্কের সিগন্যালে দাঁড়ালো।আবারও বিরক্তির একটা হিহ্ন ফুটে উঠলো তনুজার চেহারায় । তনুজা ইশানকে ফোন দিলো ইশান জানালো সে এখন সোবহানবাগ পৌছে গেছে বাস সিগন্যালে আছে। ব্যাস কথা শেষ করে তনুজা ফোনটা পার্সের মধ্যে রাখার সাথে সাথে একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলো। আর কালো ধোয়ায় চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো।যে যার মতো বাসের জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ কেউ বের হয়ে গেলো। তনুজার ততোক্ষণে গায়ে আগুন লেগে গেলো চিৎকার করতে লাগলো। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।তনুজার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বান ইউনিটে নিজেকে কষ্টে কাতরানো অবস্থায় আবিষ্কার করলো। পাশে অসহায় অবস্থায় বসে আছে তনুজার ছোন বোন মাহিষা আর ইশান।তনুজা মাঝে মাঝে কষ্টে চিৎকার করে উঠছে আকাশ-বাতাসও যেন তার কষ্টে কাঁদছে।চারিদিকে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।মুহূর্তের মধ্যে তনুজার পুড়ে যাওয়ার সংবাদ তার অফিসে পৌছে যাওয়ায় অফিসের কলিগরা এসে পৌছে গেলো তাকে দেখার জন্য।সবাই এসে দেখলো তনুজার 60পার্সেন্ট পুড়ে গেছে। সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজ করা । ইশান আর ছোট বোন মাহিষা শুধু শিশুর মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।রাতের গাড়িতে তনুজার মা,বাবা এবং শ্বশুর আসবে বলে ইশান সবাইকে জানালো। তনুজা এবং ইশান দুজনের গ্রামের বাড়িই লক্ষীপুর জেলায় পাশাপাশি গ্রামে।তনুজার কলিগরা ইশান এর কাছে জানতে চাইলো কিভাবে সে তনুজার পোড়ার খবর পেয়েছে। ইশান বললো এক ভদ্রলোক ফোন করে বললো ভাই এই ফোনের কল লিষ্টের শেষ নাম্বারটা আপনার তাই আপনাকে জানাচ্ছি এই ফোনটা যে মহিলার সে এখন ডিএমসির বান ইউনিটে শাহবাগের মোড়ে বাসে আগুন দেওয়ায় সে আগুনে পুড়ে গেছে।এই বলে লোকটা ফোন কেটে দিলে আমি এখানে এসে দেখলাম তনুজার এই অবস্থা । এই কথা বলেই ইশান হাউ-মাউ করে কেঁদে দিলো।তনুজার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল ক্ল্যাসম্যাট ঢাকায় থাকে এবং ইশান এর সাথে পরিচয় আছে তাদেরকে ইশান জানালে তারা চলে আসলো। ইশানের সাথে হসপিটালে সারারাত তারাও থাকলো।ভোরবেলায় ইশানের মা-বাবা এবং তনুজার মা-বাবাও হন্ত-দন্ত হয়ে ক্যাবিনে ঢুকলো। তনুজার মা-বাবা মেয়েকে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। তনুজার শ্বশুর-শ্বাশুড়ীও কাঁদতে লাগলো।ছোট ছেলের বউ । বউমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসে তনুজার শ্বশুর শাশুড়ী।অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে। তনুজার মা-বাবা প্রলাপ বকতে থাকলো মাহিষা আর ইশানকে ধরে বলতে লাগলো আমাদের মেয়ে বাঁচবেতো।আল্লাহ কেন এমন হলো? আমার মেয়েটাকে আল্লাহ তুমি ভালো করে দাও ইত্যাদি।এর মধ্যে ডাক্তার রাউন্ডে আসলো।তনুজার পালস চেক করলো।নাসকে ওষুধ দিতে বললো। ডাক্তার সাহেব তনুজার মা-বাবা এবং ইশানের সাথে শান্তনা স্বরূপ কিছু কথা বলে চলে গেলো।তনুজার মা-বাবা তার পাশে বসে থাকলো।ইশান আর তনুজার শ্বশুর-শাশুড়ী বাসায় ফিরে আসলো।আবার ফ্রেশ হয়ে দুপুরে হাসপাতালে যাবে বলে আসল।তনুজা তার দগ্ধ হাতে মায়ের হাতকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনভাবে হাত নাড়াতে পারছেনা । কষ্টে চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে।তনুজার কান্না আর তনুজার মা এবং বাবার কান্নায় হাসপাতালের ক্যাবিন ভারী হয়ে উঠলো আবারও কিছু ক্ষণের জন্য।এভাবে দিন গড়িয়ে রাত নেমে আসলো।তনুজার পাশে ইশান আর তনুজার মা বসে থাকলো। মাঝ রাতে হঠাৎ করে তনুজার শরীর অনেক বেশি খারাপ হয়ে উঠলো। ইমার্জেন্সী থেকে প্রথমে নাসকে ডেকে আনলো দৌড়ে গিয়ে ইশান। নার্স এসে পালস মেপে দেখলো হার্টবিট বেড়ে গেছে ঠিক মতো কাজ করছেনা। নার্স নিজে গিয়ে ইমার্জেন্সীর ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসলো। ডাক্তার এসে দেখে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে গেলে দগ্ধ হয়ে যাওয়া হাতের উপরিংশে যেন একটু পরেই তনুজা ঘুমিয়ে পড়লো।পাশে বসে তনুজার মা রুকাইয়া খাতুন তসবিহ টিপতে লাগলো আর আল্লাহর কাছে দুইহাত তুলে ফরিয়াদ করতে লাগলো আর কাঁদতে লাগলো আল্লাহ যেন খুব শিঘ্রই তার মেয়েকে সুস্থ করে দেন।এভাবে রাত পেরিয়ে ফযরের আযান ভেসে আসলো মসজিদের মিনার থেকে ।পাশের মসজিদে ইশান ফযরের নামায আদায় করতে গেল।তনুজার মা রুকাইয়া খাতুন যে জায়নামাযে বসে মেয়ের জন্য দোয়া করছিল সেখানেই ফযরের নামায় আদায় করে নিল।ধিরে ধিরে চারিদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।ইশান নামায শেষ করে আবার ক্যাবিনে ফিরে আসলো।শনিবার হওয়ায় অফিসে যাওয়ার ঝামেলা নেই। তনুজাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়ায় সে এখনও ঘুমাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর রুকাইয়া খাতুন মেয়ের কপালে হাত রাখছেন।সকাল আটটার দিকে তনুজার বাবা জনাব রফিকুল ইসলাম,ইশান এর বাবা,মা এবং তনুজার ছোট বোন নাশতা নিয়ে হসপিটালে আসলো।তনুজার শাশুড়ী তনুজার মা এবং ইশানকে নাস্তা করে নিতে বললো।তনুজার মা এবং ইশান নাস্তা করতে বসলো কিন্তু কোনভাবেই নাস্তা করতে পারলোনা দুজনার একজনও।নাস্তা করতে গিয়ে যখনই খাবার মুখের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তখনি রুকাইয়া খাতুন এবং ইশানের চোখ বেয়ে অশ্রুপাত ঘটছে। এভাবে কিছু সময় পরে নাস্তা রেখে দুজনেই উঠে পড়লো । আবারও তনুজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।সকাল 10টা যখন বাজলো তখন শাশুড়ীকে নিয়ে ইশানকে নিয়ে বাসায় আসলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য এবং সারারাত ঘুমাইনি তাই রেস্ট নেওয়ার জন্য। তনুজার মা কিছুতেই মেয়ের কাছ থেকে আসবেননা সবাই বুঝিয়ে তাকে ইশানের সাথে পাঠানো হলো।তনুজার মা বাসায় আসলো কিন্তু কিছুতেই স্থির হতে পারছেননা একই অবস্থা ইশানেরও । দুজনেই ছটফট করছে । কখন আবার হসপিটালে যাবে এই চিন্তা তাছাড়া মেয়ের কি হবে,তার মেয়ে বাঁচবেতো,সুস্থ হয়ে উঠবেতো ইত্যাদি ভাবনা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে তনুজার মা রুকাইয়া খাতুনের।এদিকে ইশান তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং শান্তনা খুজেঁ ফিরছে তনুজা সুস্থ হয়ে উঠবেতো,আবার তার ঘরের লক্ষী ঘরে ফিরে আসবেতো,ঘরটা আবার আলোকময় করে তুলবেতো ইত্যাদি বিষয়ে।মাঝে মাঝে পরিচিতজন এবং বন্ধুবান্ধবের কাছে ফোন করে বাঁচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।পরিচিতজন ফোনে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন খবর নিতে ছুটে এসেছে। তনুজার সাথে পাশের ফ্ল্যাটের সবার খুবই মধুর সম্পর্ক। কারণ সদা হাস্যেজ্বল তনুজা সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিত।পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন খোঁজ-খবর নিয়ে খানিকটা আফসোস এবং দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়ে বিদায় নিল।দুপুর হয়ে এলো ।তনুজার মা এবং ইশান দুপুরের খাওয়া কোন রকম নামে মাত্র শেষ করে নিল।তারপর হসপিটালে যারা রয়েছে তাদের জন্য খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।তনুজার মা রুকাইয়া খাতুন এবং ইশান হসপিটালে পৌছাল ।তনুজাকে লিকুইড খাবার দেওয়া হচ্ছে । কারণ তনুজার গলনালীর অনেকাংশ পুড়ে গেছে।ইশান এবং তনুজার মা তার বেডের কাছে এসে দাঁড়াল । তনুজার মা মেয়ের কপালে হাত রাখলো। ইশান পাশে দাড়ান । তনুজা ইশান আর ওর মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে অসহায়ের মতো।তনুজার চিবুক বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তনুজার মায়ের হাতের উপর।অন্যরা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হসপিটালের ক্যান্টিনে খাবারের টিফিনকারী নিয়ে চলে গেল।কিছুক্ষণ পরে তনুজার অফিসের বস এবং কয়েকজন সহকর্মী তনুজাকে দেখতে আসল । তনুজার সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করলো । ইশানকে সান্তনা দিল। ইতোমধ্যে সবাই দুপুরের খাবার শেষ করে ক্যাবিনে ফিরলো। ইশান সবাইকে তনুজার অফিসের কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।চিকিৎসার যাবতীয় খরচ তনুজার অফিস বহন করবে এই আশ্বাস দিয়ে তনুজার বসসহ সকলে বিদায় নিলো।এভাবেই দিন,রাত আর বিদগ্ধ সময়গুলো যেন পাথরের মতো এক জায়গায় এসে থমকে আছে। দুশ্চিন্তায় পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কোন কিছুই ঠিকভাবে চলছেনা। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ সবাইকে অস্থির করে ফেলছে। কেন এই মানুষকে দগ্ধ করা? কিসের স্বার্থে নিরীহ,নিষ্পাপ মুখগুলো প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।এই ধরণের নানা চিন্তার রেখা প্রত্যেকটি মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অসহায় মানব সমাজ । মহাকাল তুমি সাক্ষী থেকো এই অমানষিকতার।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আধার নেমে এল পৃথিবীর বুকে আর আধার যেন জেকে বসছে তনুজার পরিবারের সকল সদস্য মনকে ঘিরে।সন্ধ্যায় ডাক্তার রাউন্ডে এসে তনুজাকে দেখে ওষুধ পরিবর্তন করে দিল। আর শরীরটা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে তাই স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে গেল এবং নার্সকে যতটুকু সম্ভব ক্ষত স্থানগুলো ড্রেসিং করে দিতে বলে ডাক্তার সাহেব চলে গেল।রাত আটটার দিকে তনুজার শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে লাগলো।তনুজার এই অবস্থা দেখে সবার মনটা খচখচিয়ে উঠতে লাগলো। কান্নাকাটিতে আবারও ক্যাবিন ভারী হয়ে উঠলো। ইশান,ইশান এর বাবা,তনুজার বাবা মিলে ছোটাছুটি লেগে গেল । কারো মাথায় কাজ করছেনা। কি করবে? কি করবেনা? এখানে বোধহয় আর রাখা ঠিক হবেনা। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো এখনই এখান থেকে রিলিজ নিয়ে প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে হয়তো আরো ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে? ।সিদ্ধান্ত অনুসারে ইশান দ্রুত গিয়ে রিলিজ এর ব্যবস্থা করলো। রিলিজ এর কাজ শেষ করে দ্রুত একটা এ্যামব্লুয়েন্স এর ব্যবস্থা করে তনুজাকে ল্যাব এইড হসপিটালে নিয়ে আসা হলো। বার্ণ ইউনিটে নেওয়ার সাথে সাথে ডাক্তার এসে তনুজার পালস চেক করলো এবং এবং কিছু ওষুধ লিখে ইশানের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। ইশান দ্রুত হন্ত-দন্ত হয়ে ওষুধ নিয়ে আসলো।ডাক্তার জরুরি ভিত্তিতে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ইশানকে প্যাথলজী বিভাগে নিয়ে যেতে বললো নার্স এবং ওয়ার্ড বয় মিলে দ্রুত গতিতে তনুজাকে স্ট্রেচারে করে প্যাথলজী রুমের ভিতর নিয়ে গেল।বাইরে পরিবারের সকল সদস্য পায়চারী করতে লাগলো আর আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।কিছুক্ষণ পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তনুজাকে আবারও স্ট্রেচারে করে ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হলো।ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিল তনুজা ধিরে ধিরে ঘুমিয় পড়লো । তনুজার শরীরে স্যালাইন পুশ করা হলো।ইশানকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে একপালে গিয়ে বললো তনুজার পালস ঠিকমতো কাজ করছেনা,হার্টবিট অস্বাভাবিক তাছাড়া তনুজার শ্বাসনালীর আশি শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে আর সেই আগুনের তাপে শরীরের ভেতরের অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েযে যা বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে।তারপরেও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব আর আপনারা আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেল। তনুজার ক্যাবিনের কাছে সবাই দাঁড়িয়ে এবং বসে থাকলো।ইশান ক্যাবিনে ঢোকার সাথে সাথে সবাই ছুটে আসলো জানতে চাইল ডাক্তার কি বললো? রিপোর্টে কি কি সমস্যা দেখা গিয়েছে ইত্যাদি?ইশান সকলের প্রশ্নকে এড়িয়ে গেল শুধু বললো আল্লাহকে ডাকতে থাকুন । ডাক্তাররা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন ।এই কথা বলে ইশান হাত দিয়ে চোখ মুছতে,মুছতে একটু আড়ালে চলে গেল। মায়ের মন আগেই সন্তানের বিপদ আঁচ করতে পারে তাই হয়তো তনুজার মা এর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ইশানের চোখ মুছতে দেখায়।তনুজার মা রুকাইয়া খাতুন আঁচল মুখে চেপে কাঁদতে লাগলো।এভাবে রাত গভীর হতে লাগলো । এর মধ্যে ডাক্তার এসে দুইবার দেখে গেল । তারপরে ইমার্জেন্সী ভিত্তিতে ডাক্তারদের নিয়ে বোর্ড মিটিং বসলো ।তনুজার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং এ আলোচনা করা হলো । এই অবস্থায় তনুজার শাশনালীর অপারেশন করা যাবে কিনা? আর করা না গেলে তাকে বাঁচানোও দুরূহ হয়ে পড়বে বলে সিদ্ধান্ত হলো । একইসাথে সিদ্ধান্ত হলো রাতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যদি রোগীর অবস্থার উন্নতী হয় তাহলে পরের দিন সকালে একটা অপারেশনের রিস্ক নিতে হবে।রাত যখন তিনটা রাজে তখন কয়েকবার হেস্কি উঠলো তনুজার।ইশান দৌড়ে গিয়ে নার্সকে ডেকে আনল । নার্স এসে তনুজাকে দেখে ।ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে দেখলো।তনুজার অক্সিজেন গ্রহণে সমস্যা হচ্ছে । দ্রুত তনুজাকে আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হলো।সবাই বাইরে পায়চারী করতে লাগলো । এভাবে ভোর হয়ে গেল।তনুজা আইসিইউ-তে পড়ে থাকলো। সকলের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। মাথায় আজে-বাজে চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। ডাক্তার এর সাথে ইশান,ইশানের বাবা আর তনুজার বাবা দফায়,দফায় আলোচনা করতে লাগলো ।ডাক্তার সাহেব তাদেরকে জোর দিয়ে আশ্বস্ত করতে পারলোনা ।সকাল নয়টার দিকে চারজন ডাক্তারের একটি দল আবারও জরুরি মিটিং এ বসলো । মিটিং শেষে সবাই মিলে আইসিইউ-তে ঢুকলো। আধাঘন্টা পরে দুইজন ডাক্তার বের হয়ে গেল। হন্ত-দন্ত হয়ে সবাই ডাক্তারের কাছে ছুটে গেল। জানতে চাইলো তনুজার অবস্থা সম্পর্কে। ডাক্তাররা শুধু বললো অবস্থা ভালো না। আল্লাহকে ডাকতে থাকুন । দেখুন আল্লাহ মুখ তুলে চায় কিন?। কান্নার রোল পড়ে গেল । তনুজার মা রুকাইয়া খাতুন জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তাকে স্ট্রেচারে করে ইমার্জিন্সেীতে নিয়ে যাওয়া হলো।সবাই রুকাইয়া খাতুনকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো।রুকাইয়া খাতুনের জ্ঞান ফিরলো কিছুক্ষণ পর।রুকাইয়া খাতুনের কাছে তনুজার ছোট বোন থাকলো।বাকি সবাই আইসিইউ এর কাছে আবার ছুটে এলো।এরই মধ্যে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবরা এসে উপস্থিত । সবাই জানতে চাইলো তনুজার কি অবস্থা,এবং আরো নানা ধরণের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো ইশানকে। ইশান কোন প্রশ্নের উত্তর দিলনা।সবাই ইশানকে প্রশ্ন করছে আর ইশান চোখ হাত দিয়ে মুছছে।একটু পরেই স্ট্রেচারে করে তনুজার নিথর দেহ সাদা কাপড়ে ঢেকে ফ্লোরে এনে সবার সামনে হাজির করলো নার্স ।দৌড়ে সবাই ইশান এর স্ট্রেচারের কাছে গেল। স্ট্রেচারের কাছে গিয়েই তনুজার বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ইশান এবং ইশানের বাবা,মা তনুজার মুখের কাপড় সরিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।ইতোমধ্যে তনুজার মা এবং ছোট বোন দৌড়ে আসলো চিৎকার করে কাঁদতে,কাঁদতে। আকাশ ভারী হয়ে উঠলো। রুকাইয়া খাতুন আবারো জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তাকে ধরাধরি করে ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হলো।উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব ইশানকে ধরে শান্তনা দিতে লাগলো। ইশান চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। এভাবে খসে পড়লো একটি তারা,দেশ হারালো একজন মেধাবী সন্তানকে,পরিবার হারালো অনেক আদরের,ভালোবাসার মানূষটিকে।আকাশে-বাতাসে কিছু বেওয়ারিশ প্রশ্ন উত্তর খুঁজে ফিরতে লাগলো কে দায়ী এই অপমৃত্যুর জন্য ? কাদের স্বার্থে,কার স্বার্থে রাস্তায়,রাস্তায়,গাড়ীতে.গাড়ীতে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে ? মানুষের জীবন কেন আজ বিপন্ন আর মানবতা আজ অসহায় অবস্থায় জিম্মি হয়ে আছে প্রতিহিংসাপরায়ণ দুবৃত্তের হাতে ? এই আগুনে কি ঝলসে যেতে পারেনা ওদের মা-বাবা,ভাই-বোন,সন্তান এবং প্রিয়জন? হয়তো কখনো মিলবেনা এ্রর উত্তর।বিদগ্ধ সময় এভাবেই বয়ে চলবে তার গতিতে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:২৩

সুপ্ত আহমেদ বলেছেন: যুক্তি যুক্ত কথা লিখেছেন। কিন্তু মাঝখানে কিছু কথা অপ্রসাংগিক লেগেছে আমার কাছে। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন ভাইয়া।

২| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৩৩

সাঈদ রহমান ০০৭ বলেছেন: কিছু কথা অপ্রসাংগিক যা জানেত চাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.