![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মতির মায়ের ডাকে রেনুর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১১টা ৪০ বাজে। এই অসময়ে তার ঘুম আসার কথা নয়। কাল রাত থেকেই শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। কলেজেও যায়নি আজকে। স্থানীয় কলেজের বাংলার শিক্ষিকা সে। এদিকে বিন্তিরও স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। রান্নাঘর থেকে আবার মতির মায়ের গলা ভেসে আসল,
“তরকারীর লবণটা এট্টু দেইখ্যা যান, আফা।”
মতির মা আজকে রোজা। এখন রমজান মাস না। কিসের রোজা জিজ্ঞেস করা হয় নি। রেনু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক কাপ চা হলে ভালো হত, কিন্তু বানাতে ইচ্ছা করছে না। ঘরে সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা আছে, একটু পানি চড়িয়ে দিলেই হয়। তারপরও ইচ্ছে করছে না। রেনু রান্নাঘরে গিয়ে মোড়া পেতে মতির মায়ের পাশে বসল।
“শইলডা খারাপ নাকি, আফা? চা বানায়্যা দিই এককাপ?”
“দাও।”
“তরকারীটা এট্টু দেহেন আগে।”
বিন্তি স্কুল থেকে ফিরেছে। দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে জুতার ফিতা খুলছে। স্কুলের জামাটা এখনো গায়ে। ফিতা খুলতে খুলতেই বলল,
“আমি লোকটাকে আবার দেখেছি, মা।”
“কোন লোকটাকে?”
“ওই যে উঠানের কোনায়।”
“তুমি আমার সাথে ফাজলামো করছ না তো, না?” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রেনু বলল।
“মা, আমি তোমাকে আগেও অনেকবার বলেছি।”
আসলে বিন্তি কয়েকবার বলেছে সে উঠানে প্রায়ই একটা লোকের মুখ দেখতে পায়। রেনু তার কথা তেমন একটা পাত্তা দেয় নি।
“আফা, হ্যার মনে অয় ‘আলগা দোষ’ আছে। আমি মতিরে কইয়্যা খোনারের কাছ থেইক্কা তাবিজ আইন্যা দিমু। সব ঠিক হইয়া যাইব আল্লার রহমতে।”
মতির মায়ের কথায় কান না দিয়ে রেনু বিন্তিকে বলল,
“যাও মা। জামাটা পাল্টে ঘাটে যাও। আমি আসছি।”
বিন্তি জুতা জোড়া হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। একা একা পুকুরে নামতে ভয় পায় সে। রেনু তাড়াতাড়ি চা শেষ করে আলনা থেকে জামা-কাপড় নিতে গেল। কাপড় সরাতেই আলনার পেছন থেকে একটা বাঁধাই করা ছবি বেরিয়ে আসল। ছবিটা রেনুর। বিয়ের পরপর তোলা ছবি। কিশোরী একটা মেয়ের মত লাগছে তাকে। ছবির উপর গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ‘তার নামটি রেনুমালা, তাকে দেব মুক্তার মালা’। রেনু ভালো করেই জানে মুক্তার মালা একটা কথার কথা। মুক্তার মালা কিনে দেয়ার সামর্থ্য তার স্বামীর নেই। সে বরং একটা ফুলের মালা এনে দিয়ে বলেছিল, মুক্তার মালা পরে দেব, আপাতত ফুলের মালাই দেই। ঝিনুক যেরকম ভালোবেসে মুক্তাকে আগলে রাখে, সে ভালবাসার চেয়ে ফুলের মালাটা তৈরির পিছনের ভালবাসা কম কিসে? বিন্তির বাবা মারা গেছে আজ দেড় বছর। তার মৃত্যুর পরেই ছবিটার জায়গা হয় আলনার পিছনে। স্মৃতি চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি?
রেনু পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখল তার মেয়ে গলা ছেড়ে গান ধরেছে,
যখন বেলাশেষের ছায়ায়
পাখিরা যায় আপন কুলায় মাঝে
সন্ধ্যা পূজার ঘন্টা যখন বাজে
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন
আমার ব্যাথার পূজা হবে সমাপন।
এত কঠিন গান গাচ্ছে কেন মেয়েটা। কতই বা বয়স তার। এইতো দশ পেরিয়ে এগারোতে পড়ল মাত্র। তার তো ছড়া-কবিতা আওড়ে বেড়াবার বয়স এখন। নাকি তার মনে কঠিন কোন দুঃখ। কঠিন দুঃখে কঠিন গান। শুরুটা অবশ্য করেছিল তার বাবা। নজরুল সঙ্গীত-রবীন্দ্র সঙ্গীতের একগাদা সিডি এখনো ঘরে। মেয়ে শুনতে শুনতে সব মুখস্ত করে ফেলেছে। হয়ত ভালভাবে বুঝেও না, কি গাইছে সে। অথচ এত দরদ ঢেলে গায় মনেই হয় না, না বুঝে গায়। রেনু মেয়ের মাথায় হাত রাখল।
“মা, আমি ঠিক করেছি আমি লোকটাকে পরেরবার ঘরে ডাকব।”
মেয়ে এখনো ওই কথাই ভাবছে। সে আবেগেই কি গান গাচ্ছে? রেনু কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,
“লোকটা দেখতে কেমন?”
“আমি শিওর না।”
“দেখতে কিরকম? লম্বা নাকি বেঁটে, মোটা নাকি চিকন, নাকি নরমাল?”
“আমম...লম্বা। মাথার চুল কোঁকড়া”
“লোকটা কি ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করে?”
“না। শেষবার আমি যখন তাকে দেখেছিলাম, তখন সে উঠানের মাঝখানে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ভাবছিলাম তাকে ঘরে ডাকব, কিন্তু সে চলে গেল।”
রেনু আর কথা বাড়াল না। মেয়ের মাথা থেকে এটা দূর করতে হবে। উৎসাহ দিলে বাড়তেই থাকবে।
“পরেরবার যখনই তাকে দেখবে, আমাকে ডাকবে, কেমন? আর অপরিচিত কাউকে দেখলেই দরজা খুলে বাইরে যাবে না, মনে থাকবে?”
“মা, আমার মনে হয় না লোকটা অপরিচিত।”
রেনু জানে বিন্তি যে লোকটাকে দেখে, সে তার বাবা। বাবাকে ভালবাসত বলেই অবচেতন মনের কল্পনায় বাবাকে দেখে। বাবার মৃত্যুর পর অনেকদিন মেয়েটা বাবার একটা ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাত। মেয়ের কথা ভেবেই আর অন্য কিছু চিন্তা করেনি রেনু। একাই সংসারটা টেনে নিয়ে চলছে। বিন্তির চাচারা ভালোই দেখাশোনা করে অবশ্য। রেনু কয়েকদিন তার মেয়ের দিকে বাড়তি নজর দিল। কয়েকদিন মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কাটল। তারপর হঠাৎ একদিন সকালে বিন্তি বলল,
“আমি তাকে আবার দেখেছি, মা।”
“কখন? এখন?”
“কাল রাতে।”
“রাতে? অন্ধকার রাতে তুমি কিভাবে দেখেছ?”
“আমি জানি না। আমি শুধু তাকে জানালা দিয়ে দেখেছি। তারপর আমি দরজা খুলে বাইরে গেলাম তার সাথে কথা বলতে।”
“লোকটা কি তোমাকে দরজা খুলতে বলেছিল?”
“না, সে শুধু উঠানে হাঁটাহাঁটি করছিল।”
“তুমি কি কালকে তার মুখ দেখেছ?”
“ভালভাবে দেখিনি। তবে মনে হয়েছে দেখতে সুন্দর।”
“আচ্ছা, তোমাকে যে আমি বলেছি তাকে দেখলে আমাকে ডাকতে, ডাকনি কেন? এরপর তাকে দেখলে আমাকে অবশ্যই ডাকবে, কেমন?”
বিন্তি কিছু বলল না।
“তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?”
“হ্যাঁ, মা।”
সেদিন রাতে হঠাৎ রেনুর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় হাত দিয়ে দেখল বিন্তি বিছানায় নেই। ঘরের দরজা খোলা। দরজার বাইরে থেকে বিন্তির গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রেনু বিছানা থেকে উঠে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে ফেল বিন্তি সিঁড়িতে বসে বসে কার সাথে জানি হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে। রেনু উঠানের দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই।
“বাবা, একটা গান গাই? তোমার পছন্দের গান...
পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়
চাহিতে যেমন আগের দিনে তেমনি মদির চোখে চাহিও...
কি মায়াবী গলা মেয়েটার। বাতাসে পাতার সড়সড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে গানের তালে তালে মিউজিক বাজছে। একটু আগেও সুন্দর চাঁদের আলো ছিল। এখন মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করছে। চাঁদটাও বেপরোয়া হয়ে বারবার মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসাতে চাচ্ছে। বিন্তি গেয়ে চলছে...
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
লুকাতে সে জল করিও না ছল
আকাশটা থম ধরে আছে। পাতার নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কিন্তু গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে না। প্রকৃতিও মনে হয় সব কাজ ফেলে মুগ্ধ শ্রোতার মত মেয়েটার গান শুনছে। হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মধ্যে উঠানের কোনায় একটা মুখের মত ভেসে উঠল। এক মুহূর্তেরও কম সময়ের জন্য রেনুর মনে হল মুখটা বিন্তির বাবার। তার চোখে জল। সে জল লুকানোর কোন চেষ্টা তার মধ্যে নেই।।
২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৪৩
শাহ পরান সৃজন বলেছেন: প্রথমটা রবীন্দ্র সঙ্গীত, দ্বিতীয়টা নজরুল সঙ্গীত।
২| ২৩ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:১০
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: অদ্ভুত সুন্দর লিখেছেন। মনটা ভরে গেল।
প্রথমে ছোট ছোট খুঁটিনাটি এসেছে, তারপর যথাযথ বর্ণনা, ফলে গল্পে ঢুকতে কষ্ট হয় নি। পড়তে পড়তে শেষে যখন এলাম, তখন অনুভূতিময় সমাপ্তি নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
প্লাস দিয়েছি। আপনি অনুসারিত।
২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৪৬
শাহ পরান সৃজন বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ
যদিও একাউন্ট আছে অনেকদিন থেকেই তারপরও খুব একটা লেখা হয়নি। আপনাদের উৎসাহ পেলে নিয়মিত লেখার চেষ্টা করব।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:০৩
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
যখন বেলাশেষের ছায়ায়
পাখিরা যায় আপন কুলায় মাঝে
সন্ধ্যা পূজার ঘন্টা যখন বাজে
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন
আমার ব্যাথার পূজা হবে সমাপন।
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
লুকাতে সে জল করিও না ছল