![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
#পর্ব- ৩
আগামীকাল রাত ১০ টায় প্রিয়ন্তির ফ্লাইট। অথচ এর মধ্যে একবারো পিয়াসের সাথে কোনো যোগাযোগ করার সুযোগ পায় নি। মেয়েটা একটা দোটানার মধ্যে পড়ে আছে। যার জন্য অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দিতে চাচ্ছে, তারই তো কোনো হদিস নাই। এদিকে ওদের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সকল বন্দোবস্ত সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য প্রিয়ন্তি আজ ক্যাম্পাসে যাচ্ছে।
ক্যাম্পাসে ঢুকেই প্রথমে দেখা হলো সায়মার সাথে। সায়মাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়ন্তি। সায়মা ওকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে সে ভাষা খুজে পাচ্ছিলো না। তবুও বৃথা চেষ্টা করছিলো।
- চিন্তা করিস না। দেখিস, অস্ট্রেলিয়া গিয়ে তোর পিয়াস কে তুই ঠিক খুজে পাবি।
- কিন্তু আমি তো এখনো জানিই না, পিয়াস কি আদৌ অস্ট্রেলিয়া গেছে নাকি যায় নি,?
- আসলেই, ছেলেটা আমাদের সাথে এরকম টা কেনো করলো,?
- আমার মনে হয় কি জানস,? আমার মন বলছে, পিয়াস হয়তো খুব বড় কোনো বিপদে আছে।
- আমারো তাই মনে হয়। তবুও..
এর মধ্যে হঠাৎ করেই খায়রুল, গৌতম আর রিহান দৌড়ে ওদের দিকে আসলো। এসেই দেখলো প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তিকে দেখে খায়রুল বললো,
- অবশেষে আমরা পিয়াসের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের শফিক স্যারের সহায়তায় ওর বায়োডাটা খুজে ওখান থেকে ওর ঠিকানা পেয়েছি।
- ওদের গ্রামের বাড়ি কোথায়,?
- বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি থানার হাসাইল গ্রামে।
- চল, আমাকে এখনই নিয়ে চল।
- এখনই,?
- হ্যা, এখনই। আমার হাতে একদম সময় নেই। ওর গ্রামের বাড়ি গেলে ওর আত্মীয়ের মাধ্যমে হলেও হয়তো ওর একটা না একটা খোঁজ পাবো।
- আচ্ছা, চল।
এরপর সবাই মিলে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আড়াই ঘন্টা পর ওরা মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি পৌছায়। এরপর স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে ওরা হাসাইল গ্রামে গিয়ে পৌছালো। অবশেষে পিয়াসের বাড়িও খুজে পেয়ে গেলো ওরা। প্রিয়ন্তির মনে তখন খুব প্রশান্তি লাগছিলো। অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করছিলো।
কিন্তু পিয়াসের বাড়ির ভিতর ঢুকার সময় সবাই এক মুহুর্তের জন্য "থ" হয়ে গেলো। বাড়িতে অনেক লোকজনের ভীড়। মৃদ্যু মৃদ্যু কান্নার আওয়াজ। চারদিকে আতরের সুবাস। একটু এগিয়ে যেতেই একজন পুরুষের আহাজারি বাতাসে ভেসে আসলো। ধীরে ধীরে ওরা এগিয়ে গেলো। ভীড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। উঠোনে একটা লাশ দেখতে পেলো। লাশটির পাশেই বসা একজন মধ্যবয়সী লোক বিড়বিড় করে কাঁদছে। কিন্তু এ-কি,? প্রিয়ন্তি যেন নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এই লোক টিকে সে আগে দেখেছে। হ্যা, ওর মনে পড়েছে। পিয়াস যখন ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করেছিলো। তখন তো উনিই ভার্সিটিতে গিয়ে পিয়াসের জন্য অপমানিত হয়েছিলেন। উনিই তো ওদেরকে তার বাউন্ডুলে ছেলে টাকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্বটা দিয়েছিলেন। হ্যা, উনিই তো পিয়াসের বাবা। তাহলে উঠোনে পড়ে থাকা লাশ টা কার,?
প্রিয়ন্তি ধীরে ধীরে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছিলো। ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না। ওরা সবাই পিয়াসের বাবার নিকট এগিয়ে গেলো এবং পরিচয় দিলো, আঙ্কেল, আমরা পিয়াসের বন্ধু। এবং তাকে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে, আঙ্কেল,? কে মারা গেছেন,? তিনি উত্তর দিলেন, পিয়াসের মা আমাদের বাবা-ছেলে দু'জনকে ছেড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কথাটি বলেই তিনি আরো জোরে চিৎকার করে উঠলেন। প্রিয়ন্তিও জোরে চিৎকার মেরে বললো, পিয়াস কোথায়,?
পিয়াসের বাবা তখন পিয়াসের ফুপিকে ডেকে ওদেরকে পিয়াসের কাছে নিয়ে যেতে বললেন।
ফুপি ওদেরকে পিয়াসের কাছে নিয়ে গেলো। এরপর ওরা যা দেখলো, তাতে ওরা নিজেরা নিজেদের চোখ কে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এ কোন পিয়াস কে দেখছে ওরা,? ফ্রেন্ড সার্কেল মাতানো বাউন্ডুলে, চঞ্চল ছেলেটাকে আজ চেনাই যাচ্ছে না। চুলগুলো বড় বড়, এলোমেলো ও জটের মতো আঠালো। বড় বড় দাড়িতে মুখ ভরে গেছে। মুখ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। কিন্তু ঠোটের কোণে সেই হাসিটা আজও আছে। কিন্তু এ হাসিটা যে আগের সেই বাউন্ডুলে ছেলেটার দুষ্টু-মিষ্টি হাসি না। এ হাসিটা যেন অনেক বেদনার। অনেক কষ্টের। অনেক ত্যাগের।
ওরা যখন ওর সামনে গিয়ে বসলো। তখনই পিয়াস কেমন যেন করছিলো। প্রিয়ন্তি ওর সামনে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত রেখে কিছু একটা বলতে শুরু করতেই ও ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। এ ঘটনা দেখে ওরা আরো আশ্চর্য হলো। ছেলেটা এমন করলো কেন,,? ওরাও সাথে সাথে দৌড়ে পিয়াসের পিছু নিলো। পিয়াসের চাচা পিয়াসকে আটকালেন। আবার ওকে ওই রুম টাতে নিয়ে ওকে ভিতরে রেখে বাইরে থেকে রুম টা বন্ধ করে দিলেন। পিয়াসের এ অবস্থা দেখে প্রিয়ন্তির কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিলো। ভিতরটাতে কেমন যেন আহত পাখির মতো ছটফট করতেছিলো।
ওরা পিয়াসের চাচা কে পিয়াসের এমন আচরনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, পিয়াসের চাচা ওদেরকে সব খুলে বললেন।
তিনি বললেন, পিয়াসের মা দীর্ঘ দু'মাস যাবত আইসিইউ তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লরছিলো। তখন থেকেই পিয়াস মানসিকভাবে কিছুটা বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আর গতকাল রাতে অবশেষে ওর মা মারা যায়। ওর মায়ের মৃত্যুর সংবাদ ও সহজভাবে নিতে পারে নি। সাথে সাথেই ও তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ডাক্তারের সহযোগিতায় কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু জ্ঞান ফিরার পর ও আর কাউকেই চিনছিলো না। সবাইকে দেখেই ভয় পাচ্ছিলো। কাউকে ওর কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলো না। ডাক্তার জানালো, ও নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
এ ঘটনা শোনার পর, প্রিয়ন্তি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছিলো না। এক পাহাড় কষ্টে বুকটা চেপে আসছিলো। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছিলো। পিয়াসকে কখনো এ অবস্থায় দেখতে হবে ও কিছুতেই যেন ভাবতে পারছিলো না।
এরপর পিয়াসের চাচাকে ওরা জিজ্ঞেস করলো, পিয়াস কি কোনোদিনই সুস্থ্য হবে না,? ডাক্তাররা কি এ ব্যাপারে কিছুই বলে নি,,?
- হ্যা, বলেছে। ওই হাসপাতালেরই এক মনোবিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানিয়েছেন, ওর মা ওর সবচাইতে কাছের মানুষ ছিলো। তাই ওনার মৃত্যুটা ওকে অনেক হার্ট করেছে। ওর ব্রেইন ওর কাছের মানুষ টার মৃত্যু টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে নি। তাই ওর মানসিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। এখন মানসিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনে আনতে চাইলে, প্রথমে ওর মধ্য থেকে ভয়টাকে দূর করতে হবে। এবং সঠিক সেবা-যত্ন, শুশ্রুষা ও সবার আন্তরিকতা পেলে ধীরে ধীরে আবার ওর মানসিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।
এ কথাগুলো শোনার পর নিজেদেরকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো ওদের। না জেনে ছেলেটাকে নিয়ে ওরা কতকিছু মন্তব্য করেছে।
যোহরের পর পিয়াসের মায়ের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। এদিকে প্রিয়ন্তির বাসা থেকে প্রিয়ন্তিকে বারবার ফোন দিচ্ছিলো।
প্রিয়ন্তি ফোন রিসিভ করলো,
- হ্যালো, মা।
- হ্যা, মা, কই তুই,? এত দেরি হচ্ছে কেন,? আর ফোন টাও ধরছিস না কেন,?
- মা, আমার বাসায় ফিরতে আরো লেট হবে। আমার এক বন্ধুর মা মারা গেছে। আমি এখানে বন্ধুর বাসায় আসছি। তুমি বাবাকে বলো।
- তোর বন্ধুর মা মারা গেছে,!! কই, তুই তো কিছু জানালিও না।
- মা, আমার মন টা খুব খারাপ। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি এখন তোমার সাথে এত কথা বলতে পারবো না। আমি বাসায় এসে তোমাকে সব বলবো।
কথাগুলো বলেই প্রিয়ন্তি ফোন টা কেটে দেয়।
- হ্যালো,,, হ্যালো...
সেদিনের মতো ওরা পিয়াসের বাসা থেকে বিদায় নিচ্ছিলো। কিন্তু প্রিয়ন্তি পিয়াস কে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলো না। শেষবারের মতো পিয়াসের সেই বন্ধ রুমটাতে ঢুকে পিয়াসের সামনে গেলো প্রিয়ন্তি। অনেক কিছু বলার আছে ওর। হ্যা, ও আজই বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, "বলেই বা কি হবে,? পিয়াস কি আজ আমার কথা বুঝবে,? না বুঝুক, তবুও আজ আমি বলবো। হ্যা, আমি বলবো।"
প্রিয়ন্তি মনের জমানো কথাগুলো বলার জন্য পিয়াসের হাতটা ধরে ওর পাশে বসলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পিয়াস এবার ওকে ভয়ও পায়নি, দৌড়েও পালায়নি। বরং প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসছিলো। এই হাসিটা প্রিয়ন্তির কাছে অনেক টাই চেনা চেনা লাগছিলো। অনেকটাই বাউন্ডুলে ও নবাবজাদা খ্যাত সেই পিয়াসের চিরচেনা হাসি। তাই এ বেলায় প্রিয়ন্তিও কিছুটা খুশি হলো। ওর ঠোটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো।
চলবে....
#সাইফ_আরেফিন_বিপুল (ক্ষুদ্র লেখক)
©somewhere in net ltd.