![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ আমার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আমার বাসায় আজ শতেকখানেক মেহমানের আগমন ঘটেছে। কারন আমি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা প্রতি বছরই এইদিনটাতে আমার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া ও ভুরিভোজের আয়োজন করেন। আজ সে আয়োজনই চলছে।
হ্যা, আজ সে-ও এসেছে এই ভুরিভোজে। এ-কি সেও দেখি আমার জন্য দু'হাত তুলে মোনাজাত তুলেছে। সে আমার ভালোও চাইতে পারে নাকি,? আজব তো,!!
যে আমাকে নিজ হাতে খুন করলো সে-ও আমার জন্য দোয়া করছে। কত্ত আজব আজ এই দুনিয়াটা। কত্ত আজব দুনিয়ার অভিনেতাগুলো। ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করা এই অমানুষগুলো অস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। হ্যা, আমি আমার হত্যাকারীর কথা বলছিলাম। আমি আমাদের গ্রামের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবান মানিক মিয়ার কথাই বলছি। যার মেয়েকে ভালোবাসার অপরাধে সে আমায় আরো ৫ বছর আগে ঠিক এই দিনটাতেই খুন করেছিলো।
সেদিন ছিলো বৃহঃবার। আহিয়ার গায়ে হলুদ। ওর বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওদের সারা বাড়ি বিভিন্ন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছিলো। আর আমি হয়েছিলাম খুন।
হ্যা, আহিয়াই ছিলো অই নৃশংস পশু মানিক মিয়ার একমাত্র মেয়ে। একই গ্রামে বাসা ও ছোটবেলা থেকেই একই স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে ছিলো গভীর বন্ধুত্ব। স্কুল পেড়িয়ে আমরা যখন কলেজে উঠি তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্বটা ধীরে ধীরে এক সময় প্রেমে পরিণত হয়। একটা সময় এসেছিলো যখন কেউ কাউকে ছেড়ে এক মুহুর্ত থাকতে পারতাম না। দু'জন দু'জনকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসতে শুরু করি। আমি প্রতিদিনই কলেজে যাওয়ার সময় ওদের বাসায় যেতাম দুজনে একসাথে যাওয়ার জন্য। এছাড়াও আমরা প্রতিদিন বিকেলেই ওদের বাসার পিছনের আমবাগানটাতে দেখা করতাম। গ্রামের অনেকের চোখেই আমাদের এ ব্যাপারটা পরিলক্ষিত হতে থাকে।
একদিন সকালে আমি কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। এমন সময় বাইরে থেকে আহিয়ার কণ্ঠ।
-- আদনান, এই আদনান। তারাতারি বের হ।
আমি ঘর থেকে বের হয়েই অবাক। জীবনে এই প্রথম আহিয়া আমাকে নেওয়ার জন্য এসেছে। কারন বিগত প্রায় আট বছর ধরে প্রতিদিন স্কুল বা কলেজে যাওয়ার সময় আমিই ওকে আনার জন্য ওদের বাসায় যেতাম। তাই আজ এই প্রথম আমাকে নেওয়ার জন্য ও আগে এসেছে বলে একটু অবাক হচ্ছি।
-- কীরে,? আজ আকাশে সূর্যটা কি ভুলে অন্যদিকে উঠলো নাকি,?
-- দেখ, বেশি কথা বলিস না। তারাতারি রেডি হ। তোর সাথে অনেক জরুরী কথা আছে।
-- কী কথা,?
-- আগে বের হ। তারপর যেতে যেতে বলছি।
-- আচ্ছা।
আমি দ্রুত রেডি হয়ে বের হলাম। ও চোখে মুখে প্রচন্ড রকম ভয়ের ছায়া খুজে পেলাম।
-- কী রে,? কি হয়েছে,? তোকে এমন নার্ভাস ও ভয়ার্ত মনে হচ্ছে কেন,?
-- আগে বল, আমায় ভালোবাসিস তো,?
-- হ্যা, বাসি তো। কেন, তোর কি কোনো সন্দেহ আছে নাকি,?
-- তাহলে তুই আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারবি,?
-- কীসব বলছিস,? তোকে নিয়ে পালাবো কেন,?
-- দেখ, তোর আর আমার ব্যাপারটা গ্রামের লোকজনরা ভালো চোখে দেখছে না। গতকাল কে বা কারা যেন বাবার কাছে তোর আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারে নালিশ করেছে। এজন্য বাবা আমাকে কাল রাতে অনেক বকাবকি করেছে। তোর সাথে মিশতে মানা করেছে। তোকেও আমার আশেপাশে আসতে মানা করে দিতে বলেছে। তোকে আমার আশেপাশে দেখলে নাকি তোর অনেক বড় ক্ষতি করবে বলে হুমকিও দিয়েছে। আর তাছাড়া আমাকে নাকি তাঁর এক বন্ধুর ছেলের সাথে কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবে। বাবার মুখের উপর আমি তখন একটি কথাও বলার সাহস পাই নি। কিন্তু আমি যে তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এক মুহুর্তও না।
-- কিন্তু আমি তোকে নিয়ে পালিয়ে কোথায় যাবো,? এটা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব না। আমি আমার দরিদ্র বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাকে খুব কষ্ট করে তারা লেখাপড়া করাচ্ছেন। আমাকে নিয়ে তাঁদের চোখে হাজারো স্বপ্ন। আমি পারবো না তাঁদের স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে দিতে।
-- তাহলে যা, সাহস থাকে তো আমার বাবার সামনে গিয়ে তোর ভালোবাসার কথা বল। তোর বাবা-মা কে নিয়ে যা আমার বাবার কাছে। পারবি সেটা করতে,? জানি তো, পারবি না। তাই তো পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছি।
-- দেখ, আহিয়া। আমরা গরীব। আর তোরা অনেক ধনী। তোর একদিনের হাতখরচ দিয়ে আমার পরিবারের সারামাস চলে যাবে। তোর বাবা কোনোদিনই আমার মতো একটা ফকিন্নির হাতে তোকে তুলে দিবে না। আর তাছাড়া আমার জীবনের এখনো অনেকটা পথ বাকি। তোকে এই মুহুর্তে বিয়ে করাটাও আমার পক্ষে সম্ভব না। কারন আমি পারবো না তোর মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে। পারবো না তোকে সুখী করতে। তাই তুই তোর বাবার বন্ধুর ছেলেকেই বিয়ে কর। দেখিস, একদিন আমাকে ভুলে গিয়ে অনেক সুখী হবি।
-- দেখ, আদনান। এখন আমার কাছে এখন দুইটাই পথ। হয় তোর হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাবো। তবুও অন্য কাউকে আমি আমার জীবনে আনতে পারবো না।
-- প্লিজ, তুই পাগলামী করিস না। দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ, আমায় ভুলে যা।
-- ভুলে যাওয়ার জন্যই কি ভালোবেসেছিলাম,? আর তুই কি পারবি আমায় ভুলে থাকতে.?
-- হ্যা, আমি পারবো। অবশ্যই পারবো। আমি যদি পারি তাহলে তুই পারবি না কেন,?
-- আচ্ছা, তোর আর কিচ্ছু বলতে হবে না। তুই যে আমায় কি ভালোবেসেছিস, তা বুঝার আর বাকি নেই আমার।
কথাগুলো বলেই চোখের কোণে অঝোড়ে বৃষ্টি ঝড়াতে ঝড়াতে, বুকে হাজারো কষ্ট ও মনে প্রচন্ড রাগ-অভিমান নিয়ে আমার সামনে থেকে ও সেদিন চলে গিয়েছিলো। আমি শুধু ওর চলে যাওয়ার পানেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ওকে ফেরানোর মতো বা ভরশা দেওয়ার মতো কোনো বাক্য সেদিন আমার মনের ব্যকরণ থেকে খুজি পাই নি। তাই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ই ছিলো না। আমার চোখ থেকেও হঠাৎ কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে পড়তে শুরু করলো।
এরপর থেকে আহিয়ার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হয় নি। মেয়েটাকে ওর বাবা সারাদিনই বাড়িতে বন্দি করে রাখে। এভাবেই একটা সময় চলে এসেছিলো ওর গায়ে হলুদ আর আমার খুন হওয়ার রাতটা। গায়ে হলুদের দিন ও নাকি আমার হাত ধরে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ওর বাবাকে হুমকি দিয়েছিলো। তাই ওর বাবা ওকে বাসায় বন্দি করে রেখে আমাকে খুন করার জন্য লোকজন ঠিক করে।
বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে থাকায় বাবাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য আমি তখন বিভিন্ন বাসায় টিউশনি করতাম। আমি সেদিন টিউশন থেকে বাসায় ফিরছিলাম। পথিমধ্যে চোখ আটকে যায় আহিয়াদের বাসার দিকে। চোখের জলটাকে সেদিনও আটকাতে পারিনি। কিন্তু না, আমাকে যে বাবা-মায়ের স্বপ্ন যে আমায় পূরন করতেই হবে। তাঁদের কষ্টের ফসল যে আমাকে ফলতেই হবে। আহিয়াকে চিরদিনের জন্য সেদিন জীবন থেকে ডিলিট করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। অতঃপর চোখের জলটুকু মুছে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। এমন সময় আহিয়ার বাবা ও তাঁর কিছু লোকজন আমাকে ডাক দিলো। আমি যেতে চাইনি। কিন্তু আহিয়ার বাবা বললো:
- বাবা, আদনান। আমি জীবনে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। আমার মেয়ের সুখের কথা চিন্তা না করে ওকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিচ্ছিলাম। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি আমার সাথে চলো। তোমাকে আহিয়ার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
তার মুখে এসব কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবুও মোহে পড়ে আমি খুব খুশি হয়ে যাই। তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি হই। সে আমাকে তাদের বাসার পিছনের অই আমনবাগানটার একটা পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে গেলেন।
-- কী, ব্যাপার, আঙ্কেল,? আমায় এখানে নিয়ে আসলেন কেন,?
-- একটু দাঁড়াও। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবে তোমাকে এখানে কেন নিয়ে আসা হয়েছে।
আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর জন সাতেক লোক আসলো। সবার হাতে বিভিন্ন ধরনের ছুরি, চাপাতি ও রামদা। আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। আমি বললাম:
-- কী হচ্ছে এসব, আঙ্কেল,? এরা কারা.?
-- চুপ, একদম চুপ। কোন শব্দ করবি না। আজ তোকে শিখিয়ে দেবো ফকিন্নির বাচ্চা হয়ে বড়লোকের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর মতো অপরাধের শাস্তিটা কতটা ভয়াবহ,!
-- বিশ্বাস করেন, আঙ্কেল। আমি আহিয়ার জীবন থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছি। আমি কক্ষনো ওর আশেপাশেও যাবো না।
-- সে ব্যবস্থাই করছি। আজই তোকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
-- প্লিজ, আঙ্কেল। আমাকে মারবেন না। আমার জীবনের আরো অনেকটা পথ বাকি। আমাকে আমার বাবা-মায়ের স্বপ্নটা পূরন করতেই হবে। তাঁদের কষ্ট দূর করার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতেই হবে। প্লিজ, আমায় মারবেন না।
অনেক চিৎকার করেছিলাম সেদিন। কিন্তু না, ওরা আমার চিৎকার শুনে নি। আমার আর্তনাদগুলো ওদের কাছে ছিলো হাসির উপদ্রব্য। আমাকে ওরা সেদিন আর বাঁচিয়ে রাখেনি। আহিয়ার বাবা একটা ছুরি হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম আমার গলায় একটা কোপ দিলেন। আমি চিৎকার করে উঠি। আমার হৃদপিন্ড প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো ততক্ষণে। অতঃপর সাত-আটজনে মিলে ছুরি ও চাপাতি দিয়ে যে যেভাবে যেদিক থেকে পারলো আমার সারা শরীরে আঘাত করতে লাগলো। আমার শরীরটা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেলো। হাত, পা, মাথা, দেহ সবকিছু একটা অপরটা থেকে আলাদা করে দিলো। আমি ততক্ষণে এপাড়ে পাড়ি জমিয়ে ফেলেছি।
পশুগুলো আমার শরীরের খন্ডাংশগুলো একটা বস্তায় ভরে রেললাইনের পাশে নিয়ে গেলো। রেললাইনের ধারে এসে বস্তা থেকে আমার শরীরের খন্ডাংশগুলো বের করে আমার প্রতিটা অঙ্গ সাজিয়ে একত্র করে রেললাইনের মধ্যে বিছিয়ে দিলো। এরপর খুশি মনে সেদিনের মতো খুশিমনে ওরা সবাই বাড়ি চলে গেলো। আমি তখন শুধুই কয়েক টুকরো লাশ হয়ে ট্রেনের রাস্তাটায় পড়ে আছি।
ভোরের ট্রেনটা এসে আমার ছিন্নভিন্ন দেহটাকে আরো একবার পিশিয়ে দিয়ে যায়।
সকাল হলে কিছু কুকুরের খাবার হয়ে যাই আমি। হ্যা, কয়েকটা কুকুর এসে আমার মাংসের টুকরো গুলো খুবলে খুবলে খাচ্ছিলো সেদিন। হঠাৎ এ দৃশ্যটা কিছু লোকের চোখে পড়ায়, তারা এগিয়ে আসে এবং স্থানীয় পুলিশকে খবর জানায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এটা আমার লাশ ছিলো। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ধরা পড়লো আমি ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে সুইসাইড করেছিলাম।
আমি সেদিন চিৎকার করে বলেছিলাম, আমি আত্মহত্যা করি নি। আমাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনি। কেউ না।
হায়রে দুনিয়া, হায়রে দুনিয়ার মানুষ। আমি এপাড়ে এসে এসব দুনিয়ার এসব খেলা দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠছি। অথচ 'অ' আদ্যক্ষর যুক্ত মানুষগুলো অদম্য শক্তিতে খেলেই যাচ্ছে,!!
©somewhere in net ltd.