![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
#পর্ব- ১
শহরের শেষ মাথাটায় ধলেশ্বরী নদী। গোধুলিবেলায় এই নদীর অপরূপ সৌন্দর্য বিলাসিতা সহিত উপভোগ করার জন্য লঞ্চঘাটের কিনারায় ভেরানো ছোট-বড় ঢেউয়ে দোল খাওয়ানো ছোট ছোট লঞ্চগুলোকে এক উপযুক্ত আড্ডাস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলো পিয়াস। নিজের একাকীত্ব দূর করার এক প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে এই লঞ্চঘাটের আড্ডাটাকে।
প্রতিটা আড্ডাতেই চলে বিভিন্ন রম্য ও রহস্যের গল্প। কখনো বা চলে হাসি-কান্নার গল্প। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বরাবরের মতো আজও হচ্ছে আড্ডা। আজও চলছে গল্প। কিন্তু এ গল্প যে পিয়াসের নয়। এ গল্পটা এক হৃদযুদ্ধবিধ্বস্ত চপল থেকে নিরব হয়ে যাওয়া এক জীবন-যোদ্ধার গল্প, মুহুর্তেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠা এক মুমুর্ষ হৃদয়ের গল্প, এক ভালোবাসার গল্প, নির্মমতার, নিষ্ঠুরতার গল্প।
নামটি তার আয়ান। খুব চপল ও চঞ্চল এক ছেলে। পিয়াসেরই বন্ধু। কোনোদিন ওর সাথে এই প্রিয় তীর্থস্থানটিতে আড্ডা দেওয়া হয় নি। দু'দিন যাবত আয়ান লন্ডন থেকে ফিরেছে। টানা প্রবাস জীবন ওর জীবনটাকে বিষন্ন করে তুলেছে। তাই আজ ওকে নিয়ে এখানে এসেছে পিয়াস। প্রতিদিন পিয়াস তার গল্প করে। আর আজ পিয়াস গল্প শুনবে। হ্যা, আয়ানের গল্প।
সময়টা ২০১৩ সাল। আয়ান লন্ডন যাবার জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পিং সম্পন্ন করে ভিসার অপেক্ষায় নিজ গ্রামেই অবসর বেকার জীবন কাটাতে লাগলো। কখনো এরকমটা অবসর ও কাটায়নি। তাই গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে, পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে খেলতে ওর সময়গুলো হরহামেশাই কেটে যেতো। গ্রামটাকে ও গ্রামের সৌন্দর্যটাকে এর আগে ও এতোটা সুনিপুণভাবে উপলদ্ধি করতে পারে নি। তাই অবসরগুলোতে গ্রামের চারপাশটাতে প্রতিনিয়তই নয়নস্পর্শী চুম্বন এঁকে নিতো। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করতে গিয়ে কখন যে মানবিক সৌন্দর্য ওকে গ্রাস করে ফেলবে, তা ও নিজেই কখনো ভাবতে পারেনি। হ্যা, একদিন ওর চোখ পড়লো গ্রাম্য মেঠো-পথের ধারে শেফালি ঝড়া এক উঠোনে শিশুখেলাচ্ছলে মেতে থাকা এক মায়াবতী কিশোরীর উপর। শুধু চোখ পড়েই নি। চোখটা যেন মুহুর্তেই আটকে যায়। ফেরানো যে তার বড়ই দায়। আয়ানের কাছে উঠোনটাকে তখন মনে হচ্ছিলো এক সুবিশাল নীল আকাশ আর সে আকাশে জোৎস্নায় মাতাল করা এক ফালি রূপোলি চাঁদ, যে চাঁদের আলোয় পুরো আকাশে আজ বর্ণের রঙছটা। আকাশটা যেন আজ উৎসবে মেতে উঠেছে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর ঘোর ভাঙে মেয়েটার ইশারায় দেখানো হাতের ব্যঙ্গদুলোনীতে। খুব লজ্জা পেয়ে যায় ছেলেটা। কিন্তু মুখখানা যেন তার চোখের পাতার ছায়ার পুরো বিঘে জমিখানা কিনে নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করে দিয়েছে। চোখ মেললেও সেই মেয়েটা, বুজলেও সেই মেয়েটারই মুখখানার অবয়ব ভেসে উঠে প্রতিটা মুহুর্তেই। ধীরে ধীরে অবয়বটার মালিকটা আয়ানের মনের উঠোনেও বিঘেখানেক জমি কিনে নিলো।
আয়ানের বুঝতে আর বাকি রইলো না, সে যে মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রকৃতিপ্রেমিক আজ এক কিশোরীপ্রেমিকে রূপ ধারন করলো। প্রকৃতির প্রতি প্রেমটা ধীরে ধীরে উবে গেলেও অই মেয়েটার বাড়ির আশেপাশের প্রকৃতির প্রতি প্রেমটা কোনোদিনই নিঃশেষ হয়ে যায় নি। দিনের সিংহভাগ সময়ই আয়ানের কেটে যেতো শুধু ওই প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে এক পলকের জন্য কিশোরীর দর্শন পাওয়ার অপেক্ষা করতে করতে। দিন গেলো, দিন আসলো। আয়ান মেয়েটাকে শুধু দূর থেকেই দেখেই গেলো। অপ্রকাশিতই রয়ে যায় তার ভালোবাসা। হয়তো মেয়েটা বুঝেছিলো, নয়তো বুঝেনি। কিন্তু আয়ানের সুপ্ত প্রেম গুপ্তভাবেই বেড়ে উঠতে থাকলো। এভাবেই দিনানিপাত করতে করতে একদিন সময় হলো ওর ফ্লাইটের।
দু'দিন পর ওর ফ্লাইট। অথচ মেয়েটাকে কিছু বলবে তো দূরে থাক, এখনো ওর নামটাই জানতে পারে নি ও। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার আগে যে ওকে বলতেই হবে। ওর ভালোবাসার কথা যে ওকে জানাতেই হবে। কিন্তু কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলো না আয়ান। অবশেষে শুধু ওর নামটা জানার তৃপ্তি নিয়েই গমন করলো লন্ডনের উদ্দেশ্যে। হ্যা, আয়ান ওর নামটা জানতে পেরেছিলো। মেয়েটির নাম আরোহী।
দুটো বছর আয়ান শুধু ওর চোখের পাতার ক্যানভাসে আঁকা প্রিয়মুখখানা দেখে আর হৃদয় উঠোনে চঞ্চলতায় মেতে থাকা অই কিশোরীর কাল্পনিক স্মৃতি ও গল্পগুলো নিয়েই কাটিয়ে দিলো। দূরত্বটা বেড়েছে, সময়টা বেড়েছে কিন্তু সে অনুপাতে ভালোবাসাটা কমে নি। বরং সমানুপাতিক হারে ভালোবাসা বেড়েছে দিন দিন কয়েক গুণ।
আজ দু'বছর পর আয়ান দেশে ফিরবে। বুকের মাঝে তার শতদলের পায়রারা ডানা ঝাঁপটে আনন্দ উদযাপনে, বিজয় উল্লাসে মেতেছে। মন আকাশের রংটাও যেন আজ গাঢ় হয়ে বিচ্ছুরিতভাবে ছড়াচ্ছে।
দেশে আসার পর আয়ানের মনে একটাই চিন্তা, দু'বছর আগে আরোহীকে ও যে কথাটা বলতে পারেনি সে কথাটা এবার ওকে বলতেই হবে। কিন্তু কিভাবে বলবে উপায় খুঁজে পায় না। হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি আঁটলো। আরোহীর এক ক্লাসমেট জিসানের সাথে ও কথা বললো। আয়ান জিসানকে সব খুলে বললো এবং ওর কাছ থেকে হেল্প চাইলো। জিসানও সম্মতি জানালো। তারপর আয়ান ওর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললো আরোহীকে দেওয়ার জন্য।
- এই আরোহী, দাঁড়া। তোর সাথে কিছু কথা আছে।
- আরে যাহ্ তো। আমার প্রাইভেট আছে। পরে কথা হবে।
- আরে শোন, খুব জরুরী কথা।
- তারাতারি সংক্ষেপে বল।
- তোকে একজন এই চিঠিটা দিয়েছে। পড়ে নিস।
- কে দিয়েছে এই চিঠি,? আর কেনই বা দিলো আমায়,?
- পড়ে দেখিস, সব বুঝবি। আমি যাই এখন।
আরোহী আর কিছু না বলেই চুপচাপ চিঠিটা ব্যাগে রেখে দিয়ে সামনের দিকে হাটা শুরু করলো। প্রাইভেট শেষে ও ওর বান্ধবীদের কাছে চিঠির ব্যাপারে জানালো। তারপর তিন বান্ধবী মিলে একটা নির্জন জায়গায় বসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে আরোহী চিঠির ভাঁজগুলো খুলতে শুরু করলো।
"প্রিয় আরোহী,
কল্পনা যখন গল্প না হয়ে শুধু স্মৃতিতেই জড়িয়ে থাকে তখন ভালোবাসি শব্দটা উহ্যই থেকে যায়। ভালোবাসতে ভয় পাইনি, কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার আশঙ্কায় ভালোবাসি বলতে ভয় পেয়েছি বারংবার। কিন্তু আমি জানি, আমার এই অব্যক্ত ভালোবাসা যতদিন না তোমার কাছে ব্যক্ত করবো ততদিন হৃদপিন্ডের প্রতিটা কোষ আমায় নিত্য অভিসম্পাত করে যাবে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠবে ক্ষণে ক্ষণে। আমি আর পারছি না। তাইতো সকল বাধা-বিপত্তি, বৈষম্য, ভয়-সঙ্কোচ দূরে ঠেলে আজ জানাচ্ছি, 'বড় ভালোবাসি তোমায়।'
হ্যা, বড্ড বেশিই ভালোবাসি তোমায়। ঠিক ততটাই ভালোবাসি, যতটা ভালোবাসলে আমার প্রতিটা রক্তকণিকার ব্যবচ্ছেদে তোমার অস্তিত্বের সন্ধান মিলবে। ঠিক ততটাই ভালোবাসি, যতটা ভালোবাসলে আমার প্রতিটা নিউরনে তোমার স্পর্শানুভূতির দোল খেলা প্রতীয়মান হয়। গতানুগতিক ভালোবাসার মূল সংজ্ঞাটা হয়তো আমার নিকট অজ্ঞাত, কিন্তু তোমার জন্য উজার করে দেওয়া ভালোবাসাটা যে কতটা শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতম তা আমার দেহের প্রতিটা উদ্দীপক হরমোনের নিকট জ্ঞাত।
আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসাটা প্রকাশ করলাম মাত্র। কিন্তু তাই বলে এই ভেবো না যে, মধ্যরাস্তায় তোমার পথের কাটা হয়ে আগলে দাঁড়িয়ে বলবো, আমাকেও একটু ভালোবাসো। আমি শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে তোমার পথপানে তাকিয়ে শুধু তোমায় দেখবো আর অপেক্ষায় থাকবো একদিন তুমি আসবে, হাসবে এবং অবশেষে ভালোবাসবে।
ভালো থাকো সবসময়, ভালোবেসো সেদিন, যেদিন তোমার হবে সময়।"
ইতি
আয়ান।
চিঠি পড়ে আরোহীর চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কে এই আয়ান,? কেনই বা ওকে এতো ভালোবাসে,? ওর মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো। হন্য হয়ে জিসানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু দু'দিন যাবত জিসানেরও কোনো খোঁজ নেই। আরোহী বারবার চিঠিটা পড়তো আর খুব ভাবতো, কে এই ছেলেটা,? চিঠিটা পড়তে পড়তে একসময় চিঠিটার প্রেমে পড়ে যায়। হয়তো চিঠিটার লেখকের উপরও।
চলবে....
©somewhere in net ltd.