![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছেলেটি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কাছে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভ্যানে করে ভাঁজতে থাকা চিংড়ি মাছ ভাঁজা দেখছে, কিভাবে বেশ বড় বড় চিংড়ি মাছ কিভাবে ধুয়ে, লবন-মরিচ ও অন্যান্য মশলা মেশাচ্ছে, তারপর ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী উত্তপ্ত উনুনে, বেশ বড় ঢাউস আকৃতির লোহার করাইয়ের ভিতর ফুটতে থাকা তেলের মাঝে ছেড়ে দিচ্ছে, সেটা সে দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু চিংড়ী তেলে ছেড়ে দেবার পর, সেই ভাঁজার শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
এভাবে দাড়িয়ে ছিল, চিংড়ীটা ভাঁজার পরে, হাতলে উঠে না আসা পর্যন্ত, কতক্ষণ জানেনা, তবে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর, উঠে এলো মচমচে ভাঁজা, ধোঁয়া ওড়া, বাদামী রঙয়ের একটি চিংড়ী ভাঁজা! দেখেই জিভে জল! কিন্তু পকেট শূন্য... বেশ কিছুটা অপেক্ষা করে সাহস আর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চিংড়ী বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, যে চিংড়ী ভাঁজার দাম কত?
তিন টাকা! হাঁয়, তিন টাকা? ছেলেটির কাছেতো তিন পয়সাও নেই, একটাকা বা এর আশেপাশে হলে না হয়, দিন মজুর বাবার কাছে তাও চাওয়ার সাহস করতো, কিন্তু তিন টাকা! এই টাকাতে তো বাসার সবার এক বেলার তরকারী হয়ে যাবে! এই টাকা চাইলে শুধু মার নয়, নিশ্চিত ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে! তাই চোখ দিয়ে চিংড়ী খেয়েই সেদিন ধীরে ধীরে বাড়ির ঘরের পথ ধরলো। কিন্তু ফিরে যেতে-যেতে বারে-বারে পিছন ফিরে ছেলেটি চিংড়ী ভাঁজা দেখতে থাকলো......
একদিন, দুইদিন, তিনদিন কেটে গেল, কিন্তু ছেলেটির চোখ আর মাথা থেকে চিংড়ী ভাঁজার ছবি আর সরেনা! বারে-বারে, স্বপ্নে-ঘুমে-জাগরণে ছেলেটি চিংড়ী ভাঁজার ছবি-ই দেখতে থাকলো। তাই খেতে না পারুক একটু দেখে দেখে খুশী হবার জন্য সে আবার সেই চিংড়ী ভাঁজার ভ্যানের কাছে একটু আড়ালে দাঁড়ালো, যেন চিংড়ী বিক্রেতা আবার দেখতে পেয়ে দূর-দূর করে তাড়িয়ে না দেয়!
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটি চিংড়ী ভাঁজা দেখতে আসতে লাগলো, সেই ভাঁজা দেখতে-দেখতে একসময় ওটা খেতে চাওয়ার বাসনাও তৈরি হল, এবার আর দেখে মন ভরছেনা, এবার সে খেতে চায়, যেভাবেই হোক, চিংড়ী তাকে খেতেই হবে! তাই সে এটা ভাবে, ওটা ভাবে, এদিক তাকায়, সেদিক তাকায় আর কিভাবে তিন টাকা পেতে পারে তার উৎস খুঁজে বেড়ায়?
এই ভাবতে-ভাবতে আর চিংড়ী ভাঁজা খাবার অদম্য ইচ্ছাকে পূরণ করতে, একদিন সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে চলে গেল, নিজের অজান্তেই! এর আগে এই টার্মিনালের আসে-পাশে ছেলেটি বেশ কয়েকবার এলেও, একদম টার্মিনালে এই প্রথম, তাও একা, তাই এতো বড় টার্মিনাল আর অনেক বড় বড় লঞ্চ-ইস্টিমার দেখে কিছুটা ভড়কে গেল, ভঁয় আর আতঙ্কও পেয়ে বসলো তাকে।
ভঁয় পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় একটি বেস দোতালা লঞ্চ এসে থামল টার্মিনালে, সে সেই লঞ্চের মানুষ ও মালপত্র ওঠানামা দেখতে দাড়িয়ে রইলো। বেস কিছু মানুষ জন নেমে যাবার পরে, একটু ফাঁকা হতেই ছেলেটি আবার বাড়ির পথ ধরলো, এমন সময় হঠাৎ ছেলেটির চোখ আটকে গেল, তারই প্রায় সমবয়সী আর একটি ছেলের দিকে, যে ওই একটু আগে থেমে থাকা লঞ্চের ভিতর থেকেই নেমে আসছে, মাথায় কিছু মালপত্র নিয়ে, ছেলেটি সাথের যাত্রীদের কেউ নয় সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, যে কারণে সেই মালপত্র নিয়ে নেমে আসা ছেলেটিকে সে অনুসরন করলো, এবং তার ধারনা সত্যি হল, যখন ছেলেটি দেখল যে মালপত্র বহন করা ছেলেটিকে সাথের একটি লোক, আসলে ওই মালপত্রর মালিক চারটি টাকা দিল!
এবার ছেলেটির মাথায় বুদ্ধি এসে গেল, সেও এই কাজ করে চার টাকা পাবে এবং চিংড়ী ভাঁজা খাবে! তাই ছেলেটি সেই উৎসাহ আর অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আবার লঞ্চঘাটে ফিরে গেল এবং আর একটি লঞ্চের অপেক্ষা করতে থাকলো।
বেস কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর দূরে একটি লঞ্চ দেখা গেল, এই প্রথম ওই দূর থেকে পানিতে ভেসে আসা লঞ্চ তার ভালো লাগলো, এর আগে কখনোই এইসব লঞ্চ-ইস্টিমার বা এসবের শব্দ তার ভালো লাগতোনা! অপেক্ষা আর অপেক্ষার পরে লঞ্চ এলো, থামলো এবং বেস কিছু মানুষজন নেমে যাবার পরে, একটু ফাঁকা হতে ছেলেটি লঞ্চে উঠলো, এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখে এক যাত্রী তাকে একটি কাঠের চেয়ার আর একটি টিনের বাক্স নামিয়ে দিতে বললে, ছেলেটি দারুণ উৎসাহে একটি মাথায় আর একটি কাঁধে করে অতি সন্তর্পণে নামতে থাকলো... এবং কোন বিপত্তি ছাড়াই সে সব মালপত্র নামিয়ে দিতে সক্ষম হল।
অনেক খুশী আর আনন্দ নিয়ে ছেলেটি চারটি টাকার জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু সেই যাত্রী তাকে দুইটি টাকা দিল! খুবই কষ্ট পেলেও কিছু বলার বা আরও দু-একটি টাকা চাওয়ার সাহস ছেলেটির ছিলনা। যে কারণে সে আবার লঞ্চঘাটে ফিরে গেল এবং আবারো আর একটি লঞ্চ আসার অপেক্ষা করতে লাগলো...
কিন্তু সেদিন আর কোন লঞ্চ এলোনা! কারণ তখন ওই দিনের মত লঞ্চ আসা শেষ হয়ে গেছে...! তাই ছেলেটি অনেক আহত হওয়া সত্ত্বেও সেদিনের মত ফিরে গেল আর পরের দিনের স্বপ্ন দেখতে থাকলো।
পরদিন... আবার একই সময় সে অনেক বেশী সাহসের সাথেই আগের দিনের কাজ করলো এবং এবার সে তিনটি টাকা পেল। সেই টাকা দিয়ে বিকেল বেলা ছেলেটি তার স্বপ্নের চিংড়ী ভাঁজা কিনে খেল।
এবং তার পর থেকে আর কোনোদিন কারো কাছে সে তার কোন ইচ্ছে পুরনের জন্য টাকা চায়নি!
©somewhere in net ltd.