নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেড়াই-পড়ি-লিখি.....

সজল জাহিদ

সজল জাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আজও অধরা তুই...... (গল্প)

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৪৮

একঃ
ধুলো ওড়া, ধূসর গ্রামের মেঠো পথ। সময়টা ১৯৮৫। গ্রামে তখন বড় কাঁচা রাস্তাই অনেক দুর্লভ, ইট বেছানো বা পাকা রাস্তা তো সুদুরতম কল্পনাতেই ছিলনা। সারাদিনে হয়তো দুই বা একবার শোনা যায় রিক্সার বেল বাজিয়ে চলে যাওয়ার শব্দ। সারা গাঁয়ে হেটে-হেটে, ধুলো উড়িয়ে আর কাঁদা লাগিয়ে চলাচলেই অভ্যস্ত সবাই। হোক সে বাজার, স্কুল, কলেজ বা হাসপাতাল। অবশ্য খুব জরুরী প্রয়োজনে বা বড় বড় কোন কেনাকাটায় নৌকার ব্যবহার ছিল খুব।

গ্রামের রাস্তা ঘেঁসে বয়ে চলা ছোট্ট খাল। দিনে-রাতে জোয়ার ভাটার আসা-যাওয়া। কিছু নৌকার, বৈঠা আর পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের বিরক্তিকর ব্যাঞ্জনা। কারণ ছেলেটি নৌকা ভালোবাসেনা। সে সাঁতার জানেনা, তাই ভালোবাসেনা নদী, খাল বা পুকুর। জন্ম একটু শহরে পরিবেশে। সেখানে সে রিক্সা দেখেছে। সাইকেল চড়েছে। আর ফনিক্স সাইকেলের সামনের রডে বসে যেতে, যেতে বাজিয়েছে বেল টুং টাং, ক্রিং ক্রিং। দেখেছে মোটর বাইকেও বার কয়েক। বয়স তখন কতই বা তার পাঁচ কি ছয়?

গ্রামে চলে আসা হুট করে। কিন্তু মফস্বলের মায়ায় বাঁধা পড়েছে তার শিশু মন। ভালোলাগে রিক্সা-সাইকেল আর ভালোলাগে ভাঙা চুরা লাল ইটের ধুলি দেখতে। এসব নদী-খাল-পুকুর আর নৌকা তাকে বস মানাতে পারেনি। তাই সেই শিশু মন অপেক্ষায় থাকে দিন-রাত কান পেতে, শুনতে দুই একটি রিক্সার চলে যাওয়ার সময় বেলের টুং টাং শব্দ শুনতে। ভালোলাগে রিক্সার চাকার পিছনে উড়ে যাওয়া ধূসর ধুলা দেখতে। আর ভালো লাগে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো একটি ক্যালেন্ডারে সাইকেলের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে।

এভাবে দুই তিন বছর কেটে গেল। শিশু থেকে ছেলেটি আর একটু বড় হল। বুঝতে শিখল আর একটু। কিন্তু মানাতে পারেনি এখনো এই গ্রামের নির্জনতাকে। ভালো লাগেনি তার কাঁচা রাস্তাকে। মনে ধরেনি কোন সবুজ গাছ আর ধানে ভরা মাঠকে। এদিকে পরিবারে এলো আর একজন নতুন অতিথি। এখন সব মনোযোগ সেই দিকে সবার। ছোট্ট ছেলেটি হল আরও অবহেলিত। ক্ষুদে মনের বিষণ্ণতা, মন মরা হয়ে একা-একা থাকা সাথে নিত্য অভাব আর অপুষ্টিতে কোমল মুখে খটখটে বাস্তবতা।

আর যারই হোক মায়ের চোখ এড়ালোনা তা। যে কারনে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাবস্থা করা হল তারই কোন এক দূর সম্পর্কের আত্নিয়র কাছে। মায়ের বুকে পাথর বেঁধে, ছেলের মুখের হাসি ফেরাতে। মা নিজেকে বোঝাল দূরে থাক, তবুও হাসি খুশি থাক বাবা। এতটুকু বোধ বা বুঝ তার ছিল বা বুঝতে পেরেছিল কোথাও যাচ্ছে সে। এই ম্যাড়ম্যাড়ে গ্রাম আর উচ্ছ্বাসহীন অন্ধকার ছেড়ে। এতটুকু বুঝেই সে প্রথম হেসেছিল অনেকদিন পরে।

দুইঃ
বাড়ির কাঁচা মাটির পথ চলতে চলতেই সে জেনে নিয়েছিল কোথায় যাচ্ছে। সেখানে আছে পাকা রাস্তা, আছে লাল লাল ইটের দালান, আছে রিক্সা-সাইকেল আর মোটর সাইকেলের ঝংকার! কোথাও আছে রেডিও-ক্যাসেট বা টেলিভিশন! যেখানে শোনা যাবে বাজনা, ভেসে আসবে গান। খুব খুব ভাগ্যবান হলে দেখতে পাবে টিভিও দুই একদিন! টিভি সে আগেই দেখেছিল একদিন, ওই গ্রামে ফিরে যাবার আগেই। যা রয়ে গেছে তার সৃতিতে। তাই সে উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত আর আহ্লাদিতও কিছুটা।

গ্রাম ছেড়ে এক বেলার পথ পেরুবার পরে চোখে পড়লো ছেলেটির ভালোলাগার ভাঙা চুড়া লাল ইটের ধুলি ওড়া রাস্তা। আর শুনতে পেল সাইকেলের বেলের টুং টাং শব্দ। আনন্দে হেসে উঠলো খিল খিল করে। আর অবুঝ মনেই স্বপ্ন বুনে নিল একদিন তার একটি সাইকেল হবে! সে চালাবে, জোরে খুব জোরে, বাজিয়ে বেল টুং টাং, টুং টাং... এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই তার চোখের সামনে থেকে চলে গেল একটি সাইকেল, বাজিয়ে আনন্দের বেল। আর ছেলেটি পথ চলা বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল নিথর হয়ে।

ছেলেটির প্রথম ভাবনা, প্রথম স্বপ্ন আর প্রথম আকাঙ্ক্ষা হয়ে গেল একটি সাইকেল। একদিন না একদিন সে এমন একটা সাইকেল কিনবেই। এই ভাবনা আর স্বপ্নের রঙিন জাল বুনতে বুনতে চলে গেল সেই দূরের কোন আত্নিয়র বাড়ি। গিয়েই পরে গেল অন্য বিপদে। গ্রামে তবুও কোন শাসন ছিলনা কিন্তু এখানে কঠিন শাসনের বেড়াজাল। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই। নেই মা-বাবার অকিত্রিম স্নেহ। কিন্তু আছে অভুক্ত না থাকার নিশ্চয়তা। মফস্বলের আলো আধারির মায়া আর আছে সাইকেল-রিক্সার টুং টাং শব্দ। ছেলেটির একাকিত্তের আনন্দ।

এরপর থেকে ছেলেটি যখন যেখানে আর যেভাবেই দুই একটি পয়সা বা টাকা যদি পায়, বাজার থেকে বাঁচিয়ে, রিক্সায় না গিয়ে হেটে গিয়ে, কেউ দুই-এক টাকা উপহার দিলে, ঈদ বা এরকম উপলখ্যে দুই-চার টাকা পেলে, জমিয়ে রাখে খুব গোপনে একদিন সাইকেল কিনবে বলে। এভাবে ছেলেটি চার–পাঁচ বছর পরে দেখল যে তার কাছে প্রায় ৫০০ টাকা জমে গেছে! কিজে খুশি হয়েছিল সেদিন সেই টাকা গুলো গুণেগুণে। এরপর একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল সাইকেলের দাম। সেই সময়ের ১০০০ টাকা প্রায়। ভারতীয় হিরো সাইকেল, লাল বা খয়েরি রঙয়ের। তবে আরও অপেক্ষা প্রায় পাঁচ বছরের.........।

এভাবে ছেলেটি যখন এসএসসি দেবে তার কিছুকাল আগে দেখা গেল তার কাছে প্রায় ৮০০ টাকা জমে গেল! এবার যেন খুশি আর ধরেনা। বড় হয়েছে বেশ, বুঝতে শিখেছে অনেক অনেক কিছুই। কিন্তু সাইকেল দেখলেই সে শিশু হয়ে যায়। কান পেতে শোনে সাইকেলের বেলের টুং টাং শব্দ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাইকেলের চলে যাওয়ার দিকে। যেন “ক্ষুধার্ত কুকুর, অন্যের খাওয়া দেখেই সুখ পায়!”। ছেলেটিরও তাই। অন্যের সাইকেলে চালিয়ে যাওয়া দেখেই সে ওখানে নিজেকে কল্পনা করে আনন্দিত আর উচ্ছ্বসিত হয়। আর একটু রঙ লাগে তার সাইকেল কেনার স্বপ্নে।

এসএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষা হল। সেখানে পাশ করলো। এবার চুড়ান্ত ফরম ফিলাপের পালা। কিন্তু এই টাকা কোন ভাবেই তার পরিবার জোগাড় করতে পারছেনা। যাদের দিনই চলেনা তাদের কে দেবে অতগুলো টাকা? আর না হয় দিলোই কেউ, শোধ করেব কবে আর কিভাবে? যে কারণে মুখে মুখে সাহস আর সহানুভূতি দেখালেও বাস্তবে কেউ এলনা এগিয়ে। কিন্তু পরীক্ষা তো দিতেই হবে। এটাই তো আসল। এটাই বাস্তবতা সেটা বোঝার মত বোধ ছেলেটির আছে। তাই সে বাস্তবতাকে ধারন করলো আর স্বপ্নকে দিলো জলাঞ্জলি। ৯ বছরের জমানো টাকা দিয়ে সে এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপ করলো।

তিনঃ
একটা স্বপ্ন নাহয় দিলো জলাঞ্জলি, আবারো না হয় বুনবে সেই স্বপ্ন নতুন করে। সাজাবে নতুন রঙে। তাই সে দুঃখ বেশ কিছুটা পেলেও আনন্দ ছুঁয়েছিল তাকে, যখন সে পাশ করেছিল এসএসসি। না, আহামরি কোন ভালো ছাত্র সে ছিলনা। তেমন কৃতিত্তের সাথেও পাশ করেনি। সাধারন একটি বিভাগ নিয়েই সে উৎরে ছিল স্কুলের বাঁধা। এবার তবে কলেজের প্রস্তুতি। সাথে দুই-একটা প্রাইভেট বা অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশুনাটা চালিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ। বাবা-মা পারবেনা কোন খরচ যোগাতে সেটা বলেই দিয়েছে। আসলে সেই উপায়ই যে নেই। তাই নিজের ঘানি এবার নিজেকেই টানতে হবে।

অন্যের বাড়িতে থাকে। বাচ্চাদের পড়ায়। কলেজে যায়। সেখানেই খায়দায়। কিন্তু এইসব ব্যাস্ততার মাঝে আর কুলিয়ে উঠতে পারেনা আলাদা একটা প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের ভেঙে যাওয়া প্রথম স্বপ্নকে নতুন করে আঁকার রঙ-তুলি কিনতে। তাই বেঁচে থাকলে, কলেজ পাশ করে, কিছু একটা করেই নাহয় এগোবে সেই ফেলে আসা স্বপ্নের পিছে। তাই তখনকার মত ছাই ছাপা দিয়ে রাখে সে তার স্বপ্নকে। এখন মনোযোগ পড়াশুনা, বেঁচে থাকা আর আগামীর অন্য স্বপ্ন বোনায়।

কলেজের পরিবেশে গিয়ে আর নতুন নতুন বন্ধু পেয়ে বদলে গেল ছেলেটির চিন্তা-ভাবনা। মনে এলো নতুন নতুন স্বপ্ন আর কল্পনা। চোখে-মুখে নতুন নতুন সম্ভাবনার বিস্ময় আর আকাঙ্ক্ষা। তাই কলেজের প্রথম বর্ষ শেষ হতে না হতেই তার মাথায় ঢুঁকে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা আর অবারিত আকাঙ্ক্ষা। পুরনো ও প্রথম বোনা ছাই চাপা স্বপ্নের যায়গা দখল করে নিল অমিত সম্ভাবনা আর অপার সুখ ও আনন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। স্বপ্ন তখন একটা, একটাই পড়তে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেভাবেই হোক আর যত কষ্টেরই হোক।

নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা আর নতুন প্রান ও প্রেরণা পেল ছেলেটির জীবন। ভাবনা-কল্পনা আর আল্পনা সব কিছুই এখন নতুন আর আগামীর অপার সম্ভাবনাকে ঘিরে। তাই ছুটে চলা, ছুটে চলা আর ছুটে চলা। অবিরাম পথ চলা, একা একা কথা বলা। স্বপ্নের জাল বোনা। আত্নসুখে বর্ণিল হওয়া। যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর কষ্টের ফলাফল স্বরূপ কলেজ ছেলেটি বেশ ভালো ভাবেই পাশ করলো। এবার তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধ।

শুরু হল আরও প্রচেষ্টা, আরও কষ্ট আর আরও অধ্যাবসায়। তাই, এই সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধেও ছেলেটি উৎরে গেল। ভর্তি হল একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবন এবার আরও উচ্ছল, স্বপ্ন এখন আরও রঙিন। আগামী এখন আরও বর্ণিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে বেশ কিছুদিনের অবসর এলো। যেন বহুদিন পরে এমন ক্লান্তিহীন আর উদ্বেগহীন অবসর পেলো। আর এই অবসরেই পুরনো স্বপ্নের ছাই সরিয়ে তার মাথায় এসে উপস্থিত হল আর জানান দিল যে সে মরেনি। বেঁচে আছে, ছিল নিশ্চুপ হয়ে। পুরনো স্বপ্নে আবারো বিভোর হল। অবসরকে ছুটি দিয়ে নেমে পড়লো কিছু সাময়িক কাজে। উদ্দেশ্য দুটি। একঃ কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেদেবে পড়াশুনা আর নতুন জীবনের নতুন সময় আর সাথীদের সাথে একাত্নহতে। দুইঃ যদি সম্ভব হয় তো চেষ্টা করে দেখবে একটা সাইকেল কেনা যায় কিনা। কারণ এখন সাইকেলের দাম আর সেই ১০০০ টাকায় নেই। ওটা এখন ৪০০০ থেকে ৫০০০ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। তাই ওটা অনেকটা অসম্ভবই এখনো।

চারঃ
শুরু হল নতুন জীবন। অনেক অনেক আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা। নতুন নতুন বন্ধু, ভিন্ন ভিন্ন আবেগ আর অনন্য সব আবেশ। ছেলেটির জীবনের সত্যিকারের আনন্দের জীবন। আর সেই আনন্দকে আরও বহুগুন বাড়িয়ে দিল, রঙে রঙে একে, ইচ্ছেমত সাজিয়ে, করে তুলল রঙধনুময় তারই এক মিষ্টি সহপাঠিনী! যে শুধু ছেলেটির সাথে মেশে, কথা বলে, আর ঘুরে বেড়াবার সুযোগ খোঁজে। এমন অপার্থিবতাকে সে কিভাবে রাখবে দূরে। এমন দিন যে আসেনি কভু। আসবে কিভাবে, ভাবতেই পারেনি এমন কিছু কখনো, কোনোদিন। সেই সময়, সুযোগ আর সাধ্য বা মন কোনটাই তার ছিলনা যে।

তাই আবারো সাইকেল বাদ! খুব স্বাভাবিক ভাবেই। এখন শুধু পড়াশুনা, প্রেম আর প্রার্থনা একটু সুন্দর আর সুখময় আগামীর। অনেক অনেক অধ্যাবসায়, বেশ কিছু প্রাইভেট, বন্ধুদের সাথে বাঁদরামি, প্রেয়সীর জন্য বরাদ্দ সময় সবকিছু সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে বেশ একটু অন্য রকম ভাবেই। ছিল সুখ, ছিল দুঃখ। কিছু হাসি ছিল, কিছু কান্না। আর ছিল অনেক আনন্দ, কখনো কখনো বিষম বেদনা। সব কিছু ছাপিয়েই শেষ করলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বর্ণিল জীবন। বেরিয়ে পরলো কর্ম আর কালের সাথে টিকে থাকার নতুন সংগ্রামে।

পাঁচঃ
উপরওআলার বিশেষ রহমতে বেকার জীবন কাটাতে হয়নি তেমন। পেয়ে গিয়েছিল একটি ছোট চাকুরী অন্তত অন্যের দারস্ত তো হতে হবেনা? এই ভেবে আনন্দিত। ৫০০০ টাকা মাসিক স্যালারি। বেশী নয়, আবার একদম কমও নয়। নিজের খরচ, বাবা-মায়ের খরচ আর প্রেয়সীর সাথে সময় কাটানোর পরেও থাকে দুই বা একশো টাকা! বাহ, এবার তবে হোক স্বপ্ন পুরনের জন্য সত্যিকারের একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা? কারণ বড় সে যতই হোক না কেন? সাইকেল দেখলেই যেন শিশু হয়ে যায়। এখনো তাকিয়ে রয় চলে যাওয়া সাইকেলের দিকে।

এখনো কাণ পেতে শোনে বেলের টুং টাং শব্দ। এখনো গাঁয়ে মাখে চলে যাওয়া সাইকেলের চাকার পিছনে উড়ে যাওয়া ধুলো!
এবার বেশ তোড়জোড় করে খোঁজ নিতে গেল সাইকেলের দোকানে। কিন্তু দাম দেখেই বিষম খেল। এখন সাইকেল আর ৫০০০ রে হবেনা, ওটা এখন ৮ থেকে ১০ হাজারে পৌঁছে গেছে! আর যাহোক ফনিক্স নিয়ে তো শহরে চলা যাবেনা? একটু অন্যরকম তো হতে হবেই! আবারো ধাক্কা খেল আজন্ম লালিত স্বপ্ন। আবারো ধূসর হল সাময়িকভাবে। তবে এবার একটু জেদও চাপল মাথায়। সাইকেল একটা কিনবেই সে আগামী দুই বছরের মধ্যেই।

তিন মাস পরে চাকুরী পরিবর্তন করলো স্যালারি ৮০০০ টাকা। খুব খুশি সে স্বাভাবিক ভাবেই। জীবন একটু স্বচ্ছন্দ হল। মা-বাবাকে এর একটু বেশী দিতে পারছে। প্রেয়সীও বেশ খুশি বিয়ের জন্য টাকা জমবে বলে। আর ছেলেটি তো অবশ্যই সাইকেলটা কিনতে পারবে ভেবে। সেই ভাবনায় কখনো কিশোর, কখনো শিশু হয়ে একা একা হাসে। একা একাই আনন্দে হয় আত্নহারা।

বেশ চলছিল হেলেদুলে পাল তুলে। কিন্তু জীবন তো আর এতো মসৃণ আর মুধুময় হয়না। তাই জীবনকে আরও নতুন মোড় আর ভিন্ন ও বিভীষিকাময় স্বাদ দিতে একদিন হুট করে চাকুরীটা চলে গেল! প্রাইভেট চাকুরী আজ আছে কাল নাই, সেই ভাবনা বা ধারনা তখনো হয়নি তার। শুরু হল দুঃসহ যন্ত্রণা, অসহ্য কষ্ট আর বিরামহীন বিভীষিকা। জীবন থেকে জীবনকে ছিনিয়ে নিল চরম বাস্তবতা। মা-বাবার চাহিদা, নিজের টিকে টাকা, প্রেমিকার প্রেম টিকিয়ে রাখার অসম্ভব সম্ভাবনা!

জীবন যেন আর জীবন নেই, হয়ে গেছে রাস্তার ধুলোর মত। পায়ে পায়ে গড়িয়ে যায়। এখানে ওখানে হোঁচট খায়। পরিচিতরাও অপরিচিত হয়ে যায়। প্রেম হয়ে যায় বিষ। আর জীবন নিরামিষ। স্বপ্ন এখন ধূসর আর ভবিষ্যৎ অন্ধকার!

ছয়ঃ
আবারো সংগ্রাম, অসম্ভব অদম্যতা, অমানুষিক শ্রম আর অক্লান্ত পথচলা। জুটে যায় একটি চাকুরী। এবার উচ্ছ্বসিত নয়, এখন আর উদ্দীপনা নয়, নয় অযথা স্বপ্ন দেখা। নির্মম বাস্তবতা শিখিয়েছে অনেক কিছুই, চিনিয়েছে মানুষ, দিয়েছে নতুন কিছু বোধ, এসেছে কিছু পরিপক্কতা। তাই এখন আগে নিজের টিকে থাকা, ভালো থাকা, বাস্তবতাকে ভাবা তারপরে স্বপ্ন দেখা।

চাকুরীটা বেশ ভালোই বলতে হবে। খাওয়া দাওয়ার চিন্তা তেমন নাই। থাকাটাও বেশ অল্প খরচের। স্যালারিও নেহাত মন্দ নয় ১২০০০ টাকা! অনেক। প্রায় ছিড়ে যাওয়া প্রেম জোড়া লেগেছে। মা-বাবার মুখে হাসি ফুটেছে। আর ছেলেটি এখন বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ প্রেয়সী ঠিক আছে কিন্তু তার পরিবার তো ঠিক নেই। তাই আবার এক অন্য সংগ্রাম।

স্বাভাবিক ও সাম্ভাব্য কিছু ক্লাইমেক্সের পরে বিয়ে। নতুন সংসার, দায়িত্ব, সাধ, সাধ্য আর সামরথের অসম্ভব সম্মিলন। জীবনের নতুন নতুন মোড়। বছর না ঘুরতেই বাবা হয়ে যাওয়া! আরও দায়িত্ব। আরও চেপে বসা চাপ। কিন্তু তবুও আনন্দ। কিছু ব্যাঞ্জনা। বিশেষ রহমত হয়ে এলো বউয়ের চাকুরী। বিধাতার উপহার। সংসারের চাকাটা একটু সচল হল এতে। দিনগুলো রঙিন হতে শুরু করলো বেশ অনেক অনেক দিন পরে। সচ্ছলতা না হলেও অভাবটা ঘুচেছে বেশ। কমেছে নিত্য ঠোকাঠুকি।

এভাবে কেটে গেল দুই বছর। একদিন হঠাৎ ছেলেটির স্বপ্ন আবারো ছাই চাপা আগুনের ভিতর থেকে জেগে উঠলো, দেখে এক কলিগের আধুনিক আর স্টাইলিসট সাইকেল। যা দিয়ে পারি দেয়া যায় অনেক লম্বা পথও! কি আনন্দ ঘন আর উচ্ছ্বাসের সেই সব ছবি! দেখে দেখে লোভে পরে আবারো নেশার মত জেগে উঠলো সাইকেল কেনার অদম্য বাসনা।

তাই এবার আর যেন ভেঙে না যায় প্রথম, পুরনো আর একমাত্র স্বপ্ন সেই ভাবেই শুরু করলো টাকা জমানো। প্রতি মাসেই কম বা বেশী। অতিরিক্ত কিছু কখনো পেলে বা যদি পারে সংসারের খরচ কমাতে কোন যায়গা থেকে অথবা যদি পারে অর্ধাঙ্গিনীর কাছ থেকে নিতে কোন মাসে একটু বেশী আর্থিক অবদান। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, সত্য-মিথ্যার সামান্য বেড়াজালে প্রায় দুই বছরে জমে গেল বেশ কিছু টাকা, প্রায় ১০০০০! বেশ অনেকই। কিন্তু পছন্দের সাইকেলের দাম এখন প্রায় ২০০০০ টাকা! তাই আর একটু অপেক্ষায়......।

সাতঃ
নতুন বুদ্ধি এলো মাথায়। অফিসে স্যালারি রিভিউ হবে। সরকারী চাকুরীজিবিদের স্যালারি বেড়েছে। ছেলেটির অফিসও ওদের সাথে সংগতিপূর্ণ সামঞ্জস্য করবে। দুই মাসের মাথায় হয়ে গেল কার্যকর! বেশ কিছু টাকা বেড়েছে স্যালারি। ভেবে রাখলো তিন মাস চেপে যাবে এই কথা বাসার সবার কাছ থেকে। তিন মাসের টাকাটা জমলেই একটি স্বপ্নের সাইকেল কিনে ফেলবে! আর দেবে সহকর্মী আর অন্যান বন্ধুদের সাথে একটি লম্বা সাইকেল ট্যুর! সেই ভেবে ভেবে কতশত আলোচনা আর উন্মাদনা। যেন জীবনে আবারো নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে!

যে ভাবা সেই কাজ। তিন মাসের অতিরিক্ত আর গোপনে জমিয়ে রাখা স্যালারি আর আগের জমে থাকা টাকা মিলে হয়ে গেল ২০০০০ টাকা! আহ রুখবে এবার কে?

ডিসেম্বরের শেষে সাইকেল কিনবে। সহকর্মীদের সাথে ভ্রমণের পাকাপাকি করে ফেলেছে। যাবে ঢাকা থেকে অনেক অনেক দূরে। সাত দিনের সাইকেল ভ্রমন। নভেম্বর মাসের স্যালারিও চলে গেছে। এটা সাইকেল কেনার পরের অতিরিক্ত, যেটা দিয়ে ভ্রমন খরচ মেটাবে। এরপরে নতুন সাইকেল কিনে ভ্রমন থেকে ফিরে এসে নতুন বছরের শুরুতে স্যালারি বাড়ার সুখবরটা দেবে বাসায়, তেমনই পরিকল্পনা।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। বাচ্চার নতুন আর প্রথম স্কুলে ভর্তি। যেটা অরধাঙ্গিনিই করবে বলে ঠিকঠাক হয়ে আছে। যেখানে বাচ্চার বাবার কাছে কিছু চাইবেনা বা দেয়া লাগবেনা বলেই ঠিক হয়ে আছে। অফিস থেকে ফিরেছে এক সন্ধায়। বাসায় ফিরে বউয়ের মন খারাপ, খুবই খারাপ। পারলে কাঁদে বসে বসে! কি হয়েছে জানতে চায় ছেলেটি?

তার বৌ জানায়... এই অফিসে সম্মান নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়, তাই চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে এসেছে আজই...!

ছেলেটির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। স্বপ্ন হল চুরমার আর একেবারে বিলীন। মুছে গেল সুখের আঁকা সৃতি। কারণ?

হাঁয়, বাচ্চার প্রথম স্কুলে ভর্তির চেয়ে কি তার সাইকেল কেনা বেশী হল না হতে পারে?

নিজের অজান্তেই চোখের কোন গড়িয়ে পরে দু ফোঁটা জল! আর মনে মনে বলে......

আজও অধরা তুই.........

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৪৫

রানা আমান বলেছেন: খুব ভালো লাগলো লেখাটা ।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫১

সজল জাহিদ বলেছেন: ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে খাটো করবোনা। কারণ এতো এতো বড় একটা লেখা যে কজন পড়বে সেটা নিয়েই সন্দিহান ছিলাম, কারো মন্ত্যব্য তো অনেক দূরের প্রত্যাশা ছিল। আপনি এতো বড় লেখা পড়েছেন এটাই এই লেখাটার সার্থকতা আর ভালোলাগাটা একটা অনেক বড় প্রাপ্তি।

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৪

ওতানভীর বলেছেন: দারুণ

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৪

সজল জাহিদ বলেছেন: ইস এতো বড় গল্প আপনারা পড়েছেন? এতেই আমার গল্পটা ধন্য! আর আসলেই ভালোলেগে থাকলে সেটা অসম্ভব একটা প্রাপ্তি এই লেখাটার। ধন্যবাদ দিয়ে কাউকেই খাটো করবোনা।

৩| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৬

চন্দ্রপ্রেমিক বলেছেন: জীবন হয়ে গেছে রাস্তার ধুলোর মত। জীবন নিরামিষ।


অসম্ভব সুন্দর গল্পটা। জীবনের গল্পও।
অবশেষে ভালবাসা।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৪

সজল জাহিদ বলেছেন: ইস এতো বড় গল্প আপনারা পড়েছেন? এতেই আমার গল্পটা ধন্য! আর আসলেই ভালোলেগে থাকলে সেটা অসম্ভব একটা প্রাপ্তি এই লেখাটার। ধন্যবাদ দিয়ে কাউকেই খাটো করবোনা।

৪| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২৪

আমি মাধবীলতা বলেছেন: আহারে !! অনেক স্বপ্নই রয়ে যায় চির অধরা হয়ে কিন্তু...জীবন থেমে থাকে না! :(
গল্পে ভালোলাগা !

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৬

সজল জাহিদ বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।

৫| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৪০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দারুন স্বপ্ন অধরার অধরা কাহিনী...

ছোট্ট টাইপো...
যে ভাবা সেই কাজ। তিন মাসের অতিরিক্ত আর গোপনে জমিয়ে রাখা স্যালারি আর আগের জমে থাকা টাকা মিলে হয়ে গেল ২০০০ টাকা! আহ রুখবে এবার কে?
বোল্ডে এটা ২০০০ না হয়ে ২০০০০ হবে মনে হয়।:)

+++++++++++++++

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৭

সজল জাহিদ বলেছেন: জি ঠিক বলেছেন, ঠিক করে নিচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ

৬| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:২৯

শরাফত বলেছেন: মনটা ছুয়ে গেল ভাই ।
এমন কিছু ইচ্ছে নিজের মনের গভীরেই থেকে যায় যা কোনোদিন বাস্তব হয় হয় করেও আর হয়ে ওঠে না ।

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৯

সজল জাহিদ বলেছেন: জি ঠিক বলেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.