কুকুর, বিবেক এবং রাজশিশু

১০ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪৮

চোখের সামনে কুকুরটা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা আনিস সাহেব কে দেখেই লেজ নাড়াতে নাড়াতে তার সামনে এসে রাস্তা অবরোধ করে দাড়াল; বুঝতে পারছেন না আনিস সাহেব এখন কি করবেন! এর আগে এমন ঘটনার সম্মুখীন তিনি কখনই হননি! জ্বল জ্বল করছে সে কুকুরের চোখ দুটো! এ রকম চোখ তো রাতে দেখা যায়, কিন্তু সেটা তিনি দিনের বেলায় দেখতে পাচ্ছেন! হিস হিস বলে তিনি কুকুর টাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না! এই বার অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে লাগল! আনিস সাহেব পরিস্কার শুনতে পেলেন কেউ একজন বলছে তাকে, কি আনিস সাহেব ব্যাংকে কত টাকা জমা হয়েছে? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, নাহ কেউ তো নেই আশে পাশে তবে কে এই প্রশ্ন করলো? আবার সেই একই প্রশ্ন! এই বার তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন, লক্ষ্য করলেন তার সামনে দাড়ানো কুকুরটিই তাকে এই প্রশ্ন করছে!
- আমার ব্যাংকে কোনো টাকা নেই উত্তর দিলেন আনিস সাহেব
- বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের যে বাজেট ছিল সেই টাকা, মশক নিধনের টাকা? সেই গুলো তো সবই আপনি নিজের ব্যাংকে জমা করেছেন! যদি খরচই করতেন তবে আমি আপনাকে এই প্রশ্ন করতে পারতাম না, আর এখানে দাড়িয়ে মশার কামড়ও খেতে হত না আপনাকে! একটা মশা এর মধ্যেই আনিস সাহেবের গলায় কামড় বসিয়ে রক্ত চোষা শুরু করেছে! মশাটা কে তিনি মারতেও পারছেন না! এই বার কুকুর টি তাকে বলা শুরু করলো;
আনিস সাহেব, জনগণের টাকা লুট করে নিজের সম্পত্তির পাহাড় গড়ছেন ভাল কথা, তাই বলে আমার মত বেওয়ারিশ কুকুরের জন্য বরাদ্দ করা টাকাও? মশা মাছি মারা, ড্রেন-নর্দমার, আবর্জনা-ময়লার টাকাও লুট করতে একটুও লজ্জা হয় না আপনার? আরে সাহেব আপনাদের দেখলে তো আমার মত বেওয়ারিশ কুকুর পালিয়ে বেড়াত এই ভয়ে যে আপনারা আমাদের মেরে ফেলবেন, অথচ আজ কিনা আমিই আপনার পথ অবরোধ করেছি! আমার মত কত বেওয়ারিশ শিশুও এ শহরের পথের পাশে, ডাস্টবিনের পাশে, না খেয়ে ঘুমায়, যে পথকে আপনারা রাজপথ বলেন, সে কথিত রাজপথে মন্ত্রী-রাজা চলেন, তবুও তাদের চোখে পড়েনা সেই সব শিশুরা, যাদের আপনারা সাহিত্যের ভাষায় পথ শিশু ডাকেন, কিন্তু আমার মত কুকুর ওদের রাজশিশু বলে ডাকে! রাজপথে পড়ে থাকা শিশু তো রাজশিশুই বরং পথশিশু তো আপনার সন্তান, আপনি রাষ্ট্রের টাকা লুট করে নিজের ভিতরে নর্দমা, ময়লা আবর্জনায় ভরে ফেলেছেন, নিজের সন্তানদের পথশিশু বানিয়েছেন, ছি, আনিস সাহেব, ছি!
এইবার আনিস সাহেব ঘামতে শুরু করেছেন, তার খুব অস্থির লাগছে, মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে, হাল্কা সুরের কিছু একটা তিনি শুনতে পাচ্ছেন, চোখের সামনের কুকুরটাকে যেন তার মনে হচ্ছে নরকের দানব যা তাকে শাস্তি দিচ্ছে! আনিস সাহেব দু'হাত জোড় করে সে কুকুর কে সরে যেতে বলছে, এইবার তার দম মনে হচ্ছে বন্ধ হয়েই যাবে, এমন সময় তার মনে হলো কেউ একজন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, সেই হাল্কা সুরের আওয়াজ টা এবার জোরে শোনা যাচ্ছে, তিনি এই বার পরিস্কার শুনতে পাচ্ছেন তার মহল্লার মসজিদের মুয়াজ্জিন করিমের কন্ঠ! তিনি শুনছেন, আস সালাতু খাইরুম মিনার নাওম, আস সালাতু খাইরুম মিনার নাওম! ঘুম ভেংগে আনিস সাহেব দেখেন তার স্ত্রী পাশে বসে আছেন এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন! তিনি উঠে বসলেন, পাশের ঘরে গিয়ে তার একমাত্র সন্তান কে দেখে আসলেন, সে ঘুমাচ্ছে কম্বল জড়িয়ে; তার মনে পড়ল পথশিশু ও রাজশিশুর পার্থক্য! তিনি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইলেন, অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করলেন, তারপর নাস্তা করে সোজা ব্যাংকে গেলেন, একাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে দিয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হলেন, গাড়ির জানালা দিয়ে তাকাতেই তার চোখে পড়ল একটা কুকুর রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেল, দুরের ডাস্টবিনের পাশে কয়েক জন পথশিশু কি যেন খুজছে! তার কাছে আজ আর সে শিশু গুলোকে পথশিশু মনে হলো না, তার মনে হলো কয়েক জন রাজশিশু, কিছু একটা খুজছে! আনিস সাহেবের গাড়ীটা বাতাসের বেগে কর্পোরেশনের দিকে ছুটে চলছে...।

কুকুর, বিবেক এবং রাজশিশু
সরকার পল্লব

০ টি +০/-০