নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে \"আমার কবিতা নামে\" আমি ব্লগিং করি মূলত নিজের ভেতরে জেগে উঠা ব্যর্থতা গুলোকে ঢেকে রাখার জন্য । দুনীতিবাজ, হারামখোর ও ধর্ম ব্যবসায়িদের অপছন্দ করি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন

আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

চেরাগ আলী ও তান্ত্রিক - ভৌতিক গল্প ( ২য় পর্ব )

০২ রা জুন, ২০২২ সকাল ১০:১২



প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুণ

দুই

ছোট বেলা থেকেই আমি বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। বড়দের আদেশ, নিষেধের খুব একটা ধার দিয়ে যেতাম না। বয়স ছিলো অল্প তাই শরীরের রক্ত ও ছিল গরম । আজ এর গাছের ডাব পারো তো কাল ও পুকুরের মাছ ধরো । এসব ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ।
বাড়িতে ভয় যা পাবার তা শুধু বাবাকেই পেতাম । তবে তিনি যে আমাদের খুব একটা শাসন,আসন করতেন তা কিন্তু নয় । কোন কিছুতে বিরক্ত হলে, একবার চোখ তুলে তাকাতেন। বাস! ওতেই কাজ যা হবার তা হয়ে যেতো । দু’বার দুষ্টমি করার সাহস পেতাম না । বাবার ওটুকু শাসন ছাড়া আমরা ছোটরা বলতে পারো এক প্রকার স্বাধীন ই জীবন কাটাতাম ।

সারাদিন টো টো করে বনে, বাদারে ঘুরে বেড়ানো,পাখিদের পিছু পিছু, মাছেদের পিছু পিছু, প্রজাপতির পিছু পিছু ছোটাছুটি করে কখন যে, দিন কেটে চারধার আধার করে জুজু বুড়ির মতো সন্ধ্যা নেমে আসতো টেরই পেতাম না। রাত্রি নেমে এলে পেছনে ফেলে আসা দিনটাকে বড্ড ছোট বলে মনে হতো । মনে হতো, ইস! দিনটা যদি আর একটু বড় হতো তাহলে আর একটু বেশি সময় খেলাতে পারতাম। আহা! কি দিন ছিলো সে সব।। সেদিন কি আর ফিরে পাবো , পাবো না জানি । হায় ! যেদিন যায় তা যে একেবারেই যায় ।!

এ পর্যন্ত বলে, চেরাগ আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন । একটু বড় হয়ে উঠতে কি যে হলো আমার । কাউকে কিছু না বলে, না জানিয়ে মাঝে মধ্যই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করলাম । দু’চার দিন এগিক ওদিক ঘুরে, রোদ পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে, ক্ষুধা, তৃষ্নায় কাতর হয়ে তবেই বাড়ি ফিরে আসতাম।

বলেন কি ? আপনার বাড়ি পালাবার রোগও ছিলো নাকি ? আপনার মা, বাবা এ নিয়ে কিছু বলতেন না? আমি প্রশ্ন করলাম ।
বলতেন না আবার; বলে বলে ক্লান্ত হয়ে মা শেষে পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন । প্রথম প্রথম মা বিস্তর কান্নাকাটি করতেন। পরে অবশ্য তিনিও আমার এই বাউন্ডুলে স্বভাবটা মেনে নিয়েছিলেন ।
আর আপনার বাবা! ওনাকে সামাল দিলেন কিভাবে ? আপনার বাবা যে মানুষ ছিলেন, তাতে তো মেরে,কেটে আপনার হাড়-মাংস এক করে দেবার কথা ছিলো? ঝন্টু প্রশ্ন করলো ।

না, না ,বাবা সে রকম কিছু করেননি । সত্যি বলতে, আমাদের বংশে এই বাড়ি পালানো রোগটা নতুন কিছু ছিলো না। বড় হয়ে শুনেছি, বাবা,কাকাও নাকি বেশ কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন । দাদা অনেক খুঁজে, পেতে ধরে বেঁধে তাদের নিয়ে এসেছিলেন । মেজ কাকার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার ঘটনা তো আমার চোখের সামনে ঘটেছে ।

একবার তো মেজ কাকা একেবারে নিরুদ্দেশই হয়ে গিয়েছিলেন । সবাই ধরেই নিয়েছিলো আর ফিরে আসবেন না । কিন্তু তিন বছর পর ফিরে এসে বিয়ে সাদি করে সংসারী হয়েছিলেন।

আরে! এতো দেখছি আপনাদের বংশীয় রোগ । ঝন্টুর অবাক হবার ভঙ্গিতে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

চেরাগ আলীও একটু হেসে নিয়ে বললেন, তা বলতে পারো । বংশের ধারা তো আর সহজে মুছে ফেলা যায় না । তারপর থু থু করে বার দু’য়েক বাম কাধের পাশে থুতু ছেটাবার ভঙ্গি করে এক টুকরো সুপারি মুখে দিয়ে বললেন, কোন কিছু জানার প্রতি আগ্রহ বরাবরই আমার একটু বেশি ছিলো । নতুন কিছু একটা দেখলেই সেটার আদি অন্ত জেনে নেবার চেষ্টা করতাম ।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন ছিলো বৃটিশ আমল । চারিদিকে দেশ স্বাধীনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ইংরেজ তাড়াও আন্দোলন একটু একটু করে দানা বাঁধছে। একদিকে জিন্না সাহেব অন্য দিকে নেহেরু পুরো ভারত বর্ষ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি । সে সময় আমাদের গ্রাম থেকে ক্রোশ তিনেক দূরে সোনাতলা হাটে গিয়েছিলাম ছোট চাচার সাথে বড় বোনের বিয়ের কেনাকাটা করার জন্যে । কাকি মা, কাকা কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পরলে আমি পুরো হাট ঘুরে দেখতে শুরু করলাম । মেজ কাকা দু আনা পয়সা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যা হাটটা ঘুরে দেখ । সন্ধ্যার আগে আগে ঘাটে চলে আসবি । সে সময় দু'আনা মানে অনেক টাকা । মুরকি মোয়া কিনে দু'পকেটে পুরে খেতে খেতে হাটে হাটতে লাগলাম । প্রায় চারশো বছরের পুরাতন হাট । শুনেছি, সাহেবরাও নাকি এটা ওটা কিনতে মাঝে মাঝে এ হাটে আসতেন । চারিদিকে মহাজন, ক্রেতা-বিক্রেতার দর দাম হাক ডাক আর চিৎকারে পুরো হাট গমগম করছে । খাচ্ছি, দেখছি আর পর্যটকের মতো হাটছি ।

আমাদের তখন অনেকগুলো সওদাগরি নৌকা ছিলো । সে সব নৌকোয় করে বাবা, কাকারা পাট,সুপারি ,নারকেলসহ নানা দ্রব্য কলকাতা,করাচিতে নিয়ে বিক্রি করতেন। আসার সময় চন্দন কাঠসহ নানা পণ্য নিয়ে এসে ঢাকা,নারায়নগন্জ ও সোনারগাঁয় নিয়ে বিক্রি করতেন । সেটাই ছিলো আমাদের মূল পৈতিক ব্যবসা । বংশে হালদার হলেও তাই সওদাগর বাড়ি হিসাবে আমাদের বেশ নাম ডাক ছিলো ।

যা বলছিলাম, সোনাতলা হাটের ক্রেতা বিক্রেতার হাকডাক,বড় বড় দোকান পাট, সুন্দর সুন্দর পোষাক পরা লোকজন দেখতে দেখতে এক সময় হাটের মাঝখানে এক মজমায় এসে উপস্থিত হলাম । রোগা, পটকা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড় একটা ছেলে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে ভুল ভাল যাদু দেখিয়ে লোকজন জমায়েত করার চেষ্টা করছিল । জনা দশেক লোক গোল হয়ে দাড়িয়ে ছেলেটার কষরত দেখছিল আর হাসছিলো ।

গ্রাম, গন্জের হাটে এ ধরনের দৃশ্য নতুন কিছু নয় । ওষুধ, পথ্য, তাবিজ, কবজ বিক্রির জন্য গ্রামের হাটগুলোতে এ রকম দৃশ্য প্রায়:শ দেখা যায়। আমাদের বলতলা হাটেও এমন অনেক দেখেছি ।

মজমার মাঝখানে বসেছিলেন জটাধারী এক তান্ত্রিক । মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল । পিঠের এক তৃতীয়াং জুড়ে মস্ত এক কুঁজ । পরনে কালো দু’টুকরো কাপড়। এক টুকরো কোমরের নীচের অংশে লুঙ্গির মতো করে প্যাচানো। অন্য অংশটি কাধের উপর থেকে পেছনে ফেলে কুজটি ঢেকে রেখেছে । তান্ত্রিকের পাশেই বসেছিল খয়েরি রং এর লুঙ্গির উপর কালো রং এর ফতুয়া পড়া পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি । তারাও অন্যদের মতো ছেলেটার কষরত দেখছিলো আর নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা বলছিলো ।

ভীড় ঠেলে,লোকজনের ফাঁক ফোকর দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তান্ত্রীক লোকটার সাথে আমার চোখাচুখি হয়ে গেল । সে তার কুতকুতে রক্ত বর্ণের চোখ দুটো দিয়ে আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল । আমার কাছে মনে হলো, লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছি । কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারলাম না । সে চাহনিতে এমন কিছু ছিলো যে, বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

এ্যই দেখো , মজমা নিয়ে কথা বলছি, অথচ তোমরা এ যুগের ছেলে, ছোকরা তো জানই না মজমা কাকে বলে ?

কি, জানো নাকি মজমা কি ?

চেরাগ আলী সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন ।

মজমা কি তা চেরাগ আলীর বর্ণনায় থেকে পরিস্কার বুঝা গেলেও আমরা না সূচক মাথা নাড়লাম । আমরা চাচ্ছিলাম না গল্পে বাঁধা পড়ুক । মজমা হচ্ছে, কোনকিছু বেচা বিক্রির উদ্দেশ্যে গ্রাম,গন্জের হাট,বাজারে অনেক লোককে একটা জায়গায় জমায়েত করা ।

গ্রামে, গন্জে হাটে,বাজারে ওষুধ, পথ্য বিক্রির জন্য গ্রাম্য চিকিৎসক, কবিরাজ, সাপুরেরা এটা, সেটা দেখিয়ে প্রথমে লোকজন জমায়েত করতো । তারপর মজমা জমে উঠলে মোক্ষম এক সময় বেঁচা বিক্রির জন্য ওষুধ, পথ্য, তাবিজ, কবজ, মাদুলি বের করতো বিক্রির জন্য। এই যে লোকজন জমায়েত করা । এটাকে মজমা বলে ।

এমনটা তো বহু দেখেছি । ঝন্টু বলে উঠলো ।

হ্যা,সেটাকেই মজমা বলে । এখন আর আর গ্রাম গন্জের হাটে বাজারে মজমা খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। লোকজন শিক্ষিত হয়ে যাবার ফলে সমাজ থেকে এসব অপচিকিৎসা অনেকটাই বিদায় নিয়েছে । সোনাতলার হাটের সেই মজমায় যাদু দেখে তা শিখতে চেয়ে ভয়ানক তান্ত্রীকের খপ্পরে পরে গেলাম ।

অনেকক্ষন যাদু দেখিয়েও ছেলেটা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলো না । যারা জড়ো হয়েছিলো তারাও একসময় বিরক্ত হয়ে একে একে কেটে পরতে লাগলো ।

সবাই হাটে এসেছে কাজের উদ্দেশ্যে । কার ই বা এতো সময় আছে দীর্ঘক্ষন বসে এসব দেখার । চলতি পথে ভীড় দেখে একটু,আধটু মজা নেবার জন্য নেহায়েত কৌতুহল বশত দু'একজন দাঁড়ায় তাদের বেঁধে রাখা চাট্রিখানি কথা নয়।

মজমা ভেঙ্গে যাচ্ছে দেখে, কবিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে, ডাকাতের মতো হু.......... রে............ হু.....রে....হুরেরেরেরেরেরে বিকট শব্দ করে সকলকে চমকে দিলো ।

এই সময় বুড়ো, কুজো তান্ত্রিক উঠে দাড়িয়ে হাতে থাকা এক টুকরো লাল কাপড় নাড়তে নাড়তে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলতে লাগলেন, কী দেখিস? কি দেখিস । অবাক হয়ে দেখলাম, লোকটার হাতে কাপড় নয় জ্যান্ত একটা গোকরা সাপ নড়াচড়া করছে । মুর্হতে দৃশ্যপট পাল্টে গেলো । সাপের মুখ থেকে ফোসফোস শব্দে লোকজন জমে গেলো । এতো বড় সাপ আমি আগে কখনো দেখিনি । এভাবে কিছুক্ষন চলার পর তান্ত্রীক সাপের মাথাটা ধরে দুটো ঝাকি দিতেই সেটি আবার লাল কাপড় হয়ে গেলে । উপস্থিত সবাই অবাক বিস্ময়ে জমে গেলেও তুমুল কড় তালিতে কানে তালা লাগার যোগার হলো । আমার ভাবলার দেয়ালে তখন নানা প্রশ্ন জেগে উঠতে শুরু করেছে । অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম এটা কি করে সম্ভব ! লোকটা এক টুকরো কাপড়কে কি করে জ্যান্ত সাপে পরিণত করলো?

বিস্ময় তখনো অনেক বাকি ছিলো । কারণ এরপরই শুরু হলো আসল যাদু । তান্ত্রীক মুখ দিয়ে যা বলছিল, যা হুকুম করছিলো তাই তাই হয়ে যাচ্ছিল । এক টুকরো কয়লা হাতে নিয়ে তাতে ফু দিয়ে তান্ত্রীক বলল, যা,তুই পাখি হয়ে উড়ে যায় । সঙ্গে সঙ্গে সেই কয়লার টুকরোটি একটা পাখি হয়ে সকলের চোখের সামনে দিয়ে আকাশে উড়ে গেল।

মজমা ততোক্ষনে পুরোপুরি জমে গেছে । চারিদিক থেকে মানুষ এসে উপচে পরছে। আমি ও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি , যে করে হোক এই লোকের কাছ থেকে যাদু আমাকে শিখতেই হবে ।

তান্ত্রীক এরপর শুরু করলো ভেনিস করার যাদু । প্রথমে হাতে একটি আপেল নিয়ে সেটিকে একটু দূরে মাটির উপর রেখে বিনা স্পর্শে শুধুমাত্র আঙুলের ইশারায় গায়েব করে সকলকে আবার চমকে দিলো । এরপর একটি কুমড়ো, তারপর একটা জলজ্যান্ত মুরগী গায়েব করে দিয়ে তান্ত্রীক যখন ঘোষনা করলো, এবার সে গোটা একটা মানুষ গায়েব করে দিবে । তখন আর দেখে কে । এমন যাদু আশেপাশের দশ হাটে কেউ কোনদিন দেখেনি । তাই

পুরো হাট থেকে শত শত লোক এসে জড়ো হলো মজমার চারিদিকে। ধাক্বাধাক্কি শুরু হয়ে গেল । সুযোগ বুঝে, তান্ত্রীকের সাথে থাকা কবিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে, বলল, বাবা, শুধু যাদুতে তো আর পেট চলবে না । যদি অনুমতি দেন তো কিছু জনসেবা করি । তান্ত্রীক মাথা নেড়ে অনুমতি দিয়ে হাতের বাকা লাঠিটায় ভর করে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসলো ।

এরপর কবিরাজ কিছুক্ষণ গাছ,গাছড়া থেকে বানানো নানান রোগের ওষুধ, পথ্য বিক্রি শুরু করলো । এই অল্প সময়ে বেশে বেচা বিক্রি হলো । গ্রামের সহজ সরল মানুষকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই কবিরাজের কোমড়ে ঝোলানো থলেটা পয়সায় ভরে উঠলো ।

কবিরাজের ওষুধ, পথ্য বিক্রি শেষ হতেই সেই তান্ত্রিক উঠে দাঁড়িয়ে খিনখিনে স্বরে বলল, একজন এগিয়ে আয় তো। ছু মন্ত্রর ছু বলে গায়েব করে দেখাই । তারপর আপন মনে মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, গায়েব তো করতে পারবো ঠিকই কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারবো কিনা তা বলতে পারছি না ।

তখন দেখার মতো এক বিষয় হলো । ভেনিস বা গায়েব হয়ে যাবার ভয়ে কেউ আর তান্ত্রিকের কাছে এগিয়ে যায় না। সে যতোই ডাকে সবাই ততোই পিছিয়ে যায়। জীবনের মায়া কার না আছে । তার উপর যে বিকট দর্শন এই তান্ত্রিক । লোকটাকে দেখতেই ক্যামন ভয় লাগে । বুকের ভেতর অস্বস্তি হয় ।

কালো কুচকুচে শরীর । পিটের উপর কুজটায় লোকটাকে আরো ভয়ংক দেখাচ্ছে । কুজের ভারে লোকটা সামনের দিকে সব সময় নুয়ে থাকে । মাথার ঝটটা সাপের মতো বাকা হয়ে পরে আছে পিঠের একপাশে । বুক পর্যন্ত ঝুলে থাকা দাড়ির উপর দিয়ে উকি দিচ্ছে , সজারুর লেজের মতো কাচাপাকা একখানি গোঁফ । দেখতেই শরীর ভয়ে কেপে উঠে ।

আমি মজমার একেবারে সামনে গোটা তিনেক আমার বয়সি বাচ্চাদের সাথে মাটিতে আসন ঘেরে বসে মজমা দেখছিলাম। তান্ত্রীকের কথাবার্তা আর ভেনিস করে দেবার ক্ষমতা আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করে ফেলেছিল যে, মনে মনে ঠিক করে ফেললাম , যে করেই হোক এ যাদু আমাকে শিখতেই হবে । তখন কি আর জানতাম এ জন্য আমাকে কত বড় মূল্য দিতে হবে। কথার মারপ্যাচ আর ভাব, ভেলকি দেখানো এই ব্যাটা যে আসলে কত বড় এক ভন্ড ও নিম্ন পর্যায়ের তান্ত্রিক তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি ।

তবে এ জীবনে আসল সাধক বা তান্ত্রীকের দেখাও আমি কম পাইনি । সে সব অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের অন্য কোন সময় বলবো ।

যা বলছিলাম, অনেক ডাকা ডাকির পরেও যখন কেউ এগিয়ে এলো না । তখন তান্ত্রীকের ইশারায় কবিরাজ উঠে এসে নিজেই একে ওকে হাত ধরে টেনে সামনে আনার চেষ্টা করলেন । দু একজন কবিরাজের টানাটানিতে দু এক কদম এগিয়ে এলেও পরক্ষনেই তারা লাফ দিয়ে তিন কদমপিছিয়ে যাচ্ছিল । পুরো বিষয়টাতে চারিদিকে হাসির রো পড়ে গেল।

অনেকক্ষন পরেও যখন কেউ এগিয়ে এলো না । লোকের অভাবে যাদুটা দেখা যাবে না মনে করে কি ভেবে শেষমেশ আমিই এগিয়ে গেলাম ।

আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে , মজমার সবাই আর একবার হেসে উঠলো ।

তান্ত্রীক কিন্তু হাসলেন না । তিনি ঘাড় বেকিয়ে কিছুক্ষন আমাকে দেখলেন । তারপর এগিয়ে এসে হাতের বাকা লাঠিটি দিয়ে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার চার পাশে গোল একটা বৃত্ত একে ফেললেন ।

তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে বললেন, যা তোকে আটকে ফেললাম । আর বের হতে পারবি না । অতি সাহস, দু:সাহস । কথাটা বলে তান্ত্রীর দু'হাতে তালি দিয়ে খেকখেক করে হাসতে হাসতে নিজের আসনে গিয়ে বসল ।

প্রথমে বুঝতে পারলাম না কি বলছে। কিন্তু পর মুর্হুতেই বুঝতে পারলাম লোকটা আমাকে মন্ত্রবলে ওই বৃত্তটার মাঝে আটকে ফেলেছে। আশ্চর্য ! ব্যাপারটা বুঝা মাত্র একটু একটু করে শরীর অসম্ভব ভারী হতে লাগল । এতোটাই ভারী যে, এক সময় আমার আর নড়াচড়া করার শক্তি রইল না । মূর্তির মতো ঠাই বৃত্তের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম ।

তান্ত্রিক তখন চিৎকার করে উঠলো, বের হও, বের হ । পারলে বের হয়ে দেখা । অতি সাহস, দু:সাহস …. হা হা হা

আমি বের হবো কি । আমার তখন হাত,পা সব অসার হয়ে গেছে । শরীর জমে বরফ কলের বরফের চাইয়ের মতো শক্ত হয়ে গেছে ।

আমার বেগতিক অবস্থা দেখে উদ্ধার করতে এগিয়ে কবিরাজ । আমার কাছে এসে বলল, গুরু, ছোট মানুষ । ছেড়ে দিন । মাফ করে দিন।

তান্ত্রিক তখন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে এসে বললো, শুধু ,শুধু শক্তির অপচয় । যা, ছেড়ে দিলাম । বলে পা দিয়ে বৃত্তটার একটা অংশ মুছে আমার কাধে হালকা একটা টোকা দিয়ে বললেন, যা ভাগ …আমি দাঁড়নো থেকে পরে গেলাম । তান্ত্রীকের চোখে অগ্নি দৃষ্টি থাকলেও তাতেই সকলে কি এক মজা পেয়ে হো হো করে হেসে উঠলো ।

এরপর মজমা ভেঙ্গে গেলো । সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে কবিরাজ তান্ত্রীকের পায়ের সামনে লাল কাপড়ের উপর কিছু পয়সা গুছিয়ে রাখলো। তারপর পা ছুয়ে সালাম করে চলে গেলো । তান্ত্রীক আরো কিছুটা সময় সেখানে বসে থেকে। কালো রং এর ঝোলাটা, বা কাধে ঝুলিয়ে নিয়ে । সাপের মতো বাকা লাঠিটা ঝোলার হাতলে ঝুলিয়ে হাটতে শুরু করলো ।

ততোক্ষনে আমার শরীর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । হাত পায়ের ঝিমঝিম ভাবটাও কেটে গেছে । মাথাটা শুধু তখন ও একটু ভার ভার হয়েছিলো । মাটির উপর বসে এতোক্ষন তান্ত্রিকে কাজকর্ম দেখছিলাম আর মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, যে করে হোক তান্ত্রিকের কাছ থেকে যাদু বিদ্যা আমাকে শিখতেই হবে । যে ভাবনা সেই কাজ । তান্ত্রীক হাটতে শুরু করতেই আমি তার পিছু নিলাম ।

তিন

ছোট ছোট কদম ফেলে লোকজনের ভীড় ঠেলে ধীরে ধীরে তান্ত্রীক হাট থেকে বের হয়ে স্টীমার ঘাট পেছনে ফেলে মহকুমার রাস্তায় এসে দাঁড়ালো । তারপর বিশ খালীর নদীর তীর ধরে হাটতে লাগলো।

তান্ত্রীকের পিছু পিছু ঘন্টা দু'য়েক হাটার পর লোকালয় থেকে বহু দূরে চলে এলাম । এই দীর্ঘ সময়ে সে কিন্তু একটি বারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায়নি । আমিও বেশ একটা দূরত্ব রেখে চলেছি । চারিদিকে বিস্তীর্ণ জোড়ানো ধান ক্ষেত এক পাশেই বিশাল বিষখালী নদী । কলকল, ছলছল করে বয়ে চলেছে নদীর জল ।

সে নদীর ঘা ঘেষে সাপের মতো একেবেকে চলে গেছে মেঠো পথ । সে পথে লোকজনের চলাচল খুব একটা দেখা দেখা যায় না । কোথায় চলেছি, কতদিনের জন্য চলেছি । কবে ফিরবো, আধোও ফিরতে পারবো কি না তার কিছুই জানি না। শুধু এটুকুই জানি, ভেনিস করার যাদু আমাকে শিখতেই হবে আর এই লোকটাই শুধু পারে আমাকে তা শেখাতে ।

এভাবে আরো ঘন্টা খানেক হাটার পর । নদীর চর ঘেষে বড় বড় শাল,মেহগনি,কড়াই গাছ ঘেরা একটা উচু জায়গার সামনে এসে তান্ত্রিক দাঁড়িয়ে পরলো ।

ভাল করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম এটা একটা শ্মাশান । রাস্তা থেকে অল্প কিছু দূরে নদীর শরীর ঘেষে নানান গাছে ঘেরা বিশাল এক এলাকা । রাস্তা আর এই্ উচু এলাকারটির মাঝখানে ছোট একটা জলাশয় দুইয়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছে । জোয়ার, ভাটায় জলাশয়ে পানি উঠা নামার চিহৃ পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে। রাস্তা ও নদীর গা ঘেষে এখানে সেখানে ছোট ছোট কিছু নল খাগরার বন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । ফলে শ্মাশানটিকে দ্বীপের মতো মনে হয় ।

তান্ত্রীক রাস্তা ঢাল বেয়ে নেমে জলাশয় পেরিয়ে উচু জায়গাটিতে গিয়ে দাঁড়ালো । তারপর একটা বড় গাছ দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝোলার উপর থেকে লাঠিটি হাত নিয়ে গাছে গুঁড়িতে ঠুকঠুক করে আঘাত করতে লাগলো । সাথে সাথে চি, চি,কিচির মিচির করে শত শত পাখি ভয় থেকে গাছ থেকে একসাথে এদিক ওদিক উড়ে পালাতে লাগলো । ভয়াত পাখিদের ডানা ঝাপটাবার শব্দে চারিদিকে মূর্হতে এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হলো । কিছু পাখি আকাশে উঠে গিয়ে মাথার উপর চক্কর কাটতে লাগলো ।

বিষয়টা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম । কিছুতেই ভেবে পেলাম না, "যে গাছটির বেড় তিন, চার জন লোক গোল হয়ে দাড়ালেও পাবে কিনা সন্দেহ আছে , সে গাছের মোটা মোটা ডালগুলো তান্ত্রীকের হাতের ঠুনকো এক লাটির আঘাতে কিভাবে নড়ে উঠলো?" অবাক আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ।

এরপর তান্ত্রীক চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হাতের লাঠিটা দিয়ে মাটিতে পরপর দু'টো আঘাত করে কিছু একটা দেখে নিলো । তারপর একটা বৃত্ত একে ঝুলিটা তার মধ্যে নামিয়ে রেখে গাছে হেলান দিকে রাস্তার দিকে মুখ করে বসে পড়লো।

আমি তখনো রাস্তার উপরে দাড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ হা করে তাকিয়ে পাখিদের চক্কর খাওয়া দেখছি । পাখিদের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে তান্ত্রীকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, তান্ত্রিক আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর সে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন । কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো । স্পস্ট শুনতে পেলাম বুকের ভেতরের কম্পন । মনে হতে লাগলো তাবত জগৎ সংসার আমাকে এগিয়ে যেতে নিষেধ করছে । তান্ত্রিকের কাছে যাবো না ফিরে যাবো । সে দো-টানায় ভুগতে লাগলাম । হঠাৎ চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো ।

তবুও অদৃশ্য টানে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক পা, দু পা করে এগিয়ে যেতে লাগলাম । যতোই লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততোই ভয়াল একটি অনুভুতি চেপে ধরতে লাগলো । ভেতর থেকে কারা যেনো বলে উঠতে লাগলো,, যাসনে, যাসনে, যাসনে ওর কাছে ।ভয়ানক এক পরিনতি অপেক্ষা করছে তোর জন্য । কিন্তু অদৃষ্টের ফের কে রুখতে পারে । আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে জলাশয় পেরিয়ে এক সময় গিয়ে দাঁড়ালাম তান্ত্রীকের সামনে ।

কাছে যেতেই সে আমাকে হাতের ইশায়ায় বসতে বললো । আমি বসা মাত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি রে, তন্ত্রমন্ত্র শিখতে চাস, তাই না?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, হ্যাঁ, শিখতে চাই ।

তান্ত্রিক বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এ পথ অনেক কষ্টের। অনেক ত্যাগের । পারবি এতো কষ্ট সহ্য করতে।

আমি আবারো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম ।পারবো , পারবো আমাকে যে পারতেই হবে । আমি ও তান্ত্রিকের মতো এটা ওটা অদৃশ্য করে ফেলতে চাই ।

তান্ত্রিক চোখে মুখে অবজ্ঞা মিশ্রিত একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, এ এক, দু'দিনের শিক্ষা নয় রে । তাপস্যা করতে যুগযুগ লেগে যায় । তুই পারবি না । যা বাড়ি ফিরে যা । এ পথ তোর জন্য নয় ।

আমি মাথা নাড়লাম, না । যাবো না । আমি তন্ত্রমন্ত্র শিখবো । আমি সব পারি । এটাও পারবো ।

এরপর তান্ত্রীক হাত নাড়িয়ে আশপাশটা দেখিয়ে বলল, এই যে জায়গাটা দেখছিস, এটা শশ্মান । এ রকম শশ্মানে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত থাকবে হবে । শব সাধনা করতে হবে । বিসর্জন দিতে হবে । পারবি, পারবি ? বলে তান্ত্রীক খিকখিক করে হেসে উঠলো । সে হাসিতে মনে হলো, আশেপাশের সব চমকে উঠলো । ভয়ে আতকে উঠলেও আমার ততোক্ষনে গো চেপে গেছে। ভয়টাও কমে এসেছে । মাথা নেড়ে বললাম , পারবো । কি করতে হবে শুধু একবার আদেশ করুন ।

আমার বলার ধরনের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিলো যে তান্ত্রীক কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে । থাক তবে। রাতে তোর পরীক্ষা হবে যদি সব পরীক্ষায় পাশ করিস, তবে শিখিয়ে দেবো অনেক কিছু ।

এরপর তান্ত্রীক ঝোলা থেকে পিতলের আধ পোড়া একটি ঘটি বের করে আমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, যা নদী থেকে জল নিয়ে আয় । বড্ড তেস্টা পেয়েছে । গুরু সেবা করতে হবে । বুঝলি, গুরু সেবা । এর পর তান্ত্রিক ফ্যাসফ্যাসে গলায় গান ধরলো , সেবায় মিলে মুক্তি / ভক্তিতে মিলে বল/ গুরু ভজন বিনে / হয়না সাধন ..............।

ঘটি হাতে নদীর চরায় চলে এলাম। নদীতে ভাটার টান লেগেছে । কচুরী পানার দল ঝাক বেধে ভেসে যাচ্ছে ভাটার টানে । নদীতে পানি কমে যাওয়ায় চরের কাদা বালি দেখে যাচ্ছে । যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি । বহুদূরে নদীর ওপারের গ্রামের গাছ পালাগুলো ঝাপসা দেখা যায় । রোদের তেজ কমে গেছে । হালকা মিষ্টি একটা বাতাস এসে শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে ।

হঠাৎ ক্ষুধায় পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো । মনে পরে গেলে সেই সকালে খাওয়া হয়েছে । মা নিশ্চয় ভাত নিয়ে বসে আছেন ।কেন যেন মার জন্য মনটা টনটন করে উঠলো । আজব এক যন্ত্র মানব মন । এক মূর্হতে কত কি ভেবে ফেলে !

নদীর চড়া’য় নেমে । ঘোটিটি পানিতে ভাসিয়ে রেখে । হাত মুখে ধুয়ে নিলাম । ঠান্ডা পানির ছোয়ায় মূহুর্তে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল । আজলা ভরে নদীর পানি পান করতেই ক্ষুধায় আবারো পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল ।

চোখে, মুখে আবারো পানি দিয়ে , ঘোটিটা পানি ভরে ঘুরে দাঁড়াতেই হাতের ডান পাশের চরায় দেখতে পেলাম , একটা কুকুর ছানা আধ মরা হয়ে কাদায় আটকে আছে । শরীরটা এমন ভাবে কাদায় আটকে আছে যে, শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না ।

প্রথমে অদ্ভুত কিছু ভেবে চমকে উঠলে ও পর মুর্হুতেই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ছুটে গিয়ে , কাদা থেকে টেনে বের করে আনলাম কুকুরের ছানাটিকে । তারপর পানিতে ধুয়ে পরিস্কার করতেই বের হয়ে এলো কালো রং নাদুস নুদুস এক কুকুরের ছানা । ব্যাচারা ! দীর্ঘ সময় কাদায় আটকে থাকার ফলে ঠান্ডায় কুচকে গেছে । আর একটু হলে মরতো। পানি খাওয়ার জন্য চরায় নেমে কাদা বালিতে আটকে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে । মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে যায় কিন্তু প্রাণীরা ভুলে না । উদ্ধার পেয়ে কুকুর ছানাটি আমার দিকে তাকিয়ে পুই পুই করে লেজ নাড়তে লাগলো ।

হঠাত ঘটিটির কথা মনে হতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি , স্রোতের টানে সেটি অনকেটা বেশ ভেসে গেছে। দৌড়ে গিয়ে সেটিকে তুলে নিলাম । এই অল্প একটু কসরতে আমার পরনের প্যান্ট ও জামার অনেকটা অংশ ভিজে গেলো ।

ভিজে কাপড়ে থাকতে হবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো । ঘটিটা দু পায়ের মাঝখানে আটকে রেখে জামা খুলে নিংড়ে, বার দুয়েক ঝেরে নিলাম । তারপর উপড়ে উঠার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম । কুকুরের ছানাটিকে কোলে নিয়ে অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । পরনে হালকা সাদা রং একটা শাড়ি । চুলগুলো পেছনের দিকে ছেড়ে রেখেছে । পরন্ত বিকেলের সূর্যের আলো মেয়েটির মুখের উপর পরায় তাকে দেবীর মতো লাগছিলো । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটি হাসি হাসি মুখ করে বা কোলে কুকুরটিকে নিয়ে ডান হাত দিয়ে কুকুরের ভেজা শরীরে হাত বুলাচ্ছে । হারিয়ে যাওয়া কুকুর ছানাটিকে ফিরে পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছে সেটা তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ।

এমন নির্জন জায়গায় মেয়েটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । আশে পাশে কোন ঘর বাড়ি কিংবা জন বসতি চোখে পরেনি যে মেয়েটি সেখানে থেকে আসবে । অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে। কতক্ষন এভাবে কেটে গেলো বলতে পারবো না । হঠাৎ টুক করে একটা শব্দ হতেই যেন শংকিত ফিরে পেলাম । হাটুর দিকে তাকিয়ে দেখি হাত দেড়েক একটা চিতল মাছ ঘটিটির ভেতরে ঢুকে লেজ ঝাপটাচ্ছে।

এ যেন আরেক অবাক হবার বিষয় । দ্রুত মাছটিকে ধরে উপড়ে তাকাতেই দেখি কেউ নেই । মেয়েটি নেই । প্রায় লাফিয়ে উপড়ে উঠে এলাম । আশে পাশে যতোদূর চোখ যায় রাস্তা, রাস্তার ও পাশে খোলা দিগন্ত আর হাতে ডান পাশে বড় বড় গাছে ঢাকা শ্মাশন । কয়েক মুর্হুতের মধ্যে এ টুকু পথ হেটে চোখের আড়ালে চলে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয় । তাহলে মেয়েটি গেলো কোথায় ? একবার ভাবলাম, হতে পারে মেয়েটি তান্ত্রীকের কাছে এসেছে । সেখানেই গেছে । কিন্তু সেটা হলে ও তো চোখের পলকে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া সম্ভব নয় ।

হঠাৎ হাতের মাছটি নড়ে উঠায় আমি সেটির দিকে তাকালাম । সাদা আশকে যুক্ত মাছটি দেখেতে খুব সুন্দর । মাথা থেকে পেটের মাঝ বরাবর সোনালী,নীল রং একটি ঝিলিক দেয়া রেখা নেমে গেছে লেজ পর্যন্ত । পানি থেকে উপরে উঠায় অক্সিজেনের অভাবে মাছটি বারবার মুখ খুলছে আর বন্ধ করছে । ঘটিটি ঘাসের উপর রেখে পানিতে নেমে মাছটিকে পরম যত্নে পানিতে ছেড়ে দিলাম । একটু নাড়াচাড়া দিতেই সাতরে সেটি গভীরে জলে চলে গেল। তারপর হাতে ধুয়ে নদী থেকে উঠে এলাম ।

নদী হতে ফিরে এসে দেখি বেশ কিছু লোক তান্ত্রিককে ঘিরে গোল হয়ে বসে আছে । আমি সেখানে পৌছতেই তান্ত্রীক আমাকে দেখিয়ে , লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বলল, এই যে এসে পরেছে । বলেছিলাম না চিন্তার কিছু নেই । দেখেছিস তো ? গুরুর উপর আস্থা রাখতে হয় ।

‘এদিকে আয়” বলে তান্ত্রীক আমাকে কাছে ডেকে আমার হাত থেকে ঘটিটা নিয়ে দু’ঢোক পানি খেয়ে নিলেন ।

তারপর ঝোলা থেকে একটা বাটিতে কিছু মুড়ি আর এক দলা গুড় আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "খেয়ে নে, রাতে রান্না হবে । তখন ভাল মন্দ খেতে পাবি । এখন এটা খেয়ে ফেল । এখনো সময় আছে ভেবে দেখ। থাকবি না, না চলে যাবি ? এখনও সময় আছে চিন্তা করে বল । কি থাকবি ? নাকি চলে যাবি ?"

আমি বললাম, থাকবো ।

ঠিক আছে । আজ রাতে পুজোর পরে তোকে দীক্ষা দেবো । তারপর শুরু হবে তোর অন্য জীবন । এখন এই মুড়ি খেয়ে যা কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয় ।

আমি মাথা নেড়ে বললাম.আচ্ছা ।

মুড়ির বাটি হাতে একটু দূরে সরে গিয়ে একটা গাছের নিচে বসে খেতে লাগলাম । তান্ত্রীককে ঘিরে বসে থাকা বিকট দর্শন লোকগুলো এতোক্ষন বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো । আমার সাথে চোখাচুখি হতেই তারা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কথা বলতে লাগল। তান্ত্রীক গাছে হেলান দিয়ে বিশ্রামের ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন । দেখে মনে হলো গভীর ধ্যানে তলিয়ে গেছেন । আমি আপন মনে মুড়ি আর গুড় খেতে লাগলাম । খেতে খেতে এক সময় মনে হলো । যতোই খাচ্ছি মুড়ি কিংবা গুড় কোনটাই শেষ হচ্ছে না । মুড়ি শেষ করার জন্য বেশি বেশি করে খেতে লাগলাম কিন্তু বাটির মুড়ি একটুও কমলো না । আমার কষরত দেখে লোকগুলো হেসে উঠলো ।

তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে । আমাকে তাকাতে দেখে বলল, কি ক্ষুধা মিটেছে ?

আমি হ্যা বললাম । সাথে সাথে বাটির মুড়ি ও গুড় দুটোই শেষ হয়ে গেলো ।

এমন সময় তান্ত্রিক হাক দিলেন , এই চিনু যা , ছোড়াটাকে নিয়ে কাঠ কুড়িয়ে পুঁজোর আয়োজনটা সেরে ফেল ।

যাই বাবা বলে রোগা পাতলা এক চোখ কানা একটা লোক উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “চল হে ছোড়া কাঠ কুড়িয়ে আনি।” কথাটা বলে লোকটা আর দাঁড়ালো না হন হন করে শ্মানের ভেতরের দিকে হাঁটতে লাগল । খালি মুড়ির বাটিটা গাছের নিচে রেখে আমিও তার পিছু পিছু হাটে গেলাম ।

চলবে .....।
চেরাগ আলী ও তান্ত্রীক

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুন, ২০২২ সকাল ১০:২৩

জুল ভার্ন বলেছেন: প্রথম পর্বের ভৌতিক সুচণা থেকে দ্বিতীয় পর্বে ভৌতিকতা অনেক জটিলতার দিকে এগিয়ে আছে।

০২ রা জুন, ২০২২ সকাল ১০:৩৫

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: শুভ সকাল ! প্রিয় জুল র্ভান । পড়ার জন্য ধন্যবাদ

২| ০২ রা জুন, ২০২২ দুপুর ১২:০৬

মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন: জমে উঠেছে কাহিনী।
তবে বেশ দীর্ঘ হয়ে গেছে।

০২ রা জুন, ২০২২ দুপুর ১২:২৫

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । চেরাগ আলী গল্পবাজ মানুষ, কম কথায় কিছু বলতে পারেন না । দুনিয়ার সবাইকে শুধু ই জ্ঞান দিয়ে বেড়ায় । আপনার কথা বলবো তাকে । তাতে যদি কিছুটা শোধরায় । ভাল থাকবেন । শুভ কামনা আপনার জন্য ।

৩| ০২ রা জুন, ২০২২ দুপুর ১২:৪০

সোনাগাজী বলেছেন:



আমার মনে হয়, আমার মনের মাঝে জ্বীন, পরী, ভুত, পেত্নী না'থাকায়, এসব প্লট যেন কেমন কেমন লাগে।

০২ রা জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৬

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: এটা কিন্তু ভাল , মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ , শুভ ব্লগিং

৪| ০২ রা জুন, ২০২২ দুপুর ১:১১

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। ভাষা সহজ সরল। লেখা চলুক।

০২ রা জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৫

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ধন্যবাদ

৫| ০৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৭

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: পড়েছি, ভালো লেগেছে।

০৬ ই জুন, ২০২২ সকাল ১১:৩৬

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ধন্যবাদ , দু একজন পাঠকের মন্তব্যেই লেখার কষ্টটা স্বার্থক হয়ে যায় । ভাল থাকবেন ।

৬| ০৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ১২:৪২

অপু তানভীর বলেছেন: শুরুর পরের পর্বে কাহিনীর গাধুনী চমৎকার ভাবে এগিয়ে চলেছে । এতো দিন অপেক্ষা করেছি একবারে পড়বো বলে !

১৭ ই জুন, ২০২২ দুপুর ২:১৫

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আপনাকে। ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.