নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে \"আমার কবিতা নামে\" আমি ব্লগিং করি মূলত নিজের ভেতরে জেগে উঠা ব্যর্থতা গুলোকে ঢেকে রাখার জন্য । দুনীতিবাজ, হারামখোর ও ধর্ম ব্যবসায়িদের অপছন্দ করি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন

আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সওদা - ভৌতিক রহস্য গল্প (৩য় পর্ব)

১২ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৩



তিন

মধুমিতা মেসের সামনে ছোট খাটো একটা ভীড় জমে আছে। আশে পাশের দশ বাড়ি থেকে কিছু অতি উৎসাহী লোকজন মেসের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে।
মূল রাস্তায় দু’টো পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।
অনেকক্ষণ হাঁটার ফলে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছি । মনে হচ্ছে গোসল করতে পারলে ভাল লাগতো । সারাদিন প্রচন্ড দখল গেছে শরীরের উপর দিয়ে । কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে এতো লোকজন কেন জড়ো হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম না । পুলিশের ভ্যানই বা কেন এসেছে । কোন অঘটন ঘটে নিতো ! আমার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।
কৌতূহল নিয়ে মেসের ভেতরে ঢুকার জন্য পা বাড়াতেই গেটের কাছে পুলিশের একজন এসআই পথ রোধ করে দাঁড়াল । আমাকে আপাতমস্তক এক নজর দেখে নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো , “ত্র্যাই, এইখানে কি ?”
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো । লোকটার দিকে তাকিয়ে আমিও পাল্টা খেঁকিয়ে উঠলাম, এখানে কি মানে কি? মানুষ হচ্ছে শক্তের ভক্ত নরমের যম । পাল্টা খেকিয়ে উঠায় কাজ হলো ।
এবার এসআই একটু নরম স্বরে বলল,এতোরাতে এখানে কি চাই?
আমি বললাম,আমি এখানে থাকি।ভেতরে যাবো।
এখানে থাকেন?
আমি বেশ ধীঢ়তার সাথে বললাম, জ্বি, এখানেই থাকি,
কি নাম আপনার ?
ছোট্র করে বললাম, রন্জু ।
তা,এতরাতে কোথা থেকে এলেন মিস্টার রঞ্জু সাহেব ?
কাজ ছিলো তাই ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।
কি কাজ ?
এফডিসিতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ।
এফডিসি! এফডিসির কথা শুনে লোকটা আমার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকালো । তারপর নরম সুরে বলল,কি করেন আপনি, মানে আপনার প্রফেশন কি?
লেখালেখি করি। গল্প, উপন্যাস , চিত্রনাট্য লিখি ।
- ও বই লিখেন ?লোকটা কি বুঝে কি প্রশ্ন করল বুঝলাম না ।
পুলিশ আর পাগলের সাথে তর্কে যেতে নেই । যা ইচ্ছে বুঝুক, যা ইচ্ছে করুক আমার কি। মনে মনে হাসলাম এই ভেবে যে,আজ পাগল ও পুলিশ দু'জনের সাথেই দেখা হয়ে গেলো। ঝামেলা আর বাড়াতে না চেয়ে মাথা নেড়ে আমি তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, হ্যাঁ, বই লিখি।
কতোদিন ধরে থাকেন এখানে ? এসআই তার হাতের লাঠিটা উচিয়ে মেসটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলো।
আমি বললাম, বছর তিনেক হবে।
- স'দু সাহেব'কে চিনেন ?
আমি কপাল কুচকে বললাম, চিনবো না কেন ? তিনি এই মেসের মালিক । খুব ভাল করেই চিনি।
- আছ্ছা বলুন তো, উনি ক্যামন মানুষ ছিলেন, মানে, কারো সাথে কোন রকম ঝুট ঝামেলার কথা কি শুনেছেন কখনো ?
আমি মাথা নেড়ে না করে বললাম , উনি স্থানিয় মানুষ । যতোদূর দেখেছি ছোট, বড় সবার সাথেই ওনার খুব ভাল সর্ম্পক । কারো সাথে কোন ঝুট ঝামেলা আছে বলে জানি না ।
স'দু ভাইয়ের নাম শুনে ভেতরটা ক্যামন যেনো করে উঠলো । বুঝলাম না, পুলিশ স'দু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছে কেন ?

কাউন্টারের কাছে ম্যানেজার বদরুলকে দেখলাম দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে, ফুপিয়ে কাঁদছে । কাদছে না বলে বলা যায়, কান্নার ভান করছে । এতো বড় একজন মানুষের কান্নার অভিনয় দেখতে ভাল লাগেনা । তার উপরে বদরুলকে তো আরো না ।
প্রচন্ড রকমের বদ এই বদরুল। মেস বোর্ডারদের কারো সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না । সুযোগ পেলেই পানি,বিদ্যূত বন্ধ করে দেয় । স'দু ভাইয়ের কাছে বোর্ডারদের নামে বানিয়ে বানিয়ে বিচার দেয়া তো ওর নিত্য নেমিন্তিক ব্যাপার । সবার সাথে গায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করে । তার উপর, প্রতি দিনের মিল থেকেও নাকি টাকা চুরি করে ।
আমাকে দেখে বদরুল, রন্জু ভাই গো, বলে ছুটে এসে জরিয়ে ধরল ।
বদরুল লোকটাকে আমার বিশেষ পছন্দ না । আমি পারত পক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলি না । স'দু ভাই আমাকে বিশেষ খাতির করেন বলে বদরুলও আমাকে এড়িয়ে চলে । কখনো লাগতে আসে না ।
সেই বদরুলের নাটকিয় ভাবে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না ।
মানুষের আবেগকে কখনো উপেক্ষা করতে হয় না । হোক না সে যতোই মন্দ মানুষ । কিন্তু বদরুলের ব্যাপারটা ভিন্ন ।
আমি বদরুলকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম অথচ শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম; “কি হয়েছে বদরুল ? ”
বদরুল তার নাটকটা জমাতে চেষ্টার কমতি করলো না, সুর করে, সদু ভাই,বলে আবারও কাঁদতে লাগল । আমি পরিস্কার বুঝলাম ব্যাটা অভিনয় করছে ।
নিজেকে সংযত করে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলাম, সদু ভাই কি ?
বদরুল কিন্তু অভিনয় ছাড়লো না, আগের মতো ই কাদতে কাদতে বললো, সদু ভাই, সদু ভাই আর নেই।
নেই মানে ? কোথায় গেছেন ? ভণিতা না করে আসল কথা বলো ।
আমি অস্থির হয়ে উঠলাম ।
সদু ভাই, সদু ভাই আত্মহত্যা করেছেন । বলে বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। এবার আর ওর কান্নাটাকে অভিনয় বলে মনে হলো না ।
আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, “এই কি বলছিস তুই ? সদু ভাই কেন আত্মহত্যা করতে যাবে ?"
জানি না কেন ? ভালা মানুষ, রাতে সবার সাথে ডাইনিং এ বসে খাওয়া দাওয়া করার পর নিজের রুমে গিয়ে আমারে ডেকে বললো, তুই রাইটার সাবের রুমে খাবারটা দিছে কি না খোঁজ নে । আমি একটু বিশ্রাম নেই ।
আপনার রুমে খাবার দিছে কিনা সেই খবরটা রেহানার মাকে জিজ্ঞাসা করে আইসা দেখি স'দু ভাইয়ের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ । অনেক ডাকাডাকি করার পরেও উনি দরজা খুললো না । ঘুমায় পরছে মনে কইরা আমি নিজের রুমে চইলা গেলাম ।
পরে বুয়া আইসা ডাইকা নিয়া বললো সদু ভাই নাকি ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে । দৌড়ে গিয়া দেখি সত্যিই ভাইয়ে ফ্যানের লগে ঝুলতাছে । বলেই বদরুল ভ্যা ভ্যা করে কাদতে লাগলো ।
স'দু ভাইয়ের মৃত্যুর বর্ণনা শুনে আমি যারপর নাই চমকে উঠলাম , বলে এরা । স'দু ভাই কোন দু:খে আত্মহত্যা করতে যাবে ।
বদরুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, সদু ভাই এখন কোথায় ?
বদরুল চোখের পানি মুছতে মুছতে দোতালায় যাবার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলো ।
দোতালার শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটা রুম আছে । স'দু ভাই সেটাকে অফিস রুম হিসাবে ব্যবহার করেন । চেয়ার টিবিলের পাশে সিঙ্গেল একটা খাট বিছানো আছে । মাঝে মাঝে রাতে থেকে গেলে সেটাতে স'দু ভাই ঘুমান।
আমি এসআই'য়ের দিকে উপড়ে যাবার জন্য অনুমতি পাবার দৃষ্টিতে তাকালাম । এসআই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, যান। তবে কোন কিছু স্পর্শ করবেন না । এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।
ঠিক আছে, বলে আমি দৌড়ে দোতালায় উঠে এলাম। দোতালার বারান্দায় চেনা, অচেনা অনেক মানুষ । তাদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ ও রয়েছে । আমার রুমটা দোতালার মাঝামাঝি । আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে। বারান্দায় যারা দাড়িয়ে ছিলো তাদের মধ্যে যারা আমাকে চেনে তারা সরে গিয়ে শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের রুমের দিকে যাবার জন্য রাস্তা করে দিল ।

সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । সত্যি সত্যি স'দু ভাইয়ের বিশাল দেহটা ফ্যানের সঙ্গে বিশ্রী ভাবে ঝুলছে । জ্বিহবা মুখ থেকে বের হয়ে আছে । চোখ দু’টো খোলা । বিশাল দু'টো হাত দুপাশে ছড়ান । পুরো শরীরে কোন কাপড় নেই । পা দু'টো মেঝের সাথে লাগানো । এমন দৃশ্য কল্পনাও ছিলো না । কয়েক মূর্হুতের জন্য আমার মাথা ঘুড়ে উঠলো । মনে হলো আশে পাশের সব কিছু ভনভন করে ঘুরছে । কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

কিছুতেই বুঝে এলো না , স'দু ভাই কেন আত্মহত্যা করতে যাবে । সকালেও তো কতো আদর করে বিদায় দিলেন । আমার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি নেমে এলো ।

থানা থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো । পুলিশ মেসের বর্ডারদের থানাতে না জানিয়ে দূরে কোথাও না যাবার নির্দেশ দিয়ে চলে গেল ।

ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। ইতিমধ্যে আমি একটু ধাতস্থ হতে পেরেছি । সদু ভাই নেই । কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা ক্যামন করে উঠছে। বারবার সদু ভাইয়েই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।

রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের উপর আমার রাতের খাবার ঢেকে রাখা অবস্থায় রয়েছে। ভদ্রলোক সব সময় আমার খেয়াল রাখতো । আহা! বলে বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো । আমি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম । বুক চেপে ধরে খাটের উপর বসে পরলাম।
হঠাৎ এফডিসির বাইরে দেখা লোকটার কথাটা কানে ভাসতে লাগল, তোর তো আপন কেউ নেই , তাই হারাবার ও কিছু নেই । তুই তাহলে রাজি ? তুই তাহলে রাজি ? এখন আমার কাছে মনে হতে লাগলো সদু ভাই আমার আত্মীয় না হয়েও আত্মীয়ের চেয়ে অনেক বেশি আপন ছিলেন ।


চার


পরের দিন সাড়ে ১২টার সময় দরজায় প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙল । তাড়াহুরো করে উঠে দরজা খুলে দেখলাম বদরুল দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই দাড়িয়ে আছেন পরিচালক এ'তে শামস্ সাহেব। হঠাৎ তাকে এখানে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম ।

আমার মেসে এ'তে শামস্ এর মতো পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি । আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম," স্যার আপনি ?"

- দেখো দেখি তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম । এসে শুনি তোমার মেসের মালিক মারা গেছেন । চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আজ ই আমাকে আবার ব্যাংক চলে যেতে হচ্ছে । তাই ভাবলাম, এসেছি যখন দেখাটা করেই যাই । তুমি দেখছি বিধ্বস্ত হয়ে আছে । যদি একটু সময় দিতে, তা হলে কয়েকটা কথা সেড়ে নিতাম । অবশ্য এখানে দাড়িয়েও বলতে পারি ।কথাটা বলে তিনি বদরুলের দিকে তাকালেন ।

আমি অস্থির হয়ে বললাম , আপনি ভেতরে আসুন স্যার । স'দু ভাই , মানে যিনি মারা গেছেন তিনি আপনার অনেক বড় ফ্যান ছিলেন । আপনার দূর দেশে ছবিটা উনি ১০০ বারের উপর দেখেছেন । আপনি এখানে এসেছেন উনি বেচে থাকলে যারপর নাই খুশি হতেন ।

আপনি ভেতরে এসে বসুন । আমি এক মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি । আমি দরজা থেকে সড়ে দাঁড়ালাম ।

এই প্রথম রুমের ভেতরের অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা লাগল । এ'তে শামস্ সাহেব চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরলেন ।
আমি বললাম, স্যার যদি কিছু মনে না করেন ; আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি । তিনি মাথা নেড়ে বললেন, সিওর । তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, তোমার এখানে আসট্রে নেই ? সিগারেট ছাড়া আমি আবার একদম থাকতে পারি না।

আমি খাটের নীচ থেকে একটা ভাঙা চায়ের কাপ অনিচ্ছা সত্যেও বের করে টেবিলের উপর রাখলাম । কাপটা দেখে তিনি হেসে সিগারেট ধরালেন ।

আমি বদরুলকে চা দেবার কথা বলে বাথরুমে ঢুকে গেলাম ।


এ'তে শামস্ সাহেব আমাকে দু’লাখ টাকার একটা ক্যাশ চেক দিয়ে একটা কাগজে সাইন করিয়ে নিলেন । কথা হলো উনি আমার চিত্রনাট্যটি নিয়ে কাজ করবেন । শুটিং শুরু হবে মাস দু’য়েকের মধ্যেই । তখন আরো তিন লাখ পেমেন্ট করবেন ।জীবনের প্রথম সাফল্যে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম । উত্তেজনায় কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে সেটা ভাল করে না পড়তেই সাইন করে চেকটা হাতে নিলাম ।

হঠাৎ সদু ভাইয়ের জন্য ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল । আহা! মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ সব চাইতে বেশি খুশি হতেন । অথচ আমার সাফল্যে তিনি দেখে যেতে পারলেন না ।

সন্ধ্যার পর স'দু ভাইকে বংশাল কবরস্থানে দাফন করা হলো । মানুষটা যে কতো জনপ্রিয় ছিলো তা তার জানাজায় উপস্থিত লোক সংখ্যা দেখে বুঝা গেলো । মেসের ১০০ জন বোর্ডার ছাড়াও পুরো এলাকাবাসী উপস্থিত হলো মসজিদ ও কবরস্থানে ।

সদু ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেসটা যেন অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে । দোতালার বেশ কয়েকজন বর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে মেস ছেড়ে চলে গেছে ।

কথায় আছে, গুজব ছাড়াতে দশ কান লাগে না এক কানে পৌছে দিলেই সেটা নাকি নিজ থেকে দশ কানে পৌছে যায় । মধুমিতা মেস নিয়ে ও তেমন একটা গুজব মহল্লা ছাড়িয়ে পুরো দেশে জড়িয়ে পরলো ।

স'দু ভাইয়ের কুলখানির পর অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো স'দু ভাইকে নাকি রাতের বেলা মেসের বারান্দা দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটতে দেখা গেছে ।

এ কান ওকান হয়ে কথাটা যখন আমার কানে এসে পৌছলে আমি সেটাকে মোটেও গুরুত্ব দিলাম না । বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি, মরে গিয়ে সে কিনা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটবে ?

পুরোটাই মিথ্যা বোগাস ছাড়া আর কিছু না । স'দু ভাইকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে সব চাইতে বেশি মিথ্যা ছড়াচ্ছে কাজের বুয়া রেহানার মা ।

রহিমার মা স'দু ভাইকে নিয়ে ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প ফেঁদে বসেছে । একদিন সকালে এসে বললো , সে আর রাতের খাবার রান্না করতে পারবে না । কারণ সু'দু ভাইকে সে নাকি রান্না ঘরে দেখেছে ।দু'পুরের খাবারের পর সে যখন কল তলায় থালা বাসন ধুচ্ছিল, তখন নাকি রান্না ঘরে খটর মটর শব্দ শুনে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, সদু ভাই খালি গায়ে চুলার কাছে কি যেন খুঁজছে । বুয়া দরজায় দাড়াতেই, সদু ভাই নাকি তার কি তাকিয়ে বলে উঠেছেন, ও রেহানার মা ম্যাচটা কোথায় রেখেছো ? ম্যাচটা দাও, একটা সিগারেট খামু । আমি ধমক দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিলেও -

রহিমার মার এ গল্পটাই সব চাইতে বেশি ছড়িয়ে পরেছে ।

আশে পাশের দশ বাড়িতেও এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে । আমি এসব কথাবার্তাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারো সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনাও করছি না । বার দুয়েক বদরুল এসেছিল আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছে । আমি পাত্তা দেয়নি । কথার শুরুতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, বদরুল বাজে বিষয় নিয়ে কথা বলে আমার সময় নষ্ট করবে না । যাও নিজের কাজ করো গিয়ে ।

বদরুল আর কিছু বলার সাহস পায়নি মাথা নিচু করে চলে গেছে । যতোসব বাকোয়াস কথাবার্তা । আমি পূর্ণ উদোমে লেখা লেখি চালিয়ে যাচ্ছি । ইতিমধ্যে একটি পত্রিকায় আমার ছোটখাটো ইন্টার্ভিউও ছাপা হয়েছে ।

অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুতের গতিতে নতুন চিত্রনাট্য লিখে চলেছি । পরপর দু’টো ফিকুয়েন্সের কাজ শেষ করে ফেলেছি । ঝামেলা বাঁধল তৃতীয়টার সময় ।

সদু ভাইকে মেসে দেখার ঘটনাগুলো আমি গুরুত্ব না দিলেও আমার অজান্তেই মেসের ভেতর একটা কিছু ঘটে যাচ্ছিল তার প্রমাণ পেলাম আরো দু’দিন পর । আমার পাশের রুমে থাকেন ব্যাংক কর্মকর্তা ওমর ফারুক সাহেব। সাদাসিধে মাঝারি আকৃতির অমায়িক লোক । কারো আগে পিছে নেই । তিনি কিনা রাতের বেলায় কি দেখে ভয় পেয়ে হার্ট এ্যটাক করে বসলেন। মেসের সবাই ছোটাছুটি করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করালো ।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব একটা কথাবার্তা না হলেও একদিন কি মনে করে যেনো আমি তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম ।

ইদানীং বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর চেহারা বদলে গেছে । ঝকঝকে তকতকে হাসপাতাল দেখে মন ভাল হয়ে যায়। ওমর ফারুক সাহেব আছেন হাসপাতালের দোতালার একটি কেবিনে । আমি তার কাছে পৌঁছে দেখি তিনি আঙুর খাচ্ছেন । দশ বারো বছরের একটি মেয়ে তার মুখে একটা একটা করে আঙুর তুলে দিচ্ছে আর উনি মজা করে তা খাচ্ছেন। হঠাৎ আমি উপস্থিত হওয়ায় আমাকে দেখে ফুরুক সাহেব একটু লজ্জা পেলেও হেসে বললেন, আসেন লেখক সাহেব ।

আমি হেসে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেসা করলাম, তা এখন কেমন আছেন ?
জ্বি ভাল । ফারুক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি আবার লজ্জা পেলেন ।

কিছু মানুষ আছে, লজ্জা বতি লতার মতো তারা সব কিছুতেই একটু বেশি লজ্জা পান । ফারুক সাহেব ও তেমন একজন মানুষ । আমি তাকে অকারণ লজ্জার হাত থেকে বাচাতে চেয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ও কি আপনার মেয়ে নাকি ? আমি মেয়েটার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম ।
জ্বি । দেখুনতো কতো করে বলছি হাসপাতালে ছোটদের আসার দরকার নেই কিন্তু তবুও নাছোড়বান্দা আমাকে নাকি দেখতেই হবে । প্রতিদিন হাসপাতালে আসছে ।
মেয়েটার গায়ের রং হালকা শ্যামলা । কাধ পর্যন্ত কোকড়ানো ঝাকড়া চুল ।
আমি মেয়েটাকে কাছে টেনে জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম তোমার মা মনি ?
মেয়েটা ছোট করে বলল, মায়া ।
বাঃ সুন্দর নাম তো।
তুমি কোন ক্লাসে পড় তুমি ?
এক ঝাক ফোকলা দাত বের করে সে বলল, ক্লাস থ্রি'তে।
ও তাই নাকি ? আমিও তো থ্রি তে পড়ি । যাক তুমি আর আমি একই ক্লাসে পড়ি । কথাটা বলে আমি হাসলাম। মেয়টি কিন্ত হাসলো না । সে ফোকলা দাতে টুকটুক করে বলল, তুমি মিথ্যা বলছো । তুমি তো বড় । তুমি আব্বুর লেখক বন্ধু । আব্বুর সঙ্গে মেসে থাকো । আমি সব জানি ।
ওমা তাই নাকি ? তুমি তো দেখছি তোমার আব্বুর বুড়ি মা ।
আমি বুড়ি না, আমার বয়স তো মাত্র এগারো বছর ।
এমন সময় ফারুক সাহেবের স্ত্রী রুমে ঢুকলেন । আমাকে দেখে সালাম দিলেন । আমিও সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম , ভাবি ভাল আছেন ? তিনি উত্তর দিয়ে ফারুক সাহেবের সাথে কয়েকটা কথা বলে মেয়েকে নিয়ে বাহীরে চলে গেলেন ।

আমি আরো কিছুক্ষন ফারুক সাহেবের সাথে নানা বিষয়ে গল্প গুজব করলাম। রাজনীতি, শেয়ার বাজার, সঞ্চয় পত্রের সুদ ইত্যাদি নানা বিষয়ের আলোচনার ফাকে একসময় ফারুক সাহেব আমাকে বললেন, ভাই আমি আর ঐ মেসে যাবো না । একটু সুস্থ হলে জিনিষ পত্র সব নিয়ে আসবো ।
আমি অবাক প্রশ্ন করলাম, সেকি কেন ?
- মেসটার দোষ হয়েছে । ওখানে খারাপ আত্মা বাসা বেঁধেছে ।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম এসব বাজে কথা। কিন্তু কিছু বলার আগেই ওমর ফারুক সাহেব আবার বলে উঠলেন, আমি জানি আপনি এসব বিশ্বাস করেন না । তবুও বলছি, সম্ভব হলে আপনিও মেসটা ছেড়ে দিন । আমি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বললাম , আপনি ভয় পেলেন কি দেখে ?
ফারুক সাহের হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন,। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না ।
আমি বললাম , না,বিশ্বাস করবো, আপনি বলেন ।
ওমর ফারুক সাহেব একটু ঝুকে এসে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, স'দু ভাইকে দেখে ।
সদু ভাইকে ? আমি কপাল কুচকে ফেললাম ।
জি,হ্যা স'দু ভাইকে দেখে । সেদিন রাতে বাথরুমে যাবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়ে দেখি সদু ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা । আলো জ্বলছে । এতরাতে স'দু ভাইয়ের রুমে কে, তা দেখার জন্য আমি এগিয়ে গেলাম ।
দরজার দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিতেই দেখি; স'দু ভাই হাতে একটা মোটা দড়ি নিয়ে ফ্যানের নিচে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে দড়িটা ফ্যানে বাঁধার চেষ্টা করছেন।
আমি, কে ? বলার সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ও ব্যাংকার এদিকে এসে চেয়ারটা একটু শক্ত করে ধরো তো দেখি । মনে হচ্ছে পইড়া যামু ।”
এ কথা শুনার পর আমার আর কিছু মনে নেই । সঙ্গে সঙ্গে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করি । তারপর বুক চেপে ধরে পরে গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে ।
ওমর ফারুক সাহেবের কথা ফেলে দিতে পারলাম না । একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গেল । ভয় হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধির মতো একবার কারো ভেতর ঢুকে গেলে ডাল পালা ছড়াতে শুরু করে । নানান যুক্তি দিয়েও তখন তাকে আর বশ মানানো যায় না । একরাশ এলোমেলো চিন্তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেসে ফিরলাম রাত ১১টার।

চলবে ................

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:০১

খাঁজা বাবা বলেছেন: এক টানে পড়ে ফেললাম, ভাল লেগেছে।
পরের পর্ব তারাতারি দিন।
ভেঙে ভেঙে পড়তে মজা লাগে না। :P

১২ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:৩৫

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ । ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম লেখার কষ্ট লাঘব হয়ে গেলো ।

২| ১২ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২২

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর ঝরঝরে লেখা। পড়ে আরাম পাওয়া যায়।

১৩ ই জুন, ২০২২ রাত ১২:১১

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: সুন্দর ঝকঝকে মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

৩| ১২ ই জুন, ২০২২ রাত ১০:০২

অপু তানভীর বলেছেন: কাহিনী যে কোন দিকে যাচ্ছে এখনও ধরতে পারছি না । দ্রুত পরের পর্ব দিন !

১৩ ই জুন, ২০২২ রাত ১২:৩৬

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: তাহলে বলা যায় লেখক ঠিক পথেই হাটছেন, সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

৪| ১৩ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৫৪

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: ভয়ংকর কাজ কারবার শুরু হয়ে গেছে

খুব সুন্দর।

৫| ১৩ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৫:০২

রাজীব নুর বলেছেন: এই পর্ব পড়ে বেশি ভালো লেগেছে।

১৮ ই জুলাই, ২০২২ রাত ৮:২৬

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ধন্যবাদ ভাল থাকবেন

৬| ০২ রা জুলাই, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: লেকগার মান ও গতি একই থাকায় ধন্যবাদ। :)

১৮ ই জুলাই, ২০২২ রাত ৮:২৮

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ভাল একটি মন্তব্য লেখার ইচ্ছেটাকে উজ্জীবিত করে। ভাল থাকবেন। শুভকামনা আপনার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.