নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।
আমাদের তখন টেলিভিশন ছিল না ।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন টেলিভিশন শুধু ধনীদের বাসাতেই থাকতো । আমরা তখন ধনী ছিলাম না । এই কারণে আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিলো না । বাবা সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন । বেতন সর্ব সাকুলে ৫ হাজার টাকা ছিল । অনেক কষ্টে চাকরী জীবনের শুরুতে ঢাকাতে একটা জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন । এটাই ছিল বাবার জীবনে সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত । উনি ছিলেন অন্য এক ধরনের মানুষ । জীবনে কাউকে জমা খরচ দিতেন না । নিজে যেটা ভালো মনে করতেন সেটাই করতেন ।
আমার বাবার পরিবারের চেয়ে আমার মায়ের পরিবার ছিল অনেক বেশি ধনী । তাদের পুরানো ঢাকায় বিশাল বড় বাড়ি ছিলো । আবার মা ছোট বেলায় ঘোড়ার গাড়িতে করে স্কুলে যেতেন। আমার নানার বাবা ছিলেন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র । আমার নানার ছোট ভাই ছিলেন, এম্বাসেডর। নানার বোনেরা ছিলেন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । এক বোনের স্বামী ছিলেন, আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি টাঙ্গাইলের সামসুল হক । কিন্তু নানা ভাই গিয়ে ছিলেন উল্টে । মেধাবী হওয়া স্বত্বেও পড়া লেখা না করে গান বাজনা নিয়ে মজে ছিলেন । তবে এখানেও উনি বেশ নাম ডাক করেছিলেন । নজরুল সংগীতের গুরু হিসাবে তিনি বেশ নাম ঢাক ছিলো। বাংলাদেশর প্রসিদ্ধ সংগীত তজ্ঞদের মধ্যে উনি ছিলেন বিশেষ ভাবে পরিচিত ।
অপেক্ষাকৃত বনেদি ধনী হওয়ায় নানা বাড়ির ভাব সাবের সাথে আমাদের চাল চলন খুব একটা মিলত না । নানা বাড়িতে গেলে পোশাক আশাক, চাল চলনে আমরা খুব পিছিয়ে থাকতাম । মামারা নানা ভাবে আমাদের ক্ষ্যাপাতো। তার উপর বড় মামাকে আর নানা ভাইকে আমরা সবাই ভয় পেতাম যমের মতো । অন্যদের যেখানে নানা ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক হয় সরল কিন্তু আমাদের নানা ভাইয়েট সাথে সর্ম্পক ছিলো গরল ।
এমন নয় যে, নানা ভাই সব সময় আমাদের বকাঝকা করতেন । কিন্তু তার জমিদারী মেজাজ মর্জির কাছে আমরা বাতাসার মতো গলে যেতাম । তাই নানা বাড়িতে গেলে, যতক্ষণ নানা ভাই বাড়িতে থাকতেন । ততোক্ষণ চেষ্টা করতাম তার চোখের আড়ালে থাকতে । নানা ভাইয়ের ঘরের সামনের মাঠে খুব একটা দৌড় ঝাপ করতাম না । এই ভয়টা যে শুধু আমরা পেতাম তা কিন্ত নয়, মামা খালারা,এবং এলাকার লোকজন ও আমার নানা ভাইয়ের ভয়ে বিড়াল হয়ে থাকতো । প্রচণ্ড সৎ এবং একরোখা মানুষ ছিলেন তিনি ।
কিন্তু তবুও আমার নানা বাড়িতে যাওয়ার মূল আকর্ষণ ছিলো, নানা বাড়ির "টেলিভিশন । "
নানা ভাইয়ের ঘরে তখন একটা ন্যাশনাল প্যানাসনিক ২১ ইঞ্চি টেলিভিশন ছিলো । সেটাতে তখন শুধু বিটিভি চলতো । সেটা দেখার জন্য ই নানা বাড়িতে যেতে চাইতাম । বাড়ির বড় মেয়ে হিসাবে নানা ভাইয়ের কাছে, আমার মায়ের আদর ছিলো খুব বেশি । বড় মেয়ে জামাই হিসাবে বাবাও যোগ্য আদর পেতেন । কিন্তু উচ্ছিষ্ট থাকতাম আমরা ।
ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা,কাচ্চাদের মতো পুরো বাড়ি টো টো করে ঘুরে বেড়ালেও কেউ খুব একটা দাম দিতো না । অন্যান্য মামাতো খালাতো ভাই বোনেরা দামী দামী পোশাক আশাক পরিধান করলেও আমাদের পোশাকের দৈনতা কখনো কাটতো না । একই পোশাক আশাক পড়ে সব অনুষ্ঠানে যেতে হতো ।
এসব ব্যাপারে আব্বা ছিলেন, দারুণ উদাসীন । উনি সব কিছুতেই উদাসীন ছিলেন । বছরে দু'বার দুই ঈদে জামা,প্যান্ট জুতো কিনে দিতেন । সেগুলো দিয়েই পুরো বছর পার করতে হতো । এ ছাড়া কালে ভদ্রে অবশ্য নতুন পোশাক মিলত সেটা ছোট খালার কাছ থেকে পেতাম । এভাবেই আমাদের ছোট বেলাটা নানানা দৈনতায় ভেতর দিয়ে কাটতো ।
কিন্তু মা আমাদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে কোন ক্রুটি করতেন না । তবে একটা কথা না বললেই নয় , "বাবা বাজার করতেন ব্যাগ ভর্তি করে । এমন না যে, তিনি খেতে খুব পছন্দ করতেন। বাজারের বড় বড় মাছ,মাংস সব সময় কেনার চেষ্টা করতেন । আশে পাশের বাড়ির অপেক্ষা আমাদের বাড়ির খাবার দাবারের মান ছিলো আলাদা। " আহা! মার হাতের মাছ ভুনা, কলিজা ভুনা, মাংসের ঝোলে, আ্লু দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোলের স্বাদ এখন ও চোখ বন্ধ করলে টের পাই ।
বাবা জানতেন মা বড় বাড়ির মেয়ে তাই খরচটাও করতেন সাধ্য মতো । সরকারী অফিসের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরী করলেও বাবা কখনো ঘুষ খেতেন না । ফলে মা'র হেঁশেলে , মাস শেষের কয়েকটা দিন খুব টেনে টুনে চলতো । আলু ভর্তা , ডিম এই থাকতো প্রায় নিত্য দিনের মেনুতে । আমি তখন প্রায়ই চিন্তা করতাম, "এক বছর এমন কম, কম খেয়ে একটা টেলিভিশন কিনলে কি এমন ক্ষতি হয় । আব্বা এই কথাটা কেন বুঝে না ?"
আমরা যে এলাকায় থাকতাম । সেখানকার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে আমার খুব মেলা মেশা ছিলো । স্কুলের পর বাসায় এসে ব্যাগ রেখে তাদের সাথে সারাদিন টো টো করে বেড়াতাম । আশে পাশের দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে একটি বাড়ি ছিলো বেশ অবস্থা সর্ম্পণ । তারা ছিলো পাচ কি ছয় ভাই । ছয় ভাইয়ের বড় দুই ভাই সৌদি, সিঙ্গাপুরে থাকতো । তাই তাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিলো । সে সময় কারো বাসায় টেলিফোন ও টেলিভিশন থাকলে তাদের ধনী বলে গন্য করা হতো । কিন্ত ওই অবস্থা সর্ম্পণ বাড়ির অন্য ছোলে গুলো বিভিন্ন কল কারখানা বা দোকানে কাছ করতো আর ভাইদের টাকায় ফুটানি করতো। এর মধ্যে তাদের সব চেয়ে ছোট ছেলেটি ছিলো, মাদকাসক্ত ।
এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর দল বেঁধে তাদের বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে যেতো । সুযোগ পেলে আমিও যেতাম । আটটার মধ্যে পড়া লেখা শেষ করে টেলিভিশন দেখতে যেতাম । তারা বাড়ির উঠানে টেবিল রেখে তার উপর টিভি চালিয়ে দিতে । ছোটরা মাটিতে বসতো আর বড়রা বসতো চারপাশের চেয়ারে । তখন, বাংলা সিনামা, ছায়া ছন্দ , যদি কিছু মনে না করেন , টারজান, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, ম্যান ফ্রম আটলান্টিক । এইসব ছিলো হিট অনুষ্ঠান।
কিন্তু কোন এক কারণে সেই বাড়ির এক ছেলে যার নাম ছিলো , ঝালু । আমরা ডাকতাম, ঝালু মামা বলে । সেই মামার সাথে একবার কি এক প্রসঙ্গ নিয়ে আমার কথা কাটাকাটি হলে, এর পর সে আমাকে দেখতে পারতো না । পরে অবশ্য টিভি দেখার লোভে আমি তার সাথে খাতির লাগাবার চেষ্টা করার পরেও কোন লাভ হয়নি । তাদের বাড়িতে টিভি দেখতে গেলেই সে আমাকে সকলের সামনে বের করে দিতো । কিন্তু তবুও আমি যেতাম । টিভি দেখতে যাবার আগে মনে মনে দোয়া করতাম, ঝালু মামা যেন বাড়িতে না থাকে । কিন্তু কোথা থেকে যে, সে ছবি বা অনুষ্ঠানের ক্লাইমেক্সে এসে উপস্থিত হতো তা আল্লাহ্ মালুম । ঝালু মামার কোন মায়া দয়া ছিলো না আমাকে দেখলেই উনি তাড়িয়ে দিতেন । ব্যাপারটা লজ্জার, অপমানের হলেও টিভির নেশায় সেটা আমার কাছে লজ্জার বা অপমানের মনে হতো না । তাই টেলিভিশন দেখার নেশার ঝালু মামার সাথে আমার সাপ লুডু লেখা চলতো ।
সেই ঝালু মামা আজ আর নেই । তাদের পরিবারও ভেঙ্গে চুড়ে একাকার হয়ে গেছে । বানের জলের মতো পরিবারের সদস্যরা কে,কোথায় ভেসে গেছে তার কোন ঠিক নেই । কিন্তু ঝালু মামা না থাকলেও, আমার কাছে ঝালু মামার দেওয়া সেই সব লজ্জা,সেই সব অপমান আর বিশাল আকারের একটি বড় টেলিভশন আছে ।
১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৫৫
সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: টেলিভিশন থাকলে আপনার কাছে নিজেকে তখন ধনী মনে হতো , শুভ কামনা আপনার জন্য
২| ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:১৬
ফুয়াদের বাপ বলেছেন: আপনার স্মৃতিচারন লেখা পরে নষ্টালজিক হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়িতেও টিভি ছিলনা। টারজান/ম্যাকগাইভার/দ্যা ফল গাই/নাইট রাইডার এর মত সিরিজগুলো দেখার নেশায় যাদের বাড়ি টিভি ছিল তাদের বাড়ির মেঝেতে বসে হলেও দেখতাম। শুক্রবার ছিল ছায়াছবির দিন। দুপুর থেকেই টিভি বাড়িতে টইটুম্বুর জনগন। বাধ্য হয়ে জানালা দিয়ে দাড়িয়ে দেখতে হতো।
টেলিভিশন দেখার সেই সুখ নিয়ামক এখন আর নাই। এখন মুঠোহাতেই বন্দি বোকাবাক্স।
৩| ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৫২
সোনাগাজী বলেছেন:
বেশীরভাগ বাংগালী তরুণই "ঝালু" মামার মতো, সামান্য সমস্যা নিয়ে অশান্তি করে বেড়ায়।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:২৫
স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:
আমাদের টিভি ছিল না কিন্তু কখনো "ধনী নয়" মনে হয়নি।
খড়ের ঘরে থাকলেও তেমন কিছু মনে হতো না। আব্বাকে সব সময় টাকাওয়ালা মনে হতো।
আপনার লেখা খুব মনে ধরলো। ভালো থাকবেন।