নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসীম নীল আকাশে পাখী যেমন মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, কল্পনার ডানায় চড়ে আমিও ভেসে চলেছি মনের আনন্দে--রূঢ় পৃথিবীটাকে পিছনে ফেলে।

খেয়ালের বশে কোন পথে চলেছো পথিক...

শামছুল ইসলাম

পাখী ডানায় ভর করে মুক্ত নীল আকাশে মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, আমিও কল্পনার ডানায় চড়ে মনের গহীন আকাশে .......

শামছুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে...

০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:০১


(এক)
দরজায় কড়া নাড়ছি। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আমার হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে । এমন সময় শুনতে পেলাম একটা মেয়ের কণ্ঠ,
-কে?
কী বলবো বুঝতে পারছি না ।
আবার ও সেই কণ্ঠ,
-কে?
আমার পরিচয় দিলে সে চিনবে না। তাই যার সাথে দেখা করতে এসেছি তার নাম বললাম ।
-আসিফ সাহেব আছেন ?
-না, বাবা বাসায় নেই ।
আমি বিফল মনে সিঁড়ি দিয়ে নামছি । এক ভদ্রলোক আমাকে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠছেন ।
এমন সময় পিছন থেকে সেই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে আসল,
-বাবা, উনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন ।
আমি থমকে দাঁড়ালাম ।
ইনি আসিফ সাহেব । উনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ।
সালাম বিনিময়ের পর উনার বাসায় নিয়ে গেলেন ।
আমার দূর সম্পর্কের এক চাচার মাধ্যমে আসিফ সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি । জরুরি একটা কাজে চাচা হঠাৎ গ্রামের বাড়ি গেছেন । তাই আমি একাই এসেছি ।
.
চা খেতে খেতে উনি আমার নাড়ি নক্ষত্র সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন । আমার একটু রাগ হচ্ছিল । কিন্তু দরকারটা যেহেতু আমার, তাই চেপে গেলাম । উনি ঘরের ভিতরে গেলেন । আমি বারান্দা-কাম ডাইনিং রুমে বসে আছি । সরকারি বাসা- দুটো ঘর , সাথে বারান্দা-কাম ডাইনিং , একটা বাথরুম ও একটা রান্না ঘর । এর মধ্যেই আসিফ সাহেব এক কন্যা, দুই পুত্র ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন । চাচার কাছ থেকেই এসব খবর জেনেছি । খুব অনটনের মধ্যে না থাকলে কেউ এই ছোট্ট বাসায় কাউকে সাবলেট দিতে চান না। মেয়েটাকে সিঁড়ির মুখে একবার দেখেছি । মাথায় একটা ওড়না, নিষ্পাপ বড় চোখের চাহনি - ঠিক যেন ইরানি কন্যা ।
.
রূপবতী কন্যার বাবাদের অনেক চিন্তা করতে হয় । সেই চিন্তায় আমার বাদ পড়ার সম্ভাবনাই বেশি । মনে হচ্ছে এ মাসেও মেসেই থাকতে হবে । মেসের অনেক অসুবিধার মধ্যেও আমি মানিয়ে নিয়ে ছিলাম । কিন্তু মেসে সবচেয়ে বড় সমস্যা পড়া-লেখা করার পরিবেশ নেই । আমি আরো পড়া-লেখা করতে চাই । কেরানি গিরি করে জীবনটা শেষ করতে চাই না । প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দিবো । ওদিকে গ্রাম থেকে মা বিয়ে করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন । দরজায় দড়াম করে একটা লাথির আওয়াজে আমার চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল । মেয়েটা দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল । ঝাকড়া চুলের বছর দশ-বারো বছরের একটা ছেলে মেয়েটার পাশ গলে ঘরের দিকে ছুট লাগাল ।
.
আমি বারান্দার বাইরে দৃষ্টি দিলাম । মেয়েটার দিকে তাকালাম না । এখনো জানি না আমার এ বাসায় থাকা হবে কি-না । কিছুক্ষণ পর আসিফ সাহেব ফিরলেন । উনি আমাকে উনার বাসায় থাকার অনুমতি দিলেন । তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন, যার সারমর্ম হলো উনার মেয়ের সাথে যেন কোন রকম সম্পর্ক করার চেষ্টা না করি । কলোনির ছেলেরাও না-কি খুব জ্বালাতন করে । আমিও কথায় কথায় উনাকে জানিয়ে দিলাম যে, আমার মা গ্রামে আমার জন্য মেয়ে দেখছেন । সুতরাং উনি নির্ভার থাকতে পারেন । আসলেই কি এসব বিষয়ে আগাম কিছু বলা যায় ?
.
(দুই)
মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমি মেস থেকে আসিফ সাহেবের বাসায় ওঠলাম । চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ । মিরপুর রোডের পুব পাশে কলোনি, পশ্চিমে ধানমন্ডি মাঠ । কিছুক্ষণ পর পরই মিছিল চলে রাস্তায় । আমি জানালার ধারে বসে রোডের দিকে তাকিয়ে থাকি । আমি খুব ভিতু মানুষ । মিছিলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না । আমার কিছু হলে মাকে কে দেখবে ? ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই দুদিনের জ্বরে বাবা চলে গেলেন । সেই থেকে আমার সংগ্রামের শুরু । অনেক কষ্টে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই ঢাকা শহরে চলে আসি । টাইপিং শিখে ফেলি । তারপর একটা চাকরিও জুটে গেল । ছোট বোনটা গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে । এবার বাড়ি থেকে আসার সময় মার সে-কি কান্না । দেশের এই অবস্থায় কিছুতেই তিনি আমাকে ঢাকা শহরে যেতে দিবেন না । শেষ পর্যন্ত আমি মাকে কথা দিলাম, যত ব্যস্ত-ই থাকি, প্রতি সপ্তাহে মাকে চিঠি লিখব ।
.
চিঠি লেখার সময় ভাষা খুঁজে পাই না । বাড়ি গেলে মার সাথে কত গল্প হয় । অথচ লিখতে গিয়ে কলম চলে না । দুটা চিঠি দিয়েছি । দেশের যা অবস্থা, শুনছি চিঠি বিলি হয় কি-না সন্দেহ । নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে একটা চিঠি লিখেছি, পোস্ট করা হয়নি ।
.
মেসে থাকতে সময় কোথা দিয়ে কেটে যেত টের পেতাম না । এখানে এসে সময় কাটতে চায় না । বাসার সামনে দেওয়াল ঘেরা মাঠ । দেওয়ালটা মিরপুর রোড থেকে কলোনিটাকে আড়াল করেছে । দেওয়ালের পাশে, কলোনির ভিতরে একটা মুদি দোকান । সেখানে গিয়ে বসি । সবাই চৌধুরী ভাইয়ের দোকান বলে । দেশ নিয়ে, পশ্চিম-পাকিস্তানিদের অত্যাচার নিয়ে অনেক রকম আলাপ হয় । বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আলোচনা হয় । আমি চুপচাপ শুনে যাই । সিগারেট খাই না । দোকানে বসে কিছু না খেয়ে আড্ডা দেওয়া কেমন দেখায় । তাই আমার পান খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে বাবুল বিস্কুট, লজেন্স নেই কামরানের জন্য; কামরান আসিফ সাহেবের দুরন্ত ছোট ছেলে । কামরান খুব খুশি হয় । আমার সাথে আস্তে আস্তে ওর ভাব হয়ে যাচ্ছে । অবশ্য আসিফ সাহেবের মেয়ে মুন্নীর সাথে তেমন একটা কথা হয় না । সুন্দরী মেয়েরা কারো সাথে সহজে কথা বলে না । সবাই তাদের সাথে কথা বলতে উন্মুখ থাকে ।
.
এই কলোনিতে ছেলে-মেয়েরা গুরুজনদের খালু-খালাম্মা বলে ডাকে । আমিও সেই সূত্রে আসিফ সাহেবকে খালু বলে ডাকি । খালাম্মার সাথে ঘোমটার আড়ালে কথা হয়েছে । সব কিছু ভালোই চলছে । একটা অসুবিধা – ওরা তিন বেলাই রুটি খায় । কারণ ওরা বিহারি । আমার কষ্ট হয়, তবু মানুষকে কষ্ট দিতে চাই না বলে চালিয়ে নিচ্ছি । কামরানরা এদেশে দীর্ঘকাল থাকার কারণে বাঙলা বলতে ও বুঝতে পারে । বিহারিদের সম্পর্কে সবার মতো আমারও বিরূপ ধারণা ছিল । এই বিহারি পরিবারটাকে কাছ থেকে দেখে ধারণাটা বদলাচ্ছে । কামরানকে ওর খেলার সাথীরা খেপায় – একটা দুইটা মাওড়া ধরো, সকাল-বিকাল নাস্তা করো । শ্লোগানটা আমারও বেশ প্রিয় । এখন যখন কেউ কামরানকে ওটা বলে খেপায়, আমার খারাপ লাগে । আমার ছোট বোন মিলিও কামরানের মতো চঞ্চল । বাড়ি গেলে ওর জন্য বিস্কুট, লজেন্স নিতেই হবে ।
.
চিঠি পোস্ট না করলেও আমি প্রতি সপ্তাহে মাকে একটা চিঠি লিখি রাতের বেলা, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে । চিঠিগুলো টেবিলের ড্রয়ারে একটার পর একটা সাজিয়ে রাখি । সেদিনও রাতে চিঠি লিখছি – মিরপুর রোডের দিক থেকে অনেক মানুষের সম্মিলিত শ্লোগান শুনতে পেলাম । বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে অনেকে মিরপুর রোডের দিকে যাচ্ছে । বাসার সবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে । খালাম্মার নিষেধ সত্বেও খালু বাইরে গেলেন । চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে । বারান্দা দিয়ে শুক্রাবাদের দিকে তাকালাম । ৩২ নম্বরের দিকে ভারী ট্রাকের শব্দ ও হেড লাইটের তীব্র আলো দেখতে পেলাম । কিছুক্ষণ পর রাতের কালো আকাশ ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হয়ে যাচ্ছে । আবার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে । ভয় এমন একটা জিনিস যা মানুষের মধ্যকার দূরত্ব দূর করে দেয় । খালাম্মা, তাঁর ছেলে-মেয়ে ও আমি কখন যে এক ঘরে জড়ো হয়েছি, নিজেরাই জানি না । বাসার সব লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে । অন্ধকারে গোলাগুলির শব্দের মধ্যেও কয়েকটা মানুষের দোয়া-দরূদ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে । খালু সেই যে বাইরে গেছেন, এখনো ফেরেননি ।
.
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ । আমরা সবাই স্থির হয়ে গেছি । খালু কি ফিরে আসলেন ? আমি দরজার কাছে এগিয়ে যাই, জিজ্ঞাসা করি কে ?
- আমি, খালুর কাঁপা কাঁপা গলা।
দরজা খুলে দেই, উনি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন । সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ।
খালু পোড় খাওয়া মানুষ । বিহার থেকে পালিয়ে এদেশে এসেছেন ।
বিছানায় বসলে গায়ে গুলি লাগতে পারে, তাই উনি আমাদের সবাইকে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে বসতে বললেন । ভয়ঙ্কর সেই রাতের শেষে আজানের শব্দে ভোর আসে । অনেকদিন ফযরের নামায পড়া হয় না । ওযু করে নামায পড়লাম ।
.
(তিন)
সারা রাত ঘুম হয়নি । একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল । কামরান এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে । ও আমার হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল । গতকাল রাতে জানালা বন্ধ করা হয়, আর খোলা হয়নি । দুই কপাটের কাঠের জানালার ওপরের দিকে দুইটা কাঁচ বসানো আছে । সেই কাঁচের ভিতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি অবাক । সামনের মাঠের উঁচু দেওয়ালের পরেই বিশাল বস্তি । সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে পত পত করে একটা বাঁশের আগায় । পাক হানাদার বাহিনীর কিছু সৈন্য বস্তির লোকদের পতাকাটা নামাতে বলছে । কিন্তু ওরা নামাতে রাজি না । কিছু তরুণ-যুবক প্রাণের ভয়ে দেওয়াল টপকে কলোনির ভিতরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটছে ।
খেয়াল করিনি কখন খালুও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । সৈন্যরা রাইফেল তাক করে কিছু যুবককে পতাকাটার দিকে নিয়ে আসছে । আমার খুব ভয় হচ্ছে–যদি গুলি করে দেয় । এক যুবক এগিয়ে গিয়ে বাঁশের মাথায় উঠে গিয়ে পতাকাটা নামাল । কিছু যুবককে সৈন্যরা রাইফেলের মুখে সারি বেঁধে মিরপুর রোডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । ওদের অশুভ পরিণতির কথা চিন্তা করে আমি অস্থির হয়ে উঠি । এখান থেকে মিরপুর রোডটা পুরো দেখা যায় না । ওদের নিয়ে সৈন্যগুলো ধানমন্ডি মাঠের দিকে চলে যায় । ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় । আমি প্রতি মুহূর্তে গুলির আওয়াজের শব্দ শোনার অপেক্ষায় থাকি । কিছুক্ষণ পর পাক হানাদার বাহিনীর বেশ কিছু জিপ নিউ মার্কেটের দিকে চলে গেল । বস্তির যুবকরাও ফিরে আসল । খালু আমাকে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করল । গতকাল রাতে রাস্তার ধারের বিশাল বিশাল আম গাছ, শিমুল গাছ, জাম গাছ দশ মিনিটের মধ্যে কেটে মিরপুর রোডে ব্যারিকেড দেয় কিছু যুবক । সম্ভবত ওই গাছগুলো রাস্তার ওপর থেকে সরানোর জন্যই বস্তির যুবকদের নিয়ে যায় । গতকাল রাতের ঘটনা, আজকের সকালের ঘটনা – সব কিছুর মধ্যে যুবকদের অসম সাহসিকতায় খালু বিস্মিত । দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ এক হয়েছে । স্বাধীনতার এই সর্বাত্মক আন্দোলন বৃথা যেতে পারে না ।
.
ঢাকা শহরের পরিস্থিতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে স্বাভাবিক দেখানোর জন্য অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সব খুলে দেওয়া হল । কিন্তু তাতে মানুষের মনের আতঙ্ক একটুও কমল না । চৌধুরী ভাইয়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝেই ভয়ঙ্কর সব খবর পাই । ২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডি ক্লাবের খোকন ভাই পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন । উনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য একটা পিস্তল নিয়ে প্রতিরোধের জন্য ৩২ নম্বরের কাছে রাস্তার ধারে পজিশন নিয়ে বসে ছিলেন । ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত হয়ে দুই দিন তাঁর লাশ পড়ে ছিল । কারফিউ ওঠার পর পরিবারে লোকেরা একান্ত গোপনীয়তার সাথে লাশের দাফন সম্পন্ন করে ।
.
কিছুদিন পর ধানমন্ডি লেকে এক যুবক ছেলের লাশ ভেসে ওঠল । খবর নিয়ে জানা গেল ছেলেটা বুয়েটে পড়ত । কেউ ছুরি মেরে ওকে মেরে লেকে ফেলে দিয়েছে । ছেলেটা এই কলোনির-ই । গুজব ছড়িয়ে গেল, বিহারীদের কেউ ওকে মেরেছে । ও মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করত সেই অপরাধে ।
.
কলোনির পরিবেশটাও দিন দিন কেমন বদলে যাচ্ছে । কলোনির এক বিহারি পরিবারের খুব ডানপিটে একটা মেয়ে পাকিস্তানিদের হয়ে কাজ করছে । সে নাকি কলোনি থেকে যে সব যুবক মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে তাঁদের নামের তালিকা ওদের দিয়েছে । একদিন রাতে পাক হানাদার বাহিনীর লোক এসে কলোনির এক যুবককে ধরে নিয়ে গেল । উনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছোট ভাই নাকি মুক্তিযুদ্ধে গেছে । আরও খবর পেলাম, দুষ্টু যে যুবকেরা লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে মুন্নীকে বিরক্ত করতো, তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে গেছে । খুব ভালো, বাবা-মার বাধ্য ছেলেরা সাধারণত কোন বিপদে জড়াতে চায় না । নিজেকে দিয়ে আমি সেটা বুঝতে পারি ।
.
(চার)
হঠাৎ বিনে মেঘে বজ্রপাতের মতো এক বিপদ এসে হাজির হলো । এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার কোথা থেকে যেন আসিফ সাহেবের খবর পেয়েছে । প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটা আর্মি জিপ কলোনির সামনে এসে দাঁড়ায় । অফিসার এসে আসিফ সাহেবের বাসায় আড্ডা দেয় । সৈন্য সহ জিপ দাঁড়িয়ে থাকে গভীর রাত অবধি । খালু তাঁর মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন । খালু মুন্নীকে শিখিয়ে দিয়েছে ওই অফিসারকে আঙ্কেল বলে ডাকতে । আমি কে, ক্যান এখানে থাকি – এমনি অনেক কথা সেই অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করে । আমি বুঝতে পারি আমার এই বাসায় থাকাটা সে পছন্দ করছে না । খালু অফিসারকে নিয়ে বারান্দায় গল্প করে । মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ে । তখন অফিসারের চোখের দৃষ্টি দেখে আমার ভয় করে । আমি ঘরে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি । ভয় নিজের জন্য আবার মুন্নীর জন্যও ।
.
ভয় তাড়াবার জন্য আমি একটা বুদ্ধি বের করি । মার কাছে চিঠি লিখি, প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা নিয়ে । মার ভালোবাসাময় হাতের স্পর্শের অপেক্ষায় চিঠিগুলো দিন গুনতে থাকে ড্রয়ারের ভিতর ।
.
দুশ্চিন্তায় রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না । প্রায়ই স্বপ্ন দেখি অফিসারটা মুন্নীকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে । আমি বাঁধা দিতে গেলে ওর সাথের সৈন্যরা আমাকে টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে দেয় । আমি চিৎকার করে উঠি । তখন আমার ঘুম ভেঙে যায় । গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় । হাতের কাছে তাই এখন একটা পানির জগ রাখি । ঢক ঢক করে পানি খাই । এপাশ-ওপাশ করি, ঘুম আর আসে না ।
.
এই বাসা ছেড়ে অন্য বাসায় যাবার কথা ভাবছি । একদিন কথায় কথায় খালুকে বললাম যে,
-বাসা বদল করতে চাই ।
উনি করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাবা, তুমি না থাকলে আমি খুব অসুবিধায় পড়ব ।
আমি চুপ করে গেলাম ।
.
পরিস্থিতি সব সময় এক রকম থাকে না । পাক অফিসারটা প্রতিদিন আর আসে না । মাঝে মাঝে আসে । বেশিক্ষণ থাকেও না । পাক বাহিনীর দিন কাল ভালো যাচ্ছে না । মুক্তি বাহিনীর হাতে প্রায় মার খাচ্ছে, মারা পড়ছে । একদিন রাতে ঢাকা শহরে বোম ফেলা হল, রাতের অন্ধকারে । দরজা জানালা সব প্রচণ্ড বেগে নড়ে ওঠল । অনেকেই হঠাৎ এই আওয়াজে বেশ ভয় পেল । তবে এখন সবার মধ্যে থেকেই ভয়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে । শীতের মিষ্টি সকালে সামনের মাঠে খালুরা খবরের কাগজ নিয়ে রোদ পোহায় । মিরপুর রোড দিয়ে সৈন্য বাহিনীর জিপ গেলে কেউ এখন আর দৌড়ে পালায় না । আকাশে যখন মিত্র বাহিনীর বিমান আসে, সবাই মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । হাত তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে । সেদিন বারান্দা থেকে দেখলাম একটা মিগ-২১ দূরের এয়ারপোর্টে নিচু হয়ে নামছে, তার দুই পাখা থেকে ছোট ডিমের মতো কী যেন একটা ফেলল । এরকম বেশ কয়েকটা মিগ-২১ বোমা ফেলে চলে গেল । দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পেলাম । মনটা আনন্দে নেচে ওঠল ।
.
(পাঁচ)
ডিসেম্বরের প্রতিটি সকাল যেন আগের দিনের সকালের চেয়ে সুন্দর, মধুর হয়ে দেখা দিচ্ছে । ১৬ তারিখটা মধুরতম হয়ে এলো । মিরপুর রোড লোকে লোকারণ্য । একটার পর একটা বিজয় মিছিল আসছে । আমরা আজ স্বাধীন । চৌধুরী ভাইয়ের দোকানে গিয়ে একটা ক্যাপস্টান সিগারেট দিতে বললাম । উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । গত নয় মাসে কখনো উনার কাছ থেকে সিগারেট নেইনি । আমি হাসতে হাসতে বললাম,
-চৌধুরী ভাই, আজ বড় খুশির দিন । এ আনন্দের তুলনা নেই । মাকে কত দিন দেখি না । এবার বাড়ি যাব ।
সিগারেটে টান দিয়ে খুক খুক করে কাশছি । চৌধুরী ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । এমন সময় জিপ গাড়িটা দেখতে পেলাম । খালুর সেই পাক অফিসারকে নিয়ে কলোনির ভিতরে ঢুকছে জিপ গাড়িটা । ওরা তো কখনো সকালে আসে না, সব সময় রাতে আসে । আজ হঠাৎ দিনের বেলায় হাজির । গাড়ি থামিয়ে দুই জন সৈন্য সহ অফিসার গেট দিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে । সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে চাপা দিলাম । আমার মনটায় কু ডাক দিচ্ছে । চৌধুরী ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম ।
.
খালু দরজা খুলে দিল । উনার মুখে রাজ্যের উদ্বেগ । আমার ঘরের দরজা বন্ধ, দরজার সামনে দুজন সশস্ত্র সৈন্য দাঁড়িয়ে । খালু আমাকে বারান্দার কোনায় ডেকে নিয়ে গেল । ভয়ে উনার গলা শুকিয়ে গেছে । ফিস ফিস করে যা বললেন তা হল, অফিসার মুন্নীকে বিয়ে করতে চায় । একটা আঙটি নিয়ে এসেছে । ওকে পড়াবে । পাকিস্তানে ফিরে ওর জন্য এবং আমাদের সবার জন্য টিকেট পাঠিয়ে দেবে । খালু ওর প্রস্তাবে রাজি না ।
আমি ঘরে ঢুকে অফিসারের সাথে দেখা করতে চাইলাম । সেপাইরা রাজী না । কোথা থেকে যেন এক ঝলক সাহস বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার সারা দেহে বয়ে গেল । আমি দৃঢ় স্বরে ওদের সরে দাঁড়াতে বললাম । গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে অফিসার উঠে এল । ইঙ্গিতে ওদের সরে দাঁড়াতে বলল । আমি ঘরে ঢুকে সরাসরি ওকে বললাম,
--এটা আমার ঘর, তুমি এ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও ।
এত দিন যে ছেলে চোখ তুলে কথা বলেনি, তার মুখে এমন কথা শুনে অফিসারের মুখ হা হয়ে গেল । অফিসার বুদ্ধিমান লোক । বুঝতে পারছে, আজ বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে । ওদের-ই এখন সময় । তাই ঠাণ্ডা গলায় অফিসার উর্দুতে যা বলল, তা বাংলা করলে দাড়ায়,
-আমি মুন্নীর সাথে দেখা করেই চলে যাবে ।
-না, মুন্নীর সাথে তোমার দেখা হবে না ।
-কেন?
-মুন্নীকে আমি বিয়ে করব ।
-অসম্ভব, বলে অফিসার চিৎকার করে ওঠল ।
দরজায় দাঁড়ানো সেপাই দুটো রাইফেল উঁচিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল ।
রাগে অফিসারের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে । জানোয়ারটার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে খালু-খালাম্মা, মুন্নী এ ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ।
ওকে আরো খেপানোর জন্য আমি এগিয়ে গিয়ে মুন্নীর হাত ধরি । তারপর গাঢ় স্বরে বলি,
--মুন্নী, বিজয়ের এই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে আজই আমরা বিয়ে করব। তুমি রাজি?
আমার কথার আগা-মাথা কিছু বুঝতে না পেরে মুন্নী হা করে তাকিয়ে থাকে ।
আমি ওকে চোখ টিপে ইশারা করি । ও বুঝতে পারে, এটা আমার অভিনয় । পাক অফিসারের খপ্পর থেকে ওকে রক্ষা করার জন্যই আমি এসব বলছি । মুন্নী সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে ।
অফিসারের ইঙ্গিত পেয়ে সেপাই দুজন আমাকে মুন্নীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনে রুমের এক কোণে নিয়ে যায় । রাইফেলের বাট দিয়ে আমাকে আঘাত করে । আমি মেঝেতে পড়ে যাই । মুন্নী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে । খালু আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অফিসারের পা জড়িয়ে ধরে । সেপাই দুজন মুন্নীকে টেনে-হিঁচড়ে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় । একজন মুন্নীকে ধরে রাখে । অন্য জন আমার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায় । রক্তের আমার বুক ভেসে যাচ্ছে । পাক হানাদার বাহিনী ওদের কাজ শেষ করে তিন জন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ।
.
খালাম্মা পরম যত্নে আমার মাথাটা উনার কোলের উপর নেন । মুন্নী অঝোর ধারায় কাঁদছে । শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, আমি মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছিল । মুন্নী কান্না জড়ানো গলায় বলছে,
- ক্যান আপনি মিথ্যে কথা বলতে গেলেন?
আমি মৃদু হেসে বলি,
- না মুন্নী, আমি মিথ্যে বলিনি । আমি তোমাকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই ।
মুন্নীর দেহটা অদম্য কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ।
মৃত্যু যন্ত্রণা ছাপিয়ে এক ধরনের ভালো লাগার অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে । খালু আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য নিচে গেছেন । আমি বুঝতে পারছি আমি বেশিক্ষণ বাঁচবো না । তাই হাতের ইশারায় মুন্নীকে ডাকি । ও আমার পাশে এসে বসে । আমার টেবিলটা দেখিয়ে ওকে বলি,
- টেবিলের ড্রয়ারে আমার মাকে লেখা কিছু চিঠি আছে । তুমি চিঠিগুলো মাকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কোরো ।
সব কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে মুন্নী অনেক দূরে বসে আছে । পাশে কোথাও রেডিওতে একটা গান বাজছে, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে...” আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে । চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ইরানি কন্যা আমার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে ।
.
মো. শামছুল ইসলাম
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
ভাষা সহজ সরল।

০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫৩

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই ।

আমি আসলে কঠিন কঠিন ভাষা জানি না ।
বিজ্ঞানের ছাত্র। তাই কঠিনেরে করেছি বর্জন, সহজরে করেছি অর্জন ।

২| ০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো গল্প লিখেছেন।
তবে গল্প কিছু সমস্যা আছে। ঠিক সমস্যাও না। কিসের যেন একটা অভাব।

০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫

শামছুল ইসলাম বলেছেন: সমস্যাটা ধরতে পারলে জানিয়েন ।
চেষ্টা করবো পরবর্তী লেখায় উৎরে যেতে ।

৩| ০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৬

প্রেক্ষা বলেছেন: লেখাটা অসম্ভব রকমের সুন্দর হয়েছে তবে হ্যাপি এন্ডিং হলে আর কষ্ট লাগতো না :(

০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫৭

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ।

কী করবো বলেন?
জীবনটা সবার জন্য সুখের হয় না।

৪| ০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৫৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সুপাঠ্য, সুশোভন লেখা ।

০৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:১৩

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ নেওয়াজ ভাই ।

সুপাঠ্য, সুশোভন লেখা । - দুই শব্দে অসাধারণ মন্তব্য ।

৫| ০৫ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০১

রাজীব নুর বলেছেন: আমার দু'টা মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

১১ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:৩৮

শামছুল ইসলাম বলেছেন: পাঠক মন্তব্য করলো আমি তার জবাব দেবো না, এমন তো হতে পারে না ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.