নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

সাইয়িদ রফিকুল হক

আমি লিখি “দেশ, জাতি, মানুষ আর মানবতার” জন্য। আমার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনা আমার নিজস্ব ও মৌলিক রচনা। তাই, আমার অনুমতি ব্যতিরেকে এগুলো কপি বা নকল করা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা। জয় মানবের জয়।

সাইয়িদ রফিকুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিজয়দিবসের গল্প: একজন মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলীর গর্জন

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১৭



বিজয়দিবসের গল্প: একজন মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলীর গর্জন
সাইয়িদ রফিকুল হক

সোনাপদ্মা-গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলী গত সাতদিন যাবৎ ঘর থেকে বাইরে বের হন না। তিনি খুব মনখারাপ করে বাড়িতে শুয়ে-বসে রয়েছেন। বাইরে বের হতে তাঁর ভালো লাগছে না। মনটা তাঁর ভীষণ খারাপ।
সাতদিন আগে তিনি বাড়ির কাছে বড়বাজারে গিয়েছিলেন। বাজারের পাশে কয়েকটি চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে। মাঝে-মাঝে তিনি এদিকটায় আসেন। পছন্দের লোকজনের সঙ্গে মনখুলে কথাবার্তা বলেন। তবে এখানে বসে তিনি যে আড্ডা দেন—তা ঠিক নয়—তবে সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। সেজন্য তিনি এখানে এসে বসেন।

সেদিনও তিনি এখানে কিছুসময়ের জন্য এসে বসে ছিলেন। আর এককাপ চা-ও পান করেছিলেন।
এখানে, নানাজাতের নানান লোকজন আড্ডাবাজি করতে আসে। এদের মধ্যে বয়স্ক থেকে শুরু করে একেবারে ছোকরা পর্যন্ত রয়েছে। এদেরই একজনের সঙ্গে সেদিন তার বাজারের মধ্যে সামান্য কথাকাটাকাটি হয়েছে। অবশ্য তিনিই কথা বলেছেন বেশি। তবুও তাঁর ক্রোধ কিছুতেই কমছে না। কারণ, তিনি ওই ছেলেটির বেআদবি দেখে স্তম্ভিত। তিনি দেশের এইজাতীয় শত্রুদের একদম সহ্য করতে পারেন না।
তাঁর কথা বলার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ছেলেটি সবার সামনে ভারিক্কিচালে এমন সব কথা বলছিলো যে, তিনি এর সমুচিত-জবাব না দিয়ে আর থাকতে পারলেন না।

যার সঙ্গে সেদিন শমসের আলীর কথাকাটাকাটি হয়েছিলো তার নাম বেল্লাল। সে থাকে সোনাপদ্মা-গ্রামের পুবপাড়ার শেষমাথায়। তার বাপের নাম এনায়েত। লোকজন তার বাপকে এনায়েত মোল্লাও বলে। তার বাপ স্থানীয় সোনাপদ্মা-হাইস্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ছিল। বর্তমানে সে অবসরগ্রহণ করেছে। কিন্তু এখনও সে নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করে থাকে।

সেদিন, সকালে চা-পান শেষ করে মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলী বাড়ির পথ ধরতে উঠে পড়লেন। এমন সময় এনায়েত মৌলবীর ছেলে বেল্লাল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একজনের একটা কথার সূত্র ধরে বলতে লাগলো, “ওই একাত্তর-সালে কে-কী করছে, তা সবাই ভুইলে যান। আসেন, এহন সবাই মিলে দ্যাশটা গড়ি। আর দ্যাশে এহন কোনো রাজাকার নাই। দ্যাশের ভিতরে কিছু লোকজনের এসব মনগড়া কতাবার্তা। আমি কই কি...।”

শমসের আলী আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি হাতের লাঠিটা রাইফেলের মতো সোজা করে বেল্লালের দিকে বাগিয়ে ধরে বললেন, “চুপ করো, বেআদব। আর-একটা কথা বললে আমি তোমাকে এখানেই জুতা দিয়ে পেটাবো। কে বললো—দেশে রাজাকার নাই? এই তো তুমি একটা রাজাকার। আর তোমার মতো আরও কিছুসংখ্যক রাজাকার দেশে এখনও রয়েছে।”
তাঁর গর্জনে বাইশ-তেইশ-বছরের ছোকরা একেবারে চুপসে গেল। সে আর-কিছু বলার সাহস পেলো না। দোকানে অনেক লোকজন বসে আছে। এরা কেউই সামনাসামনি একজন শমসের আলীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পাবে না। কারণ, স্থান-কাল-পাত্র বলে একটা কথা আছে।

শমসের আলী এবার দোকানের কাঠের বেঞ্চটাতে বসে ধীরেসুস্থে বলতে লাগলেন, “তোমাদের মতো রাজাকারের সন্তানরা আজ দেশের ভিতরে এসব প্রচার করছে। একাত্তরের কথা ভুলে যান! কতবড় ধৃষ্টতা আর কতবড় বেআদবির কথা! আমাগরে অস্তিত্বের কথা আমরা কেমন করে ভুলে যাবো? আর একাত্তরে কে-কী করছে—তাইতো জাতির আসল ইতিহাস। এটি আমাগরে চিরদিন মনে রাখতে হবে। দেশে রাজাকার নাই—এসব শয়তানীকথা একমাত্র তোমাদের মতো রাজাকার, আর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারবংশের সন্তানরাই বলে থাকে। কারণ, তোমাদের বাপ-দাদারা ছিল একাত্তরের রাজাকার। এবার আসল কথা খুলেই বলি। তোমার বাপ এনায়েত একাত্তরে পাবনার পুষ্পপাড়া-মাদ্রাসায় দাখিল না কোন ক্লাসে যেন পড়তো। সেই সময় তার বয়স ছিল কমপক্ষে আঠারো-ঊনিশ। এই বয়সেই সে পাকিস্তানকে ভালোবেসে নিজদেশের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তোমার বাপ ছিল দেশের কুখ্যাত রাজাকার-সর্দার মতিউর রহমান নিজামীদের অধীনস্থ আলবদরের নিয়মিত সদস্য। তোমার বাপের রাজাকারির এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী চাও? তোমরা তো রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার। তাই, তোমরা এখন নিজেদের স্বার্থে আর নিজেদের দূষিত রাজনৈতিক স্বার্থহাসিলের জন্য আমাগরে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যাওয়ার কথা বলে স্পর্ধা দেখাও! তোমাদের সাহস দেখে আমরা বাঁচি না! মনে রেখো: এই দেশে চিরদিন বলা হবে—কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আর কে বিপক্ষশক্তি। তোমাদের মতো শয়তান এখনও এই দেশে আছে বলেই দেশটার অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তোমরা অধঃপতিত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা মনে কর—মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাওয়ার জিনিস! কিন্তু আমরা একাত্তরের নয়টি মাস নিজেদের জীবনবাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আর তখন আমরা স্বচক্ষে দেখেছি, আমাগরে এই স্বাধীনতা-নস্যাৎ করার জন্য এদেশেরই কিছুসংখ্যক পাগলাকুকুর পাকিস্তানীদের পক্ষ নিয়ে তাদের জন্য খেটে মরেছে। তাদের মুত খেয়েছে। দিন-রাত পাকিস্তানীদের বাপ ডেকেছিলো। আর ওরা, ওদের সেই পাকিস্তানী-বাপদের মুত খেয়েছিলো! কিন্তু কেন?”

এমন সময় চায়ের দোকানদার শরাফত আত্মচিৎকারের ভঙ্গিতে বললো, “চাচাজান, আর কইয়েন না। আমার ঘেন্না লাগতেছে! ওই রাজাকার শুয়রের বাচ্চারা একাত্তরে পাঞ্জাবীগরে মুতও খাইছে। ওরা মানুষের বাচ্চা ছিল না। এখনও না। আমার মতে, ওরা শুয়রের বাচ্চা। ওরা এই দেশের মানুষরে, একাত্তরে এতো কষ্ট দিছে যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখনও কষ্ট দিতেছে।”

“তুমি ঠিকই কইছো ভাতিজা। ওরা এমনই নরপশু।”—কথাটা বলে মুক্তিযোদ্ধা শমসেরসাহেব চারপাশে প্রায় সবার দিকে তাকালেন।

এরপর শমসেরসাহেব একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, “একাত্তরে বেল্লালের বাপ ছিল একটা রাজাকার। তাই, বেল্লাল আমাগরে মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাইতে কয়! কতবড় আহাম্মকের বাচ্চা এরা! আর কতবড় শয়তান! এনায়েত নিজেই তো এখনও ভালো হয় নাই। ওর মনের মধ্যে সারাক্ষণ শয়তান ঘোরাফেরা করে! ওর ছেলে এর চেয়ে আর কী হবে?”

বেল্লাল এতোক্ষণ মাথানিচু করে চুপচাপ চা-পান করছিলো। সে দেখলো, লোকজনের সামনে এখন কোনো কথা বলতে গেলে কপালে নির্ঘাত মাইর আছে। তাই, সে চুপ করে ছিল। কিন্তু বাপের নামে এসব কথা শুনে শমসের আলীর দিকে চেয়ে হঠাৎ সে বলে উঠলো, “চাচা, আমারে দুই-চাইর কতা ভালোমন্দ যা কন—আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমার বাপরে কিছু কইয়েন না। তিনি একজন মাস্টার-মানুষ!”

কথাটা শুনে শমসের আলী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, “তোমার বাপ সোনাপদ্মা-স্কুলের মৌলবী-শিক্ষক হইছিলো কীভাবে—তা আমি জানি। রাজনৈতিক পরিচয়ে আর আমাগরে এলাকার কিছু নেতা-নামধারী বদমাইশদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে—তাদের ম্যানেজ করে। এসব আমরা জানি। ওরে তো আমি মাস্টারই মনে করি না। ও-তো এখনও আমাগরে শত্রু।”

শেষের কথাটা শুনে বেল্লাল তাড়াতাড়ি চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে যেন একদৌড়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। সে বুঝে গেছে, এখানে আর-কিছুক্ষণ বসে থাকলে এবার তার কপালে মাইর আছে। নিজের পিঠ বাঁচাতে সে আর কালবিলম্ব করলো না।

শমসেরসাহেব তাকে ডাক দিয়ে বললেন, “এই দাঁড়াও। আমার কথা এখনও শেষ হয় নাই।”
কিন্তু বেল্লাল তাঁর কথাটা শুনে যেন দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো।

উপস্থিত লোকজন তা-ই দেখে হাসে। তারা নানাভাবে শমসের আলীর প্রশংসা করতে থাকে। কিন্তু শমসেরসাহেব জানেন, এরমধ্যেও ভেজাল আছে। কিছুসংখ্যক লোক শুধুই তোষামোদকারী। এদের বহুমুখী উদ্দেশ্য আছে। তবে ভালোমানুষও আছে। আসলে, সমাজের মানুষগুলো এখনও সুবিধাবাদী থাকতে চায়। এদের মতের পরিবর্তন হলে এই দেশের রাজাকারগুলো একেবারে নির্মূল হয়ে যেতো।

শমসের আলীর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এইরকম আজেবাজে কথা শোনার জন্যই কি তারা দেশটা স্বাধীন করেছিলেন? তার মনটা ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠতে থাকে।
তাঁর মনের অবস্থা বুঝে শরাফত বললো, “চাচাজান, আপনারে আরেক কাপ চা দেই?”
শমসের আলী আর না করলেন না। তার মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। এবার চায়ে মাথার ঝিমঝিমানিটা যদি একটু কমে!

তিনি আপনমনে ভাবতে লাগলেন: কতবড় বেআদব এরা! এদের বাপ-দাদারা একাত্তরে বিরাট ভুল করেছিলো। আজ সময় এসেছে, তাদের বাপ-দাদার সেই ভুলস্বীকার করে নিজেদের মানুষরূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। কিন্তু এরা তা না করে নিজেদের শয়তানীমতবাদের উপর ভিত্তি করেই চলছে। এদের বাপ-দাদার শয়তানী-পাকিস্তানের জন্য এখনও কাঁদছে! আর এদের বংশধরদেরও তা-ই শেখাবে! এরা কতবড় অকৃতজ্ঞ আর শয়তান! এরা কালসাপের চেয়েও ভয়ংকর। এরা সবসময় আমাগরে ছোবল মারার জন্য বসে আছে। আর এরা নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সবসময় আত্মরক্ষার ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে ইসলামধর্মকে। এরা ধর্মের শয়তান।

শমসের আলীর মনটা সেই যে খারাপ হলো। আর সহজে ভালো হচ্ছে না। তিনি সাতদিন বাড়িতে বসে মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা দেশের নামকরা লেখকদের বইগুলো পড়েছেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন ভরেনি। তাঁর মনে হলো: সর্বস্তরের রাজাকারদের দ্রুতবিচারের মাধ্যমে এদের চিরতরে নির্মূল করতে হবে। নইলে, এদের আস্ফালন থামবে না। এদের সাহস দেখে তিনি সাংঘাতিকভাবে স্তম্ভিত! আজ এরা দেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যাওয়ার কথা বলছে! তাঁর রাইফেলটা যদি এখন থাকতো!


আজ বীর-মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলীর স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার অষ্টম দিন। আজও তিনি পণ করে বসে আছেন—কিছুতেই ঘরের বাইরে যাবেন না। বাইরে গেলেই বেল্লালের মতো খবিসশয়তানদের সামনে পড়তে হয়। এদের মতো জানোয়ারের চেহারা দেখাটাও তার জন্য লজ্জার বিষয়। যাদের বিরুদ্ধে তাঁরা একাত্তরের রণাঙ্গনে ভয়াবহ যুদ্ধ করেছিলেন, আর যাদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত-পরাজিত করেছিলেন—সেই পাপিষ্ঠপামরের দল আজ দেশবিরোধী বড়-বড় কথা বলে! তাঁর মনের অবস্থা হঠাৎ এমন হলো যে, দেশের প্রয়োজনে তাঁর এখনই আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করছিলো।

আর কয়েকদিন পরে বিজয়দিবস। তবুও ঘর থেকে বাইরে বের হলেন না শমসের আলী। এই সমাজের কিছু-কিছু মানুষের প্রতি তাঁর মন ঘৃণায় রি-রি করে উঠলো। এরা এই দেশের মানুষ। অথচ, আজও এই দেশটাকে ভালোবাসে না। ১৯৭১ সালে, নয়টি-মাস যাবৎ জাতি পাকিস্তানী-হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যুদ্ধজয় করলো। আর সেই মহাযুদ্ধকে আজ ভুলে যেতে বলছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী-শয়তানগোষ্ঠী। দেশের একশ্রেণীর মানুষ-নামধারী-শয়তানদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এরা এমন ধৃষ্টতাপ্রদর্শন করার বদসাহস দেখাচ্ছে, এবং এরা আজও টিকে আছে।
তাঁর মনে হলো: রাস্তায় বের হলে এখন একটা-না-একটা দেশদ্রোহীঘাতকের সঙ্গে দেখা হয়। এদের কথাবার্তা শুনলে তৎক্ষণাৎ তাঁর পা থেকে জুতা-স্যান্ডেল খুলে অমনি তাদের পেটাতে ইচ্ছে করে।

আজ দুপুরে খাওয়ার পর নিজের দোতলাঘরের জানালার পাশে বসে তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিলো: একাত্তরের যুদ্ধজয়ের পর তাঁদের অস্ত্রসমর্পণ করাটা কোনো ভুল হয়নি তো? আজ যুদ্ধের অস্ত্রগুলো থাকলে তবুও এই দেশবিরোধীশুয়োরগুলোকে ঘায়েল করা যেতো। এখন যে তিনি একেবারে খালি হাতে! তারপর তাঁর মনের ভিতরে অদ্ভুত এক ভাবনার উদয় হলো—এখন ওদের সত্যইতিহাস ও যৌক্তিক ধ্যানধারণা দিয়ে পরাস্ত করতে হবে। এখন যুক্তির জোরই হবে মানুষের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তবুও তাঁর মনে হলো—যুক্তির সঙ্গে প্রতিরোধসংগ্রামও আজ প্রয়োজন।

তাঁর নিজের ঘরে স্বেচ্ছায় সাতদিন বন্দি হয়ে থাকায় খবরটা সারাগ্রামে রাষ্ট্র হয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। তাই, লোকজন শমসেরসাহেবকে দেখেতে আজ সকালে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। আজ আবার বাঙালি-জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি দিন—মহান বিজয়দিবস। আজ ষোলোই ডিসেম্বর তিনি ঘরের দরজা খুলে বাইরের উঠানে চেয়ারটাতে বসলেন। তাঁর মনটা হঠাৎ যেন একনিমিষে একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের মতো সতেজ হয়ে উঠলো। তাঁর চোখেমুখে এসে লাগলো সেই মহাবিজয়ের মহানন্দ।

তাঁর সমবয়সী অনেকেই এসেছেন। আর তাঁর একাত্তরের রণাঙ্গনের কয়েক বন্ধুও তাঁকে দেখার জন্য ছুটে আসতে কালবিলম্ব করেননি। তাঁরা খুব ভালোভাবে জানেন যে, একজন শমসের আলী এদেশের নিঃস্বার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। তিনি এখনও রাজাকারপ্রতিরোধে অদ্বিতীয়।

মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী তাঁর পাশে বসে বলতে লাগলেন, “একটা শয়তানের কথায় তুমি মনখারাপ করে কেন ঘরে বসে থাকবে? প্রয়োজনে আমরা ওই শয়তানদেরই ঘরে বন্দি করে রাখবো। তুমি এবার বাইরে চলো। আইজ আমাগরে বিজয়ের দিন।”
আরও কয়েকজন তাঁর কথায় জোরালো সায় জানিয়ে বলতে লাগলেন, “হ-হ, তা-ই করতে হবে। কিন্তু তুমি কেন মনখারাপ করে এভাবে ঘরে বসে থাকবে! এতে যে ওদের স্পর্ধা আরও বেড়ে যাবে। চলো, আইজ আমরা বিজয়মিছিল করে আসি!”
মুক্তিযোদ্ধা মোজাহার মিয়া বললেন, “ওদের বিরুদ্ধে আমাগরে এখনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব লোককে এখন থেকে একজায়গায় দাঁড়াতে হবে। আর সবাইকে একইসুরে-একইভাষায় কথা বলতে হবে। তাইলে, একাত্তরের হায়েনা ও এদের বংশধররা আর কোনো সুযোগ পাবে না। আমাগরে আরও মনে রাখতে হবে যে, ওরা পাগলাকুকুর। তাই, একটু সুযোগ পাইলেই ওরা আমাগরে খালি কামড়াইতে চায়। ওদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার চিন্তাভাবনা আমাগরেই করতে হবে।”
রজব আলী আবার বললেন, “আমাগরে ভাই শমসের যদি এভাবে ঘরে বইসে থাকে—তাইলে ওই শয়তানগুলারে শায়েস্তা করবে কে? তাই, আইজ থেইকে আর ঘরে নয়। চলো সবাই, বড়বাজারের চায়ের আড্ডাখানায় যাই। তার আগে আমাগরে ঐতিহাসিক বিজয়মিছিল করতে হবে।”

সবার পীড়াপীড়িতে শমসের আলী আর না করতে পারলেন না। তিনি যেন একলাফে উঠে দাঁড়ালেন, আর বললেন, “চলো সবাই। জয়-বাংলা।”

তাঁরা সবাই এখন ষাটোর্দ্ধ মানুষ। তবুও তাঁরা বীরের মতো হাঁটছে। দেখতে-দেখতে তাঁদের লোকজনবৃদ্ধি পেয়ে একটা মিছিলে পরিণত হলো। সবার আগে মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলী। তাঁর পিছনে মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী, মুক্তিযোদ্ধা মোজাহার মিয়া প্রমুখ।
একসময় শ্লোগান ধরলেন শমসের আলী: জয় বাঙালির জয়—বীর-বাঙালির নাইরে ভয়। রাজাকারের চামড়া—তুলে নেবো আমরা। পাকিস্তানের রাজাকার—এইমুহূর্তে বাংলা ছাড়। জয়...।

গ্রামের সাধারণ কিছুসংখ্যক মানুষও এই মহামিছিলে শামিল হলো। সবাইকে কাছে পেয়ে শমসের আলীদের শক্তি ও সাহস বেড়ে গেল আরও কয়েকগুন। তাঁরা এখন পল্টনের প্যারেডরত সৈনিকদের মতো যেন হাঁটছে! বীরদর্পে ছুটছে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাগণ।

রজব আলী একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, মিছিলে লোকসংখ্যা কমপক্ষে একশ’ চল্লিশজন তো হবেই। তাঁর মুখটা আনন্দে ভরে উঠলো। তাইলে, মানুষজন মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুইলে যায় নাই!
তাঁর মুখটা ধীরে-ধীরে আরও প্রশান্তিতে ভরে উঠতে থাকে।

দুর্বার-গতিতে তাঁরা শ্লোগান তুলে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ সোনাপদ্মা-স্কুলের কাছে এসে শমসের আলী মিছিলের গতি একটু কমিয়ে দিলেন। তারপর হাতের ইশারায় সবাইকে নিয়ে সেখানেই চুপচাপ দাঁড়ালেন। মাইকে একটা কথা শুনে তাঁর শিরঃদাঁড়া একেবারে খাড়া হয়ে ওঠে। তিনি মনোযোগ দিয়ে স্কুল-কর্তৃপক্ষের আয়োজিত আলোচনা-অনুষ্ঠানের একটা লোকের বক্তব্য শ্রবণ করতে লাগলেন।

লোকটা মাইকে গলাফাটিয়ে চিৎকার ও চেঁচামেচি করে বলছিলো: আমরা আজও স্বাধীন হইতে পারি নাই! কীসের স্বাধীনতা? কোনখানে স্বাধীনতা আছে? সবখানে ভারতের গোলামি! দেশস্বাধীন হয়ে আমাগরে কোনো লাভ হয় নাই। দেশে এখন স্বাধীনতা নাই! আমাগরে স্বাধীনতা নাই! আমরা এখনও স্বাধীন হইনি! বাংলাদেশ আজ কথিত স্বাধীন, আর তা শুধু খাতাকলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কোথাও কোনো স্বাধীনতা নাই। কারণ, আমাগরে চাইরদিকে ভারত। তারা আমাগরে ঘিরে রাখছে। এইটা ভারতের করদরাজ্য-গোলামরাজ্য! আমরা আজও স্বাধীনতা পাইনি! দেশে এখন কোনো স্বাধীনতা নাই! আমাগরে স্বাধীনতা নাই! আমরা তো এখনও স্বাধীন হইনি! তার আবার কীসের বিজয়দিবসপালন! এইটা ভারতের বিজয়! আমরা এই বিজয়দিবস চাইনি! আমরা...।”

শমসের আলী কথাগুলো শুনে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন। তাঁকে দেখে মনে হলো—তিনি যেকোনোসময় ফেটে পড়বেন।

একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনওই দেশের স্বাধীনতার অবজ্ঞা সহ্য করতে পারেন না। আমাদের দেশে হাজারো সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা অমূল্য সম্পদ। এটিকে যারা আজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে—তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও তাদেরই বংশজাত-পাপিষ্ঠসম্প্রদায়।

শমসের আলী সবার দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো গর্জন করে বলে উঠলেন, “এইটা ওই বেল্লালের বাপ এনায়েত মোল্লা না? ওরা তো আমাগরে এই স্বাধীনতা চায়নি। ওরা চাইছিলো শয়তানের পাকিস্তান। ওদের পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। তাই, ওদের কাছে এখন স্বাধীনতা নাই মনে হচ্ছে। ওদের সাহস কত! ওরা এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানে না! আবার বলে—কীসের বিজয়দিবস! ধর, এই হারামজাদাদের। ধর, এই রাজাকারের বাচ্চাদের। জয়-বাংলা।”

তাঁর পাশে দাঁড়ানো রজব আলী ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, “হ-হ, ওই হারামজাদাটাই তো। আর দেখেন, পাশে খাড়ায়ে ওর কথাবার্তা শুনতিছে ইস্কুলের আরেক শিক্ষক-নামধারী রাজাকার।”

শমসের আলী জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, “ধর রাজাকার ধর। এবার রাজাকারদের লেকচার থামাও। সবকয়টারে ধর। একটাও যেন পালাইতে না পারে। ধর-ধর-ধর...।”
শমসের আলীর পিছনে দাঁড়ানো সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, “ধর-ধর-ধর। রাজাকার ধর।”

তারপর শমসের আলীর সঙ্গে সবাই গগণবিদারীকণ্ঠে বলে উঠলেন, “জয়-বাংলা।”
এই একটিমাত্র ধ্বনি শোনামাত্র বক্তৃতা ফেলে রেখে এনায়েত মোল্লা স্কুলের সাধারণ মঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়ে স্কুলের পিছনদিকের আখক্ষেত ভেঙে একদিকে ছুটতে লাগলো। তার সঙ্গে আরও কয়েকটা। আর চোখের পলকে যেন ওরা হাওয়া হয়ে গেল!

শমসের আলীরা খুব অবাক হলেন আর ভাবলেন—এই বয়সেও এনায়েত-শয়তানটা এতো জোরে দৌড়ায় কীভাবে? ওদের বুঝি বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে? ওরা বুঝি লাদেনের সন্তান!

স্কুলের মাঠ খালি হতে বেশি সময় লাগেনি। এই খালি মাঠ অতিক্রম করে শমসের আলীরা তবুও ওদের ধরার জন্য ধাওয়া করে ছুটতে লাগলেন। দেশের শত্রুদের এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এবার ওদের ধরতেই হবে। জয়-বাংলা।


সাইয়িদ রফিকুল হক
১৫/১২/২০১৭

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৫

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: ভালো লাগা রেখে গেলাম।

২| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০২

প্রোলার্ড বলেছেন:


শমশের কাকাকে এই ছবিটা দেখাবেন

৩| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: ত্রিশ লক্ষ মানুষ যদি হাতে হাত ধরে দাঁড়ায় তবে তার দৈর্ঘ্য হবে ১১০০ কিলোমিটার, যা টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়ার দূরত্বের চেয়েও বেশি !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.