![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তখন আমি মাত্র এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। কোন এক বিকালে জীবনে প্রথম আহসান মঞ্জিলে যাই। ঐতিহাসিক এই নবাব বাড়িটি দেখে তখন তেমন কোন কৌতুহল বোধ করি নাই। জমিদারদের বাড়ী সামনাসামনি দেখে ভালো লেগেছিল। বারবার মনে পড়ছিল অয়োময় নাটকের কথা। আগ্রহ বলতে ওই অতটুকুই। ভেতরের ঘর গুলোতে গিয়ে কিছুটা ভয় ভয় লাগছিল। তাও আবার ভুতের ভয়। তবে ইতিহাস নিয়ে মোটেও আগ্রহ বোধ করি নাই। আগ্রহটা তৈরী হয় বড় হওয়ার পরে। তৈরী হয় কৌতুহল।
কি ছিল ঢাকার নবাবদের ইতিহাস? প্রকৃতপক্ষে এই নবাবেরা আসলে কাদের নবাব ছিলেন? যদি তারা শুধু ঢাকার নবাব হন, তাহলে ঢাকা বাদে বাংলাদেশের অন্য স্থানগুলোর শাসন কাদের হাতে ছিল? আবার ভারতবর্ষ ই’বা কোন শাসনের অধীনে ছিল?
কৌতুহল বোধ করি এই নবাবীর সমাপ্তি ও পরবর্তী প্রজন্মদের নিয়েও। কোথায় আছে তারা? ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কৌতুহল।
সময়ের তাড়নায় এই কৌতুহল বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। সাংসারিক আর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে করতে সব আগ্রহ-ই একসময় হারিয়ে যায়। কিছুদিন আগে কোন একরাতে কৌতুহল এড়াতে পারলাম না। প্রশ্নগুলো আবারো মাথার মধ্যে ঘুর-পাক খেতে লাগলো।
ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে জানলাম অনেক কিছু । ইতিহাস জানতে পেরে বেশ ভালো লেগেছে। আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে। অনেক বড় লেখা। একটু ধৈর্য ধরে পড়তে হবে।
কাহিনীর প্রয়োজনে অনেক ভিন্ন ইতিহাস নিয়েও লিখতে হয়েছে। কারণ নবাবদের ইতিহাস জানতে হলে তার আশেপাশের ভারতবর্ষের কিছু কাহিনী না জানলে কাহিনী অসম্পুর্ণ মনে হতে পারে। নবাবদের এদেশে আগমন থেকে আমাদের আলোচনার শুরু।
পাঠকদের একটা কথা প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। আমার এই লেখার মধ্যে অনেক কিছুই আছে যা অন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য উৎস হতে হুবহু কপি করা হয়েছে। আসলে সবগুলো নবাবদের ধারাবাহিক কাহিনী একত্রে কোথাও খুঁজে পাইনি। আমি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন অংশ থেকে বিশেষ বিশেষ কথাগুলো একত্রিত বা সংকলিত করতে। কোন ভুল ভ্রান্তি হলে ক্ষমাপ্রার্থী। ভুল ভ্রান্তি আমাকে জানালে শুদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করব।
১৭৩৯ সাল। সেই সময় সমগ্র বাংলায় স্বাধীন নবাব আলিবর্দি খানের শাসন বিদ্যমান। আর বাংলা বাদে সমগ্র মোঘল সাম্রাজ্যে হলো মোঘল সম্রাট নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ শাহ এর শাসন। দিল্লীর এই মোঘল সম্রাট নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ শাহ-এর রাজ কর্মচারী ছিলেন খাজা আব্দুল হাকিম। এই খাজা আব্দুল হাকিম-ই হলো ঢাকার নবাবদের প্রথম মাইগ্রেট্র্রর, যার অরিজিন হলো কাশ্মীর। এই খাজা আব্দুল হাকিমকে নিয়ে-ই আমাদের আলোচনার শুরু।
খাজা আব্দুল হাকিম ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। তবে কাশ্মীরে ব্যবসা ভালো না হওয়ায় তিনি দিল্লীতে এসে মোঘল শাসক নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ শাহ এর রাজদরবারে চাকুরী নেন। সেই সময়ে ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে ভরপুর। তৎকালীন পারস্যের সুলতান নাদির শাহ সেই সম্পদের লোভে ১৭৩৯ সালে দিল্লী আক্রমন করেন। দিল্লীর সম্রাট নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ শাহ ছিলেন সামরিক দিক দিয়ে দূর্বল। নাদির শাহও সেই সুযোগটাই গ্রহন করেছিলেন। মাত্র তিন ঘন্টার যুদ্ধে তিনি দিল্লী দখল করেছিলেন। সেই সময়ে ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ভূখন্ড বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সরফরাজ খানের নিযুক্ত (পরবর্তিতে নবাব আলিবর্দি খানের নিযুক্ত) বিভিন্ন নায়েবের মাধ্যমে শাসিত বা পরিচালিত হত। বাংলা যেহেতু মোঘলদের থেকে স্বাধীন ছিল সেহেতু নাদির শাহের আক্রমনের কোন প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।
নাদির শাহের আক্রমনে ভীত হয়ে দিল্লীর রাজ কর্মচারী খাজা আব্দুল হাকিম (যিনি ঢাকার নবাবদের প্রথম মাইগ্রেটর) তাই দিল্লী থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশে এসে তিনি প্রথমেই সিলেটে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সুতরাং বলা যায় যে, ঢাকার নবাবদের পূর্ব পুরুষদের এই দেশে প্রথম আগমন এর জায়গা হলো সিলেট। সিলেটে এসে খাজা আব্দুল হাকিম কাশ্মীরের মত আবারো ব্যবসা শুরু করেন এবং লাভবান হন। ব্যবসা ভালো হওয়ায় তিনি কাশ্মীরে অবস্থান করা তার কিছু নিকট আত্মীয়দেরকেও সিলেটে আসতে অনুরোধ করেন। তার কথা মত খাজা আব্দুল কাদির ও খাজা আব্দুল্লাহ কাশ্মীর হতে সিলেটে আসেন।
রক্তের সম্পর্কের দিক দিয়ে বিচার করলে এই খাজা আব্দুল্লাহ-ই (যিনি খাজা আব্দুল কাদিরের অনুরোধে বাংলাদেশে এসেছিলেন) হলো ঢাকার নবাবদের আসল পূর্বপুরুষ। খাজা আব্দুল্লাহ পরবর্তীতে সিলেট থেকে ঢাকা আসেন এবং ঢাকার বেগমবাজারে এসে ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময়ে ঢাকা ছিল বাংলার নবাবী আমলের নিযুক্ত নায়েব (বা প্রতিনিধি)-র মাধ্যমে শাসিত এলাকা।
পরবর্তি আলোচনা নবাবদের ধারাবাহিক পূর্বপুরুষদের তালিকা আকারে উপস্থাপন করা হলোঃ
খাজা আব্দুল্লাহ:
উপনিবেশিক আমলে পূর্ববাংলার সর্ববৃহৎ জমিদারির নাম ঢাকা নওয়াব এস্টেট। ঢাকা নওয়াব এস্টেট-এর সূচনাকারী খাজা হাফিজুল্লাহ-এর পিতার নাম খাজা আব্দুল্লাহ (যিনি খাজা আব্দুল হাকিমের অনুরোধে ব্যবসায়ের উদেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন)। রক্তের সম্পর্কের দিক দিয়ে এই খাজা আব্দুল্লাহ-ই হলো ঢাকা-এস্টেট এর নবাবদের প্রথম পূর্ব পুরুষ।
মৌলবী খাজা হাফিজুল্লাহঃ
খাজা আব্দুল্লাহর চারটি পূত্র সন্তান হয়। এই চার সন্তানের মধ্যে একজন হলেন খাজা হাফিজুল্লাহ। তিনি খুব মেধাবী ব্যবসায়ী ছিলেন। ঢাকার বেগমবাজার থেকে তিনি খুব ভালো ব্যবসা করতে থাকেন আর দিন দিন ব্যবসায়ের উন্নতি করতে থাকেন। বাংলায় ততদিনে নবাব মুর্শিদকুলী খান এর প্রতিষ্ঠিত নবাবী আমলের সমাপ্তি হয়েছে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন বিদ্যমান।
১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে জমিদারি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে খাজনা বাকী পড়ায় মোগল আমল থেকে চলে আসা জমিদারিগুলির দুর্দিন শুরু হয় ও অনেক পুরনো বনেদী জমিদার তাঁদের জমিদারি হারায়। এ বন্দোবস্তের পরেও যারা জমিদারি ক্রয় করছিল তাদের মধ্যেও অনেকেরই জমিদারি নিলামে উঠে। নব্যপুঁজিপতি ব্যবসায়ী বা বানিয়ারা নিলামে উঠা ওই সব জমিদারি ক্রয় করে ব্যবসায়ী থেকে জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রেক্ষাপটেই মৌলবী খাজা হাফিজুল্লাহ ১৮০৬ সালে বাকেরগঞ্জে প্রথম জমি ক্রয় করেন। ক্রয় করতে থাকেন একের পর এক জমিদারী। খাজা হাফিজুল্লাহ ক্রয়কৃত জমিদারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলঃ ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমানে টাঙ্গাইল) আতিয়া পরগনা, সুন্দরবনের আইলা, টিয়ারখালী, ও ফুলঝুরি পরগনা।
খাজা হাফিজুল্লাহ তার জীবদ্দশায় তার ভাতিজা খাজা আলিমুল্লাহকে উত্তরাধীকারী করে যান।
খাজা আলিমুল্লাহঃ (জন্মঃ ? মৃত্যুঃ ১৮৪৩-১৮৪৬)
(ঢাকা নওয়াব এস্টেট পরিচালনাঃ ১৮৪৩-১৮৪৬)
খাজা আলিমুল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে ঢাকা নওয়াব এস্টেট সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
ঢাকা নওয়াব এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৬ সালে। এই এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা হলেন খাজা আলিমুল্লাহ। প্রকৃতপক্ষে এই এস্টেটের মূল ব্যবসা হলো এস্টেটের নামে ক্রয়কৃত সমস্ত সম্পত্তি ও বিভিন্ন স্থানের জমিদারী ও পরগনা সমূহ। এই এস্টেটের একজন পরিচালক থাকবেন এবং এই পরিচালক-ই নওয়াব বা নবাব হিসাবে ভূষিত হবেন।
খাজা আলিমুল্লাহ হলেন ঢাকা নওয়াবী এস্টেটের প্রবক্তা। তার চাচা খাজা হাফিজুল্লাহ-র কোন যোগ্য উত্তরসূরি ছিল না। এজন্য তিনি তার ব্যবসার কৌশল ভাইয়ের ছেলে খাজা আলিমুল্লাহকে শিখিয়ে দিয়ে যান। তার মৃত্যূর পর তাই খাজা আলিমুল্লাহ-ই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হন। খাজা আলিমুল্লাহ তার চাচা হাফিজুল্লাহর মতই বিচক্ষণ ছিলেন।
খাজা আলীমুল্লাহ বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা জেলায় বিস্তর জমিদারি ও বহুসংখ্যক নীলকুঠি ক্রয় করেন। তিনি মহাজনি কারবার করতেন এবং ঢাকা ব্যাংকের একজন প্রধান অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। খাজা আলীমুল্লাহর প্রভাব প্রতিপত্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার তাঁদের ভূ-সম্পত্তি পরিচালনার জন্য তাঁকে মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। তাঁর সময় খাজা পরিবারের ধন-সম্পত্তি পুরোপুরি একটি একক এস্টেটে পরিণত হয় এবং তাঁদের খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। খাজা আলীমুল্লাহ তাঁর নিজের সহায় সম্পত্তি মৃত্যুর পরেও অটুট রাখার নিমিত্তে তা একটি ট্রাস্ট ফান্ডের অধীন এনে একজন উপযুক্ত উত্তরাধীকারীর কর্তৃত্বাধীনে রেখে যেতে মনস্থ করেন। সার্বিক দিক বিচার করে তিনি পুত্র আবদুল গনিকে উপযুক্ত বিবেচনা করেন এবং ১৮৪৬ খ্রি. একটি ওয়াকফনামা ও কয়েকটি দানপত্র দলিল (হেবা বেল এওয়াজ) সম্পাদন করে যাবতীয় সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক কারবার তাঁর কর্তৃত্বে ছেড়ে দেন এবং অন্যান্য পুত্র-কন্যা ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ভাতা ধার্য করে দেন। উক্ত ওয়াকফ দলিলকে ঢাকা নওয়াব পরিবারের প্রভাবের মূল চাবি কাঠি বলা হয়।
তার মৃত্যু হয় ১৮৫৪ সালে। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি ১৮৪৬ সালে পূত্র আব্দুল গনিকে নওয়াবী এস্টেটের নওয়াব নিযুক্ত করেন।
(০১) নওয়াব খাজা আবদুল গনিঃ (জন্মঃ ১৮১৩, মৃত্যুঃ ১৮৯৬
(ঢাকা নওয়াব এস্টেট পরিচালনাঃ ১৮৪৬-১৮৯৬)
খাজা আবদুল গনির ছিলেন পিতা খাজা আলিমুল্লাহ-র মাধ্যমে নিযুক্ত ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে খেতাব প্রাপ্ত প্রথম নওয়াব। ১৮৪৬ সালে তিনি ঢাকা নওয়াব পরিবারের অর্থাৎ নওয়াবী এস্টেটের নওয়াব নিযুক্ত হন।
খাজা আবদুল গনির ইংরেজ শাসকদের সাথে তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তখন তার বয়স মাত্র সাতাশ বছর। সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় তিনি ইংরেজদের অর্থ, হাতি, ঘোড়া, নৌকা সবকিছু দিয়ে খুবই সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন। সে জন্য বাংলার শাসক হ্যালিডের রিপোর্টে গনি মিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৮৬০ সালে ঢাকায় মুসলমান শিয়া-সুন্নীদের দাঙ্গা যখন ইংরেজ সরকার থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন নওয়াব আবদুল গনি নিজের চেষ্টায় তিন দিনের মধ্যে ঢাকা শহরকে শান্ত করেছিলেন। ১৮৬৭ সালে ভাইসরয় তাঁকে আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন এবং ১৮৬৮ সালে কে.সি.এস.আই (কিং কম্পানিয়ন অব দিঅর্ডার অফ দি স্টার অব ইন্ডিয়া) উপাধি লাভ করেন। ১৮৭৫ সালে তাঁকে বংশানুক্রমিক 'নবাব' উপাধি দেওয়া হয়।
ঢাকা শহরে নওয়াব আবদুল গনির প্রভাব প্রতিপত্তের প্রতীক ছিল আলী মিয়ার ক্রয়কৃত রংমহল। যা বর্তমানে 'আহসান মঞ্জিল' নামে পরিচিত। তিনি বাড়ীটিকে মেরামত করে ছেলে আসহানউল্লাহ্ এর নামে নামকরণ করেন। বাড়ীটি ঢাকাবাসীর কাছে 'নবাব বাড়ী' হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। ঢাকা শহরের শাহবাগ, বেগুনবাড়ী সহ অনেকাংশেরই মালিক ছিলেন নওয়াব আবদুল গনি। তিনি বেগুনবাড়ীতে চা বাগান করেছিলেন। ঢাকায় পেশাদারী ঘোড়দৌড় শুরু করেছিলেন বলে অনেকের মতে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান আবদুল গনির সম্পত্তি ছিল। তখন ঘোড়দৌড় ঢাকায় শহুরে বিনোদন হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
খাজা আবদুল গনিই ঢাকা শহরে প্রথম বিশুদ্ধ পানির সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৮৭৯ সালে নওয়াব আবদুল গনির কে.সি.এস.আই উপাধি পাওয়া এবং প্রিন্স অফওয়েলসের সুস্থ হয়ে ওঠা উপলক্ষে সরকারকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেছিলেন। তখন একটি কমিটি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ঢাকাবাসীর জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা হবে। নওয়াব আবদুল গনি আরও প্রায় দুই লক্ষ টাকা দান করেছিলেন এই প্রকল্পে।
ব্যক্তিগত জীবনে আবদুল গনি দুই বার বিয়ে করেছিলেন। তার সন্তানাদির সংখ্যা ছিল ছয়জন। ১৮৭৭ সালে খাজা পরিবারের দায়িত্বভার দিয়েছিলেন পুত্র আহসান উল্লাহের উপর। ১৮৯৬ সালে যেদিন তিনি পরলোকগমন করেন সেদিন ঢাকার সকল স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ ছিল।
(০২) নওয়াব খাজা আহসান উল্লাহঃ(জন্মঃ ১৮৪৬, মৃত্যুঃ ১৯০১
(ঢাকা নওয়াব এস্টেট পরিচালনাঃ ১৮৯৬-১৯০১)
পিতার মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১৮৯৬ থেকে তিনি ঢাকা নওয়াবী এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব পান। ১৮৯৬ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
জীবদ্দশায় তিনি অনেক দানশীলতার পরিচয় দেন। মাত্র পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন চ্যারিটিতে অন্তত ৫০ লক্ষ রুপি দান করেন। কুমিল্লা শহর প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ অবদান রাখেন ও আর্থিক সহায়তা করেন। তার উল্লেখযোগ্য ভুমিকার কারণে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেঃ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (যা বর্তমানে বুয়েট) এবং পটুয়াখালীতে হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও আরও অনেক বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯০১ সালে ১৬ ডিসেম্বর তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তার পরে ঢাকার নবাব হন তার পুত্র খাজা সলিমুল্লাহ।
(০৩) খাজা সলিমুল্লাহবা নওয়াব সলিমুল্লাহ (জন্মঃ ১৮৭১, মৃত্যুঃ ১৯১৫
(ঢাকা নওয়াবী এস্টেট পরিচালনাঃ ১৯০১-১৯১৫)
১৯০১ সালে পিতা খাজা আহসান উল্লাহ-র এর মৃত্যুর পরে নওয়াব এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব বা মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত হন তার পুত্র খাজা সলিমুল্লাহ। তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিমলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তিনি ঢাকার রমনা এলাকায় নিজ জমি দান করেন।
১৯০৩ সালে বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে নওয়াব সলিমুল্লাহ পূর্ববাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। ওদিকে আসামের উৎপাদিত চা ও অন্যান্য পণ্য বিদেশে রপ্তানীর ব্যাপারে পরিবহন ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে কোলকাতার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের চিন্তা করে বৃটিশরা, এই সাথে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাও চলতে থাকে। বৃটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নবাবের আবেদন যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলা বিভাজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর প্রেক্ষিতে কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হল। যদিও এই বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে পাঞ্জাবে ‘মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। আবার বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র ভারত জুড়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ এবং মুসলিম বিদ্বেষের ঝড় বয়ে যাওয়ায় স্যার সলিমুল্লাহকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সর্বভারতীয় পর্যায়ে মুসলিম ঐক্যের কথা ভাবতে শুরু করেন।
উল্লেখ্য নওয়াব সলিমুল্লাহ যখন নওয়াব এস্টেটের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে সময়ে নওয়াব এস্টেটের অর্থনৈতিক অবস্থায় মন্দা চলছিলো। যদিও নওয়াব এস্টেট তখনও ঋণের জালে জর্জরিত হয়নি। নওয়াব সলিমুল্লাহ কর্তৃক মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব গ্রহণকালেও জমিদারি মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলো। একটি হিসাব থেকে জানা যায় নওয়াব আহসানুল্লাহর মৃত্যুকালে নগদ টাকা প্রমোসরী নোট ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ লাখ। সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড এবং দান খয়রাতের দিক থেকে তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। দান খয়রাত করা ছাড়াও জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে তাঁর প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কিন্তু জমিদারির আয় খরচের তুলনায় তেমন বৃদ্ধি পায় না। ফলে তিনি ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি জনকল্যাণ কাজেই তাঁর বিপুল অর্থ সম্পদ ব্যয় করেছেন।
১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের জন্য ঢাকায় মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স-এর সভা অনুষ্ঠানের সকল ব্যয় তিনি নিজেই বহন করেন। ফলে তার ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। মাড়োয়ারী ও অর্থলগ্নীকারী মহাজনদের নিকট থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল চৌদ্দ লক্ষ টাকা। ঋণ দাতারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। কিন্তু জমিদারির আয় তেমন না থাকায় তিনি জমিদারির আয় থেকে এ ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণ পরিশোধ করতে তিনি সম্পত্তি বন্ধক রাখতে বাধ্য হন। ব্রিটিশ সরকারের নিকট সম্পত্তি বন্ধক রেখে ষোল লক্ষ পচিশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে হিন্দু মহাজন ও মাড়োয়ারীদের নিকট থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করেন।
খাজা আতিকুল্লাহ পরিবারের অন্যান্যদের সমর্থন নিয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহর বিরোধিতা শুরু করেন। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট এবং অপরদিকে পারিবারিক কোন্দলে-এ উভয় সংকটে নওয়াব সলিমুল্লাহর পক্ষে এস্টেট পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার ইতোপূর্বে বিশেষ কতগুলি কারণে দেশীয় জমিদারদের মধ্যে যারা তাদের জমিদারি সফলভাবে পরিচালনা করতে অপারগ ছিলেন তাদের এস্টেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ১৮৭৯ সালে ‘বেঙ্গল কোর্ট অব ওয়ার্ড’ অ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। এ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল এস্টেট পরিচালনায় ব্যর্থ জমিদারের জমিদারি সরকারের অধীনে নিয়ে পরিচালনা করা এবং সকল খরচ মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ এস্টেটের অংশীদারগণের মধ্যে প্রাপ্য অংশ মতো প্রদান করা।
নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ খাজা পরিবারের এজমালি সম্পত্তি এবং তার নিজের সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ তাঁর নিজের অংশ কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনা করার জন্য ন্যস্ত করার পর নওয়াব এস্টেটের অন্যান্য অংশীদারগণও জমিদারি পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। একে একে অন্যান্য অংশীদারগণও তাঁদের নিজ নিজ অংশ কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনার জন্য ন্যস্ত করেন।
পরবর্তীতে নওয়াব পরিবারের সর্বসম্মতিতে খাজা হাবিবুল্লাহ বাহাদুরকে এস্টেটের মোতাওয়াল্লী বা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
(০৪) নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ বাহাদুর (জন্মঃ ১৮৯৫, মৃত্যুঃ ১৯৫৮)
(ঢাকা নওয়াবী এস্টেট পরিচালনাঃ ১৯১৫-১৯৫২)
ঢাকার পঞ্চম এবং শেষ নবাব। তাঁর পিতা ছিলেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর। তার শাসনামলেই ঢাকার নবাব পরিবারের সম্পদ ও জৌলুশ কমতে থাকে এবং ১৯৫২ সালে ইস্ট পাকিস্তান এস্টেট অ্যাকিউজিশন অ্যাক্ট দ্বারা যা চূড়ান্তভাবে বর্জন করতে হয়।
নবাব হাবিবুল্লাহ বার বার চেষ্টা করেন তার পিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্য খাজা খায়রুদ্দিন এবং স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি ভিত্তির কারণে তিনি ব্যর্থ হন। নবাব হাবিবুল্লাহ এসেম্বলি নির্বাচনে বাংলা থেকে স্বতন্ত্রপার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তিনি তাঁরই আত্মীয় এবং মুসলিম লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত খাজা খায়রুদ্দিনের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
শেষের দিকে অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। তিনি আহসান মঞ্জিলের প্রাসাদ ছেড়ে দেন এবং ঢাকার পরিবাগে অবস্থিত গ্রীন হাউস নামে নবাবদের আরেক বাসস্থানে বাস করাশুরু করেন। ২১শে নভেম্বর ১৯৫৮ তারিখে নবাব হাবিবুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে, ঢাকার বেগমবাজারে নবাবদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে তার পিতার পাশে সমাহিতকরা হয়।
(০৫) নবাব খাজা হাসান আশকারীঃ (জন্মঃ ১৯২০, মৃত্যুঃ ১৯৮৪):
১৯৫২ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই হিসাবে নবাব খাজা হাসান আশকারী ঢাকার জমিদার ছিলেন না। কিন্তু নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর সন্তান হিসাবে তিনি ছিলেন নবাব হিসাবে পরবর্তী উত্তোরসূরী। খাজা হাসান আশকারী ছিলেন একাধারে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের খেলোয়ার এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় অনেক এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাকিস্তান জুট মিল এসোশিয়েশন, ঢাকা ক্লাব এবং পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড।
১৯৭৪ সালে তৎকালীন পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে হাসান আশকারীকে পাকিস্থান নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু প্রথমে সম্মত হন নাই। তিনি হাসান আশকারীকে বাংলাদেশে তার জনগণের সাথে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু হাসান আশকারী সাহেবের আগ্রহের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু তাকে পাকিস্থান যাওয়ার সম্মতি দেন। বাকী জীবন নবাব হাসান আশকারী সস্ত্রীক পাকিস্থানের করাচীতে বসবাস করেন এবং ১৯৮৪ সালে সেখানেই পরোলোক গমন করেন।
পরবর্তিতে নবাব পরিবারের কি হয়েছিল তা আমার জানা নাই। জানলে আপনাদেরও জানাবো।
©somewhere in net ltd.