নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসেত সাহিন

ওয়াসেত সাহিন

পেশায় একজন প্রকৌশলী । গান শুনতে , বই পড়তে এবং বেড়াতে ভালবাসি ।

ওয়াসেত সাহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারানো সৌরভ

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৩

ম্যানেজার মাইডিয়ার আলাপী মানুষ । আরিফ সকাল সকালই উত্তরা ব্যাংকের এই শাখাটিতে গেছে । লকার ভাড়া করবে । সেদিন দিনের বেলা বাসার তালা ভেংগে ডাকাতরা সব সোনা দানা নিয়ে যাওয়ার পর হুঁশ হয়েছে । সব শুভার্থীরা অবাক হয়ে বলল,’ আজকাল এত সোনা দানা কেউ ঘরে রাখে বলেন ?’ আরিফ বলল,’ কোথায় রাখে ?’

‘ কেন আপনি কি কাচা মাছ খান ? লকারে রাখে ভাই লকারে ।‘ তাদের পরামর্শেই লকার ভাড়া করতে আসা ।



ম্যানেজার ইকবাল হাসান বেশ করিৎ কর্মা লোক । আরিফকে উঠতে হল না । তাকে ভিজিটিং চেয়ারে বসিয়ে চা খাওয়ালেন । একজন অফিসারকে ডেকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন । অতি দ্রুত কাজ সম্পন্ন হল ।

কথায় কথায় জানা গেল ইকবাল হাসানের ফাদার ইন ল পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিটায়ার্ড ডিডি । উৎকর্ণ হল আরিফ । তাঁর নাম জানতে চাইল । নাম শুনে চমকে উঠল সে ।

অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল,’ আপনার স্ত্রীর নাম কি জেসমিন ?’

এবার বিস্মিত হবার পালা ইকবাল হাসানের , বলল,’ হ্যাঁ , কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন ?’

জেসমিন ! জেসমিন !! আরিফের মনে হল সময় থেমে গেছে । নাকি পিছিয়ে গেছে ?

কত বছর আগের কথা ? ত্রিশ বছর । কোথা দিয়ে গেল সময় ? কেমন ঘোর লাগে আরিফের ।



সেবার এসএসসি পাশ করেছে আরিফ । কৈশোরের কলি যৌবনের দিকে দ্রুত ধাবমান । ওদের বিল্ডিংএর দোতলায় থাকেন শহীদ সাহেবের পরিবার । তার ছেলে মিঠু আরিফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বন্ধুর বোন জেসমিন । ওদের কলেজে ফার্সট ইয়ারের শেষের দিকে জেসমিন নাইনে উঠল । আরিফের ভেতরে তখন যৌবনের স্ব্পন বীজ অংকুরিত হচ্ছে । দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে অচেনা রঙধনু । চেতনার ধূ ধূ প্রান্তর সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে । নানা বর্ণ আর গন্ধের ফুলে শোভিত হয়েছে উদ্যান । ভাবনার মৌমাছি নতুন ভাললাগার মৌচাক ভরে তুলেছে ।

জেসমিনের দিকে তাকালে কেমন অচেনা লাগে । ওর ঘন কাল চুল যেন জীবনান্দের ‘ চুল তার কবেকার’ এর চেয়ে সুন্দর স্ব্পনময় । ওর চোখ যেন প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতায় চাঁদের কিরণ মেখে অনন্ত মায়ায় ভাস্বর । ওর হেঁটে চলা যেন অজানা মুদ্রার নৃত্য । ওকে যত দেখে বুকের গভীরে তত কষ্ট বেড়ে যায় । চিন চিন ব্যাথা করে । কিসের অভিমানে বুক ফুলে ওঠে । অকারন কান্নার স্রোত কন্ঠ চেপে ধরে । চেষ্টা করেও নিজেকে দূরে রাখা যায় না । জেসমিন শুধু টানে । দূর্বার প্রবল আকর্ষনের ঘোর জেগে থাকে । সব ভয় লজ্জা শংকা উপেক্ষা করে একদিন সন্ধার পর সিঁড়ির নিচে জেসমিনের মুখোমুখি হল আরিফ । পেছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকল । থেমে ফিরে তাকাল জেসমিন । সব রিহার্সেল এলোমেলো হয়ে গেল আরিফের । এভারেষ্টের কঠিন পথ মনে হল সামনে । অনেক কষ্টে সাধ্য সাধনায় সার্টের বুক পকেট থেকে ছোট চিঠিটা বের করে জেসমিনের দিকে বাড়িয়ে দিল । বলল ,’ আমার কিছু জরুরী কথা এতে লেখা আছে । পড়ে উত্তর দিও ।‘ জেসমিন ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে চিঠিটা নিল ।

আহ , কি শান্তি । প্রেমের কঠিন প্রসব বেদনা বুঝি মুক্তি দিল আরিফকে । মনে হয় পৃথিবী জয় করা হয়ে গেছে । শুধু ঝান্ডা উড়ানো বাকী । মাঠ পাথালে হেঁটে স্কুলের বারান্দার দিকে এগোল সে । নিজেকে মনে হচ্ছে দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন ।

পরদিন সকাল থেকে অপেক্ষা শুরু হল । উত্তরের অপেক্ষা । একদিন , দুদিন , তিনদিন গেল । খবর নেই । কি হল ? পথে ঘাটে সামনে পড়ে গেলে জেসমিন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকছে । শংকা চেপে ধরল আরিফকে । আশার ফানুস চুপসে যেতে শুরু করল ।

সেদিন ভোরে জেসমিনের দেখা পাওয়ার আশায় আশে পাশে ঘুরে এল আরিফ । মেয়েটি মাঝে মাঝে ভোরে শিউলী তলায় ফুল কুড়াতে যায় । এ ক’দিন ওখানে যাচ্ছেনা ও । হতাশা গ্রাস করতে থাকল আরিফ কে ।

ঘরে এসে বিছানায় শুয়েছে । অগ্নিমূর্তি ধারন করে বাবা এসে ঢুকলেন রুমে । বললেন,’ অনেক সেয়ানা হয়েছ, না ? চিঠি লেখ !’

পা থেকে সেন্ডেল খুলে ইচ্ছামত প্যাদানী দিলেন । আরিফ শুয়েই রইল । মারের কোন অনুভূতিই তার নেই । লজ্জা ঘৃনা অভিমান ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে । ব্যুমেরাং হয়ে আসা স্বপ্নের আঘাতে ও যেন পঙ্গু হয়ে গেছে ।



প্রত্যাশার বিপরীতে এ আঘাতটি আরিফের জন্য খুবই তীব্র ছিল । ওর মন ভেংগে গেল । এমন পরিনতি আরিফের ধারনার বাইরে ছিল । জেসমিন এমন করল কেন কিছুতেই ভেবে পেল না । সে তার অসম্মতি জানাতে পারত । চিঠি না নিতে পারত অথবা ফেরত দিতে পারত ।

জীবন যাত্রার ধরন পালটে গেল আরিফের । উচ্ছল জীবন ম্রিয়মান স্তব্ধ হয়ে গেল । পথে ঘাটে দেখা হলে বেদনার্ত চোখে তাকায় জেসমিনের দিকে । কিন্তু কেমন স্বাভাবিক মেয়েটি । যেন কিছুই হয়নি । কৌতুক মেশানো দৃষ্টি ওর । ভাব যেন ভালই জব্দ করা গেছে আরিফকে । এত সুন্দর একটি মেয়ে এমন নিষ্ঠুর হয় !

সময় বোধকরি কিছু জিনিশ বদলে দেয় । লুবনা , জেসমিনের ছোট বোন । সে একদিন রহস্যময় হেসে একটা ছোট চিরকুট ধরিয়ে দিল আরিফের হাতে । জেসমিনের চিঠি ! বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হল আরিফ । দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে দরোজা আটকে চিঠির ভাঁজ খুলল । জেসমিন তার আচরনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে । নিজের ভালবাসার কথা প্রকাশ করেছে । আরিফের জীবনে আবার যেন ছন্দ ফিরে এল । অনেকদিন পর নিশ্বাস , দৃষ্টি আর নিদ্রায় তৃপ্তি খুঁজে পেল । অনেক গুছিয়ে বিশাল এক চিঠি লিখল ।



কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল উত্তর আসছে না । একদিন ওকে সামনে পেয়ে কিছু বলতে চাইল । কিন্তু মেয়েটি খুব দ্রুত হেঁটে আরিফকে অতিক্রম করে চলে গেল । হতভম্ব হয়ে গেল আরিফ । জেসমিনের এ বিচিত্র আচরণের কোন ব্যখ্যাই সে খুঁজে পাচ্ছেনা ।

কেমন নিষ্ঠুর আর অদ্ভূত খেলা মেয়েটির !



আরিফ ওকে প্রাণপনে ভুলতে চাইল । এদিকে শহরের এক বড়লোকের ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ল জেসমিন । বেশ মাখামাখি সম্পর্ক গড়ে উঠল ওদের । চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিইবা করার থাকল আরিফের !



ইন্টার পাশের পর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হিল আরিফ । অনেক দূরে ফেলে এল মহকুমা শহরটিকে । ছুটিছাটায় যাওয়া হয় । জেসমিন সেই একই রকম সুদূর রহস্যময় নারী । অন্যের বাগানে ঠাঁই নেয়া প্রস্ফুটিত গোলাপ ।



দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনালের পর এসে জেসমিনকে আর পাওয়া গেল না । ওর বাবা বদলী হয়ে গেছেন অন্য শহরে । তীক্ষ্ণ কষ্ট বিদ্ধ করল আরিফকে । আর বুঝি কোনদিন দেখা হবেনা !এ জীবনে কখনো আর বুঝি ভাসবেনা ওই প্রিয় মুখ দৃষ্টির সীমানায় ! হোক না অন্যের , চোখে চেয়ে দেখার প্রশান্তিটুকুতো ছিল ! তাও হারাল চিরতরে !



জীবন কি আর থেমে থাকে ? এযে বহতা নদী ! আরিফের জীবনও থেমে রইল না । পেরিয়ে এসেছে ত্রিশটি বছর । মাঝে মাঝে , নিজস্ব একান্ত সময়ে সেই কথাগুলো মনে হয় । ভাবে হয়তো কোনদিন কোথাও দেখা হয়ে যেতে পারে । চেনা যাবেতো ওকে ? কার সাথে বিয়ে হল ওর ? ও কি ভাল আছে ? ওর হৃদয়কি আজো রয়েছে সেই কঠিন পর্বতময় নিষ্ঠুর ? আরিফের কথা কি মনে পড়ে ওর ? কষ্ট কি হয় একটুও ?



ইকবাল হাসান অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে । বলল, ‘ কি হল আরিফ সাহেব ? কি ভাবছেন ? কথা বলছেন না যে ? আপনি কি জেসমিনকে চিনেন ?’

চমকে উঠল আরিফ । দ্রুত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল । বলল,’ জ্বি জ্বি , আমরাতো একসময় একই বিল্ডিংএ ছিলাম । ওর বড় ভাই মিঠু আমার বন্ধু ।‘

‘বাহ , তাহলেতো দেখছি আপনি আমার আত্বীয় ?’

‘ তাতো বটেই ।‘

মোবাইল টিপল ইকবাল হাসান । সংযোগ পেতেই বলল,’ এই শোন , তোমাদের এক পরিচিত আত্বীয় আমার সামনে বসে আছে । দেখতো চিনতে পার কিনা ?’ মোবাইলটা আরিফের দিকে এগিয়ে দিল ইকবাল । আরিফের ভেতর যেন শূণ্য হয়ে গেছে । বজ্রাহতের মত বসে রইল । ভেতরে কাঁপুনী শুরু হয়েছে । তা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে । হাত কাঁপছে । কিভাবে মোবাইলটা নেবে ও ? মনের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে স্থির হতে চেষ্টা করল । ইকবাল হাসান বলল,’ কি ভাই, ধরেন কথা বলেন ।‘ কি কথা বলবে আরিফ ! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । বহু কষ্টে বলল,’ জেসমিন , আমি আরিফ । তুমি ভাল আছ ?’ ওকে চিনতে পারলনা জেসমিন , জিজ্ঞেস করল,’ কোন আরিফ ?’

‘ ওইযে সি টাইপ বিল্ডিংএ নিচতলায় ছিলাম ।‘ ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড সাড়া পাওয়া গেল না । আরিফ আবার বলল,’ তুমি ভাল আছ ?’

‘ হ্যাঁ আছি । আপনি কেমন আছেন ?’

‘ ভাল আছি । শোন , ব্যাংকে এসে তোমার হাসব্যান্ডের সাথে পরিচয় হল । দারুন মাইডিয়ার লোক । তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী । মিঠু , কাকা কাকি ভাল আছেন ?’

দ্রুত কথা শেষ করে বিদায় নিতে চাইল আরিফ । ইকবাল হাসান হেসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল । বলল,’ নিজের লোক হয়ে গেলেনতো । যোগাযোগ রাখবেন ।‘

‘ নিশ্চয়ই ।‘

ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল আরিফ । জীবন কি অদ্ভূত, ভাবল ও ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫০

joos বলেছেন: খুবই ভাল লিখেছেন। +

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫০

ওয়াসেত সাহিন বলেছেন: ধন্যবাদ । ভাল থাকবেন ।

২| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৪৭

শূন্য পথিক বলেছেন: ++

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫১

ওয়াসেত সাহিন বলেছেন: ধন্যবাদ । শুভকামনা রইল ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.