নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি

মোঃ ইয়াসিন আরাফাত অর্নব

অবচেতনার খেরোখাতা

মোঃ ইয়াসিন আরাফাত অর্নব › বিস্তারিত পোস্টঃ

শুন্যতার গল্প

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৪২



"আমি 'শুন্যতা'।
কিন্তু তোমার অপেক্ষা আমি সর্বদা পূর্ণ ।
আমাকে তোমার ভয়,
অথচ আমি তোমারই মায়ায় গড়া ।
স্বপ্ন ফুরোলে কেবল আমি আসি তোমার কথায়,
অথচ আমাতেই তোমার যত স্বপ্নের আনাগোনা……….।।"
---'শুন্যতা'র লাইব্রেরির একটি কবিতার বইয়ের পাতা থেকে, লেখক অজানা।
অনেক অনেক শব্দ চারদিকে । শব্দগুলো ঠিক তরঙ্গ নয় , অনুভূতি । হ্যাঁ, অনেক রকমের অনুভূতি । বিচিত্র বর্ণের, অনেক রঙ্গের । বাসে আমার সামনের সিটে বসা মেয়েটা আমার খুব প্রিয় একটা গানের কলি মনে মনে আওড়াচ্ছে । মাঝের একটা লাইন মনে করতে পারছে না কিছুতেই । আমি মনে করিয়ে দিতে পারি, ইচ্ছে করছে না । মেয়েটার পাশে মেয়েটার স্বামী বসে আছে, সে খানিকটা উদ্বিগ্ন । মা কে দেখতে যাচ্ছে তারা । ছেলেটার মা ভয়ানক অসুস্থ । ছেলেটা অফিসের একজন সহকর্মী মেয়ের দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকায় । সহকর্মী মেয়েটি তাকে এড়িয়ে চলে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে পছন্দ করে এবং, মেয়েটার ঠোঁটের ডান পাশে একটা তিল আছে ।
চারপাশ থেকে এই মুহূর্তে এমন অসংখ্য তথ্য আমার মস্তিষ্কে আঘাত হানছে । আমি শুনতে না চাইলে সেটা পরিণত হচ্ছে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় । আর মাথাটা পরিণত হচ্ছে অগণিত বার কম্পনপ্রাপ্ত টিউনিং ফর্কে । ঘণ্টার মতো একঘেঁয়ে একটানা আওয়াজ করতে থাকে তখন এক একটা তথ্য । উফ্, সাথে ব্যথাটাও ! তাই আমি শুনছি । আমাকে শুনতে হচ্ছে । আমাকে শুনতে হচ্ছে বাসের এই মানুষগুলোর প্রতিদিনকার হিংসা, দম বন্ধ করা উদ্বিগ্নতা, মায়া, আর কাম ।
পাশে বসা বুড়োমতো লোকটা বললেন, "বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ?"
প্রচণ্ড মাথাব্যথার মধ্যে আমি লোকটার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালাম । ষাটোর্ধ বয়স, বয়সের তুলনায় হাবেভাবে খুবই ছটফটে । মুখে ধবধবে সাদা চাপদাড়ি, মুখটাতে বয়সের ভারে বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব চলে এসেছে - বয়সের ঠিক যে পর্যায়ে চলে গেলে পরিণত বয়সের চেহারাটা আর আন্দাজ করতে পারা যায় না । লোকটার হাসিটা মায়াভরা, দেখে আমার বাচ্চাদের হাসির কথা মনে পড়লো । মাথার একপাশের চিনচিনে ব্যথা একটা অদ্ভুত তথ্য জানান দিল । লোকটা প্রতিদিন তার আলিসান বাড়িটার সামনে দিয়ে একটা নোয়াহ গাড়ীকে গ্যারেজ থেকে বের হয়ে চলে যেতে দেখেন । তাঁর কোন গাড়ী নেই, ঐসব গাড়ীতে চলাফেরা পছন্দ করেন না তিনি । কোথাও ঘুরতে বের হলে পায়ে হেঁটে বা বাসে চড়তে ভালো লাগে তাঁর । পেনসনের টাকা দিয়ে করা বাড়িটা তাঁর একার, বাড়ীতে একাই থাকেন, সন্তানাদি তাঁর সাথে থাকে না । তার গ্যারেজে কোন গাড়ী নেই । এভাবে যুক্তি ছাড়া ভুতুড়েভাবে গ্যারেজ থেকে একটা গাড়ী বের হতে পারে না । এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটুকু নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর কারো সাথে কথা বলেননি । ভদ্রলোক একটু আগে ঐ গাড়ীটাই কল্পণা করছিলেন এবং এই অভিজ্ঞতাটা কোন এক বিচিত্র কারণে সম্ভবত তাঁর অতি প্রিয় । তিনি আমার সাথে কথা বলার আগে একটু পর পর অস্থির হয়ে ঘড়ি দেখছিলেন । গাড়ীটা প্রতিদিন গ্যারেজ থেকে সাড়ে পাঁচটায় বের হয় । তখন তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে তার ঘরের দক্ষিণের জানালাটা ধরে চেয়ে থাকেন । তার ঘড়ি অনুযায়ী এখন সাড়ে চারটা বাজে ।
আমি আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম । বন্ধ হয়ে আছে । বিরক্ত লাগল । নতুন ব্যাটারী লাগালাম গতকাল, এত সমস্যা দিচ্ছে কেন?
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম আবার । সামান্য চমকে উঠলাম, কারণ মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের ভিতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে । তাঁর চেহারা, হাবভাব আগের মতোই, কিন্তু কিছু একটার ভয়াবহ পরিবর্তন হয়েছে, যা আমি ঠিক ধরতে পারছি না । মাথাব্যথাটাও ছেড়ে দিল সাথে সাথেই, থেমে গেল আশেপাশের মানুষের যতসব আজেবাজে তথ্যের বকবকানিটাও, কেন জানি মনে হলো এই থেমে যাওয়ার সাথে ভদ্রলোকের আচমকা পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক আছে । আমি ভদ্রলোকের মন থেকেও কিছু পড়তে পারছি না । এই মুহূর্তে ব্যক্তিত্বের ভয়াবহ পরিবর্তন হওয়া বয়স্ক মানুষটা প্রচণ্ড কৌতুহলের সাথে আমাকে আগাগোড়া দেখছে । পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল, "ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।"
আমি জিজ্ঞাসু চোখে বললাম, "মাফ করবেন, আপনাকে চিনতে পারছি না । আপনি কি আমার পূর্বপরিচিত ?" তিনি আমার কথা শুনতে পেয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, "আপনাকে প্রথম দেখে যেমনটি ভেবে ছিলাম আমরা, মোটেও তেমন নন আপনি । মস্তিষ্কের ক্ষমতা সামান্য বাড়ালে সেটুকু সহ্য করার মতো অভিযোজন এখনও হয়নি আপনাদের । শব্দ আর আলো দিয়ে যোগাযোগ করতে হবে আপনার সাথে । অভিযোজিত না হয়ে এ পর্যায়েই এভাবে এসে যাবেন ভাবিনি । মাথাব্যথার জন্য দুঃখিত" । তারপর স্মিত হেসে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে বললেন, "আপনাকে 'শুন্যতা'য় স্বাগতম ।"
খেয়াল করলাম, 'তুমি' থেকে 'আপনি'তে উঠে এসেছেন তিনি ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আপনাকে এখনো ঠিক চিনতে পারলাম না । ঠিক করে বলবেন কি, আপনি কে? আমাকে কিভাবে চিনেন? আর 'শুন্যতা' কি?"
"আমার পরিচয়ের থেকে আপনার পরিচয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ । আচ্ছা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন, নামবেন কোথায় ?"
আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার ঠিক মনে নেই কোথায় নামব । বাসে কেন উঠেছি, সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না । আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর থেকে কোন স্মৃতিই আর তেমন মূল্যবান মনে হয় না, দৈনন্দিন কার্যকলাপও ভুলে যাই । তবে খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকের গলার স্বরটা আমার পরিচিত, খুবই পরিচিত । কোথায় যেন শুনেছি… কোথায় শুনেছি ?
"আপনি আমাকে পরিচিত ভাবছেন কারণ এ চেহারাটা আপনার পরিচিত । আমার চোখের দিকে ভালোভাবে তাকান । চিনতে পারবেন তাঁকে ।"ভালো, এখন আমার মন পড়তে পারছেন ভদ্রলোক । অবাক হলাম না, একটু আগে আমিই পড়তে পারছিলাম তাঁকে । তাঁর চোখের দিকে তাকালাম । চোখ দেখে মনে হচ্ছে এই চোখটা অনেক কিছু দেখেছে, অনেক কিছু । কিন্তু মুখমণ্ডলটা অন্যরকম , চোখটার সাথে ঠিক খাপ খায় না, যেন একেবারে অন্য কোন অস্তিত্বের, মুখটা বয়স্ক এবং পরিচিত । আমি সাথে সাথেই আমার ছোটবেলার 'হোমিওপ্যাথী নানা'কে চিনতে পারলাম ।
"নানাভাই, তুমি?"
"আপনি যাঁকে ভাবছেন, ইনি সেই লোক নন, এই চেতনাটা তাঁর নয় । তবে বলা যায়, দেহটা তাঁর মতো ।"
"আপনি কি তাহলে অশরীরী কেউ, একজনের দেহ দখল করে বসে আছেন?"
আমার পরিহাসে ভদ্রলোক আঘাত পেলেন মনে হলো ।
"আমাদের খুব অল্প কয়েকজন টিকে আছে", তিনি বলতে লাগলেন,"আপনাদের মহাকাশটার মহাবিস্ফোরণ হয়ে সৃষ্টি হবার ঠিক আগের মহাসংকোচনের সময় আমরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাই ।"
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঠিক আপনাদের মতোই আমরা একটা বুদ্ধিমান প্রজাতি ছিলাম । আপনাদের আকাশে আপনাদের পৃথিবীটা ঠিক যে অবস্থানে, আমাদের গ্রহটা ঠিক ঐ অবস্থানেই ছিল । এর ঘূর্ণনবেগ, আকার আকৃতি, আহ্নিক আর বার্ষিক গতি হুবহু আপনাদের পৃথিবীর মতোই ছিল, আপনাদের মতো ঐ গ্রহটাই ছিল আমাদের পৃথিবী- 'হাজমাদ' ।"
"সত্যি বলতে কি আমাদের আকাশটাও হুবহু আপনাদের আকাশটার মতো ছিল । প্রতিটা গ্রহাণু, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র এর কোয়ান্টাম অবস্থান পর্যন্ত খুব কাছাকাছি মিলে যায় আপনাদের সাথে । "
"আমরা অবশ্য একটু ভিন্ন ছিলাম । দেখুন, দেখতে একরকম হলেও আমরা পুরোপুরি মানুষ ছিলাম না । এই বিষয়ে বায়োলজি বলতে চাচ্ছি না, মাফ করবেন । আপনার রুচিতে বাঁধতে পারে আর আমারও লজ্জা করছে । তবে আপনাদের মতো আমরাও কোন ভিনগ্রহের প্রাণীসত্ত্বার খোঁজ পাইনি ।"
"আমরা যখন বুঝতে পারলাম আমাদের মহাবিশ্বের পরিণতি, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে । মহাসংকোচন শুরু হয়ে গেছে । এই মহাসংকোচনের পর আবার মহাবিস্ফোরণ হতে পারে । এর আগে কতবার হয়েছে সে হিসেব পাইনি আমরা । এর পরে কতবার হবে, সেটাও অনিশ্চিত ।"
এতক্ষণে বাইরে খেয়াল করলাম । তুমুল বৃষ্টিপাত হচ্ছে । গাড়িঘোড়া তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না, আবছা আবছা মনে হচ্ছে ব্যস্ত রাস্তাঘাট । এর মধ্যে ভদ্রলোকের আষাঢ়ে গল্প শুনতে ভালোই লাগছে ।
আমি বললাম, "তারপর?"
"আমরা অনেকদিন ধরে পড়ে থাকা পরীক্ষামূলক একটা প্রজেক্ট চালু করলাম । এটা সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল ।"
"আমাদের ক্লোনিং এর মতো?"
"না, তবে ব্যাপারটা আরও ভয়ানক । এটা ছিল দৈহিক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ চেতনাকে শক্তিতে পরিণত করা ।"
"এটা কি আদৌ সম্ভব?"
"আমাদের জগতে, আর আমাদের বায়োলজিতে এটা অসম্ভব ছিল না ।"
"তারপর? যাদের উপরে করা হয়েছিল পরীক্ষা তারা পুরোপুরি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল?"
"হ্যাঁ"
"আপনি বললেন, আপনাদের বুদ্ধিমত্তা অনেকটা মানুষের মতো, এমন একটা রূপান্তর সহ্য করলেন কিভাবে?"
"আমরা আপনাদের মতো আবেগপ্রবণ নই । আবেগ অনুভূতির চেয়ে যুক্তি বেশি কাজ করত আমাদের । খুব বেশি না, পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা সবাই পরিণত হয়ে যাই দেহহীন চেতনায়, আপনি এইমাত্র যেটা বললেন- অশরীরী । শুরু হলো আমাদের 'দেহহীন' যুগ ।"
"আর সেটা মহাসংকোচনে টিকে থাকতে সাহায্য করল কিভাবে?"
"আমরা প্রথমে এলোমেলোভাবে মহাকাশে ঘুরে বেড়াতাম । পরিব্রাজক হয়ে গিয়েছিলাম, মহাকাশের অনেক রহস্য আবিষ্কার করেছিলাম 'দেহহীন' যুগেই । আর আমাদের মহাকাশ ছোট হয়ে আসছিল, আমরা বুঝতে পারছিলাম মহাপ্রলয় আসন্ন । তখন সবাই সবার চেতনাকে একত্র হয়ে বিশাল একটা অস্তিত্ব তৈরি করে অপেক্ষা করছিলাম মহাপ্রলয়ের ।"
"মহাপ্রলয়ের পর আমার শক্তিবলয়ে যখন চেতনা কাজ করা শুরু করল, তখন অনুভব করলাম, আমার চারপাশের জগত আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে । একটু অন্যরকম একটা প্রজাতিতে ভরে গেছে চারপাশ । এরা আমাদের থেকে একটু উন্নত । আবেগ, অনুভূতি আর কল্পণা আমাদের তুলনায় সীমাহীন, সাহিত্যচর্চা, মায়া, রাগ, কষ্ট, ভালোবাসার মতো কিছু ব্যাপার আছে যা আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, নিজেদের 'মানুষ' ডাকে ওরা ।"
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"মজার ব্যাপার কি জানেন, আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না যখন আমরা দেখলাম, ওরা কেউ এখনও সৃষ্টি হয়নি।"
"সৃষ্টি হয়নি মানে?!"
"চেতনা ফিরে আসার পর আমরা যা দেখছিলাম, এগুলো সবই আসলে ওদের স্মৃতি, আমরা এই মুহূর্তে যেই বাসটিতে বসে আছি সেটি আপনার ঐ নানাভাইয়ের স্মৃতি । এগুলো এখনও ঘটেনি ।"
"আমি এখনও বুঝলাম না"
"এই মুহূর্তে আমরা আপনার নানাভাইয়ের জীবনের এমন একটা সম্ভাবনার মধ্যে বিরাজ করছি যেই সম্ভাবনাটা আপনার জগতটা থেকে কাট আউট হয়ে গেছে । আপনাদের পৃথিবীতে আপনার নানাভাই কখনো শহরে আসেননি বা তাঁর কখনো এত বড় বাড়ি ছিলনা । তিনি ডিল্যুসনে ভুক্তভোগী কোন রোগী ছিলেন না, তাঁর সন্তান কখনো তাঁকে ফেলে নোয়াহ গাড়ীতে করে চলে যায়নি, যেটার হ্যালুসিনেশন দেখতে উনি প্রতিদিন জানালা ধরে চেয়ে থাকবেন । অথচ এসব ঘটনাই এখানে দেখা যাচ্ছে । তার মানে, এসব ঘটনা হচ্ছে কখনো না হওয়া ঘটনা । আর এ জগতটা হচ্ছে 'সৃষ্টির আস্তাকুঁড়' বা বলা যায় 'সম্ভাবনার আস্তাকুঁড়' । এখানে কোন কিছু থেকেও নেই তাই আমরা এর নাম দিয়েছি 'শুন্যতা' । "
ভদ্রলোকের কোলে একটা বই পড়ে ছিল । দক্ষিণ মেরুর উপকথা নিয়ে একটা বই । সেদিকে তাকিয়ে একটা বিচিত্র জিনিস মনে হলো আমার । ভদ্রলোকের এসব কথা যদি সত্য হয়, তবে এমন সব বই থাকা উচিত এখানে যা এখনও লিখা হয়নি ।
ডান দিকে তাকালাম । খেয়াল করলাম, দৃশ্যপট বদলে গেছে । আমার চারপাশে সারি সারি বইয়ের তাক । দেয়াল জুড়ে অদ্ভুত সব চিত্রকর্ম । গোলকধাঁধাঁর মতো ঘিরে রয়েছে । একটা বই হাতে নিলাম । রবার্ট ফ্রস্ট, ঈটস এর সবগুলো কবিতা আমি আগেই পড়েছি । তাদের নামে লেখা বইয়ে ঠিক তাদের মতো করে লিখা কিছু কবিতা পড়ার পর বুঝলাম, এ কবিতাগুলো এখনও লেখা হয়নি । এবং সত্যি কথা বলতে এগুলো আরও সুন্দর, এর অন্তর্নিহিত ভাব আরও রোমহর্ষক । বুঝলাম এই লাইব্রেরিটা হলো 'কখনও না হওয়া' লাইব্রেরি । কিভাবে এখানে আসলাম আমি জানিনা, কিন্তু এত অদ্ভুত একটা জগতের সন্ধান পেয়েছি, ঘুরে বেড়াতে দোষ কি?
এটা এমন একটা সৌন্দর্যবোধ যা কখনও আগে অনুভব করিনি । এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম সমস্ত কবিতা, গল্প, শুনে গেলাম সমস্ত গান, দেখে গেলাম সমস্ত গুহাচিত্র ও চিত্রকর্ম । সবগুলোই কেমন যেন একটু অদ্ভুত, পৃথিবীর হয়ে যাওয়া গল্প, গান, চিত্রকর্মের সাথে মিল নেই এদের কোন । এরা কখনো হয়তো সৃষ্ট হবে । কেউ লিখবে প্রেয়সীর জন্য, কেউবা নিজের খেয়ালে, সৌন্দর্যের মাধ্যমে কেউ ছড়িয়ে দেবে বিষণ্নতা, কেউ আনন্দ । মার্কেজের কখনো না লেখা জাদুবাস্তবতার একটি উপন্যাসও পড়লাম । পড়লাম শেক্সপীয়ারের একটা নাটক যা আমাদের জগতে তিনি লিখেননি । কখনও না লেখা, কখনও না ভাবা, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লাম মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে । এগুলো কবে কাট আউট হয়ে গেল? হারিয়ে গেল আমাদের জগত থেকে? হয়তো রবীন্দ্রনাথ আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে কিংবা ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো আর কবিতার পংক্তিগুলো লিখে যাওয়ার সুযোগ পেলে লিখে যেতেন এগুলো । দেখলাম ভ্যান গগ আত্মহত্যা না করলে আরও কত রকমের আলোর ঘূর্ণিকে বন্দী করে রেখে যেতে পারতেন তার কখনও না আঁকা চিত্রকর্মে । তলস্তয় আর দস্তোয়োভস্কি এর না লেখা উপন্যাসও বাদ যায়নি । চার্চিল, রুজভেল্ট, চে গুয়েভারা, হিটলার - তাঁদের সবার বিকল্প পরিণতি পড়লাম কখনও না হওয়া ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে । আরও অনেক অনেক বিশ্ব, অনেক সৃষ্টি, অনেক মহাবিস্ফোরণের মহাকাব্য পড়লাম যা আগে হয়নি কখনোই । কত কত জগত থেকে হারিয়ে যাওয়া লাখ লাখ সম্ভাবনা…
যত নতুন রকমের গল্প ধরছিলাম, ওগুলো আরও সুন্দর হচ্ছিল । পো এর না লেখা গল্পগুলো আরও ভয়ংকর, লাভক্র্যাফটের না লিখতে পারা গল্পগুলো হচ্ছিল আরও রহস্যময় । আরও কিছু বই, গান, চিত্রকর্ম বের হলো- খুবই অদ্ভুত কিছু সাহিত্য । একটি প্রাণীহীন গ্রহের সবচেয়ে বড় পাথুরে রাস্তার পাথরদের কল্পিত গান শুনতে পেলাম । কোন এক সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহের অসংখ্য উপগ্রহের একটিতে প্রচণ্ড অভিকর্ষে ধ্বসে যাওয়া নভোযানের পাশে বসে লেখা এক নভোযাত্রীর মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া শেষ লেখা পড়লাম (অবশ্যই যেটা কখনো ঘটেনি), এখনও সৃষ্টি না হওয়া আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির একটা গ্রহে স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ নিষ্পাপ কিছু ছোট ছোট মায়াকাড়া প্রাণীর বিলুপ্তি আর ঠিক তার পাশের গ্রহের একটা গ্রামে রাজনৈতিক নৃশংস গণহত্যা, এ দুই গ্রহের কোনটিকে ক্রন্দনরত মৃত্যুদূত প্রাধান্য দেবে তার দ্বিধা নিয়ে মনকাড়া একটা কবিতা পড়লাম…অনেকটা সময় পার হলো এভাবে ।কতদিন? কত সপ্তাহ? কত মাস কিংবা বছর? আমি জানি না । আমি প্রায় পুরো লাইব্রেরি ঘেঁটে শেষ করে ফেলছি, সময়ের কোন ধারণা নেই এখানে । খিদে তো প্রশ্নই আসে না, বাসে নিজেকে আবিষ্কারের পর থেকে দৈহিক কোন প্রয়োজন অনুভব করিনি আমি, একঘেঁয়েমিও লাগছে না ।...
হঠাৎ লাইব্রেরির এক কোণে জেনিকে দেখতে পেলাম । জেনি, কতদিন দেখি না ওকে ? ওর মৃতদেহটার কথা মনে পড়ল । অ্যাক্সিডেন্টে মারা ও মারা গেল ঠিক যেই বয়সে, আমার স্মৃতিতে ও সেই বয়সটাতেই আটকে গিয়েছিল । সেই বয়সটার তুলনায় আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়ানো জেনির বয়স কিছুটা বেড়েছে । সাথে ছয় কি সাত বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে । মেয়েটা আবদারের সুরে বলল, "আব্বু, আব্বু, চিড়িয়াখানা যাব।" জেনি বলল, "এই চলনা, অনেকক্ষণ হল তো ।", হাসছে ও । গালে টোল পড়ছে আগের মতোই, আমার খুব প্রিয় আর পরিচিত সেই হাসি, সেই সতেজ ত্বক …
আমি এই জেনিকে কি বলব? ওদের কোন অস্তিত্ব নেই । ও বেঁচে থাকবে, আমাদের একটা সন্তান হবে, কোন এক ছুটির দিন আমরা সবাই মিলে ঘুরতে বের হব, এটুকুন ছোট একটা মেয়ে "আব্বু, আব্বু" বলে চিৎকার করবে - এই সমস্ত সম্ভাবনা তো কাট আউট হয়ে গেছে । ওরা এখন সৃষ্টির আস্তাকুঁড়ে হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব ।
না । না,আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ওসব কিছু । ঐ তো ছোট মেয়েটা ডেকে বলছে, "আব্বু, তোমার জন্য একটা বই নিয়েছি? দেখ । হ্যাপি বার্থডে ।"
একটা বই নিয়ে এগিয়ে এসে আমার গালে চুমু খেল । আমি জড়িয়ে কোলে তুলে নিলাম আমার মেয়েকে । কী জীবন্ত, কী বাস্তব । আমি জড়িয়ে ধরে রাখলাম যাতে হারিয়ে না যায় । আর ওদিকে বাচ্চাটা চিৎকার করে যাচ্ছে, "এই আব্বু, তুমি কাঁদছ কেন? এই আব্বু !"
চোখ খুললাম । দেখি বুড়োমত একজন মানুষ গল্প বলছে । আমরা গোল হয়ে বসে শুনছি । চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, গ্রামের পুঁথিপাঠ চলছে । কিন্তু গল্পটা খালি একটু অন্যরকম । টেনে টেনে সুর করে পড়ছে না, গম্ভীর একটা স্বরে কবিতা আবৃত্তির মতো বলে যাচ্ছে । আমার কোলে ছোট মেয়েটা । পর্দার আড়ালে গ্রামের মহিলারা বসে আছেন । ঐখানে জেনিও আছে । হঠাৎ খেয়াল করলাম, গল্প বলা বুড়োমতো মানুষটি আমার বাবা । সেই ছোটবেলায় শোনা তাঁর আবৃত্তি, গমগম কণ্ঠে তোলা অবরুদ্ধ সব অনুভূতি । যিনি আমার ছোটবেলায় কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে চলে গেলেন । কেউ তাকে আর কখনো খুঁজে পায়নি, বড় হবার পর তাঁর মানসিক সমস্যার কথা শুনেছিলাম দূরসম্পর্কের চাচার কাছ থেকে, যাঁর কাছে বোঝার মতো পড়ে ছিল আমার শৈশব আর কৈশোর । কিন্তু আমি এখন যা দেখছি, এ এক অন্যরকম জীবন, অন্য কোন এক সম্ভাবনা, যা আমার জীবন থেকে কাট আউট হয়ে গেছে । আমি আসলে কতগুলো সম্ভাবনায় ঘুরে বেড়িয়েছি এখন পর্যন্ত? কতক্ষণ ধরে আছি আমি 'শুন্যতা'য় ? সব জীবনেই কি ওরা বেঁচে আছে? আমি কতবার দেখেছি ওদের এই নিয়ে? আমার বাবার কণ্ঠে তাঁর গল্পে ফিরে এলাম । কতক্ষণ ধরে গল্প বলছেন তিনি? নাকি নতুন গল্প বলছেন? প্রথম লাইনে ফিরে এলেন কেন?
"অনেক, অনেক দিন আগে…."
"অনেক, অনেক শতাব্দী আগে…."
"অনেক, অনেক মহাকাশ বর্ষ আগে…."
"অনেক, অনেক মহাবিস্ফোরণ আগে…."
"অনেক, অনেক…………….."
আমি এলিয়ে পড়লাম আবারও ঘুমের কোলে ।
……. একটা গ্রহ, পুরো গ্রহটা জুড়ে একটা মহাসাগর । আমরা এক গ্রহ ভর্তি মহাসাগরে অনেকগুলো সদ্যজাত শিশু, সাঁতরে বেড়াচ্ছি । সবাই মিলে অনুভব করলাম- সাগরটা যোগাযোগ করছে আমার সাথে, যেন সাগরটা আমাদেরই একটা অংশ, সাগর আর আমরা সবাই মিলে একটাই প্রাণ এবং সাগরটা জীবিত । সাগরটা নীলচে, কিন্তু জড় পানি নয়, তরল প্রোটোপ্লাজম । সাগরটা ফিসফিস করে কিছু বলল আমাদের কানে । …
আমার মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, "আর কত ঘুমাবি?"
আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম । কেউ আমাকে বলেনি, তবুও আমি বুঝলাম; ইনিই আমার মা, জন্ম দেবার সময় মারা গিয়েছিলেন যিনি ।
"হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়"
আমি খেতে বসলাম । তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ । একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকলে মানুষের চোখ মস্তিষ্কে একটা স্থির দৃশ্য তৈরি করে নেয় সেই দৃশ্যটার । আমি প্রাণপনে মুখস্ত করে নিতে চাইলাম তাঁর মুখটা । অনেক কথা বলছিলেন তিনি । কিছুই মাথায় ঢুকল না । এটা বুঝলাম, কি একটা কাজে আমাকে বের হতে হবে । আর দেখা পাব না তাঁর । হয়তো দেখা পাব, অন্য কোন সম্ভাবনায়, মনে থাকবে না তার কিছুই । বের হবার সময় তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম । ...
"………..মহাসংকোচনের পর যখন আমাদের চেতনা আসে, এই 'শুন্যতা' আবিষ্কার করি আমরা", বাসে আমার পাশে বসে আগের মতো বলে চলেছেন তিনি, "….আপনিই আমাদের দেখা মহাবিস্ফোরণ পরবর্তী প্রথম সৃষ্টি ।"
"আমি আমার মায়ের কাছে ছিলাম, এখানে এলাম কিভাবে?"
"আপনি তো প্রথম থেকে এখানেই ছিলেন ।"
দেখতে পেলাম আমার ছোটবেলার 'হোমিওপ্যাথী' নানার সাথে আরও দুইজন বৃদ্ধ যুক্ত হয়েছেন । ওরাও তার মতোই অস্তিত্ব । তাঁদের একজন বললেন, " 'শুন্যতা' মাঝে মাঝে আপনার পরিচিতজনদেরকে বিভিন্নভাবে দেখায় ।"
চিন্তিত দেখালো তাঁকে । বললেন, "ওগুলো বাস্তব নয় । ওগুলো তাঁদের জীবন থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া সম্ভাবনা ।"
"না, না!" আমি মাথার চুল ছিঁড়তে থাকলাম । আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
"কোনভাবেই কি এইসব সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবে আনা যায় না? "
"আপনি সৃষ্টির কথা বলছেন, এটা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব না । আপনাদের মতো আমরাও তিনটি প্রশ্নের উত্তর পায়নি । স্রষ্টা কে, প্রকৃতিতে সবকিছুতে এত ঘূর্ণন কেন এবং এনট্রপি কমানো যায় কিভাবে? "
এনট্রপির কথা আসতেই অদ্ভুত একটা চিন্তা আসল আমার মাথায় ।
জানতে চাইলাম, "আচ্ছা, এখানে এনট্রপি কেমন?"
"এখানে এনট্রপির মান ঋণাত্মক অসীম ।"
"এমন কিছু কি করা যায় না যাতে এনট্রপি স্বতস্ফূর্তভাবে বাড়তে থাকবে?"
"আপনি যেভাবে ভাবছেন, সেটা আমরাও ভেবেছিলাম । এনট্রপি ঋণাত্মক থেকে বৃদ্ধি পেয়ে শুন্যতে আসবে, শুন্য থেকে বাড়তে বাড়তে শুন্যতায় যাদের আমরা দেখছি, এদের সবার অস্তিত্ব আসতে থাকবে । মানুষদের পৃথিবীতে মহাসংকোচন শুরু হবে । ধ্বংস হয়ে যাবে আপনাদের জগত । এরপর নতুন একটা মহাবিস্ফোরণে তৈরি হবে নতুন এক মহাকাশের, এই শুন্যতার সবার অস্তিত্বলাভ করবে । কিন্তু এতে অকল্পনীয় শক্তির দরকার । আমরা এত শক্তি কিভাবে পাব? "
ঐ দুইজন বৃদ্ধের একজন বললেন, "আমরা অনেকেই আমাদের মহাসংকোচনে টিকতে পারিনি । যারা টিকেছি, তারা কিভাবে এই শুন্যতায় এসে ভিড়লাম, তাও জানিনা । তবে এখানে আসার পর একটা জিনিস অনুমান করতে পারছি । মহাকাশটা প্রতি মহাসংকোচন-মহাপ্রসারণে নিজেকে একটু একটু করে পারফেক্ট করার চেষ্টা করে । আপনারা আমাদের থেকে একটু উন্নত, এখানে যাঁরা আছেন, সৃষ্টি হবার পর তাঁরা মানুষ হিসেবে পরিচয় দিলেও আপনাদের থেকে তাঁরা খানিকটা উন্নত হবেন । পাইয়ের মান আপনাদের সময়ে পূর্ণতা পেয়েছে, তাঁদের সময় হয়তো টাইম প্যারাডক্স থাকবে না । যাই হোক, ‘শুন্যতা’য় আসার পর আমরা সবাই অদ্ভুত এক বিষণ্নতায় ভুগেছি । অন্তহীন অনন্তকাল এইখানে অন্তহীনভাবে কাটিয়ে দেওয়ার কাছে মৃত্যু তো অনেক বড় স্বাধীনতা । শক্তির তো আর অপচয় হয় না, আমাদের চেতনাগুলো হয়তো এই সৃষ্টিগুলোর মাঝে ছড়িয়ে যাবে । ওদের জীবদ্দশায় কোন ঘটনা দেখলে হয়তো ডেজাভ্যু হয়ে আমাদের এখনকার দেখা ঘটনাগুলো মনে পড়বে তাদের । যখন একদিন সবাই মিলে আমাদের শক্তিগুলো বিচ্ছুরিত করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম, ঠিক সেদিন এখানকার সৃষ্টি না হওয়া মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতি শিখলাম আমরা । এটা শুন্যতার মধ্যে থেকেও আশা দেখায় এমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি । আপনাদের অবশ্য ঐ অনুভূতিটা অনুভব করবার ক্ষমতা নেই । এটা এনট্রপি বৃদ্ধির কাজে সাহায্য করতে পারে । "
আমার নানাভাই ঐ বৃদ্ধটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, "তোমার কি মনে হয় ঐ অনুভূতি কোন কাজে আসবে? আমার কাছে ওটা অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তিহীন একটা রিচুয়ালের মতো লেগেছে । প্রার্থনা করা সবসময়ই অন্ধবিশ্বাসের একটা ব্যাপার ।"
বৃদ্ধটি স্মিত হেসে বললেন, "চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? আমরা এখনও এখানকার ফিজিক্স ভালোভাবে জানি না । আর আমরা তো আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া মহাবিশ্বে দেখেছিলাম, অনেক সময় বিশ্বাসই নতুন বিজ্ঞানের জন্ম দেয়। "
এরপর আমি অত্যন্ত ভয়ানক একটা দৃশ্য দেখলাম । আমি ঠিক বলতে পারব না কি দেখেছি, তবে এটুকু ধারণা করতে পারলাম আমি ওদের আসল রূপ দেখেছি । এটা ঠিক 'ভয়ানক' নয়, ঠিকভাবে বললে এটা 'ভয়ানক সুন্দর' । আমার কাছে মনে হলো অনেকগুলো কোয়াসার, অচিন্ত্যনীয় আয়তন জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে । মুখ বোঝা যাচ্ছে না, তবে সবাই যে উপরের দিকে মুখ তুলে আছে, এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার । একটা তীব্র ঝনঝন শব্দ হলো যেন অনেক অনেক আলোকবর্ষ বিস্তৃত একটা কাঁচের দেয়াল ভেঙ্গে গেছে । কিছু একটা হবে এখন, কিছু একটা .....
ঠিক এ মুহূর্তে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । কি কারণে জানি মনে হলো, কিছু একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে, খুব বড় একটা পরিবর্তন । উঠে বসলাম, অনেকদিন ধরে না কাটা দাঁড়িগোঁফ খুব চুলকোচ্ছে । জামা কাপড় অবিন্যস্ত, আমার ছোট পরিচিত ঘরটার চারপাশে চোখ বুলালাম । এই প্রচণ্ড মায়াময়, এত বিস্তৃত একটা যাত্রা, এত বাস্তব একটা অভিজ্ঞতা, এটা সামান্য একটা স্বপ্ন ছিল? বিছানার পাশে একটা অদ্ভুত নামের বই রাখা । আমি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম ।কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে একটা ইনজেকশন দিয়ে গেলেন । আমি শান্ত ছিলাম, একদম শান্ত ।
আমার মনে হচ্ছে আমি ভালো হয়ে গেছি, আর কখনো সবাই মিলে ধরাধরি করে আমাকে ওষুধ খাওয়াবে না, পাশের রুমের বৃদ্ধ লোকটা আর কল্পণায় কোন গাড়ী দেখে চেঁচিয়ে উঠলে আমিও তার সাথে চেঁচাবো না । আমার আর এই মানসিক অসুস্থদের আশ্রমে থাকার আর কোন প্রয়োজন নেই ।
আজ আশ্রমের সাধারণ কক্ষে সবাই মিলে টেলিভিশন দেখছিল, একটা অদ্ভুত খবর শুনলাম, বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, মহাসংকোচন শুরু হয়ে গেছে । বিস্তারিত কিছু শোনার আগে কেউ একজন বদলে ফেলল টিভি চ্যানেল, আর আমি সকালে আমার বিছানার পাশে পাওয়া গল্পের বইটা পড়তে শুরু করলাম । খুব ছোট একটা মেয়ে আমাকে এই বইটা উপহার দিয়েছিল একদিন, শুধু এটুকুই মনে আছে আমার । খুব মিষ্টি একটা রূপকথার গল্প ।
আমি ডুবে গেলাম রূপকথার জগতটাতে ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.