![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ পহেলা অক্টোবর, ২০১৯, ৩০তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রতিবছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও এই দিবসটি পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বছর বয়সী প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। চলমান সহস্রাব্দে সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২০৫০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আট থেকে বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ২০৩০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা দুইকোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি হবে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় পৃথিবীর সব দেশেই প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে এবং তাদের অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাবে।
প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, কর্মঅক্ষমতা, পরিবার হতে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের কল্যাণের জন্য প্রবীণবিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে –
ক) ১৯৩৮ সালে রাশিয়ায় বার্ধক্য নিয়ে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
খ) ১৯৬৫ ও ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের কিছু কিছু আলোচনায় বার্ধক্য এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়।
গ) ১৯৮২ সালের অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রবীণ বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা (Vienna International Plan of Action on Ageing (VIPAA) গৃহীত হয়। দিকনির্দেশনায় ১৪টি মূলনীতির আলোকে প্রবীণদের কল্যাণ বিধানের লক্ষ্যে ৬২টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
ঘ) ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় প্রতি বছর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর প্রবীণদের সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদায় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হয়।
ঙ) ১৯৯৪ সালে কায়রোতে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বয়স্ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
চ) আর ২০০২ সালে বিশ্বের ১৫৯ টি দেশের প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে প্রবীণ বিষয়ক ২য় বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে একটি সুসংবদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয় যা ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা’(Madrid International Plan of Action on Ageing) হিসাবে পরিচিত। উক্ত আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়-
(১) সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
(২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন। (৩) নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন।
(৪) জীবনব্যাপি এবং শেষ জীবনেও স্বচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
(৫) প্রবীণরা কোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয়-বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ।
(৬) প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে।
(৭) জেন্ডারকেন্দ্রীক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার।
(৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান।
(৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা।
(১০) প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা।
(১১) উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান।
(১২) আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারির্পাশ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়া।
এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণায় যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
(ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন।
(খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি।
(গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
এছাড়াও সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
প্রবীন দিবস পালন করার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য হচ্ছে :
(ক) প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি, বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির করা।
(খ) প্রবীণদের দীর্ঘ জীবন, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ’ অধিকার রক্ষা ও পুণর্বাসন।
মানুষের জীবনে বার্ধক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের কারো নেই । আজকে যারা যুবক তারা আগামী দিন প্রবীণ। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। মানুষের দুনিয়ার জীবন হলো জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়। অবশ্যই আমাদের আরো একটি জীবন রয়েছে যার নাম পরকালীন জীবন। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। দুনিয়ার জীবনটা হলো ক্ষণকালীন এবং পরকালীন জীবনের শষ্যক্ষেত্র। পরকালীন জীবনে সফলতা পেতে হলে দুনিয়ার জীবনটা আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথে কাটাতে হবে। পরকালের জীবনই প্রকৃত জীবন, অনন্ত জীবন। মানব জীবনচক্র মূলত কয়েকটি পর্যায় ক্রমিক স্তরের সমষ্টি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য এই পাঁচটি স্তরে মানুষের জীবনকে ভাগ করা হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই জীবনের এক একটা স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরে উপনীত হতে হয়। জীবন চক্রের সর্বশেষ ধাপ বা পরিণতি হলো বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব । মানব জীবনে বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা। শুধু বয়সের কারণে বা বার্ধ্যকের কারণে প্রবীণরা গুরুত্বহীন অবস্থায় অবমূল্যায়নের জীবন ধারণ করবেন, তা এই সচেতন ও সভ্যসমাজে হতে পারে না। তারা অবজ্ঞা-অবহেলায় থাকতে পারে না। আধুনিক ও নবীন সমাজ আমরা সকলে দায়বদ্ধ প্রবীণ সমাজের নিকট। প্রবীণরাই আমাদের জন্ম দিয়েছেন, তারাই আমাদের শিশুকাল, শৈশবকাল ও কৈশোরকালের লালন-পালনকারী।
তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হয়েছি, আমাদের সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়েছে এই প্রবীণ মানুষগুলোর পরিশ্রমে, তাদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তায়। তাদের আত্ম-উৎসর্গিত জীবনের চরম সুবিধাভোগী আমরাই। প্রবীণদের জীবনকাল বিসর্জনের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই আধুনিক উন্নতমানের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা । প্রবীণরা হলো এই সুন্দর জীবন ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার রচিয়তা। তাদের প্রতি কোন বৈষম্য নয়, কোন করুণা নয় কোন অবহেলা নয় বরং প্রদর্শন করতে হবে নৈতিক, আদর্শিক ও ধার্মিক মহা প্রতিদান। তারাই আমাদের জীবনের শত প্রেরণার নিরন্তন উৎস, জীবন্ত কিংবদন্তি। একজন সক্ষম মানুষ তার জীবনের পুরোটা সময় শেষ করে দেয় যে পরিবারের জন্য, জীবনের শেষ সময়ে সেই পরিবারে থাকাটা তার নৈতিক অধিকার। আর এই অধিকার হলো আল্লাহ প্রদত্ত। এটা তাদের প্রতি কোন দয়া নয়। কোন অনুগ্রহ নয়। সুতরাং পরিবারই হচ্ছে প্রবীণদের আসল ঠিকানা। অথচ বাবা-মা প্রবীণ হয়ে গেলে আজকের সন্তানরা তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মায়ের মনের যে লুকানো আকুতি তা সন্তানরা দেখতে পায় না। এটা ভেবে দেখে না যে, সেই সন্তানরাও একদিন প্রবীণ হবে, একদিন তাদের সন্তানও একই আচরণ তাদের সাথেও করতে পারে। কাজেই সন্তানের জীবদ্দশায় কোনো বাবা-মাকেই যেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। পরিবারই যেন হয় প্রতিটি প্রবীণের নিজ আবাস, এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
ইসলামে বার্ধক্যে উপনীত পরম শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার প্রতি সেবা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল-কুরআনের সূরা বনী-ইসরাইলে ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে আল্লাহর ঘোষণা-
১. তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা।
(বনী-ইসরাইল : ২৩)
২. তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, ন¤্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (বনী-ইসরাইল : ২৪)
৩. কুরআনে কারীমের সূরা লোকমানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহর ঘোষণা- আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। (লোকমান : ১৪)
৪. পিতা-মাতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন – আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর। (নিসা : ৩৬)
৫. পিতা-মাতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা কাহক্বাফে ১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন – আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। (আহক্বাফ : ১৫)
উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে পিতামাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা সন্তানের ওপর অপরিহার্য কর্তব্য। তবে সন্তানের ওপর পিতা মাতার অধিকার যে বেশি। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
১. হযরত আবু হুরায়রা (রা বলেন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা
আমার সাহচর্যে সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? রাসূল্লাহ (সা
বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূল্লাহ (সা
বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূল্লাহ (সা
বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন তারপর কে? রাসূল্লাহ (সা
বললেন তোমার পিতা। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে নিকটাত্মীয়। (সহীহ বুখারী : ২/৮৮৩)
২. হযরত আবু উমামা (রা হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি একবার রাসূলে করীম (সা
কে জিজ্ঞাসা করল, সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক কি? তিনি বললেন, ‘তারা উভয়ই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’
(ইবনে মাজা : ৩৬৬২)
৩. নবী করীম (সা আরও বলেন : ‘ঐ লোক হতভাগ্য! ঐ লোক হতভাগ্য! ঐ লোক হতভাগ্য! জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (সা
! কার শানে একথা বললেন? নবী করীম (সা
বললেন, যে লোক পিতা-মাতার একজন কিম্বা দু’জনকে তাদের বৃদ্ধ বয়সে পেল অথচ জান্নাতে দাখিল হল না, সে হতভাগ্য’। (মুসলিম : ২৫৫১)
৪.পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লহর সন্তুষ্টি এবং তাদের অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (সুনানে তিরমিযী : ৪/৩১০)
৫. পিতা-মাতার পায়ের নিচে জান্নাত। (আল মু’জামুল কাবির : ২/২৮৯, সহীহ আত-তারগীব- ২/৩২৭)
উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করলে, তাদের সেবা-যতœ করলে জান্নাত পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে তাদের অন্তরে কষ্ট দিলে, তাদের সেবা-যতেœ অবহেলা করলে আল্লাহর অসন্তুষ্ট ও জাহান্নাম লাভের উপায় হবে।
পৃথিবীর উন্নত দেশে ও আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতেও এই সম্মানের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। একারণেই সেখানে যানবাহনে যাতায়াতে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে, ব্যাংকের লেনদেন কার্যক্রমে প্রবীণদের বিশেষভাবে সহযোগিতা দেবার ব্যবস্থা আছে।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে প্রবীণদের সম্মান করা, প্রবীণদের শ্রদ্ধা করা, প্রবীণদের মর্যাদা দেয়া ও প্রবীণদের সহায়তা করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য। প্রবীণদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের অসম্মান কখনও আমাদের মূল্যবোধ হতে পারে না। ইসলাম এটা অনুমোদন করেনি। প্রবীণের যুক্তি, চিন্তা ভাবনা, বুদ্ধি আর নবীনের শক্তি-এই দুইয়ে মিলে আধুনিক সমাজের উন্নতি। প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ, আমাদের কাছে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে চলমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তাই –
১. প্রথমে মনে রাখতে হবে প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের পরিবারেরই সদস্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতোই তার সাথে সুন্দর আচরণ করার মাধ্যমে তাদের অসাহায়ত্ব দূর করতে হবে।
২. পরিকল্পনার আলোকে তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে বোঝার পরিবর্তে তাদেরকে সম্পদে পরিণত করতে হবে।
৩. অধিকারের প্রশ্নে নয় বরং তাদের জীবনের শেষভাগ যেন সফল, সার্থক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে।
৪. একাকিত্ব জীবন নয় নিজ পরিবারের ছেলে-মেয়ে, বৌমা ও নাতী-নাতনীসহ থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. সামাজিক সম্মানবোধ ও মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে, করুণা করে নয় বরং ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সকল সন্তান তথা দায়িত্বপ্রাপ্তদের তাদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে।
৬. আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সবসময় প্রবীণদের আদর যতœ দিয়ে শিশুদের ন্যায় প্রতিপালন করা। যে ভাবে তারা আমাদেরকে শিশুকালে লালন-পালন করেছে। তাদের প্রতি মায়া মমতা, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কোন ক্রমেই তাদের মধ্যে যেন এই ধারণা না হয় যে তারা আমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা।
৭. প্রবীণদের নিয়মিতভাবে ডাক্তার দেখাতে হবে ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পূর্ব থেকে রোগের ধারণা নিয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ খাওয়াতে হবে।
৮. বাসায় প্রবীণদের নিয়মিত সময় দিতে হবে। তাঁদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে হবে। তাঁদেরকে হাসি খুশি রাখতে হবে।
প্রবীণদের দৈনন্দিন জীবন যাপন স্বাচ্ছন্দ্যময় করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং তাঁদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদেরকে সচেতন করাসহ নানাবিধ জটিল সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য গত ১২ সেপ্টেন্বর, ২০১৪ সনে ঢাকায় প্রথমে বাংলাদেশ জেরিয়াটিক সোসাইটি পরে ২০১৮ সনে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ভিওিক কাজ শুরু করে। সোসাইটি প্রতি বছর ণবধৎ নড়ড়শ নামে একটি বই বের করছেন।
প্রবীণদের বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে যাচ্ছেন। প্রবীণদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি একটি অরাজনৈতিক, সেবামূলক ও অলাভজনক জনকল্যাণমূলক সামাজিক সংগঠন। এই সোসাইটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাতীসংঘের প্রস্তাব অনুসারে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবীণদের সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সোসাইটি দেশের সকল প্রবীণকে একটি পতাকাতলে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে অধিকাংশ প্রবীণরা অবনতিশীল স্বাস্থ্য, আর্থিক দীনতা এবং সামাজিক নিরাপওাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। তাই, প্রবীণদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এবং এনজিওসহ জনকল্যাণমূলক সংগঠনগুলোকেও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যম তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সনে বয়ষ্ক ভাতা চালু, প্রবীণ বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা-২০১৩ অনুমোদন ও পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন এবং ২০১৪ সনে ৬০ উর্ধ্ব প্রবীণদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করলেও এখনো অনেক প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। তাই নিম্নলিখিত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তাব আকারে পেশ করা হলো-
১) পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে প্রবীণদের জন্য বিদ্যমান আইন অনুসরণে প্রবীণ বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা এবং ভরণ- পোষণ আইন সংস্কার, সময়োপযোগী, উন্নত এবং আধুনিক করা।
২) মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বেড ও কেবিন সংরক্ষণসহ কনশেসন রেটে স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা এবং একইভাবে কনসেশন রেটে ফার্মেসি হতে ওষুধ ও পথ্য সামগ্রী পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা।
৩) আর্থিক সমস্যা বিবেচনায় এনে গণ পরিবহনে (সড়ক, রেল, স্টীমার এবং বিমানপথ) তাদের জন্য আসন সংরক্ষণসহ কনসেশন রেটে টিকেট এর ব্যবস্থা করা।
৪) বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উর্ধ্বগতি বিবেচনায় শুধুমাত্র সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সল্পমূল্যে রেশনিং সিস্টেম চালু করা।
৫) আর্থিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকে তাদের জন্য হেলপ ডেস্ক এবং পৃথক পৃথক কাউন্টার রাখার ব্যবস্থা করা।
৬) বিভিন্ন সঞ্চয়ী স্কীম বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র স্কীমে, পুজিবাজারে, এবং সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিভিন্ন প্রকার বন্ড ও লাভজনক প্রকল্পে উচ্চতর হারে বিনিয়োগের সুযোগ প্রবর্তন করা।
৭) সিনিয়র সিটিজেনদের কল্যাণে ‘প্রবীণ কল্যাণ সঞ্চয়পএ’ প্রবর্তনসহ প্রবীণ ওয়েলফেয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা ।
৮) সার্কিট হাউজ, ডাক বাংলা, পর্যটন মোটেল এবং বেসরকারি হোটেল-রিসোর্টে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৯) আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে আহুত সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আচার অনুষ্ঠানে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে আমন্ত্রণ জানানোসহ তাদের আসন সংরক্ষণ এবং তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রদানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১০) জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা, দুর্যোগে সিনিয়র সিটিজেনদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিমালা প্রবর্তন করা। সরকারি ও বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ট্রেনিং সেন্টারে রিসোর্স পারসন অথবা অতিথি বক্তা হিসেবে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা করা।
১১) ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট প্রাপ্তি, ভিসা প্রাপ্তি, জাতীয় গুরুত্ব সনদপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে অগ্রাধিকার/বিশেষ বিবেচনায় গণ্য করা।
১২) সরকার কর্তৃক সিনিয়র সিটিজেনদেরকে পৃথক স্মার্ট কার্ড অথবা পরিচয়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা।
১৩) পেশা ভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে তাদেরকে কাজে লাগানো।
১৪) গণমাধ্যমসমূহ তথা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সামাজিক আন্দোলন ও শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবীণদের জীবনের বিভিন্ন দিক, পরিচর্যা, সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
১৫) শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বার্ধক্য ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত করা।
১৬) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন- মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদিতে সাপ্তাহিক ধর্মীয় বিশেষ দিনে ওয়াজ মাহফিলে প্রবীণদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরার ব্যবস্থা করা।
১৭) পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সন্তানকে সচেতন করার জন্য ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ানোর ব্যবস্থা করা।
১৮) পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলায় সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা।
১৯) অন্যান্য দিবসের মত গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলে প্রবীণ দিবস পালন করা ।
পরিশেষে আমি বলতে চাই-
ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালন করার জন্য সন্তানদের সরকার, বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা প্রয়োজন। যেমনিভাবে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয় শিক্ষকদের, করদাতাদের, সমাজ সেবকদের, সাংবাদিকদের, পেশাজীবিদের, বিভিন্ন দিবসে গুনিজনদের। আল্লাহ পূর্বেই পিতা-মাতার খেদমতের জন্য অ্যাওয়ার্ড এর ঘোষণা করেছেন। আর সেই অ্যাওয়ার্ড হলো জান্নাত। যারা পিতা-মাতার খেদমত করবে তারা জান্নাতে যাবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার খেদমত করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক দিন।
©somewhere in net ltd.