![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রমজান মাস জুড়ে বিএনপি এককভাবে ৬০০০ ইফতার পার্টি দিচ্ছে। তথ্যটি জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। জামায়াতে ইসলাম দিচ্ছে দেড় লাখ ইফতার পার্টি। সূত্র বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। উদ্দেশ্য হচ্ছে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত না করতে পারা কর্মীদের হতাশা কাটানো, মনোবল চাঙ্গা করা, ঈদের পর আবার মাঠে নামানোর মন্ত্রে উজ্জীবিত করা। বিএনপি ৬০০০ ইফতার কোথায় কোথায় দিচ্ছে– তা ব্যারিস্টার রফিক স্পষ্ট করে বলেননি। তবে বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ে কর্মীদের চাঙ্গা করতে এসব ইফতার পার্টির আয়োজন হলে বাজারে অর্থ সরবরাহ ভালই হবে। তবে জামায়াতে ইসলাম কিভাবে লক্ষাধিক ইফতারের আয়োজন করতে যাচ্ছে তা নিয়ে অনেকে হয়ত বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে শহরের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে এসব আয়োজন জামায়াত করতেই পারে। সে ধরনের পরিকল্পনা জামায়াতের থাকলে তা তারা কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তা আমাদের মতো অনভিজ্ঞ মানুষ হয়ত হিসাব মেলাতে মাথা চুলকাবে, কিন্তু জামায়াতের কাছে এটি হয়ত তেমন কোন কঠিন ব্যাপারই নয়। আমরা এসব ইফতার পার্টির খোঁজখবর হয়ত রাখি না। কিন্তু আমাদের আশপাশেই হয়ত সে সব ইফতার পার্টি প্রতিদিন হয়ে যাচ্ছে- আমরা তা বুঝতে পারি বলে মনে হয় না। কেননা, জামায়াতের রাজনীতিতে গোপনীয়তা কৌশল এবং পরিকল্পনা এতটাই রক্ষা করা হয়ে থাকে যা অন্যরা কমই বুঝতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার চোখে ধুলা দিতেও জামায়াত সিদ্ধহস্ত এটি প্রমাণিত সত্য।
সে যাই হোক, এক সময়ের চারদলীয় জোট (হু. মু. এরশাদও এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন) ১৪ দলীয় জোটকে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে টেক্কা দিতে ১৮ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়েছিল, গেল নির্বাচনের আগে এরশাদ সাহেবের দীর্ঘদিনের অনুগত কাজী জাফর যোগ দিয়ে ১৯ দলীয় জোটের পরিসর বাড়ালেন, সর্বশেষ দীলিপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দলের একাংশ গিয়ে ২০ দলীয় জোটের ‘মর্যাদা’ আরও বাড়িয়েছে, বাংলাদেশে সব কিছুই সম্ভব। এই জোটের বর্তমান সংখ্যাটি হয়ত ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। কারণ দলের কর্মী, সমর্থক, ভোট না থাকলেও বড় দলের প্রধানের সঙ্গে ছোট দলের প্রধান পরিচয় নিয়ে বসার সুযোগ থাকলে অনেকেই সেই সুযোগ নেবেই। অন্যদিকে বড় দল দেশের জনগণ এবং বিদেশীদের বলতে পারেন যে, তার সঙ্গে এতটি দল রয়েছে, তিনি এত সংখ্যক দলকে নিয়ে গঠিত জোটের প্রধান। বিষয়টি একেবারেই মনস্তাত্ত্বিক। সেই সুবিধাটি পেতেই বাংলাদেশে এখন জোটের সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানোর প্রবণতা ও আগ্রহ বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে ২০ দলের সঙ্গে যত দলই যুক্ত হোক না কেন মানুষ চেনে দুটো দলকেই, একটি বিএনপি, অন্যটি জামায়াত। কর্নেল অলি আহমদ বিএনপি করে ২০০৬ সালে কিছু একটা হতে এলডিপি করলেও আবার বিএনপির কাছেই নিজের আত্মসমর্পণ করেছেন। অন্য কোন নেতা নেইÑ যাঁদের দলের চাইতেও ব্যক্তিগত পরিচয়ে তাঁরা দেশের মানুষের কাছে একটি ভাল মর্যাদার আসন নিয়ে আছেন।
যা হোক, ২০ দলীয় জোট ঢাকায় এখন প্রতিদিন একটি করে বড় বড় ইফতার পার্টি দিচ্ছে। তাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন, মোনাজাত দিচ্ছেন, একটি বক্তৃতাও দিচ্ছেন। শরিক দল ছাড়াও বিএনপির বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগেও আয়োজিত ইফতার পার্টিতে তিনি যাচ্ছেন এবং বক্তৃতা দিচ্ছেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণে যে বিষয়গুলো প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসে তা হচ্ছে, এ সরকার অবৈধ, স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট, দুর্নীতিবাজ, দেশ ধ্বংসকারী, গণতন্ত্র হত্যাকারী ইত্যাদি। এ সরকারের পেছনে দেশের জনগণ নেই। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ১৯ দলীয় জোটের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষই এখন সরকারের বিরুদ্ধে, ২০ দলীয় জোটের পক্ষে আছে। তিনি দেশের সামগ্রিক অবস্থার যে বিবরণ তার বক্তৃতায় প্রতিদিন দিয়ে থাকেন তাতে জনগণ অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে, গুম ও খুনের ভয়ে মানুষ আতঙ্কে আছে। দেশের মানুষ নাকি তাকে এ কথাও বলছেন যে, বিএনপি কেন এই সকারের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করতে আন্দোলন করছে না। সে জন্য তিনি তার দলের নেতাকর্মী, ২০ দলের নেতাকর্মীদের ঈদের পর সরকার উৎখাতের আন্দোলনে যুক্ত হতে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। দল বা জোটের কোন সাংগঠনিক সভায় আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের বাস্তবতা, করণীয় ইত্যাদি নির্ধারণের কোন নজির এখানে নেই, অথচ ইফতার পার্টিতে রাজনৈতিক কর্মসূচীর ঘোষণার কথা প্রতিদিনই বলা হচ্ছে। তাতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী শুভানুধ্যায়ী ইফতারে অংশ নিচ্ছেন, খানাপিনা করে যে যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। এতে কতটা চাঙ্গা তারা হচ্ছেন, ঈদের পর ঘোষিত কর্মসূচীতে কতটা অংশ নেবেন তা তখনই কেবল বলা যাবে। এক বছর আগেও অবশ্য রমজানে ইফতার পার্টিতে একইভাবে সরকার উৎখাতে কর্মী সমর্থকদের রমজানের পর মাঠে নামতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন নির্বাচন পূর্ববর্তী অবস্থা ছিল, জামায়াতের অংশগ্রহণ নানা কারণে একচ্ছত্র ছিল, তারপরও কোন ঈদের পরই আন্দোলন জমানো যায়নি। এ বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। তারপরও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে অতীতে কোন আন্দোলন জমে না ওঠার অভিজ্ঞতা আছে বলে এবার বা কোন বারই বিরোধী দল তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। আন্দোলন কোন দিনক্ষণ দিয়ে হয় না। হয় বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় নেমে গেলে, দেশ চালাতে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলে, দেশে চরম দুরবস্থা, দুঃশাসন, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের সঙ্কট সকল সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, জনগণ তেমন পরিস্থিতির পরিবর্তন অপরিহার্য- এমনটি অনুধাবন করলে, এর পক্ষে তাদের অবস্থান বোঝাতে প্রস্তুত হলে। দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, পরিবর্তনের জন্য তৈরি রাজনৈতিক শক্তির ওপর জনগণের আস্থা স্থাপন। যে কোন বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধনে দলসহ সকল সচেতন মহলকেই বিষয়গুলো নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিবেচনায় নিতে হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখতে হয়। রাজনীতির বিশ্লেষণে আমরা যারা এ ধরনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণগুলো যুগ যুগ ধরে পড়ে আসছি, শিখে এসেছি, বাস্তবে সংঘটিত বড় বড় পরিবর্তনের অভিজ্ঞতায় পর্যবেক্ষণ করে থাকি, তাদের বোধহয় আবেগতাড়িত হওয়ার কিছু নেই। সেই তত্ত্বজ্ঞান বিবেচনায় নিয়েই দেশের বর্তমান সামগ্রিক অবস্থা জনগণের চাওয়া-পাওয়া, চিন্তা-ভাবনা আন্দোলন আহ্বানকারী দল বা জোটের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-অনাস্থা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস থেকে অনেক ধারণা করা যায়। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকেও এসব বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকেই দেখা যেতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন দাবি করেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ অংশ নেয়নি এবং এই ৯৫ শতাংশ মানুষ তার দল বা জোটের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে- এমনটিই দাবি করেছেন। প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীর জানা আছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহত করার জন্য যে ধরনের তা-ব, ধ্বংসলীলা, হত্যাকা- ও জোরজবরদস্তি করা হয়েছিল তা থেকে ভোটে অংশগ্রহণের সংখ্যা ব্যাপক না হলেও যা তিনি দাবি করেছেন তা বাস্তবের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং পরিণতি সম্পর্কে গেল দু’সপ্তাহে এই কলামেই প্রকাশিত আমার লেখা দু’টোতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সুতরাং এ নিয়ে নতুন করে লেখার প্রয়োজন নেই। তবে মোট ভোটারের ৯৫ শতাংশ যদি বিএনপি-জামায়াত জোটের সমর্থক হয়ে থাকেন তাহলে সরকারের অবস্থান ৬ জানুয়ারিতেই নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার কথা। বাস্তবে তেমন হয়নি। মানুষ একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির মতো একটি বড় দল এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তা প্রতিহত করতে সকল শক্তি নিয়োগ করলে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজেরা অংশগ্রহণ না করে প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে না দেয়া- একটি রাজনৈতিক দ্বৈতচারিতা বা চালাকি বলা যায়। সে ধরনের নির্বাচনকে নিয়ে মনগড়া কথা বলা, বানোয়াট তথ্য দাবি করা, নির্বাচনকে অবৈধ বলে চালিয়ে দেয়া কোন সৎ রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে না। বিএনপি যদি সত্যি সত্যিই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বর্জনের আহ্বান জানিয়ে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি বা প্রতিহত করার কাজে অংশ না নিত, ভোটারদের ভোটদানে বাধা না দিত, তাদের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়টি জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে বোঝাত, তা হলে নির্বাচন শেষে একটা চিত্র ফুটে উঠত। তারপর নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিএনপি সেই নির্বাচনের অসম্পূর্ণ দিকগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরলে এর একটি গ্রহণযোগ্যতা পেত। কিন্তু বাস্তবে তা না করে রক্তক্ষয়ী অবস্থা তৈরি করায় ৯৫ শতাংশ মানুষ ১৯ দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছে, ২০ দলের সঙ্গে আছে এমন দাবির কোন বাস্তব ভিত্তি থাকে না। ১৫৪ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে তাদের নির্বাচিত হওয়াটি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ বলার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। কোন নির্বাচনে একজন বা সকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে আইনগত কোন সংঘাত নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। একটি আদর্শবাদী ও জনতুষ্টিমূলক নির্বাচন হওয়ার সুযোগ না পেলেও নির্বাচনটি এক ধরনের পরিসমাপ্তি টানতে পেরেছে। ফলে গঠিত সরকার বা সংসদ এর কোনটিকেই আইনগতভাবে অবৈধ বলা যাচ্ছে না। সাংবিধানিকভাবেই সরকার ও সংসদ বৈধ। নৈতিকতার বিষয় নিয়ে তর্ক করা যাবে, কিন্তু সেই পরিস্থিতির দায় কার ঘাড়ে কতটা পড়ে সেটিও বিবেচ্য বিষয়। সে কারণেই এখন বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, সরকার ও সংসদ সম্পর্কে যে সব অভিযোগ করছেন তা নিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ বা সমর্থন পাওয়ার মতো কোন বাস্তবতা চোখে পড়ছে না। মানুষের মনে এই নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও হতাশা আছে, সরকার ও সংসদ নিয়েও ক্ষোভ আছে। কিন্তু তার মানে এমন নয় যা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মতামতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এখানেই পার্থক্যের জায়গাটি বিরাজ করছে। এই পার্থক্য বাস্তবতাকে মানা না-মানার গভীর ব্যবধান থেকেই তৈরি, সেখানেই নিহিত রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় দেশে যে দুঃসহ অবস্থার চিত্র অঙ্কন করছেন তা বাস্তবে কতটা আছে, কতটা নেই, কতটা ভৌতিক, অতিরঞ্জিত- তা দলের রাজনীতির সঙ্গে যাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই তারা যেভাবে মূল্যায়ন করবেন, যাঁরা এ পক্ষের রাজনীতি করেন- তাঁরা একভাবে, অন্যপক্ষের হলে অন্যভাবে বিশ্বাস করেন। সুতরাং তাঁর মতামতের সঙ্গে ৯৫ শতাংশ মানুষ একমত- তা কিন্তু কোনভাবেই প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
বেগম খালেদা জিয়া দেশের যে ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করেছেন তা যদি পুরোপুরি সত্য হতো, তা হলে তো মানুষ তাঁর প্রতি ভীষণভাবে আস্থাশীল হয়ে উঠত। হ্যাঁ দেশে সমস্যা আছে, সুশাসনের অভাব এবং সমস্যাও আছে। আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী ব্যক্তিস্বার্থে এমন অনেক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে যা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। ছাত্রলীগের নাম করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব ছাত্র মস্তানি করছে, লেখাপড়া না করে অর্থবিত্ত গড়তে দুর্নীতিতে লিপ্ত হচ্ছে- তাদের দিয়ে শেখ হাসিনা বা সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতি বাস্তবায়ন করা যাবে না- এমন অভিমত ধীরে ধীরে উচ্চারিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভের বড় জায়গা শুধু এখানেই। দেশের অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কিছু অভিযোগ থাকলেও সামগ্রিক অর্জন অনেক বিশাল। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে দেশের সব কিছু নিয়ে প্রবল জনমত সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শেখ হাসিনা যদি তাঁর দল এবং তরুণদের সঠিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন তা হলে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার বিষয়ও অনেক কমে যাবে। অন্যদিকে বিএনপির শাসন, অর্জন ইত্যাদি মানুষ এখন তুলনা করতে পারছে। সেদিক বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগের অর্জনের তালিকা ধরে ধরে দেখাতে গেলে সেটি কতটা বড় হবে, তার পাশে বিএনপি বা ৪ দলীয় জোট শাসনের তেমন কোন তালিকা দাঁড় করানোই বেশ কষ্টকর হবে। যাদের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়নি- তারা বিষয়গুলোকে সেভাবেও ঝালাই করে দেখেন। অন্যদিকে ২০১৩ সালে আন্দোলনের নামে দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। ফলে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের কথা শুনলেই মানুষের মধ্যে গেল বছরের স্মৃতি নতুন করে ভেসে ওঠে, তাই এক ধরনের আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। অন্যদিকে যে সব নেতাকর্মী গেল বছর দীর্ঘ হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, পোড়াপুড়ি করেছিল তাদের সম্মুখে তখন একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা ছিল। নির্বাচনে জোট জয়লাভ করলে তারা ক্ষমতায় যাবে, ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা তখন আদায় করে নেবে এমন বাস্তবতায় হরতাল সফল করার জন্য দৈনিক যে কয়েক হাজার টাকা এক একদিন একজন নেতা তার নিজের এলাকায় খরচ করতেন তা তখন দেয়ার যেমন মানুষ ছিল, তুলে নেয়ার পরিকল্পনাও ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার রায় ঘোষিত হলে জামায়াত হয়ত চেষ্টা করবে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে। নৈরাজ্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ জামায়াতের রয়েছে- সেটি ২০১৩ সালে প্রমাণিত হয়েছে। তবে তাদের সেই রাজনীতিতে পা দিয়ে বিএনপি কতটা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মূল্যায়নের বিষয়। এবারও যদি একই ধারায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয় তা হলে পরিস্থিতি কোন্ দিকে মোড় নেবে তা বলা মুশকিল। তবে জামায়াত কেমন প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনীতিতে তা বোঝা যাবে মামলার রায়গুলো ঘোষণার পর পরই।
সব শেষ কথা, ঈদের পর আগস্ট মাস। এটি বাঙালী জাতির জন্য একটি ভয়াবহ শোকের মাস। তবে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিসত্তার বিরোধীদের কাছে এটি একটি শুভ মাস বলে বিবেচিত। তাদের শুভ বিশ্বাসের পেছনে পাকিস্তানের জন্ম ১৪ আগস্ট, সেই বিশ্বাসে আস্থাশীল হয়েই তারা ১৫ আগস্ট সংঘটিত করেছিল, ২১ আগস্টও সংঘটিত করেছিল, ১৭ আগস্ট ৫০০’র মতো জায়গায় একসঙ্গে বোমা হামলা করেছিল। সবই বেছে বেছে আগস্ট মাসকে ‘পবিত্র’ মনে করেই করা হয়েছিল। সেই বিশ্বাস থেকেই ১৫ আগস্টকে তারা তাদের একটি জন্মদিন হিসেবে পালন করে থাকে। বেগম জিয়ার জন্মদিন প্রতীক মাত্র। এর তাৎপর্য তাদের কাছে গভীর ও সুদূরপ্রসারী- তা এদের কত সংখ্যক মানুষ এখন বুঝতে পারে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাঁরা বিশ্বাস করেন বলে দাবি করেন, তাঁরা আসলে এসব কতটা বিশ্বাস করেন, আস্থায় নেন জানি না। তবে আমার ধারণা ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলনের পেছনে আগস্টের প্রতি কারও কোন মহলের বিশেষ কোন অন্ধবিশ্বাস আছে কিনা, ভেবে দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ শোক পালনের পাশাপাশি নূতনভাবে আগস্ট সৃষ্টির নতুন কোন ষড়যন্ত্র তৈরি হয় কিনা, সেদিকে কতটা নজর রাখবে, সচেতন থাকবে তাও দেখার বিষয়। তবে দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদ শেষে ভালভাবে কাজে ফিরে আসা, রুটি-রুজির ব্যবস্থা করা, পরবর্তী ঈদ-পূজা-পার্বণের প্রস্তুতি নেয়ার মতো পরিবেশ ছাড়া অন্য কোন বিষয় আলোচনায় আছে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়া আন্দোলনের পরিণতি আবারও গণমানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়াই হতে পারে, যদি সরকার কোন বাড়াবাড়ি না করে।
©somewhere in net ltd.