নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন। বাংলাদেশী লেখক। দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক বাংলা ও কিশোর বাংলায় গল্প লিখি। প্রকাশিত গল্পের বইঃ প্রত্যুষের গল্প (পেন্সিল)\nউপন্যাসঃ এমনি এসে ভেসে যাই (তাম্রলিপি)।

আনু মোল্লাহ

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন এর ব্লগ

আনু মোল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিপটুসের পাল্লায় জগবুল

২৩ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ৯:১৫



আমাদের বেশ কিছু কিপটে বন্ধু-বান্ধব আছে। আমরা এদের বেশ পছন্দ করি। মানুষ হিসেবে কিপটুসরা বেশ মজার। এদের মাঝে একজন কিপটুস হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ (নাম বলা নিষেধ, বললে চিনে ফেলবেন)। ভার্সিটিতে পড়ার সময় সে কখনো পেস্ট কিনতো না। অন্যদের রুমে রুমে গিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া পেস্টের টিউব নিয়ে আসত। এরপর সেগুলো কেটে কেটে ওদের পেটের ভেতরে পেস্টের যে অতি ক্ষুদ্রাংশ আছে সেগুলো জমা করে নিজের কাজ চালিয়ে নিত।
এক সময় সে বিয়ে করল। আমরা বেশ খুঁজে-পেতে আরেকজন সর্বশ্রেষ্ঠ কিপটুসনির সাথে বিয়ে দিলাম। only great can value the great.
বিয়ের বেশ কিছুদিন পর আমরা সবাই মিলে কিপটুস-কিপটুসনির সংসার দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা বাসায় নেই। ঘর অন্ধকার। হয়ত কোথাও গেছে। কিছুদিন পর আবার গেলাম। ওদের ফোন সব সময় বন্ধ থাকে। বেশি ব্যবহার করলে ফোন তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। কখনো যদি কোন ফ্রী অফার-টফার থাকে তখন শুধু ফোনটা অন করে মানুষকে ফোনটোন দেয়। নইলে না।
এভাবে কয়েকদিন গিয়ে ফেরত আসলাম। তখন আমাদের মনে হল ওরাতো এত বেড়ানোর পাবলিক না। অন্যকোন বিষয় থাকতে পারে। আমরা বেশ করে দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করলাম। তখন দেখি ভেতর থেকে দরজা খুলল। কিন্তু ঘর তখনো অন্ধকার।
আমরা বললাম, কিরে তোরা ঘর অন্ধকার করে থাকিস কেন? আমরা আরো দুই-তিন দিন এসে ফেরত গেলাম।
ওরা বলল, না না, আমরা বাসাতেই থাকি। তবে লাইট জ্বালাই না। তোরা দরজা ধাক্কা দিলেই পারতি।
- কেন? লাইট জ্বালাস না কেন?
- আরে বিদ্যুতের যা দাম। লাইট জ্বালানোর উপায় আছে। বাড়িওয়ালা বিদ্যুৎ বিল দিবে না। আমাদেরকেই দিতে হয়। তাই খরচ বাঁচাচ্ছি। বিয়ে-শাদী করেছি। এখন তো আগের মত চলা যায় না। একটু হিসাব করে চলতে হয়।
ওদেরকে আর কিছু বললাম না। বলে লাভ নাই। আমরা বরং বাড়িওয়ালার কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম, আংকেল, আমাদের বন্ধুর বিদ্যুৎবিলটা একটু আপনিই দেন। ওরা বিলের ভয়ে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। আর ওরা যা কিপটুস বিল আপনি দিলেও বেশি খরচ করবে না। খরচ করা ওদের ধাতেই নাই।
বাড়িওয়ালা রাজি হল।
আমরা পরের মাসে আবার গেলাম। গিয়ে দেখি এবারও ঘর অন্ধকার। আমরা বললাম কিরে, এখন সমস্যা কি? এখন তো বিল বাড়িওয়ালা দেয়।
এই বলে আমরাই লাইট জ্বালিয়ে দিতে গেলাম, ওরা দুজনেই তখন আঁতকে উঠে, না না বলে চিৎকার দিল।
আমরা বললাম, কেন? এখন আবার কি সমস্যা?
ওরা বললো, "আসলে জামা-কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে বলে, আমরা বাসায় কাপড়-চোপড় পরি না। বুঝিস তো, বিয়ে শাদি করেছি এখন একটু হিসাব করে চলা লাগে।"



আমাদের বন্ধুদের মধ্যে জগলুকে সবার চেয়ে বুদ্ধিমান বলা যায়। তার এতবেশি বুদ্ধি যে সে আমাদের কিপটুস (নাম বলা নিষেধ, বললে চিনে ফেলবেন) বন্ধুর কাছ থেকে একটা দাওয়াত বের করে ফেলেছিল। ওদের কাছথেকে এটা বের করা যে কি কঠিন সেটা আপনারা যারা ওদের কে চিনেন না, তারা বুঝবেন না।
সত্য কথা বলতে জগলু নিজেকে বুদ্ধিমান দাবী করলেও, ওকে বুদ্ধিমান মনে করার মত স্টুপিড আমাদের দলে কেউ ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার পর বন্ধু মহলে ওর দাম বাইড়া গেল। ওযে আসলেই একটা বুদ্ধিমান শ্রেনীর লোক এটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে লাগল।
দাওয়াতটা নিয়া ও সবার আগে আমারেই খবরটা দিল। (আমাকেই ও খবরটা প্রথম ধাক্কাতে বিশ্বাস করার মত স্টুপিড মনে করেছে)। কিন্তু আমারও প্রথমটায় বিশ্বাস হল না। ভাবছি নিশ্চয় শালা ফ্রাংক করার তালে আছে। আর ক’দিন আগেই কিপটুসটারে (নাম বলা নিষেধ-বললে চিনে ফেলবেন) দেখলাম গুলশাল একের গোল চক্করে জুতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে কি হইছে, তোর এই অবস্থা ক্যান? জুতা হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছোস ক্যান?” ওর পায়ে একজোড়া ছেঁড়া স্যান্ডেল। কেউ বাথরুমেও ওরকমটা ইউজ করে না।
সে বলল, “নতুন জুতা সেদিন গুলিস্তান থেকে নিলাম। অফিসে পরি। ঢাকার রাস্তার যা অবস্থা, খুব তাড়াতাড়ি জুতা ক্ষয়ে যায়। একটু সাবধানে না চললে হয় না।” যদিও বলা বৃথা, তবুও বললাম, “আর কাউকে দেখেছিস এমন জুতা হাতে হাঁটতে? দেশের আর কারো জুতা ক্ষয় হয় না?”
সে বললো, “বিয়ে তো এখনো করিস নি। করলে বুঝতি। একটু হিসাব করে না চললে, আজকাল ঢাকা শহরে টেকা মুশকিল।” ওর সাথে তর্ক করা বৃথা। তাই বললাম, কিন্তু পুরোটা তো সেইভ করতে পারছিস না। পায়ের স্যান্ডেলগুলো তো ক্ষয়ে যাচ্ছে। অলরেডি এগুলোর তো অবস্থা খারাপ করে ফেলেছিস। দেখে আমারই কষ্ট হচ্ছে।”
আমার এই কথায় সে একটু খুশি হল। বলল, “এগুলোর অবস্থা আমি খারাপ করিনি। আমি কিনি নাই। আমার সামনের ফ্ল্যাটের ওরা বাইরে ফেলে রেখেছিল। একটা ফিতা একটু ছিঁড়ে গেছে তাই। আমি নিয়ে সুন্দর করে মুচির কাছে নিয়ে গেলম। সেলাই করে দিল। তিনটাকায় সুন্দর ব্যবস্থা। শালা পাঁচ টাকার নিচে দিবে না। দুই টাকা দিতে চেয়েছিলাম। শেষপর্যন্ত একটা টাকা বেশি দিতে হল।”
তখন বললাম, তো শুধু জুতা নিয়ে চিন্তা করলে হবে। তোর প্যান্টও তো ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কোন খেয়াল নাই দেখছি।
আমার কথায় ওর শোক উথলে উঠল। বলল, আর বলিস সেই কথা। চেষ্টা করেছিলাম। লুঙ্গি পরে অফিসে আসতাম। অফিসে ঢুকে পরে জামাকাপড় পরতাম। যাওয়ার সময় আবার চেঞ্জ করে ভাঁজ করে রেখে যেতাম। এভাবেই কন্টিনিউ করছিলাম। একদিন এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলে ওকে ধমক দিয়েছিলাম আর তাতেই বিপদেই পড়ি। শালা বজ্জাত।
আমিও কিউরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হইছিল।
সে বলল, আরে ঐ হারামজাদা বজ্জাত আমার লুঙ্গি ধরে টান দিছিলো। সেই থেকে আর লুঙ্গি পরি না। ভিক্ষুকদের তো মান-ইজ্জত নাই। লুঙ্গি খুলে ফেলে। হারামী সব।
আমি তাড়াতাড়ি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আড়ালে গিয়ে এক চোট হো হো করে হেসে বাসায় ফিরে এলাম।
এই যখন অবস্থা তখন আমাদেরকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে, এ কি বিশ্বাস করা যায়? দাওয়াত যদিওবা দিয়েছে কি খাওয়াবে না খাওয়াবে এই নিয়ে আমাদের মাঝে ব্যপক জল্পনা কল্পনা। গাজী বলল, যাইয়া দেখবি খালি পানি গরম করে রাখছে। শরীফ, অয় পানি গরম করলেও হিসাব করবো, পাতিলের ক্ষয় অইছে কয় পয়সা। শামীম কয় দেখবি, একদিন ভাত খাওয়াইয়া পুরা মাস রোজা রাখবো, নয় চিড়া-মুড়ি খাইয়া কাটাইবো।
ওরা চিড়া-মুড়ি খাক নয় যা ইচ্ছা করুক, ঘটনার দিন কেউ মিস করল না। আমাদের রতন, যে কিনা বেশিরভাগ দাওয়াতেই যেতে পারে না, সেও উপস্থিত।
আমি ভাবছিলাম সবার আগে গিয়া হাজির হইব। বিয়ে-শাদী করিনি। ব্যাচেলর মানুষ, বউ-বাচ্চার ঝামেলা না থাকলেও কোথাও সবার আগে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার বদঅভ্যাস আমার নাই। আজকে আর দেরী করতে ইচ্ছা হইল না। কিন্তু গিয়া দেখি প্রায় সকলেই আমার আগেই হাজির।
আমাকে দেখেই উপস্থিত বন্ধু ও বন্ধুনীরা হুড়মুড় করে ছুটে এল, “কি রে তুই খালি হাতে? ব্যাপার কি? কিছুই আনিস নি।” সবার প্রশ্নবানে আমি দিশেহারা। বললাম, দলের মাঝে আমিই একমাত্র ব্যাচেলর, তোরা সবাই যখন এত এত এনেছিস, আমার এক পেট চলে যাবে-’
আর তখনি ঢুকল জগলু আর তার সুন্দরী সহধর্মিনী। মেয়েটি যথেষ্ট সাজ-গোছ করেছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে পার্লারেও গিয়েছে। এমনিতেই সে সুন্দরী, সেটাকে আরো আকর্ষণীয় করার যথেষ্ট কসরত সে করেছে। ওরা খালি হাতে আসেনি। হাতি সাইজের এক কেক নিয়ে এসেছে। দেখে কিপটুস-কিপটুসনি যথেষ্ট মন খারাপ করল। বলল, শুধু কতগুলো টাকা নষ্ট করলি। আজকাল কেউ কেক কিনে টাকা নষ্ট করে? এর চে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসতি, আমাদের চেয়ারটা ভেঙ্গে গেছে। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু এত হাসির পরেও কিপটুস বলল, কেকটা কি ফেরত দিয়ে যদি টাকাটা নিয়ে আসা যায় – খালি খালি কতগুলো টাকা নষ্ট—’
এই শুনে শরীফ ফট করে কেকের বক্স খুলে এক কোনা থেকে একটুকরো চকলেট মুখে দিয়ে বলল, আহ! দারুন। গাজী বলল, আহহা, এখন তো আর ফেরত নিবে না। বলে সে নিজেও আরেক কোনা ভেঙ্গে নিল। সবার মাঝে হো হো হা হা।
চক্ষুচড়কগাছ বলে এক বাগধারা আছে বাংলায়। এর সত্যিকারের মানে আমরা সেইদিন বুঝে ছিলাম। খাইতে বসে সত্যি আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। সত্যিকারের খানাপিনা বলতে যা বোঝায় সবই আছে। এমন কি কক্সবাজারের রূপচান্দা মাছ পর্যন্ত আছে। শুধুমাত্র গরম পানি দিয়ে আপ্যায়ন করলেও আমরা এতটা অবাক হইতাম না।
হাউমাউ বেগে হৈ হুল্লোড়ে খানাপিনা শেষ করলাম। আমাদের কারো বাচ্চা-কাচ্চা না খাকলেও নিজেরাই বাচ্চাকাচ্চার আনন্দ নিয়ে নিজেদের হাংগ্রী এন্ড গ্রীডি স্টোমাক ভরে ফেললাম গলা পর্যন্ত। এতদিন কিপটুস-কিপটুসনিকে যত গালিগালাজ করেছি তার জন্য তৌবা করে ফেললাম মনে মনে ।
আমি ছাড়া আর কেউ নোয়াখাইল্লা ছিল না, সুতরাং খাওয়ার পরপরই বের হবে এমন তাড়া কারো ছিল না। আমি ব্যাচেলর মানুষ, সুতরাং আমার কোন তাড়া থাকা নিষেধ। খাওয়ার পরে জাবর কাটতে কাটতে সন্ধ্যা হয়ে এল। এরপর বউরা আর কেউ দেরী করতে রাজী হল না। সবাই নববিবাহিত দম্পতি। সন্ধ্যার পরে নিজেদেরকে বাইরে রাখা পছন্দ করে না।
বের হতে গিয়ে জগলুর বউ তার শাল খুঁজে পাচ্ছে না। জগুলু সুয়েটার। শরীফের জুতা নাই।
এক এক করে দেখা গেল, কারোই জুতা নাই। শীতের কাপড় নাই।
আবারো হাউকাউ।
কই গেল? কই গেল?
নতুন সুয়েটার।
শালটা আমার মা দিয়েছে।
তিনদিন হলো জুতা কিনেছি।
আমাদের কিপটুস ও কিপটুসনি (নাম বলা নিষেধ, বললে চিনে ফেলবেন) বলল, আমরা এগুলো বিক্রি করে দিয়েছি।
সবাই বলল, যাঃ -
কেউ বিশ্বাস করেনি।
কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি বিক্রি করে দিয়েছে। ওদের গলিতে যে ভাঙ্গারি দোকান আছে তার সাথে আগে থেকে এরেঞ্জমেন্ট করা ছিল। আমরা যখন হাউমাউ করে গিলছি তখন সে এসে সব নিয়ে চলে গেছে। আজকের এই এত বড় খরচের ধাক্কা সামলানোর জন্য কিপটুস দম্পতির আর কোন উপায় ছিল না।
সত্যি বলতে কি, আমার কাছে মনে হইল, এইবার ঠিক আছে, ওদের সাথে এইটাই বরং যায়। এই রকম কিছু একটা না করলে মনে হত ওদের উপর কি জ্বীনের আচর পড়ছে! এখন ষোলকলা পূর্ণ হইছে। জগলু বেচারা, যে বুদ্ধিমান হিসেবে সদ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার উপরে সবাই বিলা। তার কি দরকার পড়েছিল যেচে যেচে এই দাওয়াত নেয়ার।
পুনশ্চঃ আমাদের কিপটুস-কিপটুসনি (ইচ্ছা হয় ওদের নাম সবার কাছে বলে দিই!) সেই ভাঙ্গারিওয়ালাকে বাসায় ডেকে আনে। আর তাকে দশ পার্সেন্ট লাভে জিনিস ফেরত দিতে রাজি করায়। আমাদের রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। শীতের রাতে খালি পায়ে, খালি গায়ে বাসায় ফেরা সম্ভব ছিল না।
সবাই জগলুর নাম দিল জগবুল। জগলু+আবুল=জগবুল।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:০৩

শায়মা বলেছেন: হা হা খুব ভালো হয়েছে। :P

২| ২৩ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:৫২

বিজন রয় বলেছেন: ভালো লেগেছ। আজকাল এরকম গল্প ব্লগে আসে না।

৩| ২৫ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১১:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.