নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যত অপ্রিয়ই হোক, সত্য বলতে আমি দ্বিধা করি না। আমি সদাই সত্যে অবিচল। অন্যের কাছে থেকে কিছু জানা আমার শখ।
প্রশ্ন: ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়?
যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তবু কর্মফলে বিশ্বাস আছে বলিয়াই সে জগতের সকল রকম কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে্ সমাজ ও রাষ্ট্র কর্মফলকে ভিত্তি করিয়াই গঠিত হইয়াছে এবং ‘কর্মফল আছে’ বলিয়াই উহারা টিকিয়া আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে – কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে – কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে, তাহাই পাইবে। এক্ষেত্রে মানুষ কর্ম করিল বটে, কিন্তু ফল রহিল ভগবানের কাছে ভাগ্যলিপিতে নিবদ্ধ। মানুষ জানিল না যে, সে তাহার কাজের ফল পাইবে কি না। কর্মফলের নিশ্চয়তা থাকিলে সন্দিগ্ধ মনেও কাজ করা চলে। যেহেতু তাহাতে মানুষ ভাবিতে পারে যে, হয়ত সে তাহার কাজের ফল পাইতেও পারে। কিন্তু ধর্ম বলে – কর্ম যা কিছুই কর না কেন, ফল নির্ধারিত যাহা আছে, তাহাই পাইবে, একটুও এদিক ওদিক হইবে না। তাহই যদি হয়, অর্থাৎ কর্মের দ্বারা ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত না হয়, তবে কর্ম করিয়া লাভ কি? বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয়, তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন?
মনে করা যাক – কোন এক ব্যক্তির ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে যে, সে ‘নারকী’। এখন সে নির্ধারিত ঐ ফলোৎপাদক কার্য, যথা – চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি করিবে না কি? যদি করে, তবে তাহা সে কাহার ইচ্ছায় করে? নিজের ইচ্ছায়, না ভগবানের ইচ্ছায়? আর যদি সে কোন পাপ-কর্ম না করিয়া পুণ্য কর্মই করে, তবে তাহার ভাগ্যলিপির ‘নারকী’ শব্দটি কাটিয়া, স্বর্গবাসী এই শব্দটি লেখা হইবে কি? যদি না-ই হয়, তবে হেদায়েতের তম্বিটি কি লৌকিক? আর যদি হয়, তবে ভবিষ্যৎজান্তা ভগবান এই পরিবর্তনের সংবাদ পূর্বাহ্নে জানিয়া প্রথমবারেই অকাট্য তালিকা প্রস্তুত করেন নাই কেন?
ভাগ্যলিপি অপরিবর্তনীয় হইলে স্বয়ং ভগবানও উহা মানেন কি না। যদি না মানেন, তবে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন কেন? আর যদি মানেন, তবে তিনি লিপি প্রস্তুতির সময় স্বাধীন হইলেও বর্তমানে স্বাধীন হন কিরূপে? ভগবানের বর্তমান কর্তব্য কি শুধু তালিকা দেখিয়া দেখিয়া জীবকুলকে দিয়ে কার্য করান? তাহাই যদি হয়, তবে বিশ্বস্রষ্টার আশু কর্তব্য কিছুই নাই?
উত্তর:
ভাগ্য বা তকদির সম্পর্কে নানামুখী প্রশ্ন নতুন কোন বিষয় নয়। এটা মুহাম্মদ (দঃ)-এর সময়েও কাফের মুশরিকেরা করেছে। ইসলামের শুরু থেকেই এ প্রশ্ন ছিল এবং আছে। আরজ আলী মাতুব্বর এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। তার পরবর্তীরাও নানা আঙ্গীকে একই প্রশ্ন করেছেন। হাল আমলের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ষ্টিফেন হকিংসও প্রশ্নও একই। ১৯৯০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিগমা ক্লাব সেমিনারে প্রদত্ত ভাষনে তিনি বলেন, নিজেদের কৃত কর্মের জন্য আমরা কি করে দায়ী হতে পারি? একজনের কপালে যদি আগে থেকেই ব্যাংক ডাকাতি লেখা হয়ে থাকে তাহলে তার দোষ কোথায়? সেজন্যে তাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে?
ইসলাম কোনভাবেই একথা বিশ্বাস করতে বলে না যে, আল্লাহ তাকদিরে লিখে রেখেছেন বলেই আমরা পৃথিবীতে সব কাজ করি, বা আল্লাহ তা আমাদেরকে দিয়ে করাচ্ছেন এবং আমরা রোবটের মত তা করে চলেছি।
মহা শক্তিমান মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাকের কাছে অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। তিনি সবকিছুই জানেন। সবকিছুই তারই সৃষ্টি। তিনি মানুষকে স্বাধীন চিন্তাশক্তি দিয়েছেন। এই শক্তি মানুষ তার নির্দেশিত পথে ব্যয় করল কিনা সেটাই তিনি বিবেচনা করবেন। তকদির এবং মানুষের ইচ্ছে-এদুটো এক বিষয় নয়। এদুটোকে গুলিয়ে ফেলার কারনেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের যে কোন কর্ম করার স্বাধীনতা রয়েছে। এগুলো তকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু এগুলোর ফলাফলই তকদির। সবকিছুই তকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে আল্লাহপাক মানুষকে পরীক্ষা করবেন কিভাবে? যেমন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা না আনা, আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা না চলা সম্পূর্ণভাবেই মানুষের ইচ্ছাধীন বিষয়। এখানে তকদির বলে কোন কথা নেই। আল্লাহপাক তো পথ বাতলেই দিয়েছেন। বিশ্বাস বা অবিশ্বাস মানুষের ইচ্ছাধীন। মানুষ ঈমান আনবে কি আনবে না সেটা তকদিরের কোন বিষয় নয়। জান্নাতে যাবে নাকি দোজকে যাবে সেটাও তকদিরের বিষয় নয়। সেটা মানুষের কর্মফলের বিষয়। ভাল মন্দ বোঝার ক্ষমতা আল্লাহপাক মানুষকে দিয়েছেন। কর্মপদ্ধতিও দিয়েছেন। কেবল ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত ব্যাপার হলে আল্লাহ নিশ্চয়ই কর্মপদ্ধতি বাতলে দিতেন না। তার নবী এবং আসমানী কিতাব নাজিলেরও কোন কারণ ছিল না। মানুষকে যে পথের শিক্ষা আল্লাহ দিয়েছেন, সে পথে চলেও সফল হতে না পারলে তাকে তকদিরের লিখন মনে করে ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়েছেন। যেমন, হযরত আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলেন: যে জিনিস তোমার জন্য উপকারি সেটার জন্য আগ্রহ কর এবং সেটার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং হিম্মত হারিয়ো না। আর যদি তোমার কোন ক্ষতি হযে যায় তখন এটা বলো না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তবে এমন হতো, এমন হতো। বরং বলো যে, আল্লাহতায়ালার কদর(ফায়সালা) এমনই ছিল এবং তিনি যেমন চেয়েছেন করেছেন। কেননা, ‘যদি’ শয়তানের কাজ(এর দরজা) খুলে দেয়। [মুসলিম, হাদিস সং ২৬৬৪।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, তাকদির কর্মবিমুখতা শেখায় না, বরং কার্যক্ষেত্রে সৎ ও অটল থাকার শিক্ষা দেয় এবং কাজের পরে হতাশাগ্রস্ত না হবার শিক্ষা দেয়।
এ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে বর্তমান বিশ্বের বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভীর উত্তর:
এ প্রশ্ন নতুন নয়। মনে হয় যুগ যমানা যতোই দীর্ঘ হোক না কেন প্রত্যেক যুগেই এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে। এটা কোন বিষ্ময়কর প্রশ্ন নয়। কেননা, ইসলাম এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিয়েছে।
১. এটা অবধারিত সত্য যে, পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটছে এসব কিছুই ‘রোযে আযলে’ (পূর্বেই) লেখা হয়ে গেছে। এটা এমন ইসলামী বিশ্বাস যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন। আসমান, যমীন, জীবজন্তু, মানুষ, বৃক্ষ, তরুলতা সবই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা এসব কিছু সৃষ্টি করার আগেই এসব কিছু তাঁর জ্ঞানের মধ্যে ছিলো। কাজেই যা কিছু পৃথিবীতে ঘটে সবই আল্লাহর জ্ঞান এবং ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“একটি পাতা কোথাও ঝরে না, যার খবর তিনি জানেন না। মাটির অন্ধকারে একটি শস্যকণাও নেই, নেই কোন তাজা সবুজ (কিংবা ক্ষয়িষ্ণু) শুকানো (কিছু), যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ একটি সুস্পষ্ট গ্রন্থে মজুদ নেই। (আল আনআম, আয়াত ৫৯)।”
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “(সামগ্রিকভবে গোটা) দুনিয়ার ওপর কিংবা (ব্যক্তিগতভাবে) তোমাদের কারও উপর যখনি কোন বিপর্যয় আসে (তখন তোমাদের জানা উচিত যে,) তাকে আবার সংঘটিত করার (বহু) আগেই (তার বিবরণ একটি গ্রন্থে) লিখে রাখা হয়েছে, আর আল্লাহ তায়ালার জন্যে এই কাজটি অত্যন্ত সহজ। (আল হাদীদ, আয়াত ২২)।”
২. বিশ্বজগতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে এসব কিছু সম্পর্কে আল্লাহর জানা থাকা এবং তকদীরে লেখা থাকা মানুষের চেষ্টা সাধনার পরিপন্থি নয়। কারণ যেভাবে মানুষ চেষ্টা করবে, চেষ্টার পরিণাম কি দাঁড়াবে, চেষ্টার উপাদান কি হবে সবই লেখা রয়েছে। সেই চেষ্টা অনুযায়ী ফল পাওয়া যাবে। যদি কারও তকদিরে সফল হওয়া লেখা থাকে তবে সেসব উপাদানও লেখা রয়েছে, যার মাধ্যমে সফলতা পাওয়া যাবে। যেমন পরিশ্রম করা, নিজের বুদ্ধি বিবেক ব্যবহার করা ইত্যাদি। কাজেই চেষ্টা করা তকদিরের পরিপন্থি নয়; বরং এসব কিছুই তকদিরের একটা অংশ। রসুলকে (সা.) একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ওষুধের সাহায্যে কি সেসব অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় যেসব অসুখ তকদিরে লেখা রয়েছে? রসুল (সা.) জবাবে বলেছিলেন, ওষুধ সেবনও তকদিরের লেখার একটি অংশ।
সিরিয়ায় যখন ব্যপক আকারে মহামারীরুপে প্লেগ দেখা দিয়েছিলো। হযরত ওমর (রা.) সাহাবাদের সাথে সেখানে রওয়ানা হয়েছিলেন, কিন্তু এখবর পাওয়ারপর যাত্রা স্থগিত করেন। একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আমীরুল মুমেনীন! আপনি কি আল্লাহর লেখা তকদির থেকে পলায়ন করছেন? তিনি বললেন, হাঁ, আমি আল্লাহর লেখা একটি তকদির থেকে অন্য একটি তকদিরের দিকে পলায়ন করছি। অর্থাৎ, রোগ থেকে দুরে চলে যাওয়াও তকদিরের একটি অংশ।
৩. তকদিরের লেখা আমাদের কাছে গোপন রয়েছে এটাও সত্য। আমরা জানি না আমাদের তকদিরে কি লেখা রয়েছে। তবে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না বরং আমাদেরকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। উপায় উপকরণ কাজে লাগাতে হবে। সকল প্রকার সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব কিছু তো তিনিও করেছিলেন, আল্লাহর প্রতি যার বিশ্বাস ছিল সকলের চেয়ে অধিক। অর্থাৎ, রসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি সেনাবাহিনী তৈরী করেছিলেন, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, বর্ম পরিধান করেছিলেন। হাবশা ও মদিনায় হিজরতের আদেশ দিয়েছিলেন। হিজরতের সময় গুহায় আত্নগোপন করেছিলেন। নিজের পরিবারের লোকদের জন্য এক বছরের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করেছিলেন ইত্যাদি।
৪. তকদিরে লেখা আছে একথা বলে মানূষ যেন অলসতার দিকে ঝুঁকে না পড়ে। তকদিরের প্রতি বিশ্বাসের তাকিদ হচ্ছে, মানুষ প্রথমে কাজ করবে, উপায় উপকরণ গ্রহণ করবে, চেষ্টা সাধনা চালাবে, তারপর পরিণাম ফল আল্লাহর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেবে।
একবার মহানবী (সা.) এর সামনে দু’জন সাহাবী কুস্তি প্রতিযোগিতা করলেন। পরাজিত ব্যক্তি কোন প্রতিদ্বন্দিতা না করেই হেরে গেলো। হেরে গিয়ে বলল, আল্লাহ তায়ালা আমার সাহায্যকারী। রসুল (সা.) একথা শুনে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। প্রথমে পরিশ্রম করে চেষ্টা করো, তারপর পরাজিত হও, তারপর বলবে যে, আল্লাহ তায়ালা আমার সাহায্যকারী (আবু দাউদ)।
৫. তকদিরের প্রতি ঈমানের উপকারিতা হচ্ছে যে, মানুষ সকল প্রকার চেষ্টা পরিশ্রম করার পরও যদি পরাজিত হয়, তখন তার মধ্যে হতাশা দেখা দেয় না। বিপদে যখন পড়ে তখন ধৈর্য হারা হয় না। পরিশ্রম করার পর যা কিছু পায় সেই পাওয়াকে আল্লাহর মর্জি ভেবে সন্তুষ্ট থাকে এবং ধৈর্য ধারণ করে। আল্লাহর শোকর আদায় করে।
তকদিরের প্রতি বিশ্বাস যদি মুসলিম মিল্লাতের অন্তরে জাগ্রত হয়, তবে এমন একটি উম্মত তৈরী হতে পারে, যারা আধ্যাতি্নক দিক দিয়েও হবে শক্তিশালী এবং তাদের মধ্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা করার গুণ বৈশিষ্টও থাকবে বিদ্যমান। সেই উম্মত ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।
( লেখাটি আল কোরআন একাডেমী লন্ডন কর্তৃক প্রকাশিত কারযাভীর বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের বাংলা সংকলন ‘ফতোয়া’ নামক বই থেকে নেয়া)
©somewhere in net ltd.