নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছবিঃ আমার আঁকানো
বিকেলের মাঝামাঝি সময়। সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। গাছের ডালগুলোতে পাখিগুলো দল বেঁধে কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। ভার্সিটির বাসগুলো ও ঘরমুখো ছাত্রছাত্রী, টিচার আর স্টাফদের নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে কিছুক্ষণ আগে। ক্যাফেটেরিয়াতে এখনো কিছু ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ক্যাফেটেরিয়ার উন্মুক্ত জায়গাটাতে এক কোণে চেয়ার নিয়ে বসে আনমনে তাই দেখছেন শিউলি ম্যাম। সাধারণত স্যার ম্যামদের জন্যে ক্যাফেটেরিয়াতে আলাদা জায়গা থাকে বসার। কিন্তু শিউলি ম্যাম কেনো যেন রোজ এই স্টুডেন্টদের বসার জায়গাতেই বসেন। যদিও ছাত্রছাত্রীদের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বসেন তিনি।
আজো তেমনি বসে আছেন। ক্লাস টাইম অফিস টাইম অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও কেনো যেন এতোটা সময় পর্যন্ত এইখানেই বসে থাকেন। যেন কোনো তাড়া নেই। কিন্তু একটু পর পরই ঘড়ি দেখছেন আর বারবার রাস্তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন। যেন কারোর আসার অপেক্ষায় আছেন। এক কোণে দেখলেন এক জোড়া ছেলে মেয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসে একে অপরের দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গল্প করছে। কাপলটাকে দেখে একই সাথে ভালো ও লাগলো আবার বুকের মধ্যে কেমন মোচর দিয়েও উঠলো। আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। যেন এই জগতে নেই তিনি। অন্য কিছু ভাবছেন।
বছর পাঁচেক আগে শিউলি আর আরাফ এইভাবে এই ক্যাফেটেরিয়াতে বসেই তাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়গুলো কাটাতো। তখন তারা এই ভার্সিটি এরই স্টুডেন্টস। আরাফের সাথে শিউলির পরিচয়টা হয় অনেকটা হঠাৎ করেই। কেউ কাউকে সেকেন্ড ইয়ারের আগ পর্যন্তও চিনতো না। একদিন শিউলির স্কুল লাইফের একটা বান্ধবী তাকে ফোন দিয়ে বলে যে তার বাবার অপারেশন। জরুরী রক্ত প্রয়োজন। ভার্সিটির ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ বাঁধনের একটা বড় ভাইয়ের সাথে শিউলির পরিচয় ছিল। সেই বড় ভাইকে কথাটা জানাতেই তিনি আরাফকে কল করে ডেকে নিয়ে আসেন। শিউলির সাথে আরাফের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরাফ তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র। প্রথম দেখাতেই আরাফের শিউলিকে ভাল লেগে যায়। ঠিক কেমন ভাল লাগা সেইটা সে নিজেও বুঝতে পারেনি তখন। মেয়েটার চেহারায় একটা মিষ্টি ভাব ছিল। আর মায়া ছিল। তাই দেখেই হয়তো। শিউলিরও আরাফকে দেখে মনে হোল ছেলেটা অন্যরকম। আলাদা মনে হোল সবার থেকে। শিউলি নিজে আরাফকে নিয়ে তখনি তার বান্ধবীর বাবাকে ব্লাড দিতে নিয়ে গেল হাসপাতালে। শিউলির কথা বার্তা শিশুসুলভ আচরণ আরাফের বেশ ভাল লাগতে থাকে। শিউলিরও আরাফের চলাফেরা, তার ব্যক্তিত্ব দেখে ভাল লাগতে থাকে।
এরপর তাদের বন্ধুত্ব হয় ফেসবুকে। সেখানে তাদের আলাপ আরো বাড়তে থাকে। ক্যাম্পাসে দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে প্রায়ই। ফেসবুকে আলাপ আর ক্যাম্পাসে দেখা করা একটা সময় ওদের নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যায়। যা কিছু হোক দুজনের একসাথে থাকা লাগবেই। নিজেদের সুখ দুঃখ ও একে অপরের সাথে শেয়ার করা, ভাল লাগা খারাপ লাগা শেয়ার করা, পরস্পরকে অনেকটাই জেনে যাওয়ার পর তারা বুঝতে পারে তাদের সম্পর্কটা আসলে শুধু বন্ধুত্বের নয়। এই অনুভুতিটা পরস্পরকে জানানোর পর তারা কেউই নিজেদের মনের কথাটা জানাতে আর দ্বিধা বা দেরী কোনোটাই করেনি। তারপর থেকেই তাদের একসাথে পথ চলা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দেখা করা, ক্যাফেটেরিয়াতে বসে গল্প করা, টঙের দোকানে এক কাপে চা খাওয়া, সারাদিন ফেসবুকে চ্যাটিং, এতসব কিছু তাদের ভালবাসার সুতোটাকে আরো শক্ত করে গিঁট দিতে থাকে। ক্যাম্পাসের সবার চোখ কেড়েছিল এই জোড়াটা। তাই যেমন ছিল তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, তেমনি তাদের দেখে নাক সিটকানো জ্বলুনি মানুষের সংখ্যাও কম ছিলনা। তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করতো ওদের মতো এতো ভাল জুটি আজকাল দেখা যায়না।
আরাফের যে গুণটা শিউলির খুব ভাল লাগতো তা হোল ব্লাড ডোনেট করা। আরাফ নিয়ম করে সময় হলেই রক্ত দিতো। যখনই শুনতো কারোর রক্তের প্রয়োজন নিজের রক্তের গ্রুপ হলে আর রক্ত দেয়ার সময় হয়ে থাকলে নির্দ্বিধায় রক্ত দিতো। যখন নিজের রক্ত দেয়ার উপায় থাকতো না তখন অন্যভাবে রক্তের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করতো। এই জিনিসটা শিউলিকে খুব মুগ্ধ করতো। সেদিন দুপুরের পর ক্লাসে বসে শিউলি আরাফের একটা ম্যাসেজ পায় ফোনে। “খুব জরুরী একজনের রক্তের প্রয়োজন। আমি যাচ্ছি রক্ত দিতে। তুমি ক্লাস শেষ করে ক্যাফেটেরিয়াতে বসো। আমি রক্ত দিয়েই চলে আসবো। তুমি চিন্তা করোনা যেন। ভালবাসি।” আরাফের এমন ম্যাসেজ পেয়ে কেমনটা করে উঠলো শিউলির বুকের মধ্যে। তারপরেও নিজেকে শান্ত রেখে ক্লাস শেষ করে ক্যাফেটেরিয়াতে এসে বসলো। আরাফকে কল করলে আরাফ ফোন রিসিভ করে বললো যে সে কেবল রক্ত দেয়া শুরু করেছে। শিউলিকে অপেক্ষা করতে বলে ফোনটা রেখে দিল।
আরাফ সেদিন রক্ত দিয়েছিল। তবে একবার নয়, দুইবার। একবার সেই মুমূর্ষু রোগীকে, আরেকবার পিচঢালা সেই ধূসর রাস্তাটাকে। রক্ত দিয়ে ফেরার পথে তার রিক্সাকে ধাক্কা দিয়েছিল শহুরে রাস্তার এক বেপরোয়া দানব। সেদিন আরাফ আর রিক্সাওয়ালার দুটি শরীরকে রাস্তায় রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে সেই দানব পালিয়ে গিয়েছিল।
একটি মেয়ে কণ্ঠের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলেন শিউলি ম্যাম। চোখ দুটো ভেজা, তবে জল এখনো গড়ায়নি। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখটা ওড়নার কোনে মুছে নিয়ে তাকিয়ে দেখেন তার ডিসিপ্লিনের প্রিয় ছাত্রী এসে তাকে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যথেষ্ট ভাল ছাত্রী হওয়ায় সেই শিউলি আজ সেই ভার্সিটির সেই ডিসিপ্লিনেরই একজন শিক্ষিকা আজ। চাকরিটা পাওয়ার পর বেশ স্বস্তি অনুভব করেছিলেন শিউলি ম্যাম। যাক, জীবনের সবথেকে সুন্দর স্মৃতিগুলো থেকে তো আর দূরে থাকতে হবেনা অন্তত। প্রিয় ছাত্রীর সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বললেন। ম্যাম অনেক বন্ধুত্বপরায়ণ, তাই প্রিয় ছাত্রীর সাথে অনেকটা বন্ধুর মতোই কথা বলেন।
- ম্যাম, একটা প্রশ্ন করি?
- হ্যাঁ করো।
- রোজ দেখি আপনি ক্যাফেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকেন। তাও টিচারসদের জন্যে যে জায়গাটা রাখা সেইখানে না বসে এইদিকে বসেন। কেন ম্যাম বলা যাবে কি?
- (একটু মুচকি হেসে) কেউ একজন অপেক্ষা করতে বলেছিল আমাকে। যদি সে আসে! তাই অপেক্ষা করি।
মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এমন অদ্ভুত উত্তর শুনে। শিউলি ম্যাম এইটুকু বলেই আনমনে আবার ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকান। ম্যামের চেহারা দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়না মেয়েটা। সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শিউলি ম্যাম তাকিয়ে থাকেন ডুবন্ত সূর্যের দিকে। ওটা পুরোটা অদৃশ্য হলে আজকের মতো তাঁর অপেক্ষার পালা শেষ হবে। কাল আবার অপেক্ষা করবেন একই জায়গায়, একই সময়ে। হয়তো একদিন তাঁর আরাফ সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফিরবে তাঁর কাছে।
সমাপ্ত।
©somewhere in net ltd.