নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শখের গল্প লেখক

মোঃ আরিফুজ্জামান আরিফ

শখের বশে গল্প লিখি

মোঃ আরিফুজ্জামান আরিফ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ মিঠাইপুরের টঙের দোকান

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৪৮


সজোরে একটা ঝাঁকি খেতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোনোমতে সামনের সিট ধরে নিজেকে সামলে নিলাম। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও চোখ মেলে তাকিয়ে মনে পড়লো বাসের সিটে ঘুমিয়ে ছিলাম। বাসের মধ্যে মানুষের হট্টগোল দেখে বুঝতে পারলাম বাসের সাথে কিছু একটার ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু জোরে সংঘর্ষ না হওয়ায় বড়সড় একটা এক্সিডেন্টের থেকে বেঁচে গেছি। সময়মত ব্রেক করে বাস থামিয়ে দিলেও সামনের বাসের সাথে যেটুকু ধাক্কা লেগেছে তাতে বাসের সামনের উইন্ডশিল্ড এবং সাইড মিরর সহ বেশ কিছু জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামনের বাসেরও কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে দুই বাসের চালক আর হেল্পারের মধ্যে এখন তুমুল চেঁচামেচি চলছে। এমনিতেই লোকাল বাস, তার উপর এইসব ভাল না লাগায় ব্যাগপ্যাকটা নিয়ে বাস থেকে নেমে গেলাম। এদের গ্যাঞ্জাম সহজে মিটবে না।

বাস থেকে নেমে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি তেমন কিছুই নেই। হাইওয়ের দুই পাশে বিস্তৃত ক্ষেত আর দূরে ঘন গাছের সারি। ফোন বের করে দেখি নেটওয়ার্কও তেমন নেই। ম্যাপ দেখে কোথায় আছি বুঝার কোনো উপায় নেই। কয়েকজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু তারা কেউ বলতে পারলোনা আমরা কোথায় আছি। হেল্পার আর চালক গ্যাঞ্জামে ব্যস্ত। তাদের কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ নেই। কয়েক গজ সামনে দেখি একটা ছোট চায়ের টং দোকান। এমন জনমানবহীন জায়গায় এমন একটা দোকান দেখে বেশ অবাক হলাম। ভাবলাম ঐ দোকান থেকে একটু চা খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর আরেকটা বাস এলে তাতে উঠে পড়বো। এই ভেবে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার মতো অনেকেই বাস থেকে নেমে গেছে। বাস টুকটাক যা আসছে তাতে একটু একটু করে অনেকেই উঠে গেল। কিন্তু চায়ের দোকানের দিকে আমি ছাড়া আর কেউ এগিয়ে এলো না। একটু অদ্ভুত লাগলো এই ভেবে যে পুরো বাসে আমি ছাড়া আর কারোরই কি চায়ের তেষ্টা পায়নি! যাহোক ভেবে দোকানের ভিতর গিয়ে বসলাম। দোকানটা একটা বেশ বড় বটগাছের নিচে। বটগাছটা দেখে মনে হলো শতবর্ষী। দোকানের জঙ ধরা টিনের চালের উপর গাছের অনেক গুলো ঝুরিমূল এসে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিতরে একজন বেশ বয়স্ক লোক একা দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ পরিষ্কার করছে। পাশে একটা চুলায় কেতলির নল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। দোকানের চালের নিচেই কিছুটা খালি জায়গা আর লম্বা দুইটা বেঞ্চ রাখা আছে। আমি বেঞ্চে বসে চাচাকে বললাম এক কাপ কড়া লিকারের চা দিতে। কিন্তু আমি যে দোকানে ঢুকে বেঞ্চে বসলাম চাচা একবার মাথ তুলে তাকিয়েও দেখলেন না। এমনকি চা দিতে বললেও তাকালেন না, শুধু নিঃশব্দে কেতলির ঢাকনা তুলে তাতে লিকার দিলেন জাল দেয়ার জন্যে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও পাত্তা দিলাম না। মোবাইল বের করে আবার নেট অন করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু নেট পেলাম না। হতাশ হয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাসের যাত্রী যারা ছিল সবাই এক এক করে কয়েকটা বাস থামিয়ে উঠে চলে গেল। কিন্তু দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ একটিবার তাকিয়েও দেখলো না যে এখানে বাস থেকে নেমে কেউ একজন বসে আছে। এমনকি আমাদের বাস যে বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করেছে তারাও নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে ইঞ্জিন চালু করে চলে গেল। কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো হেল্পার বা কেউ একটিবার তাকিয়েও দেখলোনা। এখানে যে একটা দোকান আছে আর বাসের একজন যাত্রী এসে বসেছে তা যেন কারোর দেখারই বিষয় না।

যাহোক, আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বসে থাকলাম। ইচ্ছা চা খেয়ে একটু কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর একটা বাস থামিয়ে তাতে উঠে যাবো। চাচার দিকে তাকালাম আবার। চাচা নিজের মনে চুপচাপ মাথা নিচু করে চা বানিয়ে চলেছেন। দোকানে এই মুহূর্তে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। এই হাইওয়েতে যেখানে আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই সেখানে যখন তখন কেউ এসে চা খাবে এমনটা আশাও করিনি। ভাবলাম চাচাকে জিজ্ঞাসা করি এইটা কোন জায়গা। তাই চাচাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “চাচা, এই জায়গার নাম কি?” কিন্তু উনি আমার কথা কিছু শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না। চুপ করে কেতলি থেকে কাপে চা ঢালছেন। আবার একবার জোরে জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু এবারো কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। ভাবলাম উনি বোধহয় কানে শুনেন না, অথবা কথাও বলতে পারেন না। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে চায়ের অর্ডার দিলে শুনলেন কিভাবে? হয়তো উনার দোকানে ঢুকে যে কেউ চা খেতেই বসবে এমন ভাবনা থেকে চা বানাতে শুরু করেছেন। নিজেকেই উত্তর দিলাম। এসব ভেবে বাইরে রাস্তার দিকে নজর দিলাম। আমাদের বাসটা চলে যাওয়ার পর প্রায় দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাস্তা দিয়ে কিছুই যেতে দেখলাম না আর। কলেজ লাইফের এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে তাদের গ্রামে যাচ্ছিলাম আমি। তার নাম রিমন। রিমন গ্রাম থেকে মাধ্যমিক পাশ করে আমাদের শহরে এসে আমার সাথে এক কলেজে পড়েছে। সেখানেই তার সাথে পরিচয় বন্ধুত্ব। কলেজের পর আলাদা ভার্সিটি এবং ভার্সিটির পরে আলাদা শহরে থেকে জব করলেও যোগাযোগের কখনো ঘাটতি পড়েনি আমাদের। মাঝে মধ্যে ছুটিতে শহরে দেখা হলেও ওদের গ্রামে কখনো যাইনি আমি। রিমনের বিয়ের তারিখ ফিক্সড হলে এবার সে নাছোড়বান্দা আমাকে গিয়ে তার গ্রামের বড়িতে তিন দিন থাকতেই হবে। এদিকে অনেকদিন কোনো গ্রাম দেখা হয়না। তাই ভেবেচিন্তে শুক্র-শনিবারের সাথে মিলিয়ে জমে থাকা ছুটি থেকে আরো দুইদিন ছুটি নিয়ে রওনা দেই ওদের গ্রামের দিকে। কিন্তু মাঝপথে যে এরকম একটা এক্সিডেন্ট হবে তা কে জানতো! তারপরেও ওদের গ্রামে সবসময় লোকাল বাস আসা যাওয়া করতে থাকে এই ভেবেই চায়ের দোকানে বিশ্রাম নিতে বসা।

“এই লও চা!” হঠাৎ করে একদম মুখের কাছে ফ্যাসফ্যাসে গলায় শব্দ শুনে ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। রাস্তা থেকে ঝট করে চোখ ফিরিয়ে দেখি পাশেই দোকানের চাচা চায়ের কাপ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত এভাবে কেউ কাছে এসে কথা বলে? আবারতো দেখি কথাও বলতে পারে। তাহলে চুপ করে ছিল কেন এভাবে? মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না। চায়ের কাপ উনার হাত থেকে নিয়ে গরম গরম চুমুক দিলাম। এক চুমুক দিয়েই মনে হলো এর থেকে সুন্দর চা আমি এর আগে কখনো খাইনি। যেভাবে বলেছিলাম সেরকমই কড়া লিকাড় দেয়া, আর স্বাদটা এক কথায় অসাধারণ। চায়ের এক চুমুকেই চাচা মিয়ার উপর থেকে সমস্ত বিরক্তি ভাবটা কোথায় উড়ে চলে গেল! সেইসাথে বাসের গ্যাঞ্জামের জন্যে ভাঙা কাঁচা ঘুমের রেশটাও উবে গেল। চাচাকে ডাক দিয়ে জোরেই বললাম, “চাচা, চা টা তো একদম ফার্স্ট ক্লাস। এরকম চা তো আমি সত্যিই কোথাও খাইনি।” কিন্তু কথাটা মনে হলো না চাচা মিয়া কানে শুনলেন একটুও। মনে মনে আরেকবার বিরক্ত হলেও এই ফার্স্ট ক্লাস চায়ের জন্যে উনার এই ভাবটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেলাম।
খুব আস্তে আস্তে চা খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এখনো রাস্তা দিয়ে কিছুই যেতে দেখলাম না। আমাদের বাসটাকেই শেষ যেতে দেখেছিলাম প্রায় বিশ মিনিট আগে। এতো লম্বা সময়ের গ্যাপে রাস্তা দিয়ে কিছুই যাবেনা ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক লাগলোনা। এদিকে বিকেল প্রায় পার হয়ে এসেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে সূর্য ডুবে যাবে। এখানে এভাবে রাত করাটা ঠিক হবেনা। চা টা শেষ করে চাচা মিয়াকে বিল দিতে গেলাম। হাত বাড়ালাম উনাকে টাকাটা দিবো বলে কিন্তু উনি ফিরেও চাইলেন না। কি আজিব! এই লোক এমন কেন?! বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললাম। “চাচা টাকাটা নেন!” একটু রাগ হয়েই বললাম। কিন্তু উনি মাথা নিচু করে নিজের মনে মনে কাজ করেই যাচ্ছেন। শেষে টাকাটা উনার সামনে রেখে দিয়ে আমি দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন কিছু এলোনা তখন ভাবলাম হেঁটে এগিয়ে যাওয়া দরকার। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ হবেনা। একটু হাঁটতে থাকলে তো লোকালয়ে পৌঁছুবো। তারপর কিছু একটাতে করে উঠে যাওয়া যাবে। এদিকে সূর্যও ঢলে পড়েছে দিগন্তে। এই যখন ভাবছি তখন পিছন থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় চাচা বলে উঠলেন, “আশেপাশে কয়েক কিলোর মধ্যে কিছুই পাইবানা। কোনো মানুষজন আশেপাশে থাকেনা।” চাচার কথায় একটু অবাক হলাম। আমি যে হেঁটে যেতে চাইছি সেইটা উনি বুঝলেন কিভাবে? আবার দোকানের মধ্যে এগিয়ে উনার সামনে দাঁড়ালাম। “আমি যে হেঁটে আগাবো সেটা আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

“এতক্ষণ খাড়ায়া থাইকা কিছু না পাইলে যে হাইটা আগানোর কথা ভাববা এইটা তো বুঝাই যায়।” চাচা এতক্ষণে একটা বড় বাক্য বললেন। “সন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে। আজকে রাইতে এইখানে কিছু পাইবা না আর যাওনের লাইগ্যা।”

অবাক হলাম। এতোবড় একটা হাইওয়েতে বিকেল থেকে পুরো রাত কিছুই পাবোনা এটা কিভাবে সম্ভব? জিজ্ঞাসা করলাম, “এতোবড় রাস্তায় সারা রাত কিছুই যাবেনা এইটা হয় নাকি? আপনি জানেন কিভাবে?”

“এত্তোদিন এইখানে আছি আমি। আমি জানবো না তো কেডায় জানবে আর?” কথাটা বলেই চাচা হেহে করে হেসে দিলেন। কিন্তু উনার এই হাসিটা আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগলো। সত্যিই যদি অনেকদূর লোকালয় না থাকে তাহলে হেঁটে এগিয়ে যাওয়াটা বোকামি হবে। কি করা যায়! সারারাত রাস্তা দিয়ে কিছু যায় কিনা সেইটা দেখতে হবে তাহলে?

“তুমি একটা কাজ করো বাপ। এই রাতটা এইখানে আমার দোকানেই থাইকা যাও।” চাচা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন আমাকে। অবাক হলাম সাথে বিরক্তও হলাম। বললাম, “আপনি পাগল? সারারাত এই দোকানে কিভাবে থাকবো? আমি আমার বন্ধুকে ফোন দিচ্ছি। দেখি সে গাড়ির ব্যবস্থা করে পাঠাতে পারে কিনা।” বলে মোবাইলটা বের করে কল দিতে গিয়ে দেখি কল যাচ্ছেনা। একফোঁটাও নেটওয়ার্ক নেই। এইবার সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। রাস্তায় গাড়ি নেই, ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, আশেপাশে জনবসতি নেই। এমন বিপদেও মানুষ পড়ে নাকি? কোন দুঃখে যে চায়ের লোভে এই দোকানে এসে বসলাম! তখনি অন্যদের সাথে অন্য বাসে উঠে বসা উচিত ছিল। আরো আধা ঘন্টা রাস্তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু সত্যিই কোনো বাস বা গাড়ি এলোনা এই রাস্তায়। শেষে পায়ে ব্যথা শুরু হলে দোকানের বেঞ্চে ধপ করে বসে পড়লাম। দোকানের মাঝখানে তখন একটা টিমটিমে হ্যারিকেন বাতি জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন চাচা। এই আলোতে দোকানের পরিবেশটা কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে। বিকেল থেকে দোকানে আমি ছাড়া আর কোনো কাস্টমার আসেনি, কিন্তু দোকানের চুলা সবসময়েই জ্বলতে থাকছে আর তার উপর কেতলির নল থেকে ধোঁয়া বের হতেই থাকছে। আমি মাথা নিচু করে একটানা চেষ্টা করছি বাড়িতে আর রিমনকে কল দিতে, কিন্তু কোনোভাবেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছিনা। আর একটু পর পর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি যদি কোনো গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়। হঠাৎ করেই নাকে খুব সুন্দর চায়ের লিকারের সুঘ্রাণ ভেসে এলো। চাচা আরেক কাপ চা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “লও বাবা। চা ডা খাও। মন মেজাজ ভাল লাগবে।” চায়ের অস্বাভাবিক সুন্দর ঘ্রাণের জন্যেই কিনা জানিনা আমি চুপচাপ চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। এক চুমুক দিতেই সত্যিই কেমন ভাল লাগা কাজ করলো। দ্বিতীয় বার একই মানুষের হাতে বানানো একই রকম চা খেয়েও আমার মনে হচ্ছে আমি এতো ভাল চা এর আগে আর একবারও খাইনি। আয়েশ করে বসে বসে আমি চা খেতে লাগলাম। চাচা মিয়া তখন বললেন, “তুমি এইখানেই থাইকা যাও বাবা। এই জায়গাটা অনেক নিরাপদ। তোমার কিচ্ছু হইবোনা দেইখো।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কি এই দোকানেই থাকেন? বাড়ি ঘরে যান না? আর এই এলাকার নাম কি?”

“নারে বাবা! এই দোকানটাই আমার বাড়িঘর। এই দোকানটাই আমার সব।” চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “এই জায়গাডার নাম মিঠাইপুর।”

“কি বলেন!” আমার অবাক প্রশ্ন। “একা একা এরকম হাইওয়ের পাশে দোকানে কিভাবে থাকেন? আপনার সাথে কেউ থাকে? আর কেউ আসবে না? চাচী বা আপনার ছেলেমেয়ে কেউ?”

“হেহে!” একটা হাসি ছেড়ে বললেন চাচা। “কেউ নাই আমার বাপ। আমি ছাড়া আর কেউ থাকেও না। তবে একটা দুঃখ ছিল আমার এতোদিন।”

“কি দুঃখ?” আমার অবাক প্রশ্ন।

“এই দোকানে আমি অনেকদিন ধরে একলা একলা চা বানাই। মাইনষেরে চা খাওয়াইতে আমি বড্ড ভালবাসি গো বাপ। কিন্তু আমার চা খাইতে কেউ আসেনা। কত্তো গাড়ি এই পথ দিয়া যায়! আমি পথ চাইয়া বসে থাকি, কিন্তু কেউ আমার দোকানের দিকে ফিরায়ও দেখেনা। আমার বড়ই আফসোস লাগে। এই চুলাডাও কত্তোদিন ধইরা একটানা জ্বলতাছে। কিন্তু এই কেতলির চা কাওরে খাওয়াইতে পারিনা। এই জায়গায় কেউ গাড়ি দাঁড়াও করায়না। আমারে আর এই দোকানডা দেখলে তো দাঁড়াইব! কেউ দাঁড়ায় না।” চাচা নিচের দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে কথা গুলো বলতে থাক। আর এইদিকে আমি প্রচণ্ড আতঙ্কে ঘামতে থাকি। কিন্তু কেন জানি আমি উঠতে পারছিনা বেঞ্চ থেকে। চাচা আবার বলা শুরু করলেন, “আইজ, বহুত বৎসর পর তোমারে দেইখাই আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি কিরকম চায়ের পোকা। তাই আজ দুর্ঘটনার জইন্য তুমি বাস থাইকা নামলেই আমি তোমারে দেইখেই বুঝতে পারি আমার এত্তোদিনের অপেক্ষা আইজ শেষ হইবো। তোমারে দেইখ্যাই আমি যেই বুঝতে পারছি চা খাওন তোমার কিরম নেশা, তখনই তোমার চোখে আমার দোকানডা দেখাইলাম। নাইলে তো এত্তো গাড়ি এই পথে যায় সবাই শুধু এই বটগাছডাই দেখে। আইজ তুমি আইছো এই দোকানে, তোমারে আমি চিরডাকাল শুধু চা খাওয়ামু। তুমি দেইখো বাপ, আমার চা তোমার পত্তেকবারই অমৃত লাগবো একদম।”

আমার কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেল কেন আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না বিকেলে। এই দোকানটাকে যেমন কেউ দেখতে পায়না, তেমনি এর মধ্যে ঢোকার পরে আমাকেও আর কেউ দেখতে পায়নি। সবার কাছে দোকানের সাথে সাথে আমিও অদৃশ্য হয়ে গেছি। আমার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু আমার পা একদম যেন জমে গেছে। হঠাৎ রাস্তায় অনেক দূরে একজোড়া আলো দেখতে পেলাম। সাথে সাথে কোত্থেকে যেন আমার পায়ে জোর ফিরে এলো। হয়তো নিজেকে রক্ষার তাগিদেই জোর ফিরে পেলাম। ব্যাগ নিয়ে দ্রুত উঠে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। লাইট জোড়া কাছে আসতেই জোড়ে চেঁচিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে থামতে বললাম। একটি বাস। কিন্তু বাসের গতি কমছেনা। সাইডও করছেনা। সামনে দিয়ে সাঁই করে ছুটে যাওয়ার সময় দেখলাম বাসের দরজার হেল্পার বা চালক কেউ আমাকে দেখছে না। এমনকি বাসের জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকা যাত্রীদেরও কেউ আমাকে যেন দেখতেই পাচ্ছেনা। আস্ত একটা মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে কেউ যেন সেইটা দেখেইনি। কি করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কয়েক সেকেন্ড পর আরো গাড়ি আসতে দেখলাম। আমি গলার সব জোড় দিয়ে চিৎকার করে হাত নাড়ছি। কিন্তু ড্রাইভার যেন আমাকে দেখতেই পেলনা। এভাবে এক এক করে আরো কয়েকটা বাস আর গাড়ি গেল। কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পেলনা আর গাড়িও থামালো না। এরপর আমি চিন্তা করলাম যাই হোক না কেন আমাকে এই দোকান থেকে দূরে যেতে হবে। এই দোকানের কাছে যতক্ষণ আমি থাকবো আমাকে কেউ দেখতে পাবেনা। শুধু মাত্র এই বটগাছটাই দেখতে পাবে। যতো দূরেই লোকালয় হোক না কেন আমাকে দৌড় দিতেই হবে। এই ভেবে আমি যেই পা বাড়াতে যাবো তখনি নাকে এলো চায়ের সুঘ্রাণ। এমন ঘ্রাণ আমি এর আগে কখনো পাইনি। আমি সম্মোহিতের মতো চায়ের দোকানের মধ্যে গিয়ে বেঞ্চে বসে পড়লাম। চাচা মিয়া আমার হাতে এক কাপ চা দিয়ে বললেন, “এই লও বাপ, চা খাও!” আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। সত্যি বলছি এমন সুস্বাদু চা আমি জীবনে একবারো খাইনি।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:০৫

মায়াস্পর্শ বলেছেন: সমাপ্ত লিখেছেন, কিন্তু সমাপ্ত হয়নি।

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৪৫

মোঃ আরিফুজ্জামান আরিফ বলেছেন: এটা একটা অমীমাংসিত গল্প। হয়তো গল্পের চরিত্রটি চিরকালের জন্যেই ঐখানে আঁটকে গিয়েছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.