নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

(গল্প) পাখির অটোবায়োগ্রাফি

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৭





।। জসীম অসীম ।।



জল তো জলীয়বাষ্প হয়। কিন্তু পাখিরা কি জলীয়বাষ্প হয়? কিংবা কোনো মানুষ? মানুষ কি মেঘ হতে পারে? হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর নিয়তই বহন করে বিশ্বপ্রকৃতি। কিন্তু আমি তা জানি না। ুধা মানুষকে খুন করতে পারে, সে আমরা জানি। নারীকে তো কেউ কেউ খুনিই বলেন। কিন্তু কখনো কি শোনা যায় একগুচ্ছ গোলাপ খুন করেছে কোনো যুবতীকে? অথবা পানকৌড়ি, বুনোহাঁস, ধনেশ, মাছরাঙা পাখি?

পান্থ আর পিয়াসু এক নদীকূল এলাকার দুইজন মানুষ। ঝড়ের রাতে, বৃষ্টিবাদলার দিনে ওদের প্রায়ই একইসঙ্গে কেটেছে ওদের শৈশব। অবিচ্ছেদ্য এই দুইজনের আজ বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বসবাস। কিন্তু এর কারণ কী পাখি? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো গাঙশালিকেরা জানে, নীলকন্ঠ জানে, এবং জানে চকোর…মুনিয়া। কিন্তু আমি জানি না।

বৈশাখ মাসের দুপুর। আনন্দপুর গ্রামের দিকে মাটির যে দীর্ঘ পথটা গিয়েছে, সে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পান্থ। এ হাঁটার পথ নদীর মতোই আঁকাবাঁকা । সড়কপথ থেকে পান্থদের আনন্দপুর গ্রামটা খুব দূরে নেই। তাই এটুকু পথ হেঁটেই চলে যায় অনেকে।

আকাশ থেকে রোদ নয়-ঠিক যেন আগুনই ঝরছে। পথের পাশে রয়েছে কোথাও কোথাও ছায়াদার বৃ। কোনো কোনো বৃরে নিচে গ্রামের কৃষকরা কাজ ফেলে নানা গল্পে ব্যস্ত। আনন্দপুর গ্রামেই পান্থের জন্ম হয়েছিল। এখন সে ঢাকা শহরে থাকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে। শৈশবটা তার গ্রামে কেটেছে বলে গ্রামকে সে আজও ভুলতে পারে না।

আনন্দপুর গ্রামটা এখন আর আগের মতো নেই। সারাটা গ্রাম ছিল একদা বাঁশঝাড়ে আচ্ছন্ন। বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ…। আর এখন? যেন চাঁদ বাগানের মাথার উপর বাঁশ…। আহারে এত শত হিজল-পিয়াল আনন্দপুর গ্রামটা থেকে কোথায় গেল এখন? এখন কি আর এই গ্রামে পূর্ণিমায় চাঁদ নামে?

পান্থের হাতে ছাতা নেই। মাথায় দমকা রোদ। আরেকটু হেঁটে পথের পাশের ছায়াদার জামগাছটির নিচে দাঁড়ায় পান্থ। এখানে এই ভরদুপুরেও আড্ডা বসেছে। কতো গল্প। পান্থ বসে পড়ে। এমনি সময় জামগাছের পাশেই ‘ধপাস’ করে একটি যুবক পড়ে যায়-গাছের ঠিক মগডাল থেকেই। সবাই হৈচৈ করে উঠে। একজন বলে-হায় হায়রে পিয়াসুটা শেষ। পানি আন, ওসমান ডাক্তারের বাড়ি নিয়ে চল…। পান্থ বলে-কোন পিয়াসু সে? পান্থের কথার জবাব দেয় না কেউ…।

আনন্দপুর গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে বাঁধন নদী। সেই বাঁধন নদীর ওপার থেকে এক বুড়ি আসতেন পাড়ায় পাড়ায় পানসুপারি বিক্রি করতে। বুড়ির সঙ্গে আসতো বুড়ির ছোট্ট নাতি-পিয়াসু। এ কি সেই পিয়াসু? পান্থের নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন। সবাই সেই পিয়াসুকে ‘বুড়ির লাঠি’ বলতো।

পান্থদের বাড়িতে বুড়ি এলেই এই কিছুণের জন্যই পান্থ-পিয়াসু’র খেলা জমে উঠতো। দাদীর সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে নানা গল্প শুনে শৈশবেই পিয়াসু হয়ে উঠেছিল এক মহাগল্পরাজ। পিয়াসু গল্প বলতো আর তা মুগ্ধ হয়ে শুনত শুধু পান্থ। এভাবে যে কতো দিন তাদের কেটেছে।

পিয়াসুর বাবা-মা কেউ বেঁচে ছিল না। পরে তার বুড়ীদাদীও মারা যায়। এতিম পিয়াসুকে পাঠিয়ে দেয়া হয় তার মামার বাড়িতে। কিন্তু মামীদের অত্যাচারে সে সেখানে থাকতে পারেনি। মামীরা তাকে দিয়ে যত কাজ করাতেন-তত খাবার দিত না। অবুঝ পিয়াসুর মন এতে ভীষণ ভীষণতর খারাপ হয়ে যেত।

পান্থ আর পিয়াসু শৈশবে বাঁধন নদীর তীরে কাশফুল দেখতে যেত। কাশফুল দেখতে গিয়ে খুঁজে পেত পাখি। হরেক রকম পাখি। তাদের মধ্যে পানকৌড়ি-গাঙশালিক-সারস-কালীবক-কোচবকই ছিল বেশি। ছিল এক বাঁশিওয়ালাও। সারাদিন বাঁশি বিক্রি করে দিনশেষে নদীর পার ধরে বাঁশি বাজাতে বাজাতে তার নিজের বাড়িতে চলে যেত। একটু বড় হয়ে পান্থ তার মাকে বলেছিল-নদীটাতো দু-পাশের মানুষকে ভাগ করে রেখেছে। তবে এ নদীর নাম ‘বাঁধন’ নদী হলো কিভাবে? পান্থ-র মা বলেছিলেন নদীটা আসলে জল দিয়ে ভালাবাসা দিয়ে দু’পাশের মানুষকেই বেঁধেই রেখেছে। ‘বাঁধন’ নদীর ঐ যে খেয়া নৌকার মাঝি-সে তো দু’পাশের মানুষকে সারাদিন এপার-ওপার করে মিলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে।

পান্থ ছোটবেলায় ভাবতো একদিন সে বাঁশিওয়ালাই হবে। এই ভেবে শৈশবে কিনেছিল কত বাঁশি। সেই বাঁশি সবসময়ই সঙ্গে থাকতো তার। স্কুলে যাওয়ার সময়ও সঙ্গে-আসার সময়ও সঙ্গে। খাওয়ার সময়-ঘুমানোর সময়ও বাঁশি থাকতো সঙ্গী হয়ে। কিন্তু পরে কোথায় গেল বাঁশি আর কোথায় গেল বাঁশির সেই স্বপ্ন…তা সে নিজেই জানে না।

পিয়াসু-র দাদীর মৃত্যুর পর পিয়াসু যখন তার মামার বাড়িতে থাকতে গিয়েছিল-তখন বুঝলো এই পৃথিবী কতো কঠিন। মামীদের আচরণে মামার বাড়িকে তার ‘চামার বাড়ি’ মনে হতো। মামীরা ভাবতেন এ ছেলের দায়িত্ব নেবে কে? যেখানে কী না তাদের নিজেদের ছেলেদের দিকেই তাকানোর তেমন সময় নেই। তাও যদি ছেলেটা একটু কাজে মনোযোগী হতো। আর মামারা নানা কারণে মামীদের খুব ভয়ই করতেন। নানী থাকলে পিয়াসু-র একটা ব্যবস্থা হতোই। কিন্তু পিয়াসুর ভাগ্যখানা সবদিক দিয়েই সত্যিই খারাপ ছিল।

দাদীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলা থেকেই আনন্দপুর গ্রামটা পিয়াসুর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো এ গ্রামটা ছেড়ে সে কোথাও থাকতে পারেনি। একবার কাজ নিয়েছিল কোম্পানীগঞ্জের এক মিষ্টি দোকানে। কিন্তু মিষ্টি দোকানের কাজ তার ভালো লাগেনি। আবার ফিরে এসেছিল আনন্দপুর গ্রামে। কিন্তু বাঁচবে-খাবে কী করে? আগে কেউ কেউ একটু দয়া করে খেতে দিতো-পরে সবাই অভিযোগ করলো-ছেলেটার তো কাজেই মনোযোগ নেই।

কাজে কেন মনোযোগ নেই পিয়াসুর? অনেকে বললেন-পিয়াসু তোর দাদীর ব্যবসাটা ধর। টাকা কিছু লাগলে আমরা দেব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানসুপারি বিক্রি করতে ভালো না লাগলে জামতলায় একটি ছোট্টখাট্ট দোকান করে দেব। পিয়াসু তাতেও মন দেয় না। কিন্তু পেট চলবে কী করে তার? কিছুদিন বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন ঘুরেছে বাঁশি বিক্রি করবে বলে। বাঁশিওয়ালা বলে, বাঁশি বাজায় পাগলে। পাগল না হলে কেউ বাঁশি বাজায় না-বাঁশি বিক্রি করে না। আমি তো এক পাগল। তাছাড়া বাঁশি বিক্রি করার প্রথম শর্ত বাঁশি বাজাতে শেখা। বাঁশি বাজাতে শিখতে হলে তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।

বাঁশির নেশায় কিছুদিন পিয়াসু বাঁশিওয়ালার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। এই গ্রাম-সেই গ্রাম-এই গঞ্জে-সেই গঞ্জে করে কতো গ্রামে কতো গঞ্জে যে যায়। কিন্তু আবারও সে ফিরে আসে তার আনন্দপুর গ্রামে। যেন সব আনন্দ তার এই আনন্দপুর গ্রামেই।

পিয়াসু জানতে চেয়েছিল-বাঁশিওয়ালা কেন বাঁশিওয়ালা হলো-অন্য কিছু না হয়ে। বাঁশিওয়ালা বলেছিলো-ছোটবেলায় তার বাঁশির খুব নেশা ছিল। কিন্তু তার বাবার হাতে পয়সা ছিল না। তাই সে পৌষের মেলা থেকে বাঁশি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে অনেক মার খেয়েছিল মানুষের। তারপর ভেবেছিলো, বাঁশির জন্য যেহেতু এত অপমান-সেহেতু বাঁশির জন্যই জীবন উৎসর্গ করবে। বাঁশি বাজানো-বাঁশি বানানো এবং বাঁশি বিক্রির সেই হলো পেছনের এক গল্প। কিন্তু পিয়াসুর জীবনে তো এমন কিছু ঘটেনি। তবে কেন সে বাঁশিওয়ালা হবে?

বাঁশিওয়ালার আসল নাম সবুজ মিয়া। কিন্তু ও নাম এখন ‘বাঁশিওয়ালা’ নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ছোট্ট একটি সংসারও আছে তার। সংসারে আছে ছোট্ট এক কন্যা সন্তান-বাঁশির নামেই নাম রেখেছে তার। বাঁশিওয়ালা গানও রচনা করে। কখনো কখনো। সেই গানের সুর সৃষ্টি করে বাঁশিতে ঢেউ তোলে। ‘বাঁধন নদী প্রাণ দিয়েছে আমার জীবনকে…’ ‘বাঁশিওয়ালা’র এ সুর পিয়াসুর খুবই প্রিয়।

বাঁচার জন্য কী করবে পিয়াসু-সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাঁশি বাজাতে হলে-বাঁশি বিক্রি করতে হলে বাঁশিওয়ালার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কারো অধীনে কাজ করতে ইচ্ছে হয় না পিয়াসুর। নিজের মতো কাজ করবে। নিজের মতো স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু কী কাজ করবে? করবেটা কী? তা খুঁজে বের করতে পারে না।

পিয়াসু কোনো লেখাপড়াই করেনি। অথচ স্বাধীনতা চায়-সব স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার সন্ধানে সব আজব আজব চিন্তা কাজ করে তার মাথায়। ধানকাটা হয়ে গেলে ধানের জমিতে থাকা ইদুরের গর্ত থেকে ধান বের করে করে একবার অনেক ধান জমা পরে পিয়াসু। সেই ধান বিক্রি করে কিছুদিন ভালোই কেটেছে। কিন্তু সে আর কতোদিন! তাছাড়া এ কাজে সাপের ভয়ও আছে। প্রচন্ড গরমে একবার মানুষের প্রাণ যায় যায় অবস্থা-সে সময়ে পিয়াসু কিছুদিন একটি ছোট্ট বাক্সে করে অল্প কিছু আইসক্রীম নিয়ে আনন্দপুর গ্রামে বিক্রি শুরু করে। মোটামুটি লাভ হয়েছিল। কিন্তু যেই অনাবৃষ্টির অবস্থা কেটে গেল, সেই তার বিক্রি গেল খুব কমে। পেটের ুধায় পিয়াসু তখন হিংস্র হয়ে গেল। মনে হল তার দেশটা যদি মরুভূমি হয়ে যেত-তাহলে সারাদিন ‘আইসক্রীম আইসক্রীম’ করে চিৎকার করলে অনেক লাভ হতো। অথচ যখন বর্ষা এলো-জলস্ফীতি দেখা দিলো বাঁধন নদীতে-তখন আর আইসক্রীম খায় কে?

পিয়াসু কেন অন্যের কাজ করতে পারে না-তা সে নিজেও জানে না। শুধু জানে অন্যের কাজ করতে তার ভালো লাগে না। নিজের কাজও কিছু নেই যে করবে। এই কারণে তার অনেক অভাব। কিছুদিন এ-ঘর ও-ঘর পান্তাভাত ভিে করে খেয়েছে। বেশি অভাবে ‘খুদের জাউ’ করে খেয়েছে-কলাগাছের লাবড়া খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে।

পিয়াসুর মা মারা যায় তার জন্মের কিছুদিন পরই। অসুখে। আর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায়। যদি তার কাজে মনোযোগ থাকতো তবে আজ তার এ অবস্থা কি হয়? মাথায় তার যত অদ্ভুত চিন্তা। অদ্ভুত হলেও হতো-অদ্ভুতচিন্তাগুলোও স্থির নয়। আজ যদি ভাবে রুটি বিক্রি করবে-রুটিওয়ালা হবে, আগামীকাল সেই ভাবনা বদলে যায়। ভাবে-রাশি রাশি কাকতাড়–য়া বানিয়ে বানিয়ে গ্রামের কৃষকদের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু কোন কৃষক কিনবে এ পাগলের কাছ থেকে কাকতাড়–য়া?

খুব বেশি কষ্টেই পিয়াসুর ছেলেবেলাটা কেটেছে। তারপরও তার দাদী ছিল। এখন সে শুধুই একা মানুষ। দাদীর মৃত্যুর পর যখন বয়স কিছুটা বাড়লো-তখন তার এক দূর সম্পর্কের কাকা তাকে কিছুদিনের জন্য গরুছাগল লালনপালনের কাজ দিয়েছিল। করেছিলও কাজটা কিছুদিন। পরে তার মনে হলো এমন সুন্দর জীবনটা শুধু গরু আর ছাগলের পেছনে ব্যয় করার কোন মানে হয় না। পিয়াসুর কাছে মনে হলো গরুছাগলতো প্রায় সবাই লালনপালন করে-বরং জঙ্গল থেকে শিয়ালের বাচ্চা ধরে ু পোষতে পারলে কাজে দেবে। কিন্তু শেয়ালের বাচ্চা তো আর একা ধরা সম্ভব নয়। আর এ কাজে তার শরীক হবে কে?

সর্বশেষ পিয়াসুর নজর পড়ে পাখির দিকে। পাখপাখালি আগে তার অনেক প্রিয় ছিল। কিন্তু পরে মনে হলো-এগুলো ধরে তো বিক্রি করা যায়। প্রথমে নজর পড়ে যাযাবর পাখিদের দিকে। কিন্তু কোনোভাবেই সেই পাখি ধরতে পারে না সে। বাঁধন নদীর দণিপাড়ের কাছে বিরাট এক জলাশয় রয়েছে। ওখানে সারাবছরই জল থাকে। শুকনো মৌশুমেও। ওখানে আছে অনেক সারস-কালীবক-কোঁচবক। মাথার উপর বাজপাখি। পানকৌড়ি-বুনোহাঁসও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায়। মাছরাঙারতো অভাবই নেই। এলাকায় এ জলাশয়ের নাম তিতির জলা। পিয়াসু একদিন অর্ধেক মাছ দেবে বলে আনন্দপুরের রেখাদিদির কাছ থেকে তাদের কুনোজালটা নিয়ে তিতির জলায় যায়। মাছ কিছু পায়ও প্রথম। কিছু চুনোপুঁটি-একটি সরপুটি-একটি পাবদা-একটি টাকি আর কিছু চিংড়ী মাছ। এমন সময় পিয়াসু দেখতে পায় দুটি সারস কী নিয়ে যেন ভীষণ ঝগড়ারত। দৌড়ে গিয়ে ওদের উপর জাল ফেলে পিয়াসু। সঙ্গে সঙ্গেই সারস দুটি জালের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। মাছ আর সারস পাখি দুটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে পিয়াসু। রেখাদি’কে পুরো মাছ দিয়ে সারস দুটিকে নিয়ে বাজারে যায় পিয়াসু। ভালো দামে সারসদুটিকে বিক্রি করে সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফিরে। পাখি হত্যার এ প্রথম রাতেই পিয়াসু এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখে পিয়াসুর সবগুলো আঙ্গুল বঁড়শি হয়ে আছে। কেন দেখলো সে এমন স্বপ্ন? ঘুম থেকে উঠে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা সন্ধান করে পিয়াসু। ভোর হতেই স্বপ্নটা ভুলে নিজেকে পাখি শিকারী ভাবতে থাকে পিয়াসু। জালের খোঁজে নেমে পড়ে গ্রামে। শুধু কুনোজাল নয়-চুনোজাল-ধর্মজাল-টানাজাল…জগৎবেড়-বেড়াজাল-কুঁড়াজাল-ধর্মজাল-টানাজাল… কোন জালে কিভাবে কোন পাখি শিকার করা সম্ভব-এ নিয়ে রীতিমত যেন গবেষণায় নামে সে। তারপর কোন পাখি কী খায়-এ নিয়ে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে। কিভাবে পাখি শিকার করা যায়-এ ফাঁদ নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় পিয়াসুর মনে হয় শিকারী পাখির মতো তার একজোড়া পাখা থাকলে খুব ভালো হতো। কোন পাখি কোথায় বাসা বাঁধে-কোন পাখি কেমন করে ডাকে…এ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাঁধন নদীর উত্তরপাড় পার হয়ে আছে গগনবিল। সেই বিল পার হয়ে পাখসাট জঙ্গল। সেখানে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ যায় না। কারণ ওই জঙ্গলে-সবাই বলে শঙ্খচূড় আর দাঁড়াশ সাপের অতি উৎপাত। তবে পাখিও রয়েছে হরেক রকম। লোকে বলে ওই জঙ্গলের মাটিতে গাছের ঝড়া পাতা আর পাখির ঝরা পালকের পরিমাণ নাকি প্রায় কাছাকাছি। এত পাখির পালক দেখে অনেকে সন্দেহ করে-পাখিখেকো সাপও এ জঙ্গলে রয়েছে।

পিয়াসু সব ভয় অতিক্রম করে পাখসাট জঙ্গলে যায়। কেউ তার সঙ্গী হয় না। যাবার সময় দড়ি-লাঠি সব নিয়ে যায়-যদি সাপও তাড়া করে! পাখসাট জঙ্গলে ঢুকে পিয়াসুর অনেকটা ভয়ই লাগে। সাপের দেখা পায়নি-যা সুখকর। পাখিরও কোনো দেখা মিলেনি-যদিও পাখির কিছু পালক ততণে চোখে পড়েছে তার। মাটিতে ছড়ানো পালক। আর দেখা গেলো প্যাঁচা-রাশি রাশি। কালপ্যাঁচা-লীপ্যাঁচা-হুতোম প্যাঁচা-কতো রকম প্যাঁচা। একবার একটি ঝোঁপের ভিতর ফোঁসফোসানি শোনাও গেল। এক জায়গায় দেখা গেল কাঁকড়ার শুকনো কিছু খোলস, কয়েকটি শামুকেরও। ফোঁসফোসানি শুনে মনে হয় চন্দ্রবোড়া সাপের। আরেকটু এগিয়ে পিয়াসু একটি গাছের তলে সাপের খোলস দেখে ভয়ে আৎকে ওঠে। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি বউ কথা কও পাখি এবং একটি পানকৌড়ি। পানকৌড়ি দেখেই বুঝলো কাছেই হয়তো জল আছে। হ্যাঁ ঠিক। একটু গভীরে ঢুকেই দেখলো জঙ্গলের ভিতরে একটি পুকুরও রয়েছে। এ পুকুরের কথা আগে কেউ পিয়াসুকে বলেনি। আর দেখা গেল একটি বিরাট আকারের বল্লার বাসা। মাটি থেকে সামান্য উঁচু একটি গাছের ডালে।

জঙ্গলের ভিতর তেমন রোদ পড়ে না। ঘনানো অন্ধকার-ভরদুপুরেই। গাছগাছালির বেষ্টনী ভেদ করে ঠাঠাপড়া রোদ্দুরও খুব কষ্টে মাটিতে নামে।

পিয়াসু একটু এগিয়ে গিয়ে বনের ভিতরের পুকুরটা দেখতে পায়। পুকুরের পানি পানিতো নয়…যেন গোলাপজল। পুকুরজলে নীল পদ্ম লালপদ্মোর বিস্তার। পদ্মপাতার ছড়াছড়ি। খর বৈশাখেও শুকায় না এ পুকুর। পুকুরপাড় ধরে হাঁটে পিয়াসু। হঠাৎ নাকে বেলিফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। দূরে একটি রক্তজবার গাছ চোখে পড়ে। তারপরই বেতবন। আছে কিছু নলখাগড়া। এখানে ওখানে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় নয় বাঁশবাগান।

সুন্দরবনের নাম শুনেছে পিয়াসু। দেখেনি। এখন মনে হয় পাখসাট জঙ্গলই যেন সুন্দরবন। এক জায়গায় অসংখ্য তুলসী গাছ দেখে পিয়াসুর মনে হয় এ জঙ্গল কোন এককালে হয়তো হিন্দুবসতি ছিল। তবে এগুলোর অধিকাংশই বনতুলসী গাছ। হঠাৎ পিয়াসুর মনে হয় জন্তু জানোয়ার থাকলেও থাকতে পারে। বাঁশবনে কিছু বক দেখলেও ধরার উপায় নেই।

বনে এসেছে পিয়াসু পাখির বাচ্চার খোঁজে। কিন্তু পাখির বাসা খুঁজে পাচ্ছে না। তাছাড়া ভয় লাগে। সাপের ভয়। এছাড়া একা এসেছে বলে মনে হয় সারা জঙ্গলে ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জঙ্গলে পীরব আছে কিন্তু ওদের দেখতে পাওয়া যায় না-গাছের পাতার সঙ্গে মিশে থাকে। তবে মাটিতে পালক খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন পাখির। শোনা যায় পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দও। তবে সারা জঙ্গলে পাখির এতই কিচিরমিচির যে-ঠিক কোথা থেকে শব্দ আসছে-তা বুঝতে পারা কঠিন। তবে এরই মধ্যে কিছু হরিয়াল-টিয়ে-চন্দনা উড়তে দেখেছে পিয়াসু। তবে এদের বাসা চোখে পড়েনি। একটি ধনেশপাখিও চোখে পড়েছে খুব উঁচুতে। কিন্তু এদের বাসা কোথায়? পাখি যেহেতু রয়েছে-বাসাও থাকবে।

বিকেল হওয়ার একটু আগেই টিয়ে পাখির একটি কোটর খুঁজে পায় পিয়াসু। বাসায় পাখির বাচ্চাও আছে বুঝতে পারে। বড় পাখিরা কী এক ফলের শাঁস জাতীয় খাবার নিয়ে কোটরে ঢুকতেই কোটরের মুখ পর্যন্ত বাচ্চারা এগিয়ে এসে বিভিন্ন শব্দ করে উঠে। সেই কোটর বিশাল এক মহুয়া গাছে। বড় পাখিরা বাসা ছাড়তেই মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে পিয়াসু মহুয়া গাছে উঠে। গাছে উঠার ভঙ্গিটি পিয়াসুর এমন-যেন সে কোন গাছুড়িয়ার রক্ত বহন করছে।

সন্ধ্যার আগেই টিয়ে পাখির বাচ্চাগুলো নিয়ে বাড়িতে ফিরে পিয়াসু। পরদিন সারা আনন্দপুরে হৈচৈ পড়ে পিয়াসুর এ পাখির নেশা নিয়ে। দুপুরের আগেই এক শৌখিন লোকের কাছে পাখির বাচ্চাগুলো ভালো দামে বিক্রি করে পিয়াসু। ভরদুপুরে আবার সে সেই জঙ্গলে যায়।

পাখির জন্য শৈশবে পিয়াসুর যে প্রণয় ছিল-তা এখন রুচিহীনতার রূপ পায়। পাখির প্রতি প্রবল ঝোঁক এখনও রয়েছে তার। তবে তা অনাদরের। পাখি দিয়ে কী ব্যবসা হবে-এটাই এখন তার ভাবনার বিষয়। ভালোবাসার জায়গা দখল করেছে ব্যবসা। পাখিরা আগে ভালোবাসতো পিয়াসুকে। এখন ঘৃণা করে। আগের পিয়াসু সভ্য-এই পিয়াসু বর্বর। সে সারাদিন তিতিরজলার নলখাগড়ার বনে ঘুরে বেড়ায় পাখি ধরে বিক্রি করবে বলে। আনন্দপুরের অনেকেই এখন বলে পিয়াসু খুব কুশ্রী মানুষ। তার চেয়ে প্যাঁচার মনও সুন্দর।

পাখসাট জঙ্গল থেকে পাখি আর পাখির বাচ্চা ধরার কাজে পিয়াসুর দতা দিনদিন বেড়েই চলে। অনায়াসে অভ্যস্ত হাতে পাখি ধরে ফেলে। বর্শিতে টাকি মাছের জ্যান্ত পোনা গেঁথে বক ধরে ফেলে। সারাদিনের ফন্দিফিকির-কুটকৌশল ঐ পাখি শিকার নিয়েই। পাখি বিক্রি করে সে এখন মুচমুচে বড়া কিনে খায়। সিঙারা খায়-নিমকি খায়-নানা কোম্পানীর লেবেঞ্চুস কিনে আনে। সেদিন খেয়েছে ীর। আহ-কী মজা! মায়ের দুধ বেশিদিন খেতে পারেনি পিয়াসু। তাই দুধের অভাবটা যেন এখনও বোধ করে। পাখি বিক্রির টাকায় সেদিন অনেক শোনপাপড়িও কিনেছে। অথচ শৈশবে এই শোনপাপড়ি চেয়ে চেয়ে দাদীর কাছে কতো কান্না কাঁদতো। আহারে পাখি বিক্রির আগে পিয়াসু খুদের জাউ খেতে খেতে পাগল হয়ে উঠেছিল। একবার এক সকালে প্রতিবেশীর ঘর থেকে পান্তাভাত আর টকডাল খেতে না পেলে নির্ঘাত মারা যেত। আর এখন পাখি বিক্রির বদৌলতে টাকা দিয়ে পিয়াসু জিলিপিও কিনেও খেতে পারে।

যে জামগাছ থেকে অবশেষে পড়ে গেলো পিয়াসু-পরে মরেও গেলো-সেই জামগাছে উঠেছিল পাখির খোঁজেই। তবে পাখি এ সন্ধান ছিল ভিন্নরকমের।

কোনো এক শিকারীর গুলি খেয়ে পাখসাট জঙ্গলে উড়ে এসে ধপাস করে পড়েছিল এক গাঢ় সবুজ টিয়ে। প্রথমে এ পাখিকে হীরামন বা চন্দনা ভেবেছিল পিয়াসু। পরে দেখলো টিয়ে। রক্তে ভিজে সবুজ শরীর লাল হয়ে গিয়েছিল। পিয়াসু এ পাখিকে উদ্ধার করে অনেক সেবাযতœ করে। বাজার থেকে কিনে আনে চাঁপাকলা-পেয়ারা-পাউরুটি-চিড়েমুড়ি…কতো কী! তার আহত-অসুস্থ পাখিটাকে খাওয়াবে বলে। পাখিটাও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। যেন বশও মানে। শুধু এই একটি আহত অসুস্থ পাখির প্রতি পিয়াসুর কর্তব্যজ্ঞান দেখে অনেকে অবাক হয়। তবে তার পাখি ধরা ও পাখি বিক্রি কিন্তু বন্ধ নেই। সবাই ভাবে অসুস্থ পাখিটাকে সুস্থ করতে পারলেও পিয়াসু বিক্রি করে দেবে। সত্যিই কি তাই? পরিচর্যায় একসময় সম্পূর্ণ সুস্থও হয় সেই পাখি। পিয়াসু সেটাকে আর বিক্রি করে না। আদরযতœ করতে করতে পাখিটার উপর এক ধরনের মায়া তৈরি হয়। একসময় পাখিটার নামও দেয় পিয়াসু। ‘যুবরাজ’ যুবরাজ পিয়াসুর কোনো মতলব বুঝে না। যুবরাজেরও কোনো মতলব রয়েছে কী না তাও বুঝে না পিয়াসু। পিয়াসু তার দাদীর কাছে যেসব পাখির গল্প শুনতো, তা হলো ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী পাখি। কিন্তু এখন সে অনেক পাখি চিনে। বুনোহাঁস-বালিহাঁস-বেলেহাঁস। গাঙশালিক-রামশালিক-হাড়গিলা-ডাহুক-তিতির-শঙ্খচিল… কতো পাখি।

গুলি খাওয়া পাখিটাকে সুস্থ করার পর সেটাকে সে পোষা পাখির মতোই লালন করতে থাকে। পাখিটাও যেন এক ধরনের পোষ মেনে যায়। খাঁচা ছাড়াই পিয়াসুর হাতে হাতে থাকে। যেন মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। যুবরাজ পাখিটি পিয়াসুকে দেখলেই বিনীতচিত্রে ডেকে উঠে। কৃতজ্ঞচিত্তে নাড়াতে থাকে লেজ। যেন সে আর কখনো আকাশে যাবে না। শোঁ করে ঢুকবে না পাখসাট জঙ্গলে। পিয়াসু তো এসব দেখে ভীষণই খুশি হয়।

যুবরাজ পাখিটি ধীরে ধীরে পিয়াসুর ভীষণ ভক্ত হয়ে পড়ে। পিয়াসুর কথা বুঝতে চেষ্টা করে। অনেকে ভাবে, পিয়াসু এ পাখিকে শিকারী পাখি হিসেবে গড়ে নেবে-আরও পাখি শিকার করবে বলে। পাখিটিকে পিয়াসু নিজহাতে স্নান করিয়ে দেয়। দুষ্টুমি করে বলে-বল যুবরাজ বল-ভাগ্য আমার গণনা করে বল-আমি কখনো রাজা হবো কী না…। আমার মাথায় রাজমুকুট লাগলে-তোকেই করবো রাজার প্রধান দূত…ইত্যাদি। কিন্তু পাখিরওতো কিংবদন্তী আছে। স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। আছে সন্দিহান মন। কৌতূহলে-কূটপ্রশ্নে পাখিও নিজেকে জর্জরিত করে। পাখিও খুঁজে বেড়ায় নিজের আপন অতীত…পাখিরও থাকে অটোবায়োগ্রাফি…। তাই যুবরাজ পালায়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়াসু দেখে যুবরাজ ঘরে নেই। নেই তো একেবারেই নেই…কোথাওই নেই। যুবরাজের খোঁজে পাখসাট জঙ্গল তছনছ করে পিয়াসু। কোথায় পাবে যবরাজকে? নেই। কোথাওই নেই। পোষা পাখি হারানো এতটা দুঃখময়, কখনো ভাবেনি পিয়াসু। ব্যথা বেদনায় নি®প্রাণ হয়ে পড়ে। শোকদগ্ধ মন নিয়ে কখনো আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নিজেকে সে প্রশ্ন করে, পাখিরা এমন বিশ্বাসঘাতক হয়? একদিন সকালে পাড়ার একটি বালক পিয়াসুকে এসে বলে, যুবরাজকে সে দেখেছে সেই সড়কপথের কাছের বুড়ো জামগাছের মগডালে, পাতার ঝোঁপে লুকানো। শুনতে দেরি-যেতে দেরী নেই পিয়াসু’র। আঠা-কাঁটা-সুতা-খাঁচা নিয়ে ছুটে জামগাছের দিকে। আর যদি জীবনে একবার ধরতে পারে তাকে-বুঝিয়ে দেবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার জেলে বন্দী হতে সত্যি কেমন লাগে!



রচনা: বৈশাখ-১৪০০: মাতুয়াইল, ঢাকা।

প্রথম প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর, ২০০৯ : সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ, কুমিল্লা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.