নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার সারা জগৎজুড়ে বাবার নানা স্মৃতি

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২১

জসীম অসীম



আমার বাবা। কফিল উদ্দিন। শেষ বয়সে তার একমাত্র সঙ্গী ছিলো নিঃসঙ্গতা আর কষ্ট। বাবা মারা গেলেন-নাকি একটা বিয়োগান্তক নাটকে অভিনয় করে গেলেন-বুঝলাম না। সে ঘটনা বারবার ভুলতে চেষ্টা করি। পারি না।

১৯৯২ সালে আমি যখন টেলিভিশনে অভিনয় করার স্বপ্ন দেখছি-বড় ভাই সাহস দিলেন। মা বললেন-লেগে থাক। বাবা শোনালেন হতাশার সুর। বললেন-যাদের পেট নিয়ে পাগল থাকতে হয়-তাদের পক্ষে সৃষ্টিশীল কিছু করা খুব কঠিন। আমার জীবনে শেষ পর্যন্ত বাবার কথাই সত্য হয়েছিল। আমি সফল হতে পারিনি।

প্রেমে পড়লাম। প্রেম করলাম। এক মেয়ের সঙ্গে। বাবা বললেন-প্রেম করতে তো অনেক টাকা দরকার। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজে। তুমি যে এ সাহস দেখাচ্ছো-তোমার কি তেমন টাকাপয়সা আছে?

আমার মায়ের সঙ্গে আমার তেমন কোনো ঝগড়াই বাঁধেনি। বাবার সঙ্গে প্রায়ই বাঁধতো লঙ্কাকান্ড। কারণ আমরা উভয়েই মুখেমুখে তর্কবিতর্ক করতাম। ন্যায্য কথা বাবাই শিখিয়েছিলেন। কিন্তু একসময় আমার আর বাবার দেখার দৃষ্টিকোন দু’রকম হয়ে গেল। সুতরাং তর্ক নয়-কেবল হাতাহাতি বাদ থাকতো। মা আমার চেয়ে বাবাকেই বেশি বকতো। আমাকে খুব আদর করতো বলে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বড় মামা শহীদ হওয়ার পর মেজমামাকে আমরা বড় মামা ডাকতাম। একাত্তরের স্বাধীনতা বিষয়ে সেই মেজো মামা-অর্থাৎ বড় মামার কথাবার্তা আমার পছন্দ হতো না। তিনি হিন্দুদের অত্যাচারী রূপ আমার সামনে তুলে ধরতেন। আর আমি মুখে মুখে পাল্টা জবাব দিতাম। একসময় মাকে বললাম-তোমার বড় ভাই এ বাংলার লাল সবুজ পতাকার শত্র“। আমার বাবা আমার বিপক্ষে সায় দিতেন। বলতেন-তোর মামা কি রাজাকার ছিলেন নাকি?

: তা ছিলেন না। কিন্তু রাজাকারের অনেক চিন্তা তিনি লালন করেন। বাবা বলতেন-স্বাধীনতা যুদ্ধে তোমার মামার বড় ভাই শহীদ হয়েছিলেন। তুমি যদি তেমন একজন মায়ের পেটের ভাই হারিয়ে আজকের বাংলাদেশকে দেখতে পেতে-তাহলে তোমারও অনেক চিন্তা বদলে যেত।

: চিন্তা বদল কাকে বলে? তিনি তো পাকিস্তানের পক্ষেও কথা বলেন? বাবা বলতেন:কেন? পাকিস্তান আমলেও দেশে একটা নিয়ম ছিল। এখন দেশ চলছে রোগীর মতো। দুর্নীতিবাজদের খপ্পরে পড়ে সারাটা দেশ ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। কেবল কিছু লোকই একতরফা উন্নতি করে চলছে।

আমার মা প্রায়ই এসব আলাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো। বাবার সঙ্গে আমার তর্ক-বিতর্ক চললেই মায়ের হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চাইতো।

একদিন রাতে দৈনিক রূপসী বাংলা অফিস থেকে ফিরে দেখি বাবা টিভি দেখছেন। টিভি-তে বোম্বের হিন্দি ছবি। বিনোদন ছবি। আমরা ওসব ছবি দেখতাম না। পারতপক্ষে না। কখনো কখনো ভালো কাজ থাকলে দেখতাম। কিন্তু বাবা দেখতেন। সেদিনও বাবাকে বললাম-এসব ছবি কিভাবে দেখেন?

-চোখ দিয়ে। মন দিয়ে নয়।

: কী লাভ?

-নারীদের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে কিভাবে দেখা হচ্ছে-তা বুঝতে পারা।

:এসব ছবিতে বুঝবার কী আছে? বোঝার বিষয় থাকে ভালো ফিল্মে। ওসব বরং মগজ নষ্ট করে।

-আমার মগজ নষ্ট হবে না। নষ্ট হলে তোমাদের হবে। যে বয়সের ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে পয়সা দিয়েও এসব ছবি দেখে।

বাবার সঙ্গে কথা বললে বাবা প্রায়ই হঠাৎ থেমে যেতেন। আর যখন বাবাই রেগে থাকতেন-তখন তিনি আমার সকল কথারই শক্ত জবাব দিতেন।

বাবাকে একদিন বললাম-সারাটা জীবন চাকুরি করলেন। আমাদের শহরে একটি বাড়ি করে দিতে পারলেন না। আপনার খারাপ লাগে না? বাবা বললেন-এদেশে হাজার হাজার মানুষ ছিন্নমূল। রাতের বেলা রেলষ্টেশনে গিয়ে দেখো কতো ভাসমান মানুষ। ওদের তো বাড়ি নেই। পৃথিবীতে তোমরাই কেবল শহরে বাড়িছাড়া মানুষ?

আমি বললাম-আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকি-সে তো সাধারণ একটি চাকুরি করে। সে যদি জায়গা কিনে বিল্ডিং করতে পারে-তো আপনি পারেননি কেন? আপনি তো কতো আমলার সঙ্গে কাজ করেছেন। বাবা বলতেন-তার জন্য তোমার মা দায়ি। তোমার মা আমাকে শপথ দিয়ে কোনো অবৈধ পয়সা খেতে বারণ করেছিল। না হলে নিজের কষ্ট যেমনতেমন-সন্তানের কষ্ট কেউ সহ্য করতে পারে না। তোমার মা নিজে না খেয়ে তোমাদের কতো রাত খেতে দিয়েছে। তোমার কি মনে আছে? আমি বললাম-খুব মনে আছে। কিন্তু এখন যে আমরা সৎ থাকবো-তার কি নিশ্চয়তা আছে? চোখের সামনে সবাই কেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বাবা বলতেন-তুমি সৎ থাকবে না অসৎ থাকবে , তা তোমার নিজের বিষয়। তোমার বয়সী যুবকরা কেউ লাগেজ কাটে-কেউ ছিনতাই করে। আবার এমন কেউ আছে-যে লাগেজ পেয়ে মালিককে খুঁজে সেটা ফেরত দেয়। আমি বলতাম-আমি হলে ছিনতাই করতাম। বাবা বলতেন-হয়তো করতে-হয়তো না। তবে এ ঘর , এ পরিবার তোমাকে এ শিক্ষা দেয়নি। হ্যাঁ-আমি এটা বিশ্বাস করি-তোমরা ভবিষ্যতে বদলে যেতে পারো। খারাপের দিকে। সবাই না হোক-কেউ কেউ। কারণ নষ্ট সমাজের শিক্ষা অনেক সময় রক্তের শিক্ষাকেও ভুলিয়ে দেয়।

সেই ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাবা খুব গভীর রাত হলে নিঃশব্দে কোরআন শরীফ পড়তেন। অধিকাংশ সময় বাংলা অর্থসহ। আমাদের বলতেন-অর্থ না বুঝে কোরআন পড়া আর কামার দোকানে কোরআন পড়া সমান। এই বছর বিশেক আগে বারকয়েক পড়েছেন রাহে-আমল-হাদীস সংকলন। আর ১২ বছর আগে মহাভারত ও রামায়ন। আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ১ম ও ২য় খন্ড বাবাকে পড়তে দিলে বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়লেন। পড়া শেষ হলে বাবাকে বললাম-এখনও বলছি বাবা আপনি লেখা শুরু করুন। আপনার মুখের কথাগুলোই লিখুন। মাতুব্বর কৃষক হয়ে যদি লিখতে পেরেছেন-আপনি কেন পারবেন না? কবি নজরুলকে যতবার দেখেছেন-ঋষি মনোমোহন দত্তের কথাগুলোই-আপনি লিখুন। বাবা বলতেন-লেখালেখি খুব সহজ কাজ নয়। এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কী আর লেখক হতে পারবো? চেষ্টা করে দেখো-তুমি কতোদূর কী করতে পারো।

আবার বাবা লেখালেখি না করলেও কর্মরত অবস্থায় কুমিল্লা শহর ও চট্টগ্রাম থেকে আমার চিঠির অনেক উত্তর লিখেছিলেন। আমার বিয়ে দুর্ঘটনার সময় বউপক্ষের লোকের বাসা তছনছকালে বাবার সেসব চিঠি হারিয়ে যায়। পৃথিবীর কারো কাছে কোনো মূল্য না থাক-আমার কাছে বাবার সেসব চিঠির মূল্য ছিল সোনার চেয়েও মূল্যবান।

ছোটবেলায় বাবার একবার অসুখ হয়েছিল। টি.বি। সবাই বললেন-বাঁচবে না। আমার মা রাতভর কাঁদতো তখন। অনেকগুলো জমির সঙ্গে খুব বড় একটা জমি ছিল আমাদের। শুধু বাবার চিকিৎসার জন্য মা সেটা বিক্রি করে দেয় । বাবাও নিষেধ করেছিলেন। অনেকে বললেন , লোকটা তো বাঁচবে না, অনর্থক জমিটাও যাবে। মা বলেছিলো-আগে মানুষ-জমি নয়। বাবার কাশের কফ থেকে অনর্গল রক্ত বের হতো তখন। কিন্তু চিকিৎসায় বাবা ধীরে ধীরে ভালো হলেন। আবার চাকুরিতে যোগ দিলেন। আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে নামলেন। সে সময়ে টিবি-র ফ্রি চিকিৎসা ছিল না।

ইংরেজি ভালো জানতেন না বাবা। ইংরেজি বই-পত্রিকা পড়তে দিলে বলতেন-পড়তে পারবো, স্পষ্ট অর্থ বুঝবো না। সুতরাং তার থেকে বাংলা পড়া ভালো। তবে ইংরেজি ছবি দেখতেন খুব। হিন্দী-উর্দু বলতে পারতেন অনর্গল।

আমি যতদিন ঢাকায় ছিলাম-বাবার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হতো না। কখনো কখনো বড় ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। তখন মোবাইলেরও এমন ব্যবহার ছিল না। ১৯৯৪ সালে আমি যখন আমার ছাত্রী লিমাদের বাসায় থাকি-ঢাকায় ,মীরহাজিরবাগ-তখন লিমাদের বাসায় বাবা একদিন ফোন করে বসলেন। লিমা এসে আমাকে খবর দিতেই ফোন ধরলাম। বাবা বললেন-তোমার শরীর কি ভালো আছে? তোমার মা নাকি স্বপ্নে তোমাকে খুব অসুস্থ দেখেছে। যদিও আমার খুব জ্বর ছিল-বাবাকে বললাম-আমি ভালোই আছি। বাবা যেন কথাই বলতে পারছিলেন না। আবেগে কাঁপছিলেন। কুমিল্লা থাকলে বাবার সঙ্গে যত ঝগড়া হতো-ঢাকায় গেলে বাবা ততই কষ্ট পেতেন। একবার কুমিল্লায় এলেই তার অফিসের পুকুর থেকে বর্শি দিয়ে ধরে তাজা তাজা বড় মাছ আনতেন। বলতেন ,তুই যতদিন থাকবি ,আমি ততদিন তোকে অফিসের পুকুর থেকে ধরে তাজা মাছ খাওয়াবো। বাজারের একটি মাছও তোকে খেতে দেবো না।

১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০০ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি যত টাকা উপার্জন করেছি-তার সব টাকা সংসারের প্রয়োজনে দিয়ে দিয়েছি। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় মায়ের হাতে দিতাম। মা মারা গেলে একদিন বাবাকে বেতনের টাকা দিতে গেলে বাবা খুব বিব্রতবোধ করেন। বলেন-টাকাটা তোমার ছোটবোনের হাতে দাও। সেই বুঝবে-কোথায় কোথায় খরচ করতে হবে। বাবাকে আমি কোনো দিন একটি টাকাও দিতে পারিনি। ২০০২ সালে আমি যখন কুমিল্লার দৈনিক শিরোনামে কাজ করছি , তখন আমার প্রথম বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে বলে প্রতিবেলাই হোটেলে খাই। একদিন হঠাৎ করে বেতনেরা টাকা হাতে আসে। এরই মধ্যে বাবা এসে শিরোনাম অফিসে হাজির। আমি বিভিন্ন কাগজে চাকুরি করলেও শিরোনাম ছাড়া বাবা কোনো পত্রিকা অফিসে পারতপক্ষে যাননি। তখন বাবাকে নির্জনে পেয়ে পাঁচশত টাকা দিতে খুব চেষ্টা করলাম। বাবা টাকাটা নিলেন না। বললেন-তোমার এখন খুব খারাপ সময়। যখন অবস্থা ভালো হবে-আমাকে দিয়ো। আমি মরে গেলে ছোট ভাইবোনদের দিয়ো। অথচ পরে বিভিন্ন জায়গায় শুনেছি-বাবার পকেটে তখন তেমন কোনো টাকাপয়সাই থাকতো না। বাবার সঙ্গে যত ঝগড়াই হতো-বাসায় ফিরে না গেলে বাবা ততই কষ্ট পেতেন।

বাবা যখন মারা যান-সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখ-২০০৩-এ , তার দু’সপ্তাহ আগে থেকে আমার খুব অভাব দেখা দেয়। পত্রিকার চাকুরিতে আমি আমাকে আর ভাবতে পারছি না তখন। এমন কী না খেতে খেতে ক্রমাগত শুকাতে লাগলাম-তবু বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আপোষ করতে পারছিলাম না আমি । দৈনিক শিরোনামেও কাজ করছি না। আমার পাশের রুমের পান্না ভাবী প্রতিদিন আমাকে খাওয়ার মান বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কখনো কখনো জোর করে ভাত-তরকারীও দিতে লাগলেন। তখনই একদিন আমার বন্ধু স্বপ্না দেবনাথের মা-আমাকে কিছু টাকা দিলেন তার একটি কাজ করে দেয়ার জন্য। মাসিমার সেই টাকা পাওয়ার রাতেই বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর এলো-বাবা খুব অসুস্থ। কোটবাড়ি বড় ভাইয়ের বাবা থেকে বাবাকে বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে আনা হয়। আপেল আর আলুবোখারা নিয়ে বাবাকে দেখতে গেলাম। আলুবোখারা ফল আমার মা ও বাবার খুব প্রিয় ছিল। বাবাকে খুবই অসুস্থ দেখলাম। ভাবী বললেন-চিকিৎসা চলছে। দোয়া করেন। এত অভাবেও আমি কেন আপেল ও আলুবোখারা নিলাম-সেজন্য বাবা আমাকে অনেক কথা বললেন। বাবা বললেন-কোনো কিছুই যেন কিনে না নেই আর ।

পরদিন আমি রাতের বেলা বাবাকে দেখতে যাই। যাওয়ার সময় মাসিমার টাকা ভেঙ্গে একটি বড় আকারের ডালিম কিনি। বাবা ডালিমটি দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন-ডালিম খেতে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল।

পরদিন ছোটভাই দামাল বাবার কথামতো বাবাকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেলো। কিন্তু বাবার অবস্থার পরিবর্তন হলো না। আমি হন্যে হয়ে টাকাপয়সা খোঁজ করলাম। কোথাও কোনো টাকা পেলাম না। তখনই একদিন খবর পেলাম বাড়িতে ছোটবোন কথা-র ছেলে হয়েছে। কথা-কে বাবার অনুরোধে মাসখানেক আগে নরসিংদী তার স্বামীর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। বাড়ির সঙ্গে আমার তখন মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ। সেট নষ্ট। কার্ড কেনারও টাকাপয়সা নেই। তখন ৩০০/- [তিনশত] টাকার কমে কার্ড পাওয়া যেত না। বাবা যেদিন মারা গেলেন-তার আগেরদিন ছিল হরতাল। সেদিন আমি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কুমিল্লার বরুড়ার আড্ডাবাজারের বেওলাইন মহিলা দাখিল মাদ্রাসার উপর একটি রিপোর্ট তৈরি করি। রিপোর্টটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনে পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু রিপোর্ট নিতেও কর্তৃপক্ষ এলো না। আমিও পেলাম না কোনো টাকা। সারাদিন অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তারা এলো না। এ রিপোর্ট তৈরি করতে আমাকে অনেক দলিল ও কাগজপত্র রাত জেগে পড়তে হয়েছিল। সন্ধ্যায় শুরু হলো বৃষ্টি। ততক্ষণে আমি অন্য এক জায়গা থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছি। বাড়িতে ঠিক যখন যাবো-তখন ছোট ভাই দামাল এসে হাজির। বললো-এ রাতে বৃষ্টি দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। খুব ভোরে চলে যাবেন। তার প্রায় ৬ মাস আগেও বাবা আরেকবার অসুস্থ হয়েছিলেন। আমার বন্ধু স্বপ্না দেবনাথ তখন ঢাকায়। ফোনে তাকে বাবার অসুস্থতার খবর জানালে সে আমাকে ধমক দিয়ে বাড়িতে পাঠায়। তখনও খুব বৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাড়িতে যাই। বাবার জন্য আচার নিয়েছিলাম। আচার বাবা খুব পছন্দ করতেন। বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে গিয়েছি বলে বাবা বারবার বললেন-এত পাগলামী ভালো না। আগামীকাল তো আসতে পারতি।

শেষ পর্যন্ত দামালের কথায় রাতে আর গেলাম না গ্রামের বাড়িতে। ভাবলাম-ভোরে চলে যাবো। কুমিল্লার ডেন্টাল ডা: ইকবাল বাহারের বাসায় গেলাম রাতে। আমার পাওনা টাকা থেকে যদি ১০০০/- [এক হাজার] টাকাও পাই। ইকবাল বাহার আশ্বাসও দিলেন-পরদিন সকালে দেবেন বলে। গেলাম সকালে। সকাল থেকে দুপুর হলো। ইকবাল বাহার দিতে পারলেন না। বাসায় ফিরে এসেই পান্না ভাবীর কাছে শুনলাম-বাড়ি থেকে খুব খারাপ খবর এসেছে। দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে। আমি বুঝে গেলাম-বাবা আর বেঁচে নেই।

পকেটে টাকা না থাকার কারণে বাবার শেষ সময়ে আমি তার কাছে থাকতে পারিনি-এ কথা কি বিশ্বাস করবে কেউ? জানিনা। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন বাবা। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদূতকে ঠেকাতে পারেননি। বাবার মৃত্যু চোখে দেখিনি বলে মনে হয় বাবা এখনও বেঁচে আছেন। গান খুব পছন্দ করতেন বাবা। ছোটবেলায় গান গাইতেন। দারিদ্র বাবার অনেক স্বপ্ন হত্যা করেছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও বাবা কোনো এক গানের আসরে সুরের মূর্ছনায় পাগল হয়েছিলেন। মারা যাওয়ার পর সে কথা জেনেছি। আমার বন্ধু স্বপ্না বাবাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্না ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে আসার একদিন আগেই বাবা মারা গেলেন। স্বপ্নাও কখনো আমার বাবাকে দেখেনি।

ফিল্ম দুনিয়ার দিকে সাংঘাতিক একটা টান ছিল বাবার। টেলিভিশনে সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’ দেখেছিলেন খুব মগ্ন হয়ে। রাজকাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ দেখে বাবা বলেছিলেন-কিভাবে যে এত ভালো ছবি মানুষ তৈরি করে , বুঝি না। মনে হয় ঈশ্বরের শক্তি যেন মানুষের হাতে। রাজকাপুর-রাজকুমার-দিলীপকুমার বাবার খুব প্রিয় অভিনেতা ছিল। আমার সারা জগৎজুড়ে বাবার নানা স্মৃতি। এসব স্মৃতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। মুছে ফেলতে চাই এসব স্মৃতি। কোনোভাবেই সেসব মোছা যায় না।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.