![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আপাতত স্বল্প করে গল্প লিখি কল্পলোকের
হত্যা রহস্য
-আসিফ মাহমুদ
গত দুদিন হল সালেহা বেগম খুন হয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করছে, হয়রান হয়ে খুজছে খুনী কে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন নূনতম ক্লু ও পায়নি। মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হচ্ছে এ নিয়ে। সাংবাদিকদের জবাব দেয়াটা পুলিশের কাছে বেশি হয়রানির ঠেকছে। গুলশানে নিজের বাসায়ই খুন হয়েছেন সালেহা বেগম। ভাড়া বাসায় একমাত্র সন্তান রুবি কে নিয়ে থাকতেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর স্থানীয় একটি স্কুলে চাকরি করে মা মেয়ের চলতো। দশ বছর বয়সী রুবি বাক প্রতিবন্ধী, খুন রুবির সামনেই হয়েছে। হয়ত রুবী এ সম্পর্কে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারবে। তাই রুবিকে আজ দুদিন ধরে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। যদিও রুবির আত্মীয় স্বজন তার শারিরিক অবস্থা এবং সর্বোপরি হঠাত এমন দুর্ঘটনা ঘটায় তার উপর যে মানসিক চাপ পড়েছে তার দোহাই দিয়ে তাকে নিতে চেয়েছে, কিন্তু পুলিশ তাদের সিদ্ধান্তে অটল। এবং তারা রুবির পূর্ণাঙ্গ যত্নের দায়ভার নিয়েছে। ওসি রায়হান সাহেব নিজেই রুবির তত্ত্বাবধানে আছেন। তিনি দিনের প্রায় সময়ই রুবির সাথে কাটাচ্ছেন। কখনো তার সাথে খেলা করছেন, কখনো তাকে নিজেই খাইয়ে দিচ্ছেন, কখনো বা খেলার ছলে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি, রুবি রায়হান সাহেবের প্রশ্নের জবাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করেনি। কেস দিনদিন জটিল হচ্ছে। কারণ মার্ডার স্পটে খুনের কোন নিশানা নেই। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, সালেহা বেগমকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে কারো হাতের ছাপের কোন নিশানা পাওয়া যায়নি। খুনি নিঃসন্দেহে খুবই চালাক। পুরো মার্ডার স্পট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও খুনীর কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রায়হান সাহেব ও বেশ দুঃশ্চিন্তায় আছেন। প্রথমত, এই কেস টি তার ক্যারিয়ারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত রায়হান সাহেবের স্ত্রী রুবিকে মোটেও পছন্দ করছেন না। রায়হান সাহেবের ও একটি মেয়ে আছে, সোহা। সোহার বয়স ছ বছর। কিন্তু খুব পাকা পাকা কথা বলে। ইতিমধ্যেই রুবির সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার। নিজের পুতুল খেলার সব উপকরণ রুবির সাথে ভাগ করে নিয়েছে সে। রায়হান সাহেব খুব একটা বেজার না। মেয়েটা বাসায় ভীষণ একা পড়ে যায়, একটা সঙ্গী পেয়েছে কদিনের জন্য। কিন্তু রুবির আচরণ অদ্ভুত ঠেকে রায়হান সাহেবের কাছে। মেয়েটা খুব একটা হাসেনা, যখন হাসে তখন সে হাসিতে কেমন একটা রহস্য লুকিয়ে থাকে।
রাতে রায়হান সাহেব বাসায় ফেরেন। এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে সবাইকে পাওয়া গেল। কিন্তু সবার মুখ শুকনো, বিশেষত রায়হান সাহেবের স্ত্রী রুমা মুখ গোমরা করে রেখেছে। সবাইকে ভাত বেড়ে দিয়ে টেবিলে চুপচাপ বসে থাকে রুমা। রায়হান সাহেব বুঝতে পারেন, কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে আর সেটা যে রুবি কে নিয়ে তাও বুঝতে বাকি থাকেনা তার। খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে এসে বসলেন রায়হান সাহেব। সাথে সাথে রুমা এসে ঢুকল। রুমা চুপ করে আছে। ভারী বৃষ্টি হওয়ার আগে আকাশ যেমন গুমোট হয়ে থাকে তেমন।
“কি হয়েছে?”
“এই মেয়েটাকে কখন দিয়ে আসবে বলো”
“হয়েছে কি সেটা তো বলো”
“মেয়েটা সোহার সবগুলো পুতুল কেটে ফেলেছে”
“সেকি!”
“এই অদ্ভুত মেয়েটাকে ঘরে আনতে কে বলেছিল তোমাকে?”
“আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হও। আমি দেখছি ব্যাপারটা”
রায়হান সাহেব অবাক হন। এ বয়সী মেয়েদের পুতুলের প্রতি অগাধ স্নেহ থাকে। কিন্তু রুবি পুতুল গুলো কেটে টুকরো করে ফেলেছে! রায়হান সাহেবের হিসেব মেলে না। সোহার ঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। দ্রজা ফাঁক করে দেখেন ঘুমুচ্ছে সোহা। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন আর কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিরে আসলেন রুমে। আসার পথে রুবির রুমের দিকে এক পলক তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন! রুবি খাটের উপর মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে আর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। রায়হান সাহেব ভেতরে যাবেন এমন সময় ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে বারান্দায় চলে আসলেন হাঁটতে হাঁটতে।
“হ্যা ডাক্তার শুভঙ্কর! বলুন”
“পোস্ট মর্টেম এর পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাতে এসেছে”
“কি বলছে রিপোর্ট?”
“রিপোর্ট টা বেশ হয়রানিকর”
“আরে আপনি বলুন, এই কেসটাই হয়রানিকর”
“সালেহা বেগমের গলায় একটা বাচ্চা মেয়ের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। বয়স নয়-দশের মধ্যে”
“হাতের ছাপ বলতে?”
“জ্বি, ঠিকই ধরেছেন। ঐ হাতের ছাপ টাই গলায় প্রেশার ক্রিয়েট করেছে বলে আমার ধারণা”
“একটি বাচ্চা মেয়ের হাত কি একটা মধ্যবয়স্ক মহিলা কে মারার জন্য যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?”
“সেই জায়গাটাই হয়রানির রায়হান সাহেব! আমি সেই জায়গায়ই মিলাতে পারছিনা। তবে মৃত্যু ঐ হাতের চাপেই হয়েছে”
“ওকে। আমি আপনার সাথে কাল মিট করবো”
ফোন কেটে দিয়ে বারান্দা থেকে বের হয়ে এলেন রায়হান সাহেব। আর বারবার নিজেকে বলতে লাগলেন, “এ অসম্ভব!” সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রুবির রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রুবি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে গিয়ে কথা বলার সাহস পেলেন না রায়হান সাহেব। তার এমনিতেই হার্ট একটু উইক। তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। রুমাকেও কিছু বললেন না, শেষে কেস সল্ভ হওয়ার আগেই না মেয়েটাকে তাড়িয়ে কেলেঙ্কারি বাঁধায়।
সকাল বেলা তাড়াতাড়ি থানায় পৌঁছালেন রায়হান সাহেব, ডাক্তার শুভঙ্কর ইতিমধ্যেই এসে পড়েছেন।
“আপনাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাই নি তো ডাক্তার সাহেব?”
“জ্বি না, মাত্রই আসলাম আমি”
“চা খাবেন না কফি?”
“চা”
“এইই আফজাল! দুটো চা নিয়ে আয়।
তো এবার বলেন পুরো বিষয়টা”
“দেখেন রায়হান সাহেব, ফরেন্সিক রিপোর্ট কখনো ভুল হয়না। আর এটা আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছি যে সালেহা বেগমের মৃত্যুর পেছনে একটা নয়-দশ বছরের বাচ্চা মেয়ের গলা টেপা দায়ী”
“আচ্ছা, আর কোন আঘাতের চিহ্ন কি পাওয়া গেছে?”
“জ্বি না। শুধু এটিই। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। সালেহা বেগমের গলার হাড় ভেঙে গুড়িয়ে গেছে”
“এটা কি করে সম্ভব। একটা নয়-দশ বছরের বাচ্চা মেয়ের পক্ষে গলা টিপে মারা তো অসম্ভব ই তার উপর আপনি এই ভয়াবহ তথ্য টা দিচ্ছেন”
“এখন রিপোর্ট যা বলছে, আমি তা-ই বলছি। আমি রিপোর্টের বাইরে কিছু বলতে পারবোনা। আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে, মেয়েটার হাত কে ব্যবহার করে অন্য কেউ চাপ সৃষ্টি করেছে!”
“সেটা সম্ভব না, কারণ তাতে তার দুটো কাজ করা লাগবে। প্রথমত, মেয়েটাকে সামলানো যার হাত সে ব্যবহার করবে, দ্বিতীয়ত, ভিক্টিম ও তো দস্তাদস্তি করবে। সুতরাং যতই শক্তিশালী মানুষ হোক, এ দুটি কাজ একসাথে করতে পারবেনা। তবে এক উপায়ে সম্ভব, যদি ভিক্টিম আগে থেকে বেহুশ থাকে। আপনার রিপোর্ট কি বলে?”
“জ্বি না, ভিক্টিম কে বেহুশ করা হয়নি। এ ধরণের কোন নমুনা ই পাওয়া যায়নি”
“সব কেমন যেন গুলিইয়ে যাচ্ছে ডাক্তার সাহেব। সালেহা বেগমের মেয়ে রুবির বয়স নয়-দশের মধ্যে। মেয়েটা ভীষণ অদ্ভুত, অদ্ভুত সব কাজ করে বেড়ায় । আর সে এখন আমার বাসাতেই আছে”
“বলেন কি?”
“জ্বি”
“মেয়েটার ফিঙ্গার প্রিন্ট চেক করে দেখতে হবে”
“যদি ম্যাচ করেও, তাতে কি প্রমাণ হবে? এই বাচ্চা মেয়েটা খুন করেছে? তার মাকে?”
“রায়হান সাহেব, কেস তো এগুতে হবে। আপনি বরং মেয়েটিকে নিয়ে আসুন”
“জ্বি। আপাতত তাই হোক”
ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। রায়হান সাহেব হাবিলদার রফিক কে গাড়ি নিয়ে পাঠালেন রুবি কে নিয়ে আসতে। যথা সময়ে রুবিকে নিয়ে আসা হল। রায়হান সাহেব নিজে ড্রাইভ করে রুবিকে ডাক্তার শুভঙ্করের ফরেন্সিক ল্যাবে নিয়ে গেলেন। রুবির সাথে ডাক্তার শুভঙ্কর ভাব করার চেষ্টা করলেন।
“এই যে মামুণি, ভাল আছো?”
রুবির ভাবান্তর নেই, সে কথা বলতে পারেনা, ইশারা করে। কিন্তু ডাক্তার শুভঙ্করের প্রশ্নে সে কোন ইশারা ও করল না।
“মামুনি তুমি হাত ধুয়েছো আজকে? লাইফবয় দিয়ে ধুয়েছো?”
রুবি মাথা নাড়ল।
“গুড গার্ল! দেখি তোমার হাতের ব্যাক্টেরিয়া কতটুকু মরেছে। এখানে দুহাত রাখো তো মামুনি” বলে ডাক্তার শুভঙ্কর একটি গ্লাসে রুবির হাতের ছাপ নিয়ে নিলেন। রায়হান সাহেব বসে বসে দেখছিলেন। তিনিও রুবিকে কিছুটা উতফুল্ল করার চেষ্টা করলেন।
“রুবি মামুণি, তোমার হাতে তো মোটেই ব্যাক্টেরিয়া নেই। দেখো, ডাক্তার সাহেব কেমন খুঁটে খুঁটে দেখছেন। তাও খুঁজে পাচ্ছেন না”
রুবি স্বাভাবিক হাসি হাসলো। রায়হান সাহেব স্বস্তি পেলেন।
“ডাক্তার শুভঙ্কর , আজ তাহলে উঠি। রাতে ফোন করবেন”
“অবশ্যই”
রায়হান সাহেব রুবিকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরতে থেকে অবাক হলেন রুমা।
“এত তাড়াতাড়ি ফিরলে আজ?”
“রুবিকে নিয়ে গিয়েছিলাম এক জায়গায়”
মূল কথা চেপে গেলেন রায়হান সাহেব। তাতে হল উলটো, রুমা ভাবলেন রায়হান সাহেব রুবিকে নিয়ে বেড়িয়ে আসছেন।
“আমাকে বা সোহা কে নিয়ে কখনো বেরিয়েছো? পরা মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা” বলেই গজগজ করতে করতে চলে গেল রুমা। রায়হান সাহেব চুপ করে রইলেন, কিচ্ছু বললেন না। উনি কেবল ফোনের অপেক্ষা করছেন। আর ফোনে পাওয়া খবর শোনার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তাই ভাবছেন। ফোন এল প্রায় রাত এগারোটার দিকে।
“হ্যাঁ ডাক্তার শুভঙ্কর! বলুন”
“রায়হান সাহেব, ভালো খবর আছে”
“কি? বলুন বলুন”
“হাতের ছাপ টা রুবির নয়”
“বলেন কি?”
উত্তেজিত গলায় বললেন রায়হান সাহেব।
“জ্বি, ঠিকই বলছি। হাতের ছাপ টা রুবির সাথে ম্যাচ করেনি। আপনার কাজ টা বোধহয় কঠিন হয়ে গেল”
“তা হয়েছে বৈকি। আচ্ছা আমি আপনার সাথে কাল দেখা করছি। আর বডি টার সেকেন্ড একটা পোস্টমর্টেম হওয়া চাই। কিছু না কিছু তো বের হবে”
“হুম দেখছি। রাখছি আজ”
বলেই ফোন কেটে দিলেন ডাক্তার শুভঙ্কর। বোধহয় দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের কথা বলায়। কথা শেষ করে রুবির রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন রায়হান সাহেব। রুবি খাটের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আর সেই অপলক দৃষ্টি।
সারা রাত ঘুম হল না রায়হান সাহেবের। কেস টা কেমন জটলা পাকিয়ে গেছে। কিন্তু মনে মনে তার কিছুটা স্বস্তি আসে, যদি রুবির হাতের ছাপ পাওয়া যেত তবেই বা কেমন হত! কেস টা কোনদিকে গড়াত। রুমার দিকে তাকিয়ে দেখেন অঘোরে ঘুমুচ্ছে সে। কিন্তু রায়হান সাহেবের মনে প্রচণ্ড ছটফট। মেয়েটা কেন রাত হলে অমন করে খাটের উপর দাঁড়িয়ে এমন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, হিসেব মেলেনা কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতেই রাত পেরিয়ে গেল। সকাল সকাল থানায় চলে গেলেন রায়হান সাহেব।
“আফজাল, মার্ডার স্পটে সাজ্জাদ গিয়েছে?”
“জ্বি স্যার। সাজ্জাদ স্যার আর রহমান স্যার গ্যাছে”
রায়হান সাহেব ফোন বের করে সাজ্জাদ কে ফোন করলেন।
“হ্যালো সাজ্জাদ!”
“জ্বি স্যার”
“তুমি ঐ বাসায় গেছো?”
“জ্বি স্যার, আমি ওখানেই আছি এখন”
“খোঁজ নাও পুরো বিল্ডিঙে নয়-দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে কোন কোন ফ্ল্যাটে আছে আর সবার ডিটেইলস আমার চাই”
“জ্বি স্যার”
রায়হান সাহেব ফোন রেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একবার ডাক্তার শুভঙ্করের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তখনি ডাক্তার শুভঙ্করের ফোন এল।
“হ্যাঁ ডাক্তার শুভঙ্কর, আমি আপনার ওখানে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম মাত্রই”
“রায়হান সাহেব, একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে”
“কি? বলে ফেলুন”
“সালেহা বেগম কে মৃত্যুর আগে অচেতন করার ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছিল”
“ইয়েস! বলেছিলাম না আপনাকে? দেয়ার ইজ ডেফেনেটলি সামওয়ান যে এই মাস্টারপ্ল্যান করেছে”
“জ্বি”
“আর কোন তথ্য পেলেন কি?”
“এখন যেটা বলবো সেটাই বেশি চাঞ্চল্যকর”
“অত ভণিতা না করে বলে ফেলুন তো”
“সালেহার গলায় আরো একটি হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, আর সেটা রুবির সাথে ম্যাচ করেছে”
“বলেন কি? এটা কি করে সম্ভব?”
“আমিও বেশ হয়রান এ নিয়ে”
“আচ্ছা আমি আপনার সাথে দেখা করছি”
“জ্বি আচ্ছা”
ফোন রেখে রায়হান সাহেব দপ করে বসে পড়লেন। পুরো কেস টা এখন গোলমেলে হয়ে গেছে। এখন শেষ ভরসা সাজ্জাদ। রায়হান সাহেব দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। দুটোর দিকে সাজ্জাদ আর রহমান থানায় ফিরলেন। রায়হান সাহেব জরুরী তলব করলেন ওদের।
“জ্বি স্যার”
“সাজ্জাদ, খবর কি?”
“স্যার, নয়-দশ বছর বয়সী মেয়ে পুরো বিল্ডিঙে নেই। এর চেয়ে বড় আছে, ছোট ও আছে। কিন্তু এক্সাক এই কাছাকাছি এজের কোন মেয়ে নেই”
“আর কোন ক্লু?”
“সালেহা বেগমের সাথে একটা ড্রাগ গ্রুপের সাথে লিংক ছিল বলে অভিযোগ করেছে কয়েকজন। তারা সালেহা বেগম কে এই ব্যাপারে বেশ কবার প্রশ্ন করেছে, কিন্তু তিনি কর্কশ ভাষায় প্রতিবাদ করতেন বললো তারা। আর তিনি ড্রাগ এডিক্টেড ছিলেন বলেও অনেকের ধারণা”
“ইন্টেরেস্টিং। আর কিছু?”
“সালেহা বেগমের বাসায় প্রায়ই প্রচুর লোকের যাতায়াত ছিল, বেশিরভাগই ড্রাগ ডিলার বলেই ভাবে প্রতিবেশিরা”
“সালেহা বেগম ড্রাগ এডিক্টেড ছিলেন এমন কোন তথ্য তো ডাক্তার শুভঙ্কর দিলেন না”
“লোকজনের ধারণা তো ভুল ও হতে পারে স্যার”
“হুম সেটা ঠিক। আচ্ছা ঠিকাছে আমি দেখছি। আপাতত একটা কাজ করো, সালেহা বেগমের বাসা খুব ভালমত একটা তল্লাশি দাও, তন্ন তন্ন করে খোঁজো, একটা ছোট্ট ক্লু ও আমাদের কে খুনী পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করবে”
“জ্বি স্যার”
রায়হান সাহেব দ্রুত ডাক্তার শুভঙ্করের ল্যাবে রওয়ানা হলেন। যখন পৌঁছালেন তখন একদম দুপুর। ল্যাবে গিয়ে ডাক্তার শুভঙ্কর কে পাওয়া গেল না। তার এসিস্ট্যান্ট দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন।
“ডাক্তার সাহেব কোথায়?”
“উনি জরুরী কাযে বাইরে গেছেন”
পুলিশ কেস চলছে, এর মধ্যে কি এমন জরুরী কাজ তার পড়ে গেল সেটাই ভাবছেন রায়হান সাহেব। অবশ্য ব্যক্তিগত কাজ ও থাকতে পারে।
“কোথায় গেছেন কি বলে গেছেন?”
“রোজ যেখানে যান। প্রসপার ফার্মাসিউটিক্যালস”
“ও আচ্ছা”
রোজ রোজ যাওয়ার বিষয়টা রায়হান সাহেবের মাথায় ঢুকল না। তবে তিনি যেহেতু কাজে গেছেন, সেহেতু তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত না করাটাই শ্রেয় ভাবলেন তিনি। একবার বাসায় যাওয়ার দরকার, রুবি-সোহার খোঁজ নেয়ার দরকার। কে জানে আজ আবার কি বিপত্তি বাঁধিয়েছে।
বাসায় পৌঁছাতেই সোহা দৌড়ে এল। রায়হান সাহেব সোহা কে কোলে তুলে চুমু খেলেন। একটু দূরেই রুবি দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান সাহেব এগিয়ে গিয়ে রুবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রুবি হাসলো, খুব মায়াবী সেই হাসি, এই মেয়েটাকে কেমন যেন খুব মায়া লাগে রায়হান সাহেবের। মনে হয় যেন নিজেরই মেয়ে।
ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে রুবির রুমে গেলেন রায়হান সাহেব। একটা খাতায় কি যেন আঁকিবুকি করছে মেয়েটা। রায়হান সাহেবকে দেখেই হঠাত থমকে গেল। রায়হান সাহেব খুবই হতাশ হলেন, এই মুহূর্তে আসা উচিত হয়নি। রুবিকে অভয় দেয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন, স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন রুবির মাথায়। তারপর খাতা টায় চোখ বুলালেন। এলোমেলো আঁকিবুকি, একটা রুমের মত কিছু একটা আঁকা। সেই রুমে কিছু বিক্ষিপ্ত জিনিস, একটা মহিলা মেঝেতে পড়ে আছে এমনটাই দেখানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোথাও রুবি নেই।
“এখানে তুমি নেই কেন মা?”
রুবি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় রায়হান সাহেবের দিকে। যেন তিনি খুবই অন্যায় কিছু বলে ফেলেছেন। পরক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ে রুবি। রায়হান সাহেব খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে আসেন। কোন আর্টিস্ট কে দেখালে সে বলতে পারবে এই ছবি সম্পর্কে।
বিকেল বেলায় বের হয়ে আর্টিস্ট জাফর করিমের বাসায় গেলেন রায়হান সাহেব। বেশ কিছুক্ষণ তার সঙ্গে আলাপ হল। তিনি ছবিটি সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা দিলেন।
“দেখুন, ছবিটিতে মেয়েটিকে এজন্য দেখতে পাচ্ছেন না কারণ সে নিজের বাহ্যিক যেগুলো তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে সেগুলো দেখিয়েছে। নিঃসন্দেহে মেয়েটি খুবই মেধাবী। মহিলাটির পজিশন ও যেভাবে এঁকেছে তা হবে ছবির উলটো। অর্থাত সে ডাইমেনশন উলটে দিয়েছে। এটা তার মস্তিষ্কের কোন একটা ত্রুটি। আর সেটি আমি বুঝেছি দরজা দেখে। দরজার কবাটের দিকে সে হাতল এঁকেছে অর্থাৎ সে পুরো চিত্র টাই উলটো দেখেছে। মেঝেতে বেশ কিছু আঁকিবুকি রয়েছে। আমার ধারণা সে কোন তরল আঁকতে চেয়েছে, সেটা রক্ত হতে পারে বা যেকোন তরল”
“কিন্তু ভিক্টিমের কোন ব্লিডিং হয়নি, আর আমরা পৌঁছানোর পর সেখানে কোন তরল ও ছিলনা। দ্যাট মিনস সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। কি এমন তরল হতে পারে যেটা মুছে ফেলতে হল তাকে?”
“এবার সেটা তো আপনারাই ভাল বলতে পারবেন। আমি যতটুকু বুঝেছি ততটুকুই বলেছি”
“জ্বি, আপনাকে ধন্যবাদ”
রায়হান সাহেব জাফর করিমের বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা সালেহার ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। সেখানে তখনো সাজ্জাদ আর রহমান ইনভেস্টিগেশনে ব্যস্ত। সালেহা বেগমের বাসা তিনিও এক দফা চোখ বুলালেন।
“কি? কিছু পেলে?”
“না স্যার। কোন নমুনা ই মিলছে না। খুনী খুবই চালাক”
“এতটাও না। এই ঘরে যতগুলো ন্যাকড়া আছে সবগুলো সংগ্রহ করো আর ফরেন্সিকে পাঠাও। তবে ডাক্তার শুভঙ্করের ল্যাবে নয়। অন্য কোথাও”
সাজ্জাদ আর রহমান হা করে তাকিয়ে রইলেন রায়হান সাহেবের দিকে। রায়হান সাহেব দ্রুত পায়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলেন। রাতে তিনি বেশ কয়েকটি ফোন করলেন। রাত নটার দিকে একজন লোক একটি পার্সেল দিয়ে গেল রায়হান সাহেবের বাসায়। সেটা ছিল একটি মানুষের মুখের ছবি, শুধুমাত্র রোটেশন আর ডাইমেনশন চেঞ্জ করা।
ইতিমধ্যেই সাজ্জাদের ফোন এসেছে। সাজ্জাদ জানিয়েছে ন্যাকড়া গুলোর মধ্যে একটি তে কিছু মেডিসিনের আলামত পাওয়া গেছে আর পরীক্ষা করে জানা গেছে সেটি খুবই শক্তিশালী অচেতন করার মেডিসিন। এটি খুবই সিক্রেট একটি মেডিসিন যা বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ব্যবহার করা যায়না। আর এই মেডিসিন নামকরা কয়েকটী ফার্মাসিঊটিক্যাল কোম্পানির কাছেই আছে। যার মধ্যে অন্যতম একটির নামও বলল সাজ্জাদ। আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হচ্ছে রায়হান সাহেবের কাছে।
এবার শুধু শেষ পদক্ষেপ। রুবির রুমে গিয়ে রুবিকে ছবিটি দেখালেন রায়হান সাহেব। সাথে সাথে ভয়ে কুঁকড়ে গেল মেয়েটা, ইশারায় এই লোক সম্পর্কে খুব ভয়ংকর কিছু তথ্য দিল রুবি। যার অধিকাংশই বুঝতে পারলেন না রায়হান সাহেব, তবে এটুকু বুঝতে পারলেন এই লোকটি তার মায়ের হত্যার সাথে জড়িত এমন কিছুই বোঝাতে চেয়েছে রুবি।
পরদিন সকাল এগারোটায় ডাক্তার শুভঙ্করের ল্যাবে এসে উপস্থিত হলেন রায়হান সাহেব। রায়হান সাহেব কে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তার শুভঙ্কর।
“সেদিন রুবির সামনে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন কেন ডাক্তার সাহেব? চিনতে পেরে যাবে এই ভয়ে? বেচারী তো চিৎকার ও করতে পারেনা, কি করে বলবে?”
“মানে? কি বলছেন এসব?” আমতা আমতা করতে লাগলেন ডাক্তার শুভঙ্কর।
“এটিভেন নামের মেডিসিন তো একমাত্র প্রসপার ফার্মাসিউটিক্যালসে পাওয়া যায় তাইনা ডাক্তার বাবু?”
“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন, কিছু না জেনে শুনেই আমাকে আপনি ব্লেম করতে পারেন না”
“এই কেসটি ডাক্তার মাহফুজের ল্যাবে যাওয়ার কথা ছিল, আপনি আগ বাড়িয়ে কেস টি নিয়ে নিলেন”
“হুম তো? আমি এই কেস টা দিয়ে আমার ক্যারিয়ার উজ্জ্বল করতে চেয়েছি”
“সবই মেনে নিতাম। কিন্তু একটা কথা কি জানেন তো? খুনী যত চালাক ই হোক, কিছু না কিছু তো ফেলে যায় যেটা দিয়ে সে ধরা পড়বে। আপনি ও সেই ভুল টাই করে বসলেন। আপনার আইডি কার্ড টাই ফেলে এলেন”
“হাহা, এতটা বোকা আমি নই, আইডি কার্ড আমি নিয়েই যাইনি”
বলেই জিভ কামড়ালেন ডাক্তার শুভঙ্কর।
“ফেঁসে গেলেন ডাক্তার, ফেঁসে গেলেন। আমার আপনাকে কয়েকবার সন্দেহ হয়েছিল। প্রথম বার সন্দেহ হয়, যখন আপনি মিথ্যে বলেন আমাকে যে সালেহা বেগমকে কোনরূপ পয়জনিং করা হয়নি। আমার সন্দেহ তীব্র হয় যখন আপনি রুবিকে ল্যাবে আনার দিন মুখ ঢেকে রাখেন। আর আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যখন আপনি সালেহা বেগমকে সালেহা বলে সম্বোদন করেন। পরিচিত মানুষকেই মানুষ নাম ধরে ডাকে, অপরিচিত কে কখনো না”
ডাক্তার শুভঙ্কর মাথা নিচু করে বসে রইলেন। পুলিশের ঘেরাও এর মধ্যে আর কিছু করারও ছিলনা।
“আমাদের ড্রাগ ডিলিং এর গ্যাং ছিল। ঔষধের নামে ড্রাগ কেনা বেচা হত। প্রসপার ফার্মা এর একটি বড় অংশ এতে জড়িত। সালেহার বাসা ছিল আমাদের আড্ডাখানা আর স্টেশন। ড্রাগ সেখানেই রাখা হত, সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় পাচার হত। ভালই চলছিল, কিন্তু সালেহার মেয়ে রুবি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সালেহা এটাকে ড্রাগের ইফেক্ট বলে দাবি করে। আমরা অনেক বোঝাই, কিন্তু সে বোঝেনা। এক পর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে পড়ে সে। পুলিশে জানিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। আমাদের হাতে আর অপশন ছিলনা”
“বাহ! এরপর খুন করলে। আর রুবিকে ফাঁসানোর জন্য ভুয়া রিপোর্ট বানালে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না, প্রথমবার কেন বললে হাতের ছাপ রুবির না?”
“আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। হঠাত মনে হয়েছিল এই মেয়ে বিশেষ কিছুই করতে পারবেনা। কিন্তু পরে রিস্ক নেয়াটা ঠিক ভাবলাম না”
“চমৎকার ! কিন্তু আইনের হাতও অনেক লম্বা জানোতো? শুধু তুমি না, তোমার সব গডফাদার রাও এবার ধরা পড়বে”
ডাক্তার শুভঙ্করকে জেলে নিয়ে গেল পুলিশ। রাতে বাসায় ফিরলেন ওসি রায়হান সাহেব। সোহা আর রুবি দুজনকেই কাছে ডাকলেন, দুজনকেই আদর করে দিলেন। রুবিকে বললেন, “ধন্যবাদ মা, তুই অনেক সাহায্য করেছিস আমাকে” রুবি মুচকি হাসলো। রাতে বেশ আরাম করে ঘুমুতে গেলেন রায়হান সাহেব। কাল রুমা-রুবি-সোহা কে নিয়ে বেড়াতে যাবেন বলে ঠিক করলেন। রুমা কে দেখলেন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিনিও পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
(সমাপ্ত)
©somewhere in net ltd.