![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আপাতত স্বল্প করে গল্প লিখি কল্পলোকের
"নীলচুড়ি"
নীলা,
অনেকদিন পর তোমাকে লিখতে বসেছি। খুব একটা সময় হয়না আজকাল। কখনোবা সময় হলেও লিখিনা। তুমি পড়বেনা জেনেও কি করে লিখি বলো?
আজ পার্কে বসে ছিলাম, একটি মেয়ে তার প্রেমিককে বলছিলো আজ তার শখের নীল চুড়ি গুলোর একটি ভেঙে গেছে। তুমিও তো নীল চুড়ি খুব ভালবাসতে নীলা। আমার দেয়া নীল চুড়ি ই তুমি গ্রহণ করেছো শুধু, আর কিছুনা, আমার প্রেম ও না।
নীলা, আমার তো কোন দোষ ছিলনা, তোমার বাবা ই আমাকে জোর করেছিলেন, অনেক! যেদিন আমি তোমায় দেখতে গেলাম, তুমি মাথা নিচু করে বসেছিলে। আমি আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম তোমার দিকে বারবার, ভাবছিলাম, এতটা নিপুণ কোন নারী হয়! আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম, তুমি কবে একটু চোখ তুলবে আর আমি প্রেমে পড়ে যাবো। তুমি চোখ তুললে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম, আর তুমি ঘরভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ বলে দিলে আমাকে তোমার পছন্দ না। নীলা, সেদিন আমার খারাপ লাগেনি। তুমি সত্য বলেছিলে, আমি পছন্দ হওয়ার মত মানুষ আদৌ না। তোমার বাবা জেদ ধরলেন, এ বিয়ে হবেই, আমাকে খুব জোর করলেন। তার জোরাজুরির কারণ আমি ধরতে পারিনি, সেটা কি জেদ ছিল নাকি আমাকে তাঁর পছন্দ ছিল তা বুঝতে পারিনি।
নীলা, তুমি যেদিন আমাদের বাড়ি আসলে সেদিন একটুও কাঁদোনি, কেমন চুপ হয়ে গেলে। সেদিন তুমি যদি একটু কাঁদতে, সব অভিমান চলে যেত নীলা। কেন কাঁদলে না, কেন অভিমানের পাহাড় জমালে, সে পাহাড় আমি পাড়ি দিতে পারিনি, আজ অবধি। মনে আছে তোমার, আমাদের বিয়ের রাতে আমি তোমাকে নিয়ে লিখা একটি কবিতা তোমাকে শোনাতে চাইলাম। তুমি বললে তোমার ঘুম পাচ্ছে, বলেই শুয়ে পড়লে। আমি ভাবলাম, তুমি জেগে আছো, চোখ বন্ধ করে রেখেছো শুধু। আমি কবিতা পড়ে গেলাম, তুমি ঘুমুলে। সে রাতে আমি কেঁদেছিলাম নীলা, তুমি টের পাও নি। এরপর থেকে আমি আরো তিনটি রাত কেঁদেছি, শুনবে সেসব!
রোজ তোমাকে বলতাম, "চলোনা, কোথাও ঘুরে আসি।"
"না। ভাল লাগেনা।"
"ঘুরে আসলে ভাল্লাগবে।"
"কোথায়?"
"যেখানে তোমার মন চায়।"
তুমি কিছু বলতে না, চুপ হয়ে যেতে। আমি তোমার নিরবতায় উত্তর খুঁজে নিতে চাইতাম, পারতাম না।
তোমাকে নিয়ে আমি সাতান্ন টি কবিতা লিখেছিলাম জানো, একটি সম্পূর্ণ ডায়রি। সে ডায়রিটি তোমার চোখের সামনে রাখতাম অথচ নিজেকে নিজে বলতাম আমি লুকিয়ে রেখেছি। তুমি কখনো ডায়রির একটি পাতাও উল্টালে না। আমার ভালবাসার প্রতি তোমার এতটুকুও আগ্রহবোধ জন্মেনি কখনো নীলা? আমি যে তোমার দিকে এতটা প্রেমভরে তাকাতাম সেটিও তোমার পছন্দ হত না। এতটা বিরক্ত হতে আমার ভালবাসায়?
আমি রোজ বেরুনোর সময় জিজ্ঞেস করতাম, "কিছু লাগবে?", তুমি মাথা নাড়তে। কতবার জানার চেষ্টা করেছি তোমার পছন্দের কথা, তোমার প্রয়োজনের কথা, কখনো বলনি। একবার শুধু এটুকু বলেছিলে, "আমার নীল চুড়ি পছন্দ।"
আমি ব্যাগ ভর্তি নীল চুড়ি নিয়ে এলাম। তুমি উৎসাহ প্রকাশ করলে না, পরেও দেখলে না। সেদিন রাতেও আমি কেঁদেছিলাম নীলা, খুব কেঁদেছিলাম।
একদিন তুমি বললে, "আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবে?"
আমি খুব উৎসাহী হয়ে বলেছিলাম, "কোথায় যাবে বলো।"
"ইশানের কাছে।"
আমার মনের মন্দিরে একটি মাত্র প্রতিমার মত আমি তোমাকে রেখেছিলাম। আর তোমার মনে আমার একটুকু ঠাঁই হল না। বুকটা ফেটে গিয়েছিলো জানো? তবুও আমি হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলাম, "কবে যাবে?"
হঠাৎ তোমার মুখেও হাসি ফুটলো। বললে,"যখন তোমার সময় হয়।"
আমি সেই হাসিটুকুতে আমার হৃদয়ের ঘা প্রশমিত করেছিলাম নীলা। তুমি রোজ একবার করে বলতে, "কবে গো তোমার ছুটি?"
আমি হাসিমুখে বলতাম, "এইতো এই মাস শেষ হলেই।" তুমি আমার হাসিমুখ দেখে খুশি হতে, আড়ালের কান্না টা দেখতে না। আমি তোমাকে ইশানের কাছে নিয়ে গেলাম, ছেলেটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো। তুমি কেমন উৎফুল্ল ভঙ্গিতে তার দিকে ছুটে গেলে। হাত নেড়ে নেড়ে হাসতে হাসতে কত কথাই না বললে। আমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম, তোমার ঐ হাসির ভাগীদার আমি হতে পারলাম না নীলা। সেদিন রাতে তুমি বললে ছেলেটির কথা, তোমাদের প্রেমের কথা, আমি শুনলাম, কিচ্ছুটি বললাম না। তুমি বুঝলে না, তোমার মুখের প্রতিটা শব্দ কেমন করে মিছরির ছুরি হয়ে হৃদয়ে আঘাত করছে। সে রাতে আমি ঘুমাই নি নীলা, সারারাত কেঁদেছি। সে রাতেই শেষ কেঁদেছি, আর কখনো কাঁদিনি, পুরুষ দের কাঁদতে নেই। মনে আছে সেদিন তুমি বললে তোমাকে কেন ছেড়ে দিইনা আমি। আমি কিছু বলিনি, কি ই বা বলার ছিল আমার? এটা বলবো, যে তোমাকে ছাড়তে পারিনা? এটা বলবো যে তুমি আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা?
মনে আছে, তুমি ছাদে টবে ফুল গাছ লাগিয়েছিলে? সারা বাড়িতে তোমার বন্ধু বলতে ওরাই ছিল, ওদের সাথেই কথা বলতে তুমি। তুমি সারাদিন কথা বলতে, আর আমি সারারাত। ওদের বলতাম, "তোরা কত সৌভাগ্যবান জানিস? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি তোদের সাথে রোজ কথা বলে, তোদের আদর করে হাত বুলোয়। আমি যদি তোদের মত গাছ হতাম, তবে ওর একটু ছোঁয়া পেতাম, ওর মনের কথা শুনতে পারতাম, ওর হাসি দেখতে পেতাম, ওর কান্না দেখতে পেতাম! "
নীলা, মনে আছে সেই দিনটা আমাদের যেদিন শেষ দেখা? তুমি নীল শাড়ি পড়েছিলে আর আমার দেয়া চুড়ি। আমাকে এসে বললে, "কেমন লাগছে আমাকে?"
আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। খুব বেশি কষ্ট পেলে কিংবা খুব বেশি আনন্দ পেলে এমন হয়।
তুমি আবার জিজ্ঞেস করলে, "বলোনা, কেমন লাগছে?"
আমি বললাম, "তোমাকে নীলপরী লাগছে।" যদিও নীলপরী কোন বিশেষণ কিনা আমি জানিনা। তবে তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল যেটা কোন অভিব্যক্তি দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলাম তুমি নেই। তোমার কাপড়চোপড়, আসবাব কিছুই নেই। সব জায়গায় খুঁজলাম, পাগলের মত খুঁজলাম, তোমাকে কোথাও পেলাম না। টেবিলের উপর তোমার লিখা ছোট্ট একটি ফুটনোট ছিল। নীলা, তোমার কাছ থেকে আমি কথার ফুলঝুড়ি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শুধু একটি ফুটনোট ছাড়া আর কিছুই দিয়ে যেতে পারোনি। তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই তুমি নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলে।
নীলা, সেদিনের পর অনেক চিঠি লিখেছি তোমাকে। তুমি কখনো উত্তর দাও নি, হয়ত পড়োনি, কিংবা পড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছো। যে আগুনে চিঠি পুড়িয়েছো, সে আগুনে আমার হৃদয় কতগুলো বছর ধরে জ্বলছে জানো নীলা? সেদিন কেন তুমি চোখ তুলে তাকালে, নাহলে যে আমি বেঁচে যেতাম এই আগুনে পোড়ার থেকে।
নীলা, আজও হয়ত এই চিঠি টা পোস্ট করা হবেনা, হয়ত এটাও আগুনে পুড়িয়ে ফেলবো, আগের ত্রিশ টি চিঠির মতই। চিঠি পোড়ালে তো ছাই হয়ে যায়, আমার ভালবাসা কেন হয়না? আমার ভালবাসা পোড়ামাটির মত, যত পোড়াই, তত শক্ত হয়।
নীলা, আজ আমি আবার নীল চুড়ি কিনে এনেছি জানো? আমার বড্ড শখ ছিল, তোমাকে নিজের হাতে চুড়ি পরিয়ে দেব, মানুষের সব শখ কি আর পূরণ হয়!
আচ্ছা নীলা, আমার ভালবাসায় কি কমতি ছিল? একই কামরায় থেকেও আমাদের মাঝে শত আলোকবর্ষের দূরত্ব ছিল! এতটুকুও সে দূরত্ব ঘুচাতে পারলাম না। এ কি তোমার দোষ না আমার ব্যর্থতা?
নীলা, বয়স হয়েছে, বেশিক্ষণ লিখতে পারিনা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, পানি পড়ে চোখ দিয়ে, হাত ব্যাথা হয়। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বোধহয়। বয়স বাড়তে থাকলে এসব হয়ই। তুমি কেমন আছো? আমাকে তোমার মনে পড়ে কখনো? তোমার কি আর নীল চুড়ি চাই, তবে বোলো। আমি কিনে রেখেছি, পার্সেলে পাঠিয়ে দেবো। আমি ভেবে নেব, ঐ নীল চুড়িই আমার হৃদয় আর সেটা তুমি গ্রহণ করেছো।
(হুমায়ুন স্যারের 'কল্যাণীয়াসু' গল্প হতে অনুপ্রাণিত।)
©somewhere in net ltd.