নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কবি কাজী নজরুল এসলাম এর বাংলা সাহিত্যে আগমন ধুমকেতুর ন্যায়। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে তিনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা ধারণ করার সময় এখন পর্যন্ত বাংলার মানুষের আসে নি। তিনি ছিলেন এসলামের রেনেসাঁর কবি। বৃটিশদের গোলামীতে এককালের বীরের জাতি যখন লুটিয়ে পড়েছে তখনো তিনি স্বপ্ন দেখতেন এসলামের উত্থানের। তার চেতনায় ভাসত প্রকৃত এসলামের শৌর্যবীর্য। কিন্তু তার ভার সইতে না পেরে কূপমন্ডুক ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা তার বিরোধীতা করত। কিন্তু এসলামের পুনরুত্থানকারীদের জন্য, আগামী দিনের বীরদের জন্য তিনি সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য অনুপ্রেরণার গান ও কবিতা। তিনি হয়তো তার জীবদ্দশায় এসলামের উত্থান দেখে যেতে পারেন নি, কিন্তু এ উত্থানের বীজ রোপণ করে গেছেন কবিতা ও গানে।
এসলামের গুণগান, কথা বিদ্যমান থাকায় বর্তমান নামধারী মোসলমানগণ বিভিন্ন উৎসব, আয়োজনে, অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তার কবিতা ও গানের উদ্ধৃতি প্রদান করে। যদিও তারা এর মর্মার্থ কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই সন্দেহ অমুলক নয়। ‘খুশির ঈদ’ গানটিই তার বড় প্রমাণ।
তার লেখা জাগরণের গান, যুদ্ধের গান, বিদ্রোহের গান, প্রেমের গান, উৎসবের গান, নদীর গান, পাখির গান, প্রকৃতির গান, ভালোবাসার গান, দুঃখ ও বিরহের গান আপনা আপনি পরিস্থিতি অনুসারে মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়। আলোচ্য গানটি তেমনি ঈদুল ফেতর উপলক্ষে সারা বাংলায় ও বাংলা ভাষাভাষী পৃথিবীর সকল জনগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে, দোকানে, রাস্তায়, অফিসে এক কথায় সর্বত্র বেজে ওঠে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই গান তারা শোনে, গায়- কিন্তু এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে না। এ গানটি একদিকে যেমন উৎসবের গান, তেমনি বর্তমান সময়ে এই উৎসবের অর্থহীনতাও এই গানে উচ্চারিত হয়। যেমন প্রথম দুটি লাইনই ধরা যাক।
মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।
লাইন দুটিতে ঈদকে খুশির ঈদ বলা হচ্ছে সত্য, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনটির মানে যে এই জাতি বুঝতে পারে নি, তা এক নিরেট সত্য। এ জাতি মনে করছে এখানে ব্যক্তিকে আনন্দে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এখানে নিজেকে অপরের স্বার্থে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ব্যক্তিগত আনন্দে বিলিয়ের দেওয়ার ধারণা থেকে এ জাতি আজ সত্যিই নিজেদেরকে বিলিয়ে দিচ্ছে ব্যক্তিগত আনন্দ ও ভোগে। এমনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে যে এসলামের যে দিক নির্দেশনা আছে, যে সংস্কৃতি আছে তার বাইরে বিজাতীয় চিন্তা চেতনা, ধারণা, রীতিনীতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে। এ কাজে তারা নিজেদের বিলিয়ে দিতে গিয়ে ছাপ রাখছে জঘন্যতম কাজে। তাদের অবস্থা আজ এমন হয়েছে যে তারা দেদারসে টাকা পয়সা খরচ করে ঈদ উপলক্ষে কিনছে পতিতার নামে নাম রাখা পোশাক।
“তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ”
দে যাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিঁদ।।
কি সাংঘাতিক প্রতারণা! “ঈদ এলে তারা যে গানটি প্রতিনিয়ত বাজায় সেই গানে বলা যাচ্ছে সোনা দানা বালা খানা সবই আল্লাহর রাহে, আল্লাহর জন্য। সেই তারাই সোনা দানাকে নিজেদের জীবনের একমাত্র চাওয়া, একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। সামান্য টাকা পয়সার জন্য তারা খুনাখুনি করছে। ভাই ভাইকে হত্যা করছে, সন্তান পিতাকে হত্যা করছে!
অন্যদিকে যাকাত হয়ে গেছে প্রহসনের দান খয়রাত, রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার, লোক দেখানো এবাদত। অথচ সেই যাকাত আদায় এবং বিলি করার সিস্টেম একমাত্র রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসলাম না থাকায় এখন এর দায় সারা হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। যাকাত মানেই আজ গরীবের সাথে দানের নামে প্রহসন। যাকাত সংগ্রহ করতে গিয়ে কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যে ভিড়ের ঠেলায়, পায়ের তলায় পড়ে নিহত হয়েছে তার হিসেব নেই। তারপরেও কথিত সেই যাকাত ফেতরার লুঙ্গি শাড়ীগুলো এত নিুমানের হয় যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাপড়ের মানও তথৈবচ। যাকাত, সাদকা ও অন্যান্য দান খয়রাতের মালামাল, টাকা পয়সা প্রকৃত পক্ষে মো’মেনরা দেয় আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু বর্তমান দাবীদার মোসলমানদের, মো’মেনদের দান খয়রাতের পরিহাস দেখে করুণা জাগে! তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে তাদের সব চাইতে নিকৃষ্ট এবং উচ্ছিষ্ট দ্রব্যাদি। তাদের আচরণে মনে হয় আল্লাহ তাদের এই উচ্ছিষ্টের জন্য কাঙ্গাল।
তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।।
কবি এ লাইন দুটিতে মো’মেনদের বলছেন সেই ঈদগাহে নামায পড়তে যেখানে মো’মেনগণ এসলামের পবিত্রতম এবাদত, সর্বোৎকৃষ্ট আমল, জেহাদ করে গাজী কিংবা শহীদ হয়েছেন। দুনিয়ার বুকে এর চাইতে আর পবিত্রতম স্থান আর কী হতে পারে- যেখানে আল্লাহর রাহে মো’মেনগন উৎসর্গ করেছেন নিজেদের প্রাণ! আজকের মুসলমান জেহাদে যাবে দূরের কথা, জেহাদের নাম শুনলে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কোথাওবা কখনো যদি কোন সন্তান মায়ের কাছে জেহাদের অনুমতি চায়, তখন মা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর শহীদ হলে তো খুশি না হয়ে বরং কান্নাকাটি করে আকাশ বাতাস ভারি করে তোলেন। আজ সেই জেহাদও নেই, সেই ময়দানও নেই, শহীদ নেই, গাজী নেই। তাই এই খালি মাঠে মরা মুসলমানদের ঈদের নামায পড়ার ধুম ধাম করে কি লাভ?
অথচ প্রকৃত এসলামের যুগে মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে যুদ্ধের সাজে সাজিয়ে দিতেন। জীবিত ফিরে না আসার জন্য দোয়া করতেন। কখনো যদি সন্তান জেহাদের ময়দান হতে শহীদ না হয়ে জীবিত ফিরে আসত, তখন তাদের তিরস্কার করা হোত।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল এসলামে মুরিদ।।
দলাদলি, হানাহানি, নানা মাযহাব আর ফেরকায় বিভক্ত এ জাতি আজ শতধা বিচ্ছিন্ন। আল্লাহর রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী তেহাত্তর ফেরকাকেও এ জাতি আজ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ভৌগোলিক বিভক্তি। বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, আরবী মুসলমান নামে এরা পরিচিত। এক আল্লাহ, এক এসলাম, এক কোরানে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের ঐক্যের কোন যোগসূত্র নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তে তারা বিজাতির হাতে মার খেলেও একে অপরের সাহায্য না করে বরং উস্কানী দেয়। তাই বিজাতিরা এ জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে কিভাবে? কিভাবে তাদেরকে এসলামে মুরিদ করা যায় যখন তারাই সর্বদিক দিয়ে পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট জাতি হিসেবে পরিচিত? তাই এ জাতির আবার ঈদ উৎসব কিসের?
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী
সেই গরীব মিসকিন দে যা কিছু মুফিদ।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে আজ সারা পৃথিবী জোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। তাই একটা বিশাল অংশ মানুষের সারা বছরই রোজা থেকে দিন কাটাতে হয়। সারা বছরই এদের রোজা।
ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনী তওহীদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হযরত, হয় মনে উমীদ।।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারের ঈদেও হয়তো প্রতি ঘরে ঘরে এ গানটি উচ্চস্বরে বাজবে। কিন্তু কতটা বুঝবে তারা এর মানে? জাতি আজ তওহীদ বলতে বোঝে ‘আল্লাহ একজন আছেন’। কিন্তু তার হুকুমের প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়ার ধারে কাছেও এরা নেই। আল্লাহর হুকুম থেকে এরা নিরাপদে পলায়ন করে। নিজের দীনকে বিসর্জন দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করে উদারতা দেখায়। অথচ জাতীয় জীবনে চলে বিজাতীয় আইন। আর নামায রোজা করেই ভাবে তারা তওহীদে আছে। তওহীদের থাকার একটি নমুনা কবি তুলে ধরেছেন এভাবে, তশতরীতে যেভাবে অতিথিকে শিরণী দিয়ে হৃদয় উজাড় করে আপ্যায়ন করেন মেজবান, ঠিক তেমনি নিজের আত্মাকে, মাল ও জানকে আল্লাহ রসুলের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই সে দান গৃহীত হবে।
তোরে মারল ছুঁড়ে জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরি মসজিদ।
অন্য জাতির প্রতি এসলামের আহ্বান হচ্ছে তোমরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর দেওয়া আইনকে বাদ দিয়ে অন্যায় অবিচারে ডুবে আছ। তোমাদের সামনে শর্ত তিনটি। তোমরা আল্লাহর দীনকে মেনে নাও। তাহলে আমরা ভাই ভাই হয়ে যাব। তোমাদের মাঝে আমাদের মাঝে কোন ব্যবধান থাকবে না। যদি তা না কর তাহলে তোমরা তোমাদের ধর্ম, তোমাদের বিশ্বাসে অটল থাক- তবে শাসন ক্ষমতা আমাদের হাতে দিয়ে দাও। আমরা তোমাদের নিরাপত্তা বিধান করব। আর যদি তোমরা তাতেও রাজী না হও তবে আমাদের সাথে লড়াই করতে তৈরী হও। কিন্তু মানুষের প্রকৃতিই এমনই যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা যুদ্ধেই নেমেছে। কিন্তু মো’মেনগণ বিজয়ী হয়ে তাদের উপর প্রতিশোধ না নিয়ে বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমা করে দিয়েছেন।
কিন্তু বতর্মান মুসলিম জাতি অন্যদের কি ক্ষমা করবে, তারা নিজেরাই অপরের করুণা ভিক্ষা করে। শুধুমাত্র করুণা করে বাঁচতে দেওয়াতেই তারা খুশি। আরবের বুকে যে এসলামের উত্থান ঘটেছে সেই আরবের পাশে ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজেদের দেশে ইহুদীবাদী ইসরাইলের করুণা ও লাঞ্ছনা নিয়ে বেঁচে আছে। অথচ আরবরে বাদশাহরা, আমীররা কোটি কোটি ডলার খরচ করে মসজিদ বানাচ্ছেন, ক্বাবাকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছেন। কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছেন প্রমোদ ভ্রমণে। কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এসলামের জন্য তাদের ন্যূনতম ত্যাগ নেই, সংগ্রাম নেই। নিকৃষ্ট সম্পদ দান-খয়রাত করে আল্লাহর চোখকে ধোঁকা দেওয়ার পাঁয়তারা। সারা দুনিয়ায় যাদের গোলামী, সেই গোলাম জাতির আবার ঈদ উৎসব! তাই কবির ভাষায় এক শক্ত আঘাত ছাড়া এই মুর্দা মুসলিম নিঁদ টুটবে না।
©somewhere in net ltd.