নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আতাহার হোসাইন:
দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তার মেয়াদের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। বর্তমান সরকারের শেষভাগটা ছিল একদিকে দুর্দান্ত গতিময়, বহু ইস্যুর জন্মদাতা অন্যদিকে ইস্যুগুলোকে দ্রুততার সাথে সামাল দেওয়ায় পরিপূর্ণ। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে বলতে হয় তাদের সাফলতা-ব্যর্থতা দরিদ্র দেশের অন্য সরকারের মতই গতানুগতিক। তবে শেষ চার বছরের মাথায় এসে সার্বিক দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় না আসার মত কোন যুক্তি নেই। কারণ বিরোধী দল এমন কিছু করতে সক্ষম হয় নি যে মানুষ তাদের ক্ষমতায় আনতে চাইবে। আবার বিএনপি’র সা¤প্রতিক অতীতও অতটা ভাল নয়। কিন্তু শেষ বছর এসে হঠাৎ ক্ষমতাসীন দলটি মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে। জরিপে দেখা যায় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অধিকাংশ জনমত চলে গেছে বিরোধী দলের পাল্লায়। প্রথমে প্রবল আত্মবিশ্বাসের কারণে আওয়ামী লীগ একটি দৈনিকের করা জরিপকে উড়িয়ে দিলেও, পরে তার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশা ব্যক্ত হয়েছে “উন্নয়ন করে কী করবো? এত উন্নতির পরেও মানুষ আমাদের ভোট দেয় না” বাক্য দিয়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসা একটি রাজনৈতিক দল এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে জনপ্রিয়তা এত দ্রুত তলানীতে গিয়ে ঠেকল? এর কারণ হয়তো আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের অনেকেই জানেন না কিংবা জানলেও মানতেও চাইবেন না। কিন্তু আমরা পথে ঘাটে চলি, চায়ের দোকানে বসি, বাসের যাত্রীদের সাথে কথা বলি এক কথায় সাধারণ মানুষের সাথে মিশি। সংবাদ মাধ্যমের সাথে জড়িত থাকায় ঢাকার বাইরের রাজনীতি সম্বন্ধেও খবর রাখতে হয়। আমরা জানি, আওয়ামী লীগকে নিয়ে মানুষ কি বলছে আর কী করছে। আমরা দেখি প্রতিপক্ষের গোঁফে তা দেওয়ার দৃশ্য। তাদের কথা একটাই, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে একবার সরুক! এবার ৭৫’র চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হবে তাদের।’ ‘৭৫ পরবর্তীতে দীর্ঘ ২১ বছর পর দলটি সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা ত্যাগের সাথে সাথে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ভাগ্যে যা ঘটেছিল এবারে তার চেয়ে বহু বেশি দুর্গতি অপেক্ষা করছে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। গত কয়েকদিন আগে আরটিভি’র একটি টকশো’তে ঠিক এই কথা বলেই আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সমর্থকদের সাবধান করে দিয়েছেন নিউ এজ সম্পাদক জনাব নুরুল কবীর। তিনি বলেছেন- ‘আগামীবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে না তখন তাদের অবস্থা কি হবে তা তাদের ভেবে দেখা দরকার।’ কারণ, আওয়ামী লীগের সাথে সাথে তাদেরও আত্মহত্যা ঘটে যাবে। একথা মনে রাখতে হবে যে নুরুল কবীরদের মত যারা দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সাথে জড়িত এবং স্বভাবতই রাজনীতি সচেতন, তাদের বিশ্লেষণ উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। জনাব নুরুল কবীর একথাও বলেছেন যে, তার কাছে অন্তত ডজন খানেক মন্ত্রী এবং উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিকগণ জিজ্ঞাসা করেছেন আসলে আওয়ামী লীগের গতি প্রকৃতি কোন দিকে, কি হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ভাগ্যে? অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপিরাও জানেন না তাদের যাত্রা কোন দিকে। বিগত সময়ে তাদের বিপরীতমুখী বক্তৃতা বিবৃতি থেকে এটি বার বার প্রমাণিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এক কথা তো তথ্যমন্ত্রী বলেছেন তার বিপরীত কথা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এককথা তো আইনমন্ত্রী বলেছেন আরেক কথা। শেষ পর্যায়ে এসে আওয়ামী লীগ খেই হারিয়ে ফেলেছে, তাল গোল পাকিয়ে ফেলেছে এমন রিপোর্ট বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারংবার উঠে এসেছে। বিশেষ করে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবির পর এই চিত্রটি মারাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের এই অবস্থার মৌলিক কারণ তিনটি: আওয়ামী লীগের এই পতনের পেছনে মৌলিক কারণ তিনটি বলে আমি মনে করি। এই তিনটি কারণ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হয়তো এই নিবন্ধের আকার একটু বড় হয়ে যাবে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টির গুরুত্ব অনুসারে আমাকে তাই করতে হবে। পাঠককে মনে রাখতে হবে আমি এটি কোন বিনোদনমূলক লেখা লিখছি না যে এটি সু-পাঠ্য রচনা হবে, এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেলবেন। এটি একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা এবং যারা রাজনীতির সাথে জড়িত তাদেরকে উদ্দেশ্য করে লেখা। আশা করি এটি দিশেহারা জাতির দিক নির্দেশনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ফ্যাক্টর-১: ধর্মীয় ইস্যু: একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে ৯১ পরবর্তী যে কয়টি সরকার পরিবর্তীত হয়েছে তার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যারা জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তার পেছনে মূল কারণ ছিল দুর্নীতি। অর্থাৎ দুর্নীতিই ছিল একমাত্র মাপকাঠি যার উপর ভিত্তি করে তাদের জয় পরাজয় নির্ধারিত হতো, সরকার পরিবর্তন হতো। স্বাভাবিকভাবে একটি সরকার নির্ধারিত পাঁচ বছর পার করলে তাদের সা¤প্রতিক দুর্নীতির স্মৃতিটাই সাধারণ মানুষের মনে দগদগে হয়ে থাকে। যার কারণে দ্বিতীয়বারের মত কোন সরকারকেই আর তারা ফিরিয়ে আনে না। অন্যদিকে পাঁচ বছর আগে অনুরূপ দুর্নীতিবাজ একটি সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসন ভুলোমনা বাঙ্গালীর মগজ থেকে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে। যার কারণে সা¤প্রতিকদের চেয়ে পুরনোরাই তাদের ভোট পেয়েছে। এছাড়া অবশ্য তৃতীয় কোন পথও সাধারণ মানুষের সামনে খোলা নেই। তাই আমরা অতীত থেকে দেখতে পাই একটি সরকার পর পর দ্বিতীয়বার আর ক্ষমতায় আসতে পারে নি এবং একটি টার্ম গ্যাপ দিয়ে পূর্ববর্তী দলটি ক্ষমতাসীন হতে পেরেছে। কিন্তু এবারে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। আগে দুর্নীতি কম আর বেশি একটি ফ্যাক্টর হলেও এবার আর দুর্নীতি বিবেচ্য বিষয় নয়। মানুষ ধরেই নিয়েছে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করবেই। কেউ কম আর কেউ বেশি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে অন্য জায়গায়। এবারে ক্ষমতাসীন দলটি অন্যান্য বারের ন্যায় পরাজয় মেনে নেওয়াতেই শেষ নয়। তারা সংখ্যাধিক্যের জোরে সংবিধানে পরিবর্তন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে জল এতটাই ঘোলা করে ফেলেছে যে তাদের ‘এক্সিট ওয়ে’টা নিরাপদ নয়।
এর পেছনে মৌলিক ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়- ধর্মীয় অনুভূতি। প্রথমত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান, এর উদ্যোক্তা কথিত ‘নাস্তিক’ এবং ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয়, সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত কথিত ‘থাবা বাবা’র হত্যাকাণ্ড এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার লাশ দেখতে যাওয়া এবং তাকে ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যাদান, দৈনিক আমার দেশ কর্তৃক বিচারপতিদের আলোচিত স্কাইপ কেলেঙ্কারী ফাঁস, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগকে জনতার কাছে প্রমাণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আওয়ামী লীগ ইসলাম বিদ্বেষী সরকার এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের পৃষ্ঠপোষক, ধর্ম তাদের কাছে নিরাপদ নয়। সর্বশেষ শাপলা চত্ত্বরে শাহবাগ আন্দোলনের হোতাদের নেপথ্য নায়ক গুটিকয় নাস্তিক এবং থাবা বাবার ব্লগে ইসলাম এবং রসুলাল্লাহকে অবমাননার প্রতিবাদ এবং ১৩ দফা দাবি নিয়ে শাপলা চত্ত্বরে আগত হেফাজতী কর্মীদেরকে রাতের আঁধারে পুলিশী হামলার মুখে উচ্ছেদ ঘটনা আওয়ামী লীগের মুখে গভীর কালিমা লিপ্ত করে দিয়েছে। শাপলা চত্ত্বরের এই উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে নানা মহলে রয়েছে নানা গুজব। অভিযানে আহত নিহত নিয়ে রয়েছে নানা মত। সঠিক কোন তদন্ত না হওয়ায় এই গুজব ডালপালা ছড়িয়ে বিস্তার করেছে দেশে এবং দেশের বাইরে।
এমতবস্থায় আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে যতই ধর্মপ্রাণ বলে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করুক না কেন, কিছুতেই তারা মানুষকে তা বিশ্বাস করানোর আপাততঃ কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যতই উল্ল্যেখ করুন না কেন, তিনি ঘুম থেকে ফজরে উঠে কোর’আন পড়েন, নামাজ পড়েন-এ নিয়ে বিপরীতমুখী প্রচার-প্রচারণাও কম নয়। প্রচার-প্রচারণা এমনভাবে হয়েছে যে, জনগণ আওয়ামী লীগকে ইসলামের শত্র“ বলেই ধরে নিয়েছে। এমতবস্থায় আওয়ামী লীগ মুখে যতই ইসলামের অহিংস বাণী আর সুন্দর সুন্দর কথা বলুক না কেন, বিরোধীপক্ষ এটাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই করা হচ্ছে বলে জোরে শোরে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছে। আবার তরিকত ফেডারেশন বা অন্য আরো কয়েকটি ধর্মীয় দল দ্বারা প্রচারের চেষ্টা করলেও বৃহত্তর দলগুলি তাদেরকে ওলামায়ে ছুঁ অর্থাৎ ভাড়াটিয়া আলেম বলে জনগণকে বোঝাচ্ছেন। এতে আওয়ামী লীগের কোন লাভ হচ্ছে না বলেই মনে হয়। এতে আওয়ামী লীগের শরীরে যে এসলাম বিদ্বেষী ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দূর হবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে এদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ ইসলামে বিশ্বাসী। ধর্মীয় কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ দুর্বল হলেও ইসলামের বিপক্ষে কাউকে কথা বলতে দেখলে তারা জ্বলে উঠে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন অপরাধী চরিত্রের মুসলমানও তার ধর্ম এবং রসুলের অবমাননা মেনে নেয় না। দীর্ঘ ১৪০০ বছর পরও যখন ইসলাম নিভু নিভু করছে, মুসলিম জাতি এক কঠিন ক্রান্তিকাল পার করছে, শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেতর এবং বাইরে থেকে শক্তি হারাচ্ছে ঠিক তখনও তারা আল্লাহ, রসুল এবং কোরআনের অবমাননা মেনে নেয় না। বরং এর চাইতে তাদের নিজেদের জীবন উৎসর্গ করাকেই শ্রেয়তর মনে করে। ১৪০০ বছর যাবত তাই করে আসছে। সা¤প্রতিক স্যাম বাসিল কর্তৃক ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ নামে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানব কুলের মুকুটমনি শেষ রসুলকে চিত্রায়িত করে তাঁর পবিত্র জীবনকে যেভাবে অবমাননা করেছে তার প্রতিবাদে বহু মানুষ জীবন দিয়ে দিয়েছে। পিছিয়ে পড়া দেশ আফগানিস্তানের কোন এক ভূ-স্বামী তার সমুদয় সম্পত্তির বিনিময়ে স্যাম বাসিলের মাথা চাওয়ার নজিরও রয়েছে। অথচ জনগণকে সহজেই উত্তেজিত করার জন্য কথিত নাস্তিকদের এসলাম বিদ্বেষী বক্তব্যগুলো এমনভাবে উত্থাপিত হয়েছে যে, মানুষ ধরেই নিয়েছে এ কাজে বুঝি আওয়ামী লীগের হাত রয়েছে। বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের আগামী বার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে এখন এই ফ্যাক্টরটিই কাজ করছে। এতে করে আওয়ামী লীগকে বিদায় দিয়ে কাকে লাভবান করা হচ্ছে তা তারা চিন্তা করবে না। জামায়াতে ইসলামী এই ধর্মীয় ইস্যুকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে যাওয়া নেতাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ফ্যাক্টর-২: দুর্নীতি ও পাঁচ বছরের অসফল দিকগুলো: আগেই বলেছি সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে প্রচলিত সিস্টেমে ক্ষমতায় যারা যাবে তারা দুর্নীতি করবেই। হতে পারে সেটা কম আর বেশি। যে তুলনামূলকভাবে কম করবে সে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যাবে। এখানে দুর্নীতি ও পাঁচ বছরের ব্যর্থতাকে দ্বিতীয় ফ্যাক্টর হিসেবে তুলে ধরছি এই জন্য যে খুচরা এক আনা মিলেই কিন্তু ষোল আনা হয়, টাকা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় দুর্নীতি ও অযোগ্যতা প্রধান ফ্যাক্টর হলেও ধর্মীয় ইস্যু এবং আবেগ প্রথম তালিকায় উঠে যাওয়ায় স্বভাবতই এটি দ্বিতীয় তালিকায় নেমে যায়। ব্যর্থতার তালিকায় প্রথমেই যুক্ত হবে বড় বড় কয়েকটি দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারী। এর মধ্যে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, পদ্মাসেতু, ডেসটিনি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রেলের ঘুষের টাকা নিয়ে পিএস ধৃতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
ফ্যাক্টর-৩: ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি (Geo-political Issue): সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এখন পৃথিবীব্যাপী। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই প্রকট যে তারা চাইলে পৃথিবীতে যা ইচ্ছা তা করতে সক্ষম। এ জন্য তাদের সামরিক শক্তি, প্রচার মাধ্যম, প্রভাবিত করার মত কূটনৈতিক যোগ্যতা, গোয়েন্দাদের তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি অর্থাৎ সর্ব দিক দিয়ে তারা পরিপূর্ণ মাত্রায় সক্ষম। তারা চাইলে যে কোন দেশকে যে কোন সময় পথে বসিয়ে দিতে পারে, সামরিক হামলা করে পর্যুদস্ত করে দিতে পারে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ইত্যাদি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসকল কাজের বৈধতা আদায়েও তাদের বলয়াধীন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কোন অভাব নেই। বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তাদের সে শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার করে নেয় নি। তারা মিত্রতা করেছে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশি এবং এশিয়ার বুকে নব উদীয়মান শক্তি ভারত ও রাশিয়ার সাথে।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই বঞ্চনাকে স্মরণ করে আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলে নি। অপরদিকে ভারত ভাগ হওয় থেকেই অর্থাৎ জন্মগতভাবে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে শত্র“তা বিদ্যমান। আবার চীনের সাথে ভারতের রয়েছে আঞ্চলিক আধিপত্য এবং সীমান্ত নিয়ে সমস্যা। শত্র“র শত্র“ হিসেবে পাকিস্তান এবং চীনের রয়েছে স্বার্থগত বন্ধুত্ব। আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী হওয়ায় বাংলাদেশের অপর জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপি বন্ধুত্ব করেছে চীন-পাকিস্তানের সাথে। ভূ-রাজনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে আছে যে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক সাম্রাজ্যবাদী দেশেরই লোলুপ দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবার চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের চলমান সংকটে কে কি ভূমিকা রাখবে তাই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্য দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। ভারত পক্ষাবলম্বন করছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্র পক্ষাবলম্বন করছে বিরোধী জোটের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমতাসীন দলটির বিপক্ষে যেতে বাধ্য করেছে সম্ভবত গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূস প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে যতই সুদখোর, মহাজনী ব্যবসায়ী বলে আখ্যা দিন না কেন, এই কথা দেশীয় বাজারে চললেও আন্তর্জাতিক বাজারে মোটে চলবে না। আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সুদের প্রসার ঘটিয়ে গরীব দেশের অর্থকে পুঞ্জিভূত করাকেই সমর্থন দেবে এবং দিচ্ছে। আর সেই দৌঁড়ে এদেশীয় প্রতিনিধি হিসেবে ড. ইউনূসরাই সবচেয়ে এগিয়ে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার সাথে রয়েছে তাদের গভীর সখ্যতা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারংবার একথা বলা হয়েছে যে, মার্কিন প্রভাবাধীন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন উঠিয়ে নেওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ড. ইউনূসই। আবার দেশীয়ভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ সদস্য এদেশেরই ভোটার। আগামী নির্বাচনে যে তারা তাদের আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেনা তার নিশ্চয়তাও আওয়ামী লীগকে কেউ দেয় নি। বরং হুমকিই দিয়েছে। তারা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করলেও তারাও ভোটের নির্বাচনে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি আগেই বলেছি এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই বাড়তে বাড়তে বৃহৎ হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হলে যা হবে: উদ্বেগের কারণ হচ্ছে এই যে আগামীবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না গেলে আওয়ামী লীগ গত পাঁচ বছরে প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে যেভাবে দমনপীড়ন করেছে তার শোধ তুলতে বিপক্ষ দলগুলো কিছুতেই দেবে না তারা। ২০০১ সালের ক্ষমতা ত্যাগ পরবর্তী ইতিহাস আওয়ামী লীগের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে ফাঁসির আদেশগুলো জামায়াতকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে। আদালতের রায়ের কারণে জামায়াত আগামীবার নির্বাচনে অংশগ্রহণও করতে পারবে না। অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত ক্ষমতাহীন অবস্থায় আওয়ামী লীগের উপর কঠিন প্রতিশোধ নেবে এটা একটা সাধারণ কথা। এতে দোসর হিসেবে জামায়াত পাবে বিএনপি এবং হেফাজতে ইসলামকে (শাপলা চত্ত্বরের শোধ নিতে)। রাজপথসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর হামলার মধ্য দিয় ইতোমধ্যে তা ফুটে উঠেছে। প্রশাসনিক সহযোগিতা আওয়ামী লীগের উপর থেকে উঠে গেলে কী হবে তাও সাধারণভাবে অনুমেয়। তবে আওয়ামী লীগও যে বসে থাকবে তা নয়। আওয়ামী লীগ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি সংগঠিত। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী। আর এই দুই শক্তির সংঘাত বাধলে সেটা বিরাট লড়াইয়ে পরিণত হবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের স্থিতিশীলতা। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানদের সা¤প্রতিক বক্তব্য থেকে আশা করা যায় পাশ্ববর্র্তী এই প্রতিবেশী দেশটি আওয়ামী লীগের সমর্থনে কাজ করতে পারে। কেননা ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগিতার জন্য ভারত তৈরি ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়েছিল।
আর যদি শেষ পর্যন্ত তাই হয় তবে দেশে একটা গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এ সময় বর্তমান বিরোধী জোট সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-পাকিস্তান ব্লকটির। ইউনূস ফ্যাক্টর, বিশ্বব্যাংক ইস্যু ও জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল আখ্যা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। চীনও আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থে নিজেদের ভূমিকা রাখায় বিশেষভাবে আগ্রহী হতে পারে। কারণ, এটা চীনের আওতাধীন এলাকা এবং শত্র“রাষ্ট্র ভারত এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন কথা হচ্ছে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকগণ কী বিজ্ঞচিত ও উভয় পক্ষের জন্য সুবিধাজনক পদক্ষেপ নেবেন তাই দেখার বিষয়। লাঠি না ভেঙ্গে সাপ মারার কোন সুবিধাজনক অর্থাৎ কম ক্ষতির দিকটি গ্রহণ করাই তাদের কাছে কাম্য।
সূত্র: দৈনিক নিউজ ১৭ নভেম্বর
©somewhere in net ltd.