নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেবিফেস

স্বপ্ন ভাঙ্গি, স্বপ্ন গড়ি,স্বপ্নে আমার বসত বাড়ি।

বেবিফেস › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্ন চারিণী(গল্প)

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:১২



আমার দাদা যে আমার আপন দাদা, ছোটবেলা এটাই বুঝতাম না। তখন ভাবতা্‌ম, উনি আমার চাচাত ভাই-বোনদের সূত্রে আমাদেরও দাদা। অনেক বড় হয়ে জানলাম, দাদা আমাদের আপন দাদা অর্থাৎ আমার বাবার বাবা। তবে হৃদ্যতাটা কখনই সেভাবে গড়ে ওঠে নি। তাই আজ দাদার মৃত্যুতে সবার সাথে আমরাও কাঁদছি কিন্তু, হৃদয় ছেঁড়া সেই মমতা অনুভব করছি না।

দেখলাম, আমার ঘরে আমার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাদি সাঁজছে। পরিপাটি করে শাড়ি পরল,চুল আঁচড়িয়ে সুন্দর করে খোঁপা বাঁধল, আমার ক্রিমের কৌটা থেকে ক্রিম নিয়ে মাখল, চোখে সুরমা লাগাল। ভাবলাম দাদী সুরমা পেল কই? আমিতো সুরমা নেই না। তাছাড়া শুনেছি দাদি কখনও শাড়ি পরত না। পর্দা রক্ষা হবে না তাই। তবে অসম্ভব সুন্দর লাগছে দাদিকে।

দাদী পানের বাঁটা নিয়ে খাটেঁর কোনায় বসল। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছি শুধু। একটু পরে কাছে গিয়ে বললাম, এ কি দাদি! দাদা মারা গিয়েছে, সবাই কান্নাকাটি করছে, বাড়ি ভরে গিয়েছে লোকজনে, আর তুমি সাজগোজ করে এখানে বসে পান খাচ্ছ!

দাদী পানটা মুখে দিতে দিতে হাসছে আর বলছে, আজকেইতো আমার সাজবার দিন, পান খাবার দিন রে দিদু ভাই। আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ খুশির দিন।

কি বলছ তুমি পাগোলের মত!

দাদী আমার হাতটা ধরে পাশে বসিয়ে বলল, পাগলামি না রে দিদি। শোন মৃত আর জীবিতের সুখ দুঃখ এক রকম না। তোদের যাতে দুঃখ হয় তাতে আমার হয় না। এই দিনটার জন্য আমি চল্লিশ বছর ধরে প্রতিটা মূহুর্ত ছট ফট করেছি।

মনে পড়ল দাদীকে তো আমি কোনদিন চোখেই দেখি নি। দাদী বলতে যাকে চিনি সে আমার সৎ দাদী। কিন্তু একবারও আমার তা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে, এই দাদীই আমাকে মমতায় সিক্ত করে বড় করেছে। এই দাদীর পাশে শুয়ে শুয়েই আমি গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি আদুরে গলায় দাদীকে বললাম, তোমার কথা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না দাদী, একটু বুঝিয়ে বলবে?

শোন তাহলে, তোর দাদার সাথে আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমার মাত্র আট বছর বয়স। তোদের বাড়িতে আসার সময় খেলার পুতুল আর খেলার সাথী দুইটাই আমার বাবা মা আমার সাথে দিয়ে দিয়েছিল। পৃথিবীর কিছুই আমি জানতাম না, চিনতাম না। ধর্ম, কর্ম, জীবন, সংসার, দায়িত্ব, কর্ভব্য সবই আমাকে আমার শাশুড়ি মা শিখিয়েছিলেন। বলতে পারিস তাঁর চোখেই আমার পৃথিবি দেখতে শেখা। মহিলা অতিশয় ধার্মীক, বুদ্ধিমতি আর উদার ছিলেন। উনার নিজের কোন মেয়ে ছিল না, তাই আমাকে নিজের মেয়ের মত, নিজের মেয়ের মত কি পরের মেয়েকে নিজের মেয়ে করে নেয়ার জন্য মনে হয় তার চেয়েও একটু বেশি ভালবাসতেন।

আস্তে আস্তে জীবনে বাঁকের পরে বাঁক এল। কৈশোরের চপলতায়, তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায়, যৌবনের উদ্দামতায় তোর দাদার প্রতি কিভাবে কখন যে তীব্র ভালবাসা, তীব্র আকর্ষণ জন্মাল জানি না। কি কঠিন ভাবে যে তাকে ভালবাসতাম, কি তীব্র আকাংখায় যে তাকে কাছে পেতে চাইতাম তা তাকে আমি বুঝাতে পারতাম না।

সে যখন কাছে আসত, কি এক লজ্জায়, ভয়ে কাঠের মত শক্ত, আড়ষ্ট হয়ে থাকতাম আমি। নিজের উপরে খুব রাগ হত, ভিতরটাকে বাইরে আনতে জানতাম না বলে।

কি ভাবে তিনটা বাচ্চা হল তাও ছাই ভাল বুঝলাম না। শাশুড়ি মাও মারা গেলেন, আমার কোলের বাচ্চাটা তখন ছোট। কিছুদিন পরে তোদের বাড়িতে এই দালান দেওয়া হবে, ইট, বালি, সিমেন্ট, কাঠ এনে বাড়ি ভর্তি করা হল। মিস্ত্রী, শ্রমিকের আনাগোনা। বাড়িতে শোর গোল শুরু হয়ে গেল।

আমি ভাবলাম, হায় আল্লাহ! এত পুরুষ মানুষ সব সময় বাড়িতে থাকবে, আমার তো পর্দা রক্ষা করা হবে না। তোর দাদাকে বলতেই সে আমাকে বাপের বাড়িতে রেখে এল। পরে বুঝেছিলাম, তোর দাদা চাইলে উঠানের ওপাশে বেড়া টেড়া কিছু দিয়ে আমার পর্দার ব্যবস্থা করে দিতে পারত।

যাহোক তিন মাস পরে যখন বাড়ির কাজ পুরো শেষ হল, আমি এ বাড়িতে ফিরে এলাম। এসে দেখি বিশাল দালান তৈরী হয়েছে। সারা বাড়ি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সব যেন ঝক ঝক করছে। খুশিতে আমার মন ভরে গেল।

দুইদিন পরে এক বিকেলে, তোর দাদা আমার ঘরে এল। একটু যেন লজ্জিত, একটু যেন কুন্ঠিত। আলতো করে আমার একটা হাত ধরে পাশে বসল। আমার শিহরিত শরীর মনে উদ্দাম নৃত্য শুরু হল, প্রেমের মধুর বাঁশি বেজে উঠল। বুঝলাম, আমার বিরহে তোর দাদার মধ্যে কি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, বুঝলাম এবার সে বলবে, আমার আর বাপের বাড়ি যাওয়া হবে না। মনে মনে বললাম, আমিই কি আর তোমায় ছেড়ে যাব! তুমি ছাড়া আমার জীবন কেমন ধূসর মরু তা আমিও এই তিন মাসে তোমার মতই বুঝেছি গো।

তোর দাদা বলল, ছবি, তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে। মনে মনে বললাম, জানি তো কি বলতে তুমি এই বিকেলেই আমার ঘরে এসেছ। মুখে বললাম, বলেন, কি কথা?

সে বলল, দালান তোমার পছন্দ হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ, খুব। আর বাড়ি ঘর এত সুন্দর গুছানো দেখে আমার আরো ভাল লাগছে।

ছবি, আমি তোমার কাছে একটা অনুমতি চাই।

কিসের অনুমতি? আপনি এমন দ্বিধা করছেন কেন? বলেন আপনার কি অনুমতি চাই?

মানে, ইয়ে, মানে, সুরমা মেয়েটা অনেক কাজের, এতদিন বাড়ির সব তো ওই করেছে। ও যদি আমাদের সাথে থাকে, তোমার সন্তান, সংসার কোন কিছু নিয়েই তোমার আর ভাবতে হবে না। তুমি তোমার ইবাদত বন্দেগী নিয়েই থাকতে পারবে।

ওঃ সুরমাকে যেন আমাদের বাড়িতে রেখে দেই এই কথা বলছেন? এতো আমি নিজেই আপনাকে বলব ভেবেছি। ওর জন্য আমার ও খুব খারাপ লাগে, এই বয়সে একটা বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে এসেছে, তাতে না আছে বাবা মা, না আছে চলার সংগতি।

না, আমি ঠিক তা বলছি না, মানে এই বয়সের অনাত্মীয়া একটা মেয়েকে বাড়িতে রাখা কি লোকে ভাল চোখে দেখবে!

এতে লোকের খারাপ দেখার কি আছে! ও আমাদের বাড়িতে থাক, তারপরে যদি রাজী হয়, দেখে শুনে ভাল একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন।

না, মানে, বলছিলাম কি।

কি বলেন?

না, মানে তুমি যদি অনুমতি দাও, ওকে যদি আমি বিয়ে করে রাখি। আসলে সংসার তো তোমারই, সবই তোমার, ও শুধু কাজের মানুষের মত থাকবে আর কি।

আমার মনের উপরে তখন বজ্রপাত হল, প্রচন্ড ঝড় বইতে শুরু করল, আমার চোখের সামনে থেকে পৃথিবীর সব আলো নীভে গেল। আমি বললাম, স্বামীর ইচ্ছেই স্ত্রীর ইচ্ছে, আপনি যদি খুশি হন, আমার কোন আপত্তি নেই। কিভাবে কেমন করে আমি কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলাম আমি জানি না, জানিনা কে আমাকে তখন কথা বলার শক্তি যুগিয়েছিল।

দূরের মসজিদ থেকে সকরূন আজানের ধ্বনী ভেসে এল, আবছা আলোয়, অবনত মস্তকে তোর দাদা আমার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমিও অযু করতে গেলাম। সেই ছিল, আমার শরীরে তোর দাদার শেষ স্পর্শ। আমি সবই মেনে নিলাম, চেয়ে নিলাম শুধু ছোট্ট এইটুকু।

তোর দাদার বিয়ে হল ক’দিন পরে।এক সময় হাঁড়ি ভাগ হল। আমি আমার ছেলে মেয়ে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম, বলতে পারিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেলাম।

কেউ কিছু বলল না, কোন প্রতিবাদ হল না, শুধু তোর বাবা এটা মানতে পারে নি। কিন্তু, নিজের ক্ষতি ছাড়া ওই ছোট বয়সে ওর তো আর কিছু করার ছিল না, তাই ও করল। লেখা পড়া ছেড়ে দিল, সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরত, ইচ্ছে হলে বাড়ি এসে খেত, না হলে আসত না।

আমার ছেলেটার অনুভূতি বড় তীক্ষ্ণ ছিল রে, আমার অসম্মান, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, কষ্ট সবই ও বুঝত। মাঝে মাঝে তোর ছোট দাদীকে যাচ্ছে তাই বলে গাল দিত, বাড়ির সবকিছু ভাংচূর করত। আর তোর দাদা তা শুনে প্রায়ই বেধড়ক মার দিত ওকে, মাঝে, মাঝে বাড়ি থেকে বের করে দিত। কতদিন ওকে আমি চুরি করে খেতে দিয়েছি!

আমার অবশ্য খুব বেশী দিন কষ্ট করতে হয় নি। কয়েক দিনের জ্বর ভোগেই আমার মুক্তি ঘটল। কষ্টের সমুদ্রে ভেসেছিল আমার বাচ্চাগুলো। আমি ওদের জন্য শুধু দোয়া করতাম, এখনও যেমন করি। মরেছিলাম বলে আফসোস তেমন হয় না রে, আমিতো বেঁচেও মরে ছিলাম। চল, পানি গরম হয়েছে, তোর দাদাকে গোসল করাতে হবে।

এতক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে গেছি দাদীর কথা। আমি আর আমাতে ছিলাম না।দাদির শেষ কথাটায় সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম, তুমি গোসল করাবে কি! ওখানে কত পুরুষ মানুষ থাকবে! তুমি যাবে ওখানে!

মুচকী হেসে উঠে দাঁড়াল দাদী বলল, দূর পাগলী, মৃতের আবার পর্দা কি! আমি কি বেঁচে আছি! তাছাড়া তোর দাদা ছাড়া আর কেউ আমাকে দেখতেও পাবে না।

গরম পানি, সাবান দিয়ে আলতো কোমল হাতে হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু মমতা নিয়ে দাদী দাদাকে গোসল করাল, কাফন পরাল, আনুসঙ্গিক আরো যা দরকার, সব করে দাদাকে সাজিয়ে দিল।

দাদার লাশ যখন কবরে নামানো হল, দাদীও আস্তে আস্তে নেমে গেল সেই কবরে। কবরে মাটি দিয়ে সবাই ফিরে এল, আমার দুচোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে দুটো অশ্রুর ধারা,আর মুখে নির্মল হাসির ছটা।



মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২১

লাবনী আক্তার বলেছেন: অসাধারণ গল্প। অনেক ভালো লাগা রইল।

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:১৭

বেবিফেস বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ লাবনী আক্তার আপু ।ভাল থাকেন।

২| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:১৩

আমি ইহতিব বলেছেন: ভালো গল্প লিখেন আপনি এটা আবার স্বীকার করছি। ২য় ভালো লাগা।

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:১৮

বেবিফেস বলেছেন: মন থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে। শুভ কামনা রইল।

৩| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২২

ফারাহ দিবা জামান বলেছেন: গল্পটা পড়ে দুঃখ পেলাম।
অদ্ভুত দুঃখ।
যাই হোক,
গল্পকে আমি কখনো গল্প ভাবতে পারিনি।
গল্পের ভেতর জীবনই খুঁজেছি।
যখন পেয়েছি ভালো লেগেছে।
আপনার বলার ভঙ্গিটা সাবলীল।
ভালো থাকবেন।

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১১

বেবিফেস বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.