![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনেক দিন কথা হয় না মঈনের সাথে। তা প্রায় এক বছর তো হবেই। তবে ও কি করছে, কেমন আছে এ খবর রাখি সব সময়ই। মঈন হল আমার সেঝ চাচার ছোট ছেলে। আমাদের সকল ভাই বোনেরও ছোট। কাল বিকেলে হঠাৎ ফোন দিল, ও প্রান্ত থেকে ওর কন্ঠ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে এতদিন যে ওর সাথে একটা দূরত্বের আড়াল, একটা অস্বস্তি ছিল তা দূর হয়ে গেল। সেই টল মল পায়ে হাঁটা, আধো আধো কথা বলা মঈনকে কোলে তুলে নেয়ার অনুভূতিটা সাঁই করে মনের মধ্যে চলে এল। বললাম,ভাল আছিস দাদা? তুই কাল এসেছিস না? উঠেছিস কোথায়?
হ্যাঁ আপা আমরা ভাল আছি, উঠেছি খিলখেতে মারিয়াদের বাসায়। আপনি কেমন আছেন? দীপ্ত, দুলাভাই ভাল আছে?
হ্যাঁ সবাই ভাল, দীপ্ত অনেক বড় হয়ে গেছে। তুই বাসায় আসবি না?
হ্যাঁ আসব তো, এতদিন পরে এলাম, আপনাকে দেখতে আসব না!
বৌ নিয়ে আসবি?
হ্যাঁ, আপনি তো এখনও বৌ দেখেননি।
কবে আসবি?
দেখি কখন আসি।
শোন, তুই আসার আগে আমাকে একটু জানিয়ে আসিস।
আচ্ছা আপা। মারিয়ার সাথে কথা বলেন, বলে ফোনটা ধরিয়ে দিল ওর বৌয়ের কাছে। বৌ সালাম দিয়ে কথা বলল, কন্ঠটা তেমন ভাল লাগল না, তবে কথা বার্তা মন্দ না।
আমার মনের মধ্যে তখন উৎসব আনন্দের ধুম লেগে গেছে, প্রায় সাত বছর পরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে সাথে আবার নতুন বৌ! ভিতরের আলোড়নটা বাইরে প্রকাশ করতে পারছি না কারণ, ওর বিয়েটাকে কেউ আমরা ভাল ভাবে নেই নি।
রাতে আমার ছেলে, তার বাবা ঘরে আসার সাথে সাথেই বলে উঠল, বাবা জান আম্মু মঈন মামাকে দাওয়াত করেছে, আবার মামী সহ। আমি পাশের রুম থেকে শুনে মনে মনে হাসছি আর বলছি, শালা কুটনীর বাচ্চা!
আসলে মঈনের বিয়ে সম্পর্কে আমাদের বাসায় ভাল কথার চেয়ে মন্দ কথাই বেশি হয়েছে। অন্যদিকে তার বাবা তাকে না না কাজে বাধা দেয়,মাঝে মাঝে এক আধটু বকাও দেয় কিন্তু, মাকে কিছু বলে না বরং মায়ের সব কথা, সব কাজ বাবার কাছে ভাল এ নিয়ে ওর অনেক হিংসে, অনেক প্রতিবাদ। কথাটা ওভাবে বলেছেও শুপ্ত একটু আশা নিয়ে, যদি বাবা মাকে একটু বকা দেয়।
ছেলের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে তার বাবা আগের ব্যঙ্গবিদ্রূপ ঝেড়ে ফেলা আন্তরিক কন্ঠে আমায় বলল, “ওদের আসতে বলেছ? কবে আসবে?” আমি বললাম, “না দেখ ও নিজে থেকে আসতে চাইল, বৌকেও নিয়ে আসতে চাইল, আমি কি করে না করি! ওদের কালই আসতে বলি?”
বল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে বললাম, “মঈন, তুরা কালকেই চলে আয়, শোন সকাল সকাল আসবি, সারাদিন আমার কাছে থেকে সন্ধ্যায় যাবি। কিরে আসতে পারবি? তোদের কোন সমস্যা নাই তো?”
না আপা, কোন সমস্যা নাই, আমরা কালই আসব।
মঈন বেশ কত বছর দুবাইতে আছে, আয়ও মন্দ করে না, চাচি আম্মা আমাদের সবাইকে বললেন, ওর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে, আমরা যার যার মত মেয়ে দেখছি তবে অনানুষ্ঠানিক ভাবে। মঈন দেখতে সুন্দর, সত্যবাদিতা, বিনয়, বাস্তববোধ, দায়িত্ব সচেতনতা অর্থাৎ একটা ভাল ছেলে হওয়ার জন্য যে সকল বৈশিষ্ট্য দরকার তার সবই তার আছে তাই বৌ সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশাও কম না। এমন সময় শুনলাম মঈন একটা ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। শুধু তাই না, মেয়েটার একটা বাচ্চাও আছে যাকে ও নিজের বাচ্চা হিসেবে গ্রহণ করতে চায়।
মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল। ইস কি আহ্লাদের কথা! বললেই হল! অসম্ভব, এ বিয়ে আটকাতেই হবে, এটা ছিল আমার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া।
আসলে এ ধরণের সম্পর্ক, বিয়ে বা কাজে আমরা যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাই, বাধা দেই তার কারণ এতে কিছুটা শঙ্কা তো আছেই। ঘর ভাঙ্গা মেয়ে ভাল হবে কি? ভালই যদি তো তার ঘর টিকল না কেন? অতীত তার বর্তমান জীবনকে কতটা প্রভাবিত করবে, অন্য বংশের, অন্য রক্তের একটা বাচ্চা আমাদের মত হবে কি না! তবে সর্বোপরি আমাদের মধ্যে যে জিনিষটা কাজ করে তা হল, মিথ্যে অহং এবং পরশ্রীকাতরতা মানে আরও ভাল হয় যদি বলি নারীশ্রীকাতরতা।
বিশাল এক এস এম এস পাঠালাম, একটু পরেই দেখি মঈন ফোন দিয়েছে। কিরে তুই নাকি একটা ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করবি? আবার তার সাথে এক বাচ্চা! লোকে আমাদের বলবে কি? চাচি আম্মা এটা কিভাবে নেবে ভেবেছিস? ঝাঁজের সাথে আমার সরাসরি প্রশ্ন।
মঈন স্বভাব সুলভ বিনয়ের সাথে বলল, হ্যাঁ আপা, আপনি যা শুনেছেন তা সত্যি। মেয়েটা ভাল আপা, ওর একটা এক্সিডেন্ট আছে এই যা। আচ্ছা আপা আমার যদি একটা বাচ্চা থাকত আর আমার এমন কোন এক্সিডেন্ট হত, আপনারা কি আমাকে বিয়ে করাতেন না? আমাকে এভাবে থাকতে দিতেন? আমার জন্য আপনি যেটা চাইতে পারেন তা কেন অন্যের জন্য চাইতে পারবেন না? অন্তত আপনার কাছ থেকে তো আমি এটা আশা করি নি আপা।
এটুকু বলার পরে ও ওর নিজের কিছু কষ্ট, ওর পার করে আসা কিছু দুঃসহ সময়ের কথা বলল। ওর কথার মধ্যে অস্পষ্ট একটু ইংগিত তীক্ষ্ণ একটা প্রশ্ন হয়ে আমার বুকে এসে বিঁধল। আমরা ওর প্রতি যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করি নি, আজ আমাদের কি অধিকার আছে আমাদের তথাকথিত মান-সম্মানের কথা ভেবে ওর ভালবাসাকে অস্বীকার করি?
আমার ঝাঁজের মাত্রা খাদে এসে নামল। আমি বললাম, তুই কি করে ভাবলি একটা ডিভোর্সী মেয়ে তোকে সুখি করতে পারবে? ওই ঠুনকো আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।
আমি আবেগে কিছু করছি না আপা, মেয়েটাকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি, আমার সাথেই তো কাজ করে। আর মা প্রথমে আপত্তি করলেও আমি বুঝিয়ে বলার পরে সম্মতি দিয়েছে। আপনারা যে বলেন, আমি সুখী হব না। সুখের কি কোন গ্যারান্টি আছে আপা? আপনাদের পছন্দে বিয়ে করলেই আমার সুখ হবে এমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন? আমার বিশ্বাস, আমি ওদেরকে নিয়েই সুখী হব আপা। আর যদি নাই হই তবে এটাকে আমি আমার নিয়তি বলেই মেনে নেব, আপনারা অসম্মত হন না আপা।
আসলে প্রথম ধাক্কাটা মনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়েছিল এই যা, না হলে ওর পক্ষে ওর কাছে যে যুক্তি আছে , আমার নিজের কাছে তো তার চেয়ে কম নেই। তাই আর এগোতে না পেরে বললাম, ঠিক আছে, যা করতে চাইছিস কর, আল্লাহ যেন তোদের সুখী করেন।
আমিতো ওর সবই জানি, এইস, এস, সি পাশ করার পরে ওর বড় ভাই ফিরোজ ওকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়ে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন তখন মঈনের দু চোখ ভরে।
ছয় মাস যেতে না যেতে ফিরোজ মারা গেল বিনা নোটিশে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য, ভাইয়ের লাশ নিয়ে মঈন দেশে এল। আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা সেরে আসতেও এক সপ্তাহ লেগে গেল। এই কটা দিন ভাইয়ের লাশের মত পৃথিবী সমান ভারী বোঝাটা ওই কচি বুকে একা বয়েছে ছেলেটা।কোন মমতা ভরা বুক তাকে বুকে জড়িয়ে নেয় নি, কোন স্নেহ মাখা হাত তার অশ্রু মুছিয়ে দেয় নি।
মঈনের মুখের দিকে আমি তাকানোর সাহস পেতাম না। উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভাসমান খড়-কুটোর মত ওই জীবন্ত মানুষটার কি দেখব আমি! মঈন আবার বিদেশে গেল। তবে লেখা পড়া করতে না, চাকরি করতে, না হলে যে মায়ের পেটে ভাত জুটবে না।
অতটুকু লেখা পড়া জানা ওইটুকু বাচ্চা ছেলে কি করতে পারে! ঢাকায় থেকে ছয়মাসের একটা কোর্স করে মঈন দুবাই গেল। ফিরোজের কয়েকজন বন্ধু ওকে সাহায্য করেছিল, আমরা না। আমরা ওর জন্য যা করেছিলাম তা লজ্জায় লুকিয়ে রাখার মতই যৎকিঞ্চিত। সকলের না থাকলেও মঈনের পরিবার এবং মঈনকে সাহায্য করার মত সামর্থ্য যে আমাদের কারোরই ছিল না, এমন তো নয়।
মঈন শুধু নিজের না, সংসারেরও হাল ধরল, ভাল করেই ধরল।অপরিচিত স্বজনহীন বিদেশে, অতবড় শোকের আগুন বুকে নিয়ে কি কঠিন দিনই না ওকে পার করতে হয়েছে, আমরা তার কতটুকু খবর রেখেছি! আরও একটা কঠিন সত্যি যা আমি অনেক পরে জেনেছি, মঈন দুবাই যাওয়ার কয়েক দিন আগে ওর প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায়। ওর বাস্তবতা, সংসারের প্রতি দায়িত্ব, মায়ের প্রতি দায়িত্ব এসব বিবেচনা করে, ও ওর ভালবাসার কথা আমাদের কাউকে জানায় নি, বরং মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, নিজে উপস্থিত থেকে নিজের প্রেমিকাকে অন্যের বৌ করে পাঠিয়ে দেয় স্বামীর ঘরে।
আমার হিসেব মিলাতে আর দেরি হল না। কোন আগুনে, কতটা পুড়ে মঈনের মন এমন খাঁটি হয়েছে যা ডিভোর্সী একটা মেয়েকে সম্মান এবং মর্যাদা দিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখাতে পারে। একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির অসহায়, উচ্ছিষ্ট একটা বাচ্চাকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে তার অন্ধকার জীবনটাকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে।
ওরা এল, বৌ দেখলাম, মেয়েটা চোখে লাগার মত না হলেও চলন সই। কথা বার্তায় বুঝলাম যথেষ্ট বুদ্ধিও আছে । ভাল লেগেছে ওর অকপট সহজ প্রকাশ। রান্না বান্না যা করেছিলাম, তার প্রক্রিয়া যাই হোক প্রতিটাতেই আমার মমতা ঢালা ছিল। ওরা ভাল খেতে পারল না,যদিও অন্যদের খাওয়া দেখে বুঝেছিলাম, রান্না খুব একটা খারাপ হয় নি।
ওদের বাচ্চাটা ওদেরকে কয়েকবার ফোন দিল। বাচ্চাটাকে ওরা সাথে আনে নি, কারণ হিসেবে যদিও বলল, সে তার নানুকে ছাড়া থাকতে পারে না, সর্বোপরি তার ঠান্ডার সমস্যা। ওরা যাই বলুক, আমি জানি আমি নিয়ে আসতে বললে ওরা তাকে রেখে আসত না।
বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।এই ছোট্ট একটু সীমা অতিক্রম করতে পারলাম না! আমার ঘরের মানুষেরা বিষয়টা কিভাবে নেবে, প্রতিবেশীরা কি ভাববে এটুকু না ভাবলে কি চলত না! হাসি পাচ্ছে নিজেকে দেখে। এ ধরণের অক্ষমতার প্রমাণ আমি নিজের জীবনেও বড় কম দেই নি।
মঈনের সামনে নিজেকে বড় বেশি ছোট মনে হচ্ছে। তবে ভাল লাগছে এই ভেবে যে, আজকের তরুণেরা আমার মত না, জীবনের, সমাজের জঞ্জালগুলো এরা কত সহজে সরিয়ে দিতে পারে! কত স্পষ্ট এদের সত্যি উপলব্ধি এবং কি স্বচ্ছন্দ তা প্রকাশের ক্ষমতা কি চমৎকার তার বাস্তবায়ন ভাবতেই আমার মস্তক অবনত হয়। মনে মনে বলি অনুজের কাছে এ অবনতি আমার বার বার ঘটুক, প্রতিনিয়ত ঘটুক।
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:০১
বেবিফেস বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকেন।
২| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৯
আমিভূত বলেছেন: খুব কষ্ট লাগলো আপু ,আসলেই আমরা নিজের সমস্যাই শুধু বড় করে দেখি কিন্তু অপরের কষ্টকে দোষ মনে হয়
আপনার ভাইয়ের জন্য শুভকামনা । তারা যেন সুখী হয় ।
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:০৩
বেবিফেস বলেছেন: আলহামদু লিল্লাহ, তারা অনেক ভাল আছে। শুধু তারাই না, সকলকে যদি সুখী দেখতে পারতাম!
৩| ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৫৩
সপ্নাতুর আহসান বলেছেন: গল্প নাকি বাস্তব? ভাল লিখেছেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:১৯
নীল-দর্পণ বলেছেন: sukhe thakuk tara