নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্ত্যজ বাঙালী, আতরাফ মুসলমান ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান।রবীন্দ্রনাথ

ইমন জুবায়ের

জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন/ জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন। [email protected]

ইমন জুবায়ের › বিস্তারিত পোস্টঃ

এ -তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী/মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৪৬

মধ্যযুগের বাঙালি কবিরা দেবতাদের কাহিনী নিয়ে এক ধরনের কাব্য লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই কাব্যগুলি মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে অসংখ্য কবি অজস্র মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। মধ্যযুগটি ছিল ধর্মীয় যুগ। সুতরাং মঙ্গলকাব্যে দেবতাদের প্রাধান্য ছিল; এবং তাতে মানুষের ভূমিকা ছিল গৌণ। আসলে মঙ্গলকাব্য হল মধ্যযুগের দেবতাদের জীবন কেন্দ্রিক কাহিনীকাব্য।

কিন্তু, কাব্যের নাম মঙ্গলকাব্য হল কেন?

দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ-কাব্যগুলি রচনা করা হয়েছে বলে এই কাব্যের নাম মঙ্গলকাব্য-অনেকেরই এমনই ধারণা। আবার কারও কারও মতে: এ-কাব্যগুলি গাওয়া হত এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার অবধি; তাইই মঙ্গলকাব্য নাম। অনেকেই আবার এ ধারণা অস্বীকার করে দাবি করে বলেন যে: যে বিশেষ সুরে মঙ্গলকাব্য গাওয়া হত সে -সুরের নাম মঙ্গল।

মঙ্গলকাব্যের নাম কয়েক ধরণের হত। অর্থাৎ পৃথিবীতে যে দেবতার পুজা প্রচারের জন্য কাব্যটি রচিত-সে দেবতার নামানুসারেই কাব্যের নাম হত। চন্ডীর পুজা প্রচারের জন্য যে মঙ্গলকাব্য রচিত হত, তার নাম: ‘চন্ডীমঙ্গলকাব্য’; আবার মনসা দেবীর পুজা প্রচারের জন্য যে মঙ্গলকাব্য রচিত হত, তার নাম: ‘মনসামঙ্গলকাব্য’। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের মধ্যে ‘চন্ডীমঙ্গলকাব্য’ এবং ‘মনসামঙ্গলকাব্য’ কাব্য দুটিই বিখ্যাত।

মাণিক দত্ত, দ্বিজ মাধব,দ্বিজ রামদেব, ভারতচন্দ্র রায় এবং মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০) প্রমূখ কবিরা চন্ডীমঙ্গলকাব্য লিখেছেন । এ ক্ষেত্রে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর একটি উক্তি স্মরণীয়। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ অপাঠ্য’। তবে অনেক আধুনিক গবেষকই কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এই কারণে যে, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট পরিমানে উৎকৃষ্ট মানের কাব্য রয়েছে। আর সবচে বড় কথা হল: মঙ্গলকাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মধ্যযুগের বাংলার সমাজচিত্র। কাজেই, সামাজিক ইতিহাস উপলব্দির জন্য মঙ্গলকাব্যের পাঠ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে এক্ষেত্রে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচনা পাঠ অনিবার্য। আমি সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

মনসামঙ্গলকাব্যের অর্ন্তগত বেহুলা-লখিনদরে কাহিনীটি বাংলায় অতি সুপরিচিত। তবে চন্ডীমঙ্গলকাব্যের কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনীটিও কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক নয়। এ কাহিনী বিষাদিত নয় বরং আনন্দ আর পুলকে ভরপুর। সবচে বড় কথা হল এ কাহিনী আমাদের, অর্থাৎ বাঙালির। যুগ যুগ ধরে এ গল্পটি বর্ণিত হয়েছে বাংলার কৌমসমাজে। মঙ্গলকাব্যের লেখকগণ তাদের পূর্বপুরুষদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন, গভীর শ্রদ্ধা করতেন; এই আজকের আমাদের মতোই। সে কারণেই মঙ্গলকাব্যের কবিরা কাব্য রচনার জন্য নতুন বিষয়ের সন্ধান করেননি, পূর্বপুরুষদের গল্পই বার বার নতুন করে লিখেছেন। কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনীটিও সেরকমই, মূল কাহিনী অবিকৃত রেখে একেকজন কবি একেক ভাবে লিখেছেন। তবে সবার শিল্পমানই যে সন্তোষজনক, তা কিন্তু বলা যাবে না। তবে সংগত কারণেই কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এক্ষেত্রে অনন্য।

কিন্তু, কি রয়েছে কালকেতু-ফুল্লরার আখ্যানে?

বলছি সংক্ষেপে। নীলাম্বর নামে এক দেবতা ছিল। স্বর্গে তার দিনগুলি সুখেই কাটছিল । তার স্ত্রীর নাম ছায়া। নীলাম্বর ছায়া কে গভীরভাবে ভালোবাসত। তারপরে দেবতা শিবের অভিশাপে নীলাম্বর স্বর্গচ্যূত হল। ধর্মকেতু নামে একব্যাধের পুত্রস্বরূপ পৃথিবীতে জন্ম নিল নীলাম্বর। তার নাম হল কালকেতু। ছায়াও অন্য এক ব্যাধের ঘরে জন্মাল, ছায়ার নাম হল ফুল্লরা। ফুল্লরার যখন এগারো বছর বয়েস, তখন তার সঙ্গে কালকেতুর বিয়ে হল।





প্রাচীন বাংলার কৌমসমাজে কোনও এক নিষাদ বুড়ো এ গল্পটি বলছেন বা এ গল্প উদ্ভাবন করেছেন- একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমাদের এমনটাই কল্পনা করে নিতে হবে, নইলে গল্পের প্রকৃত স্বরূপ আমাদের উপলব্দির বাইরে থেকে যাবে। তখন আমি প্রাচীন বাংলার কৌমসমাজ বললাম বটে, কিন্ত ততদিনে প্রাচীন বাংলায় আর্যসংস্কৃতির বিস্তার ঘটে গেছে, কেননা, মঙ্গলকাব্যে আমরা দেবতা শিবকে পাই, যদিও শিব অনার্য দেবতা, তবে তার উপস্থাপনটি অনিবার্য ভাবেই বৈদিক ...




...যা হোক। কালকেতু ছিল সাহসী, স্বাস্থবান এবং চতুর শিকারী। (কীভাবে গল্পের বাঁক নিচ্ছে লক্ষ করুন) কালকেতুর ভয়ে বনের পশুপাখি সব আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠেছে। কালকেতুর নিক্ষিপ্ত বিষমাখা অব্যর্থ তীর যেন এক একটি মৃত্যুবাণ! বনের পশুপাখির আরাধ্য দেবী হলেন চন্ডী; ইনিই মহাশক্তি। দেবী চন্ডী বনের পশুপাখিদের বাঁচাতে সম্মত হলেন। দেবী পশুপাখিদের এক অলক্ষ্য স্থানে লুকিয়ে রাখলেন। কাজেই কালকেতু আর শিকার পায় না, পায় না। খানিকটা বিস্মিত হয়েই সে বনের এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগল। হঠাৎই একটা হরীতকী গাছের আড়ালে একটি গুইসাপ দেখতে পেল সে । কালকেতু গুইসাপটি ধরে বাড়ি নিয়ে এল। ফুল্লরা তখন স্বামীর পথ চেয়ে বসেছিল। কালকেতু শিকার আনবে তবেই না রান্না হবে।

বাড়ি ফিরে কালকেতু ফুল্লরাকে গুইসাপ দেখিয়ে বলল, এটি আজ রাঁধ। তার আগে দেখ যদি পাশের বাড়ি থেকে কিছু খুদ যোগাড় করতে পার কিনা। আমি এখন হাটে যাচ্ছি।

বলে কালকেতু হাটে চলে গেল।



কালকেতু-ফুল্লরার গল্পটি আবহমান বাংলার গল্প বলেই এর ভিতরে অনিবার্যভাবেই গ্রামীণ জীবনের ছবি রয়েছে। বন, বাড়ি, উঠান, রান্নাবান্না, খুদকুঁড়ো আর হাট। মধ্যযুগের বাঙালি কবিরা গ্রামীণ পরিবেশ ভালোবাসতেন বলেই কি তাঁরা তা নিয়ে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন? নতুন গল্পের সৃষ্টি করতে চাইতেন না ? উনিশ শতক অবধি বাংলা সাহিত্যের এই ধারাই অব্যাহত ছিল। তার আগে অবশ্য কাব্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলেন নদীয়ার মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব।





ফুল্লরা পাশের বাড়ি থেকে খুদ নিয়ে ফিরে এল।

ওমাঃ এ কী! এ কে দাঁড়িয়ে রয়েছে!

উঠানে একটি উদ্ভিন্ন যৌবনা সুন্দরী যুবতী দাঁড়িয়ে রয়েছে বলেই ফুল্লরার এমন বিস্ময়সূচক মন্তব্য। যুবতীর শরীরে যৌবন তরঙ্গে রূপালি বিদ্যুতের ফলার মতন রূপের ঝিলিক।(আসলে গুইসাপটিই ছিল স্বয়ং দেবী চন্ডী; এখন দেবী বিশেষ কারণে রূপ পাল্টেছেন)

ফুল্লরা সুন্দরী যুবতীকে তীক্ষ্মকন্ঠে শুধালো, এই কে তুমি ? এখানে কেন এসেছ শুনি?

চন্ডীরূপীনি যুবতী তখন বলল, কালকেতুই তো আমায় এখানে নিয়ে এলে। কেন, তুমি তখন দেখতে পাওনি?

একথা শোনামাত্রই ফুল্লরার শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে এল। এ সর্বনাশী দেখছি আমার সুখের সংসার ধ্বংস করে দেবে ! হে শিব, এখন আমি কি করি? কালকেতুও তো ফিরে এল না। ফুল্লরা চিৎকার করে বলল, তুমি চলে যাও! ছিঃ, লোকে তোমায় এখানে দেখে কী বলবে। বেবুশ্যে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ফুল্লরা।

না, আমি যাব না আমি এখানে থাকব। আমি এখানে থাকতে এসেছি। সুন্দরী যুবতী বলল। কন্ঠস্বরে একগুঁয়েমি ভাব।

ফুল্লরা তখন কী করে। ও হাটের দিকে দৌড়াতে লাগল। হাটের মাঝে কালকেতুকে দেখতে পেয়ে সব খুলে বলল। কালকেতু তো সব শুনে অবাক। দ্রুত বাড়ি ফিরে এল সে । সুন্দরী যুবতীর দিকে হাত তুলে বলল, এই! কে তুমি? যাও! এখুনি চলে যাও!

না! আমি যাবো না!

যাবে না? না! ক্রোধে অধীর হয়ে কালকেতু তখন ধনুকে তীর যোজনা করল। মুহূর্তেই দেবী চন্ডী তখন আপন স্বরূপ ধরলেন।

কালকেতু সে মোহনীয় রূপ দর্শন করে মুগ্ধ হল। অভিভূত হল। তার হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগ্রত হল।

চন্ডী তখন বললেন, আমি দেবী চন্ডী। তোমরা আমার পূজা প্রচার কর। আমি তোমাদের অঢেল সম্পদ দেব।

অভাবিত সৌভাগ্যে কালকেতু-ফুল্লরা বিষম ঘোরের মধ্যে পড়ল।

দেবী চন্ডী ওদের সাত কলস ধন দান করলেন।

তারপর?

তারপর সে ধন দিয়ে কালকেতু গুজরাট বন কেটে নির্মান করালো এক বিরাট নগর । সে নগরে ভাড়ু দত্ত নামে এক খল চরিত্রের লোক ছিল। সে কালকেতুর মন্ত্রী হতে চাইল। অবশ্য কালকেতু রাজি হল না।ষড় করতে ভাড়ু দত্ত তখন গেল কলিঙ্গে । সে কলিঙ্গের রাজাকে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করল। বাঁধল যুদ্ধ । সে যুদ্ধে কালকেতু গেল হেরে। ধানের গোলায় সে লুকিয়ে রইল ফুল্লরার পরামর্শে । কলিঙ্গরাজের সৈন্যরা তাকে বন্দি করে নিক্ষেপ করল কারাগারে । কারাগারের ঘোর অন্ধকারে কালকেতু দেবী চন্ডীকে স্মরণ করল। দেবী চন্ডী কালকেতুর ওপর সদয় ছিলেন। দেবী চন্ডী কলিঙ্গের রাজাকে দেখা দিলেন স্বপ্নে। কলিঙ্গের রাজা কালকেতুকে মুক্তি দিলেন, ফিরিয়ে দিলেন কালকেতুর রাজ্য। কালকেতু আবার রাজ্য শাসন করতে লাগল। ফুল্লরা আর তা দিন সুখে কাটতে লাগল। শেষে তারা বৃদ্ধ

বয়েসে নীলাম্বর এবং ছায়ারূপে ফিরে গেল স্বর্গে।

এ-গল্পটি অবলম্বন করেই ১৫৭৫ অব্দের কাছাকাছি সময়ে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গলকাব্য লিখেছেন । হুমায়ূন আজাদ এই সালটি (১৫৭৫ অব্দ) নির্ধারণ করেছেন। এ বিষয়ে অবশ্য খন্দকার মুজাম্মিল হক বাংলাপিডিয়ায় ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। খন্দকার মুজাম্মিল হক এর মতে ১৫৭৫ অব্দে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী পৈত্রিক ভিটেমাটি ত্যাগ করেন এবং তিনি চন্ডীমঙ্গলকাব্য রচনা করেন ১৫৯৪ থেকে ১৬০০ অব্দের মধ্যে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী যদি সত্যিই সত্যিই ১৫৭৫ অব্দে পৈত্রিক ভিটেমাটি ত্যাগ করেন তাহলে চন্ডীমঙ্গলকাব্য লেখার অবকাশ তখন তাঁর কোথায়? এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে।

সেই যাই হোক। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গলকাব্য লিখেছেন খানিকটা বিচিত্র পরিস্থিতিতে। কবির জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। বাবার নাম হৃদয় মিশ্র; মায়ের নাম দৈবকী। সে সময় বাংলা-বিহারে রাজা মানসিংহের রাজত্ব। সে প্রসঙ্গে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গলকাব্য লিখেছেন:





‘ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজ-ভৃঙ্গ গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ।’




দামুন্যা গ্রামে এক অত্যাচারী ডিহিদার ছিল। তার নাম মামুদ শরিফে। ১৫৭৫ অব্দে মামুদ শরিফের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কবির পরিবার মেদিনীপুরের উদ্দেশে গ্রামত্যাগ করে। পথে অশেষ দূর্গতি পোহাতে হয়েছিল। রূপরায় ডাকাতের কবলে পড়েছিলেন। অন্নবস্ত্রহীন, যাত্রাক্লেশকর অনির্দিষ্ট জীবন। সে যাই হোক। শেষে অবশ্য কবির পরিবারটি মেদিনীপুরের আড়রা গ্রামে আশ্রয় পান। এবং এর কিছুকাল পরে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী জমিদারপুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে এই রঘুনাথেরই অনুপ্রেরণায় চন্ডীমঙ্গলকাব্য রচনা করেন। এজন্য জমিদার তাঁকে ‘কবিকঙ্কন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল। কবি তৎকালীন বাংলার বাস্তবজীবনে ছবি অপূর্ব দক্ষতায় এঁকেছেন। খন্দকার মুজাম্মিল হক এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘সাধারণ বাঙালি জীবন থেকে নেওয়া উপাদানের দ্বারা মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যের চরিত্র অঙ্কন করেছেন। চন্ডীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার মুখ্য বিষয় হলেও সমকালীন সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই মানব -চরিত্র ও প্রকৃতি -পরিবেশের বস্তুনিষ্ট বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। ...বস্তুতান্ত্রিক ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত মুকুন্দরামের মুরারি শীল, ভাড়ু দত্ত, ফুল্লরা চরিত্র বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এসব কারণে তাঁর চন্ডীমঙ্গলকাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সৃষ্টি। ’ (বাংলাপিডিয়ায়)

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর আরেক বৈশিষ্ট্য হল এই যে তিনি নিস্পৃহ ছিলেন, চন্ডীমঙ্গলকাব্য রচনাকালে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এটি লেখকের একটি বড় গুণ। এ জন্যেই তাঁকে ‘ বস্তুতান্ত্রিক ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত’ বলা হয়েছে।

কিন্তু বাংলার ইতিহাসে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কেন বিশিষ্ট?

গভীর মানবিক বোধের জন্য বাংলার ইতিহাসে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী অনন্য।

১৫৭৫ অব্দে ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মেদিনীপুরে চলে যান। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সে দুঃখজনক অধ্যায়টি কখনও বিস্মৃত হন নি। বরং মুকুন্দরাম চক্রবর্তী একটি শান্তিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন । লেখকগণ সাধারণত তাঁদের স্বপ্নের কথা তাঁদের শিল্পমাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও ব্যাতিক্রম নন। তাই আমরা দেখতে পাই গুজরাট বনে কালকেতুর নগরে অত্যাচার আর অনাচার নেই; শোষণ আর বঞ্চনা নেই। কালকেতু তাঁরই এক প্রজাকে বলছেন: তুমি আমার নগরে বাস করে ইচ্ছেমত জমি চাষ কর। কর দিও তিন বছর পর পর। করের হার হাল প্রতি মাত্র এক টাকা। আর যখন ফসল ফলাবে তখন আমার লোকেরা তোমার ওপর অত্যাচার করবে না। আমার নগরে অত্যাচারী ঢিহিদার থাকবে না ...



আমার নগরে বৈস যত ভূমি চাহ চষ

তিন সন বই দিও কর।

হাল পিছে এক তংকা

না করো কাহার শংকা

পাট্টায় নিশান মোর ধরো।

খন্দে নাহি নিব বাড়ি

রয়ে সহে দিও কড়ি

ডিহিদার না করিব দেশে।




এসব মানবিক বোধ স্মরণ করেই কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় লিখেছেন:



এ -তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী/মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়





কুড়ি শতকে রবীন্দ্রনাথ কি মুকুন্দরাম পাঠেই উজ্জীবিত হয়ে লিখেছিলেন



আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে/

নইলে মোদের রাজার সঙ্গে মিলব কি সত্ত্বে।





এভাবেই আজও বাংলার মানবিক বোধটিকে প্রবাহমান দেখতে পাই তার কাব্যে, তার কবিতায় ...



তথ্যসূত্র:



আল মাহমুদ; শ্রেষ্ঠ কবিতা

হুমায়ূন আজাদ: লাল নীল দীপাবলী (বাংলা সাহিত্যের জীবনী)

বাংলাপিডিয়ায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে নিবন্ধ

Click This Link

Click This Link

Click This Link

http://prothom-aloblog.com/posts/16/32914

Click This Link

Click This Link

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৩৩

রাশমী বলেছেন: কবি কঙ্কন মুকুন্দরামের অসাধারন পঙতি হল (ড. মাহবুবুল আলম এর বই থেকে)

যেই ঘরে দু সতীনে করেনা কন্দল।

সে ঘরে যে বসে চেড়ি সে বড় পাগল!!

অনুক্ষন দু-সতীনে করয়ে কন্দল।

তবে দাস দাসী পায় পরম মঙ্গল!!

B-)) :-B

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:২২

ইমন জুবায়ের বলেছেন: Thanks! :)

২| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:১৩

সোমহেপি বলেছেন: ছেলেবেলায় বেহুলার কিচ্ছা শুনতাম ...


ডিঙা চলে চলেরেরে ডিঙা চলে বেসামাল
..........

বড় হয়ে জানলাম মনসামঙল ছিল এইটা।


চন্ডীমঙল সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না।আপনার লেখাটা পড়ে কিছুটা জানা হয়ে গেল।

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:২১

ইমন জুবায়ের বলেছেন: এমনিতে চন্ডীমঙ্গলের চেয়ে মনসামঙ্গলই পপুলার বেশি।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

৩| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:১৪

অপরাজিতার কথা বলেছেন: ভালো লাগলো।

ইতিহাসের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্বেও খুব একটা পড়া হয় না।খুব এক ঘেয়ে লেখনীর কারনে।আপনার মত যদি গল্পচ্ছলে বলা হয় ,খুব সহজ সরলভাবে-তো আমার মত বোকা সোকা পাঠকদের বড়ই উপকার হয়।আশা করছি আরো নতুন কিছু জানতে পাব আপনার ব্লগে।আর পুরোন গুলো পড়ে শেষ করার অধীর অপেক্ষায় আছি!অসংখ্য ধন্যবাদ।

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:২৫

ইমন জুবায়ের বলেছেন: এক ঘেয়ে লেখনীর কারনে আমারও ইতিহাস পড়তে ইচ্ছে করত না। সেই কারণেই এই রসালো ব্যবস্থা। :) ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। এটা না -জানার মাকাল ফল ফলেছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
অনেক ধন্যবাদ।

৪| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:০৮

পদ্ম।পদ্ম বলেছেন: +++++

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:১৭

ইমন জুবায়ের বলেছেন: :) ধন্যবাদ।

৫| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৪৭

নাজিম উদদীন বলেছেন: ভাল লাগল।

'কালকেতু ও ফুল্লরা' নামে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। সেখানেই প্রথম এদের সম্বন্ধে জানতে পাই।

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:৪৪

ইমন জুবায়ের বলেছেন: সেলিনা হোসেনও লিখেছেন এদের নিয়ে।
ধন্যবাদ।

৬| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ২:২৩

তৌফিক জোয়ার্দার বলেছেন: আপনার ব্লগ স্কুল কলেজের পাঠ্য করা উচিত। ভাবছি জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদকে চিঠি লিখব। :)

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:২৩

ইমন জুবায়ের বলেছেন: মাননীয়, আমার ব্লগ স্কুল-কলেজে পাঠ্য করার দরকার নাই। বরং ইন্টারনেটের খরচ কমে আসুক এবং গ্রামেগঞ্জে তা সুলভ হয়ে উঠুক। যেন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী সহজে আমার ব্লগ পড়তে পারে। আমি এমনই ভাবি।
ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.