| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাস্কর পাল
আমি এক কলমধারী বিরাগী,, কাল্পনিক তাই কল্পনাটাই বেশি
হারানো সেই নিরুপমা
-ভাস্কর পাল
আজ থেকে ছয় বছর আগে, আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক দেবো। সেই বছর জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের একমাস আগে হঠাৎ করেই হারিয়েছিলাম আমার শিরদাঁড়া, আমার বাবাকে। বাবা ছোটো থেকে আমায় শিখিয়েছিল কঠোরতার সাথে বন্ধুত্ব করে তার সঙ্গে লড়াই করতে। বাবার মৃত্যুর পর হাতের মুঠো থেকে হারিয়ে গেছিলো জীবন্ত কত স্বপ্ন। বাড়ির দায়িত্ব এসে পরে কাঁধের উপর বোঝা হয়ে, যেই বোঝা বহন করার মতো ক্ষমতা তৈরি হয়নি তখনো। তবুও ক্ষমতাটা তৈরি করে নিতে হয়েছিল কয়েক দিনের মধ্যে। উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করেই লেগে পড়লাম একটা ছাপাখানার চাকরিতে। বোন আছে সে তখন ক্লাস নাইনে। মা শাড়ির ব্যবসা শুরু করলো খুবই সামান্য পুঁজিতে। কোনও রকমে চলছিল। রাতে ঘুমাতে গেলেই বদ্ধ চোখের নিচে ভেসে উঠত জীবন্ত সব স্বপ্ন। আর পড়ার টেবিলে রাখা ডাক্তারির বইগুলোর দিকে তাকালেই চোখ দিয়ে উষ্ণ গলিত লাভার ন্যায় অশ্রু নেমে এসে আমায় দুর্বল করে তুলত। বাবার কত স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তারি পড়বো। বাবাও নেই আর স্বপ্নটা থাকলেও তার পূর্ণতা আমার ভাগ্যে লেখা নেই। প্রতি রাতে এসব মনে পড়লেই আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। পারতাম না সমস্তটা ভুলে নিজেকে বাস্তবের সাথে মানিয়ে নিতে।
হঠাৎ বাসটা ব্রেক কসলো, আর আমি চোখ খুলে চমকে উঠলাম। এখন অফিস বাসে বসে। এই কয়েক বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আমি বি.কম. শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে গত একবছর ধরে চাকরি করছি। সকাল 9 টায় অফিস বাসে করে অফিস, আবার এই বাসেই সন্ধ্যে 7 টায় বাড়ি ফেরা। মাঝপথে থমকে যাওয়া জীবনটা বেশ আবার গতির পথে সচল ধারাতেই চলছিল।
আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ঘরে বসে আছি আর পুরনো বইগুলো ঘাঁটছি। হঠাৎ একটা বই এর পাতা উল্টাতে-উল্টাতে দেখি একটা পাতায় পেনসিল দিয়ে চার লাইন লেখা
“অজানার তরে আচমকাতে ধাক্কা লাগলো মাঝপথে-
থমকে গেলো হৃদয় হঠাৎ
হালকা কাজলে চোখ আটকে; বুকের মাঝে গভীর মেঘ বৃষ্টি আনে সন্ধ্যা রাতে,
কয়েক মুহূর্তে খুব গোপনে মন বেঁধেছে তোমার সাথে”
কবিতাটির নিচে লেখা ‘নিরু….’
লেখাটা দেখে আচমকা হেসে উঠলাম আর মনে পরে গেলো সেই দিনের কথা। “নিরুপমা….তার সাথে কলেজ-স্ট্রিট-এ প্রথম দেখা হয়েছিল। একটু অস্বাভাবিক ভাবেই আলাপ; আচমকা একটা ধাক্কায়। দু’জনেই ‘সরি’ বলে উঠি, তারপর কি করে একটা ছোট্ট আলাপ তৈরি হল। সেও ডাক্তারি পড়বে; আমার থেকে একবছরের ছোটো। কয়েকটা বই সে পাচ্ছিলো না, আমি খুঁজতে সাহায্য করেছিলাম। ওখানেই শেষ। তার এক বান্ধবী তাকে ‘নিরুপমা’ বলে ডেকে ওঠায়, সেই থেকেই নাম জানা। তারপর আর কখনো দেখা হয়নি, আলাপ তো দূরের কথা। সেদিন চোখ বন্ধ করলেই তার ছবিটা ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো আমার হৃদয়ের বসন্ত কেটে নতুন পুষ্প যেন ফুটে উঠেছে। সেইদিন রাতেই বইয়ের পাতায় তাকে নিয়ে চার লাইন লিখেছিলাম। তারপর তো আচমকাই জীবনে ঝড় নেমে আসে, আর ঝড়ের রেশ কাটতে অনেকটা সময় লেগে যায়। ততদিনে তাকে ভুলেই গেছিলাম, আজ এই লেখাটা দেখে মনে পরে গেলো নিরুপমার কথা। এখন মনে পরেও লাভ কি? অনেকটা সময়ের ফারাক; আর সে কি আমায় মনে রেখেছে নাকি? হয়তো কবেই ভুলে গেছে!
অফিসের বাসে প্রতিদিন একই সিটে বসতাম জানলার ধারে। তারপর ব্যাগ থেকে হেড-ফোন বের করে কানে গুঁজে চোখ বন্ধ করে গান শুনতাম। একদিন বাড়ি ফেরার সময় বসে আছি হঠাৎ আমায় কেউ বলে উঠল, “এই যে শুনছেন?”
আমি চোখ খুলে অবাক, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে। সেই এক মুখ, একই রকম চোখের কাজল; শুধু চোখের চশমাটা এক্সট্রা। তাছাড়া পুরো নিরুপমার মতো দেখতে। হঠাৎ আমার দৃষ্টি ভঙ্গির ব্যাঘাত ঘটিয়ে সে বলল, “এই যে, আমাকে জানলার ধারের সিটটাতে বসতে দেবেন?”
আমি আনমনেই ঘাড় নাড়িয়ে দিলাম। আমি তার পাশে বসলাম। বাসের অন্যান্য সিট্ ভর্তি ছিল তাই হয়তো আমার এখানে বসলো। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হাই আমি নিরুপমা, নিরুপায় রায়, আজই আমার অফিসে ফার্স্ট ডে।”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, “নমস্কার আমি আকাশ।”
সে একটু হেসে জালনার দিকে মুখ করে রইল। বাগবাজার আসতেই বাস থেকে নেমে গেলো; আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে তারপর আস্তে-আস্তে পথের মাঝে মিলিয়ে গেলো। আমার বিশ্বাস হল না এই একঘণ্টার মুহূর্ত টা। পরদিন সকালে যথারীতি আমি জানলার ধারের সিটটা ফাঁকা রাখলাম, বাগবাজার থেকে সে উঠল আর এই সিটটাতেই বসলো। বলল, “বাব্বা আমার জন্য সিটটা রেখে দিয়েছেন বুঝি?” আমি কিছু বলতে পারলাম না, একটু হাসলাম।
এখন আর গান শুনি না, হেড-ফোনটা ব্যাগেই রয়ে যায়। নিরুপমার আসা-যাওয়ার মুহূর্তটা অনুভব করি আর মাঝে-মাঝে তাকে আড়-চোখে দেখি। এইভাবেই কাটছিল। তার প্রতি একটা গুপ্ত আকর্ষণ, যা ভালোবাসায় পরিণত হচ্ছিলো সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম। তার সঙ্গে এখন বন্ধুত্বটা ভালোই জমেছে। বাসে যাওয়া-আসার পথে অনেক কথা হয়। তার বাড়িতে বাবা-মা, দাদু-দিদা সবাই আছে; জয়েন্ট ফ্যামিলি। সে বাড়ির একমাত্র মেয়ে।
এই ভাবে কিছু মাস কেটে যায়। একদিন আমি বলি, “এই রবিবার ছুটির দিন, কোথাও দেখা করবে? যদি অসুবিধা না থাকে!”
সে বলল, “আচ্ছা করতে পারি, কিন্তু জায়গাটা আমি ঠিক করবো; বাগবাজার গঙ্গার ঘাট বিকেল ৫ টায় চলে এসো।”
আমি বললাম, “আচ্ছা আসবো।”
যথারীতি ঐ দিন বিকেলে পৌঁছে গেলাম। সে আগেই চলে এসেছিলো। আমরা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছি। হালকা হাওয়ায় নিরুর খোলা কেশ তার মুখের মধ্যে এসে পড়ছে। আমি তার চুল মুখ থেকে সরিয়ে বললাম, “আমাকে চিনতে পারোনি নিরু?”
সে একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। আমি বললাম, “মনে আছে, ছয় বছর আগে কলেজ-স্ট্রিটে বই কিনতে গিয়ে ধাক্কা লেগেছিল।”
“তার মানে তুমিই সেই?”
“হ্যাঁ, আমিই সেই। তারপর থেকে চোখ বন্ধ করলেই তোমাকে দেখতে পেতাম। উচ্চমাধ্যমিকের আগে বাবা মারা যায় আর পরিবারের দায়িত্ব নিজের উপর পরে। এসবের মধ্যে তোমায় ভুলেই গেছিলাম, কিন্তু বাসে সেদিন তোমায় দেখার পর বিশ্বাস হচ্ছিলো না তুমি আবার ফিরে আসবে এই ভাবে।”
দুজনেই চুপ করে রইলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্যি তখন গঙ্গার জল লাল করে নিদ্রায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিরু হঠাৎ বলে উঠল, “ভালোবাসো আমায়?”
আমার মুখের গুপ্ত অপ্রকাশ্য ভাব বুঝে নিতে তার বেশি সময় লাগেনি হয়তো। কিছুক্ষণ পর আমি বলি, “হারিয়ে যাওয়া পরিচয়-হীন মানুষটাকে আবার কখনো ফিরে পাবো ভাবিনি, আজ ফিরে পেয়ে আর হারাতে চাই না।”
সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমার কাঁধে মাথা রেখে সুদূর গঙ্গার দিকে তাকিয়ের রইলো। নিদ্রা মগ্ন রবির আলো পড়ন্ত বিকেলের রেশ কাটিয়ে সন্ধ্যে নামার আভাস দিচ্ছে। আর আমাদের দুইটি হৃদয় একত্রিত হয়ে অস্তগামী সূর্যের কোমল রঙে রঙিন হয়ে চলেছে।
©somewhere in net ltd.