| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাস্কর পাল
আমি এক কলমধারী বিরাগী,, কাল্পনিক তাই কল্পনাটাই বেশি
শেষ ট্রাম
-ভাস্কর পাল
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় রোজই আমার ট্রামে করে ফেরা অভ্যাস।Esplaned to Sham bazaar রাতের শেষ ট্রাম টা ধরে এক দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে বসা। তারপর কিছুক্ষন রাতের ব্যাস্ত কলকাতা কে জানালা দিয়ে দেখা তারপর ব্যাগ থেকে হেডফোন টা বেড় করে কানে গুঁজে বিরহের সেই রবীন্দ্র সংগীত কিংবা পুরনো হিন্দি গান চালিয়ে চোখ বোজা।
চলন্ত পথে বিছানো সাপের মতো এঁকেবেকে চলা লাইন ধরে ব্যাস্ত কলকাতা কে পিছনে ফেলে ঢিক ঢিক করে এগিয়ে চলা। সিগন্যাল ছাড়াই এগিয়ে চলা কিংবা শত ভিড়ের মাঝে সাপের মতো পথ খুঁজে নেওয়া সবই পারতো কিন্তু এই ঐতিহ্য কে পিছনে ফেলে সবাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যই হয়তো ট্রাম গুলোর অর্ধেক সিট্ খালি রয়ে যেত।
দীর্ঘ ২ টো বছর ট্রামে করে ফিরে ট্রাম বীনা ফেরার কথা ভাবতে পারি না এখন আর। আমি নেমে যাই কলেজ স্ট্রিটে। ট্রাম আর কলেজ স্ট্রিট এই দুটো নামই যেন আমার সাথে মিশে গেছে। প্রথম যখন ক্লাস ইলেভেন এ কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলাম বাবার সাথে তখন বুঝিনি এই স্ট্রিটে এসেই বারবার আমায় হারিয়ে যেতে হবে তার মায়ায়। এ কলকাতা বড্ড মায়াবী। কেলেজ স্ট্রিটে নেমে বইয়ের মাঝ দিয়ে ফুটপাত ধরে হেটে শিয়ালদাহ যাওয়া তারপর কল্যাণী কিংবা রানাঘাট লোকাল ধরে বাড়ি ফেরা।
সকাল নয়টায় বেরোনো আর রাত্রির প্রায় সোয়া দশটায় বাড়ি ঢোকা এ নিত্য অভ্যাসেও যেন প্রেম আছে। দু-বছর ধরে এই অভ্যাসেই আমি অভ্যস্ত।
আজ বুধবার কাজের খুব ছাপ ছিল অফিসে। তাই খুব ক্লান্ত লাগছে। ট্রামে উঠেই নিজেকে সিটে হেলিয়ে দিয়েই। চোখ বন্ধ করলাম। কিছুক্ষন এই ভাবেই কাটার পর শুনতে পেলাম "টিকিটটা করে নিন, কলেজ স্ট্রিট এলো বলে"। চোখ খুলতেই চোখটা আটকে গেলে আমার বিপরীত দিকে বসা একজন কে দেখে। চোখে চশমা, হাতে ডাইরি কলম। কিছু ভাবছে আর কিছু লিখছে। আমি নিত্য যাত্রী কন্ট্রাক্টর দাদারাও চেনে আমায় কিন্তু এই ট্রামে এই মহিলাকে কখনো দেখিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই কলেজস্ট্রিট ঢুকলো। আজ আর হেটে যেতে ইচ্ছা করছে না। কলেজ স্ট্রিট নেমে অটো ধরে শিয়ালদাহ চলে গেলাম। তারপর ট্রেন ধরে বাড়ি। আমার নিত্য দিনের রুটিন শুরু।
পরের দিন ফেরার পথে আবার সেই মহিলা কে দেখলাম ধর্মতলার পরের স্টপেজ থেকে ওঠেন। হয়তো সেও আমার মতোই নিত্য যাত্রীনি হতে চলেছেন।
ভীষণ স্তব্ধ, উঠে বসলেন ব্যাগ থেকে সেই ডাইরি আর কলম বের করে একই ভাবে খানিক ভাবেন খানিক লেখেন। ভীষণ কৌতূহল হলো ডাইরির লেখা গুলোর প্রতি। কিন্তু কোন অজুহাতে কথা বলবো তা খুঁজে না পেয়ে আমিও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম।এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেলো। সেই ট্রাম সেই সময় সেই ডাইরি আর সেই চশমা পড়া মেয়েটি।
আজ খুব বৃষ্টি ছাতা ছিল না কোনো রকমে অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রামে ওঠা প্রায় ভিজেই গেছি। তার কাছেও আজ ছাতা ছিল না ভিজে ভিজে সেও উঠলো। তারপর ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুছতে লাগলো। বেশ কিছুটা পথে ঢিক ঢিক করে ট্রাম চললো। বৃষ্টিটা একটু কমেছে, ট্রাম ছন্দে ফিরেছে। সে তার ব্যাগ থেকে ডাইরি বের করতে গিয়ে ব্যাগ থেকে জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' বইটি পরে গেলে।আমি এই সুযোগ হাতছাড়া না করে, ক্ষণিক মুহূর্তের পদাঘাতে সেটা তুলে তাকে দিয়ে বললাম আপনার বইটা পরে গেছিল। সে ধন্যবাদ জানিয়ে ডাইরি খুলিলো। তার স্তব্ধতার ব্যাঘাত ঘটাতে পারলাম নাহ ।।
এই ভাবেই কয়েকটা মাস কাটলো মিটমিটিয়ে চাওয়া আর খুচরো কিছু বাক্যলাপ এর মাধ্যমে। এক দিন আমার সাথেই সে কলেজ স্ট্রিট নামলো। আমি জিজ্ঞাসা করে উঠলাম "হঠাৎ আজ এখানে নামা হলো"? সে উত্তরে বলেছিলো "কিছু বই কিনবো,, পুরনো বই কোথায় পাওয়া যায় জানেই??" আমি তাকে যথারীতি পুরনো বইয়ের দোকানের কাছে নিয়ে গেলাম বললাম "কি বই কিনবেন?" "জয় গোস্বামীর কয়েকটা কবিতার বই কিনতাম।" তা সব বইই কেনা হলো। তারপর সে ওখান থেকে বাস ধরে বাড়ি ফিরবে। বাসে ওঠার আগে আমি একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম "আপনার নামটা জানতে পারি!" সে প্রতি উত্তরে বললো "কেন বলুন তো! আপমার নামটা কি?" "আমি বাধ্য ছেলের ন্যায় বললাম "সৌজন্য, সৌজন্য সেন।" তার বাস এসে গেলো। সে ওঠার আগের মুহূর্তে ধন্যবাদ জানালো বই গুলো খুঁজে দেওয়ার জন্য আর বলে গেলো “আমি ইন্দিরা, ইন্দিরা রায়চৌধুরী”।।
রজনীর মধ্য প্রান্তে আসিয়া কলেজ স্ট্রিটের শতাধিক বইয়ের মাঝে, তাহার সেই কথা গুলো যেন জ্বলন্ত দীপ্তির ন্যায় আমার কর্ণে প্রবেশ করিয়া হৃদয়ে আসিয়া মিশিলো। সারা রাস্তা ফেরার পথে তার কণ্ঠ যেন নুতনের ন্যায় আমার মনের অন্তরালে বাজিয়া উঠিতেছিলো। তারপর আমি দুদিন অফিস গেলাম না প্রচন্ড জ্বর আর ঠান্ডা লেগেছিলো। হয়তো সেদিন রাতে ফেরার পথে শ্রাবণের শেষ বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই।
তারপর দিন অফিস গিয়ে ছুটির অপেক্ষায় ছিলাম। কখন ট্রামে উঠবো আর তার সাথে হয়তো নতুন কথোপকথন এর এক নতুন সূচনা ঘটবে। তার সম্পর্কে এতদিনে যা যা জেনেছিলাম সে ডাক্তারী পড়তো কিন্তু বাবা মারা যাওয়ায় তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। সংসার এর ভার বহন করতে তাকে চাকরিতে ঢুকতে হয়। আর শেষ আলাপে জেনেছিলাম তার নামটা। আমার কৌতূহল তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানার। সে ডাইরি তে কি আছে কি লেখে সে। চশমার আড়ালে তার চোখ দুটোয় অনেক রহস্যের ছাপ চোখে পড়েছে সেগুলো জানতে বড্ড ইচ্ছা করে। সারাদিন অফিসে বসে এই ভাবলাম। শেষ ট্রামের অপেক্ষাতে এই ভাবেই সারাটাদিন কেটে সন্ধ্যা নেমে আসলো।। সেই ট্রামে কাটানো আধা ঘন্টার সময়টা যেন আরো বাড়িয়া উঠুক ট্রাম তার গতি আরও ধীর স্থির করিয়া তুলুক। সময়ের ছন্দের প্রবাহমানতা আরও কমুক। আমি কেবল তার আঁখিদ্বায়ের মাঝে তাকিয়ে তাহার আঁখিতে লুকিয়ে থাকা সমস্ত রহস্য উদ্ধার করিব।
কিন্তু আমার সমস্ত প্রতীক্ষার আজ অবসান ঘটলো না। সে আজ উঠলো না ট্রামে। হয়তো আসেনি অফিসে। এই ভাবে একদিন দুদিন করে গোটা সপ্তাহ হয়ে গেল সে এলো না। সে একটা এনজিও তে কাজ করে এটুকু জানতাম। ভাবছি খোঁজ নেবো। পরদিন অফিস থেকে হাফ ডিউটি করে বেরিয়ে পড়লাম ধর্মতলার পরের স্টপেজে এসে নামলাম। তারপর লোক জনকে জিজ্ঞাসা করে অনেক খুঁজে পেলাম তার অফিসের খোঁজ। অফিসে তার খোঁজ নিতেই জানতে পারলাম সে আর নেই। গত সপ্তায় যেদিন আমি আসিনি অফিসে সেদিন তার বিরাট একসিডেন্ট হয়। কয়েক ঘন্টা বেঁচে ছিল তারপর সব শেষ।
আমি অফিস থেকে তার বাড়ির এড্রেস নিলাম। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কাউকে পেলাম না। পাশের বাড়ির একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তার মা তার মামার বাড়ি চলে গেছে। বড্ড একা হয়ে পড়েছে স্বামী মেয়ে দুজনকে হারিয়ে।
আমি নির্বাক আমি স্তব্ধ,, কোথা থেকে কি হয়ে গেলে কিছুই জানতে পারলাম না। অনেক কিছু যে জানার বাকি ছিল।এখন প্রতি দিন ট্রামে ফেরার পথে সেই সিটটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয় সে বসে ডাইরি তে লিখছে স্তব্ধতার গল্প। সবই এক আছে আমার ফেরার পথ, কলেজ স্ট্রিট, শেষ ট্রাম আর সেই চশমা পড়া মেয়েটা। ইতিহাস গড়লো সে ডাইরির অন্তরেতে, তবুও প্রতিদিন আমার যাত্রিণী হয়েই থাকে সেই শেষ ট্রামে,, আমার বিপরীত সিটটাতে।।
©somewhere in net ltd.