নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পোকা মাকড়ের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু দিন বেঁচে থাকা

.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা

সাঈফ শেরিফ

আমার প্রোফাইলের পুরোটাই অন্ধকার, আলো নেই |যৌবনে যন্ত্র শাসনের পুঁথিপাঠ কালে মনে বাসা বাধে দুরারোগ্য কর্কট রোগ, সেখান থেকেই দগদগে মানসিক ক্ষত | আজ তাই রুটি-রুজির দায়ে কোনো এক বিরান ভূমে নির্বাসিত, দেশে ভিক্ষে নেই | জীবন ধমনীর ভেতর থেকে কন্টাকীর্ণ ডালপালা টেনে হেচড়ে জুটে দুটো পয়সা, চিকিত্সার পথ্য| সংকীর্ণ হয়ে আসা অস্তিত্বে তাই অভুক্ত থাকা হয় অনেক প্রহর, সেখানে নিদ্রা, স্নান , ক্ষৌরকর্মের সময়, সুযোগ প্রায়শই নেই |দূর ভবিষ্যতে সুস্থতার সনদ নিয়ে দেশে ফিরলে, ততোদিনে হয়ত জীবনের চাহিদাশূন্য নির্বিকার কেউ একজন |

সাঈফ শেরিফ › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক লাখ ষাট হাজার টাকা

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ ভোর ৬:৪৫

শৈশবে আফজাল আঙ্কেলের বর্ণালী কনফেকশনারিতে যাওয়াটা ছিল আনন্দের বিরাট এক উপলক্ষ । বোয়াম ভর্তি চকলেট, তাক ভরা বিস্কুট, ট্রে ভর্তি মিষ্টির কনফেকশনারি ছিল সেটি। খাবারের বিপরীত তাক ভর্তি খেলনা। আমি শূণ্য হাতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। খেলনা হাতে পাবার সর্বশেষ স্মৃতি তারও অনেক আগে । অস্ট্রেলিয়া গিয়ে খেলনা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন বাবা। খেলনা পাবার স্মৃতি এতটুকুই ।খেলনা বা চকলেট জাতীয় 'অন্যায়' আবদার করার সুযোগ হয়নি বাবার হোটেলে। ঘটনাচক্রে ১৮ টাকা পেয়েছিলাম মায়ের মারফত। শহরে গেলে ১৫ টাকায় টেনিস বল পাওয়া যায়। বাসার কাছে আফজাল আঙ্কেলের দোকানে ১৮ টাকায় পাওয়া যাওয়া উচিৎ!



দোকানের কর্মচারী মোটাসোটা কাসেম ভাই এর হাতে ১৮ টাকা দিয়ে বললাম ওই টেনিস বলটা দিন । কিন্তু সেটার দাম ২২ টাকার কম তিনি রাখবেন না। অনেক অনুনয়, বিনয় করেও তাকে গলানো গেলনা । চার টাকার জন্য সেবার আমার টেনিস বল কেনা হয়নি।



অন্যের বল-ব্যাট হাতে নিয়ে বিকেলের খেলাধুলা চালিয়ে গিয়েছি ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত। তারপরে বন্ধ হয়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা যখন চাঁদা তুলে দল করে খেলা শুরু করে। অর্থাভাবে আমার আর কখনই খেলার মাঠে ফিরে যাওয়া হয়নি। ঠিক আছে পড়াশোনাই করি, খেলে সময় নষ্ট করে তো ভাল চাকুরি মিলবেনা।



আমি বাবার কাছে কিছু চাইনি। কিন্তু পরের সম্পদ দেখে মন খচখচ করা মানুষ বিরল না। স্কুলের প্রতিটা ছেলের যখন সাইকেল, আমার সাইকেল পাবার প্রয়োজনটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। মার মারফত জানতে পারি স্কুলে প্রথম হলে সাইকেল মিলবে, ২ য় হলে ভাল ঘড়ি বা জুতো, ৩ য় হলে হরলিক্স। পুরস্কারের লোভের চাইতে বাবার ভয়টা ছিল পড়াশোনায় মন দেবার মূল কারণ। নিজের কাছে শপথ করলাম কোনদিন টিভি দেখবোনা, খেলতে যাবোনা। সহপাঠীদের কেউ খেলতে ডাকলে বিরক্ত হতেন বাবা। ওরা ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে চলে যেত।এমনকি ঈদের দিনেও ঘরের বাইরে আমাকে পাওয়া যেতনা।



মেধাশূণ্য সেই ছাত্র অমানুষিক পরিশ্রম করে বাবার ৩য় পুরষ্কার হরলিক্স জিতেছিল। সেই প্রাপ্তিতে তাই অনিবার্য কারণে সহপাঠীদের ধিক্কার ছিল।



"আমাদের মত খেলা ধুলা, আড্ডা দিয়ে পড়াশোনা করলে তুমি ফেল করতা মিয়া!"



শুধু পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে ভাল ফলাফল করা মেধাবী অনেক, তাদের সমাদরও বন্ধু মহলে ব্যাপক। আসলে ভাল ফলাফল করতে খুব বেশি পরিশ্রমী হওয়া লাগেনা, কৌশলী, মেধার পরেও কিছুটা ভাগ্যের স্পর্শও লাগে। অথচ আমার মনে হত এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলে ছিটকে পড়বো, ফেল করবো। বাবা নীল রঙের পোগ্রেস রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে তীর্যক মন্তব্য করবেন যদি ১ম স্থানের বাইরে কিছু দেখেন। কাজেই কৌশল, মেধার চর্চা, সময়ানুবর্তিতা কোন কিছুই হিসেবের মাঝে আসতো না।

প্রতিবেশি আন্টি যখন এসে দেখে গেলেন প্রায় অন্ধকার এক ঘরে মেঝেতে বসে পড়ছি --বাবা-মাকে শুনিয়ে গেলেন ছেলেকে একটা পড়ার টেবিল কিনে দেননা কেন ? ক্লাশ এইটে উঠে পড়ার টেবিল জোটে আমার এবং প্রথমবারের মত একটা বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার মর্জি হয়।



বাবার কলিগদের সামনে বাবার মাথা উচু রাখাটা এক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পুরোপুরি নিরাশ করিনি তাকে । প্রাথমিক, জুনিয়র দুটোতেই ট্যালেন্টপুল ছিল।মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয় আমার বাবার কী অর্থাভাব ছিল? তার চাইতে বরং নিজের পায়ে দাড়িয়ে নিজেরটা নিজে করে বাঁচার নির্দেশনা ছিল তাঁর উঁচু গলায়। আমি জানি আমার বাবার বাসা একান্তই আমার বাবার--সেখানে আমি অতিথি মাত্র । সেখানে বেড়াতে গিয়ে একটা ক্ষণস্থায়ী হোটেল মনে করেছি সব সময়। ছটফট করেছি কবে নিজের পায়ে দাড়াবো, নিজের রোজগার হবে, মুক্তি পাবো বাবার হোটেলের কারাবাস থেকে।



বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝলাম ছাত্রাবাসে আমাকে নির্বান্ধব হয়েই কাটাতে হবে। ক্লাশ সিক্সের পর থেকে যে নির্বান্ধব, ঘরবন্দী-- তার মানসিক পছন্দ ও প্রবৃদ্ধি সমকালীন-সমবয়সীদের সাথে যাবেনা ---এটাই ছিল মর্ম কথা। আড্ডা দিলেই 'মেধাশূণ্য' ছাত্রের ফেল করার ভয় আকড়ে ধরতো, অথবা অতিরিক্ত পড়ার জন্য মেধাশূণ্য ছাত্রের 'আতলামি' করার বাড়াবাড়ি দেখানো হত বুঝদার ছাত্র পাড়ায়।



সময়ের মত অর্থ আতঙ্ক আমাকে আকঁড়ে ধরতো। টাকা পয়সার সমস্যায় পড়লে তো বাবা দিবেন না-- এটা জেনেই বয়স বেড়েছে।নির্বান্ধব ছিলাম বলে কোন বন্ধুর কাছে হাত পাতা যাবেনা-- সেটিও ছিল মাথায়। ১০০ টাকায় ৫০ ইউনিটের কার্ড কিনে ফোন বুথ থেকে সময় গুণে মাকে ফোন দিতাম। ফলাফল খারাপ হবার ভয়ে টিউশানি করাতাম না। বাবা যে ২-৩ হাজার পাঠাতেন ভালই চলে যেত। সেখান থেকে কিছু বাচাতাম, বিপদে-আপদে যদি লাগে। ভাল শার্ট, ব্র্যান্ডে কিছু, শৌখিন হবার কথা ভুলেও ভাবতাম না। মেধাশূণ্য, আতঙ্কবাদী, দুর্বল চিত্তের জীবদের বিপদাপদ মনে হয় বেশি হয়, সাহসীরা এত দুর্ভাগা হয়না।



কিন্তু কি অদ্ভুত নিয়তি! জীবন যুদ্ধের যতসব ঝামেলা এড়াতে যেই আমি ঘরবন্দী ছিলাম, পরের কথায় সাহস করে ঘর থেকে বেরিয়েই আমি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ি। ঋণ আমাকে জাপটে ধরে, অযোগত্য-অপ্রাপ্তি-অর্থহীনতার খোটা দেয়, জীবন নামক জুয়া খেলে নিঃস্ব হবার আতঙ্ক তৈরি করে। মনে হয় এখনও সেই বাবার হোটেলে দায়বদ্ধ হয়ে বন্দী আছি, বহু যুগ পরেও নিজের পায়ে দাড়িয়ে ওঠা হয়নি।



টিকে থাকতে হলে আমাকে আবার জুয়া খেলতেই হবে। খেয়ে না খেয়ে জমানো এক লাখ ষাট হাজার টাকা নিয়েই আমাকে জুয়ার আসরে হাজির হতে হবে। ঘরবন্দী গরু সিদুরে মেঘ দেখে ডরায়, সাহসের পরীক্ষা দিতে দিতে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তায় জীবনটা দম বন্ধ করা প্রাগৈতিহাসিক গুহার মত মনে হয়।



ওভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে জুয়ার আসরে নিঃস্ব, রিক্ত করে দিলেই যদি মুক্তি মেলে।









মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৮:০৪

অকপট পোলা বলেছেন: মনে হলো যেনো নিজের জীবনের ছায়া পড়লাম! আমার বাবা একটু ভিন্ন হলেও মর্ম একই ছিলো। আমিও জমিয়েছিলাম প্রায় আশি হাজার টাকা।

কিন্তু আজ যখন মনে হয় কত সুখ আর ছোট ছোট আনন্দের বিনিময়ে ঐ টাকা জমেছিলো, তখন টাকা পয়সা কে বড়ই মূল্যহীন মনে হয়। ছোট একটা দুর্ঘটনা শেষ করে দিতে পারে ঐ নগন্য সন্চয়। তো কি লাভ ঐ ত্যাগ বা সন্চয়ে!


তবে ভাই মনে করবেন যে হয়তো তাই আপনি আজ সফলতার প্রান্তে। আরও ভালো অবস্হানে। জানি বলবেন যে, ঐ ত্যাগ না হলেও আপনি এখানে থাকতেন! বাট, একচুয়ালী, হু নোওজস?? ভবিষ্যত সুন্দর আর আনন্দময় করার যথাসম্ভব চেষ্টা করুন। সেটাই আসল এখন..

২| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৮:২৪

আহমেদ আলিফ বলেছেন:
একটু আমার কথা বলি ! আমার বাবা আমাদের প্রচুর পিটাতেন :((
অবশ্য তিনি বলতেন আমাদের ভালোর জন্যই তিনি তা করেন কিন্তু আমার কখনো বিশ্বাস হতো না । এখনো আমার চোখের সামনে সে ঘটনাগুলি ভাসে । আমি নিয়ত করেছিলাম আমার ছেলে মেয়ে হলে তাদের কখনো মারবো না । এখন আমার সারে চার বছরের একটা ছেলে । এখন মনে হয় বাবা সন্তানের ভালোর জন্যই করেছেন । এতটা বেশি না হলেও কিছুটা শাসন অবশ্যই দরকার ।
"বাবা তোমাকে ভালোবাসি"

৩| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৯

ঝটিকা বলেছেন: পাচ ভাই বোন ছিলাম আমরা। আব্বার সরকারী চাকরির হিসাবের টাকা। নিউজ প্রিন্ট কাগজ, প্লাসটিকের কেড্স, কোন প্রাইভেট টিউটর বিহীন আমাদের পড়ালেখা। চিনির দাম বেশি ছিল বলে চা'য়ে গুড় খেতে বলতেন। শ্যাম্পু, তুথপেস্ট আমার আব্বার কাছে বিলাশিতা মনে হত। যদিও আর্থিক অবস্থা এতটা শোচনিয় ছিল না, উনার ধারনা ছিল বিলাশি জীবনে লেখা পড়া হয় না। এখন আমাদের চিন্তা ধারা বাবা মা'দের থেকে কত পার্থক্য!!মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের ছেলে মেয়েদের কি ভালোভাবে মানুষকরতে পারব?

৪| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:০৭

উম্মু আবদুল্লাহ বলেছেন: পড়লাম। আপনি আপনার দুঃখ বিলাসকে ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাবার শাসন আর মায়ের ভালবাসা পাবার সৌভাগ্য খুব বেশী মানুষের হয় না। আপনি সেই ভাগ্যবান কয়জনের একজন। ভাল থকুন। পারলে আপনার বাবা মাকে আমার সালাম পৌছে দেবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.