নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বুনোগান

বুনোগান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেসবুক বান্ধবী

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:২৭

ফেসবুক বান্ধবীর আমন্ত্রণ পেয়ে একটা ব্যাক-পেকে কিছু কাপড় গুছিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। জীবনী দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাবার সময় তাকে আমার অভিসারের আপডেট দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। অবশ্যই টাইম টু টাইম আপডেট দিব বলে তাকে আশ্বস্ত করেছি।

আমাকে এয়ারপোর্ট ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চড়তে হবে। ফারিয়াই আমার টিকেট কেটে রেখেছিল। গন্তব্য কোথায় আমি এখনও জানি না, জানি সে তার মায়ের বাড়ী যাচ্ছে। গতকাল রাতে সে ম্যাসেজে জানিয়েছিল। আমি মজা করে বলেছিলাম আমিও যাব। চল। এই হোল কথা। ষ্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেন আসতে আরও কিছু সময় বাকী। সে আগের ষ্টেশনে ট্রেনে উঠেছে।

জীবনীকে আগের রাতে বলতেই সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল,
-- যাক তোমার এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ পেয়ে গেলে দেখছি!
আমি মুচকি হেসে--- দেখা যাক কি হয়।
আমরা এই এক্সপেরিমেন্টের বিষয়টি বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম। আমার একটা রোগ আছে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি ভেবেছি। আর সেগুলো শুধু ভাবনায় আবদ্ধ ছিল না, সেগুলো বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত নিজেকে হিপোক্রেট বলে মনে হত।

এই সকালেও ষ্টেশনে বেশ ভীর। প্লাটফর্মের চাতালটা বেশ লম্বা। মাথার উপরে পর পর ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বসানো। সেখানে কোন ট্রেন আসছে যাচ্ছে তার ডিসপ্লে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ ঘোষণাও দিচ্ছে।
ফারিয়ার ট্রেনটি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ফারিয়ার সাথে দেখা হবে বলে আমার কিন্তু সে রকম এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বহুদিনের পূরানো বন্ধুর সাথে দেখা হবে। আসলে অল্প কিছুদিন আগে ফারিয়ার সাথে আমার পরিচয়। ম্যাসেঞ্জারেই পরিচয়, ম্যাসেঞ্জারেই কিছু ভাবনার আদান প্রদান। আমার অদ্ভুতুড়ে ভাবনা হয়তো বা তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
ভাবনা সবাই ভাবে, এ এমন আশ্চর্য জনক কিছু না। মনে মনে সবাই কথা বলে। এক মুহূর্তের জন্যেও এই কথা থেমে থাকে না। কথা মানেই ভাষা। মানুষ তার উচ্চারিত শব্দের উপর বিমূর্ত অর্থ আরোপ করেছে, যা সমাজের সকলের কাছে একই অর্থ বহন করে। এটাই ভাষা। ভাষায় সামাজিক জ্ঞান সঞ্চিত থাকে। সেই জ্ঞানের পরিসরে আমরা যা ভাবি সেটাই ভাবনা। প্রায়শই আমার ভাবনা কোন বিষয় নিয়ে আবর্ত হতে থাকে।
ইদানীং একটা ভাবনা আমাকে বেশ পেয়ে বসেছে।
মানুষের নৈতিকতা-বোধে আমি বেশ আশ্চর্য হই। ঘৃণা থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত খুন করে যাচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি কোনায় যুদ্ধ বিগ্রহ, হিংসা বিদ্বেষ লেগেই আছে। এইসব ঘৃণা মানুষের নৈতিকতা বোধে বিশেষ নাড়া দেয় না। কিন্তু আন্ত সম্প্রদায়-গত এমন কি লিঙ্গ ভিত্তিক মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই অনৈতিক চোখে দেখে। এর মধ্যে নর নারীর ভালোবাসা সহজাত প্রাকৃতিক। সমাজ তো বটেই বিবাহিত জীবনে পর নর নারীর মধ্যে ভালোবাসা ভয়ংকর রকম অগ্রহণ যোগ্য ব্যাপার। কিন্তু এই ভালোবাসা বা আকর্ষণ বলে কয়ে আসে না। এবং আসে বলেই, এর প্রতি প্রচণ্ড ঈর্ষা থেকে বিবাহিত জীবনে যত সন্দেহ ও অশান্তির জন্ম নেয়।

এই প্রসঙ্গে আমি আমার নিজের বিবাহিত জীবন নিয়ে অনেক ভেবেছি। এই মধ্য বয়সে এসে আমি দেখলাম আমার আর জীবনীর মাঝে মানসিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। দু'জনেই আট নয় ঘণ্টা করে অফিসে কাটাই। ঘুমানোর সময় বাদ দিলে বাসায় তিন চার ঘণ্টা নিজেদের জন্য সময় পাই। সেটাও কেটে যায় সংসারের হাজারো সমস্যা ও ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ আলোচনা করে। নিজেদের একান্ত করে পাওয়া, প্রেম ভালোবাসার কথা বলার সময় কোথায়? সেই একঘেয়ে জীবন।
জীবনের বেশীর ভাগ সময় অফিসের কলিগদের সাথেই কাটাতে হয়। কলিগদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনাই জীবনের অংশ হয়ে উঠে। অফিসই হয়ে উঠে পরিবার। একটি যৌথ পরিবার। যেখানে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে সম্পর্কের একটি জাল তৈরি হয়ে যায়। অফিসই হয়ে উঠে জীবনের মূল অংশ।
বিবাহিত একঘেয়ে জীবনের ফাঁকে কখন যে কোন কোন কলিগ বা বসদের সাথে মানসিক শেয়ারিং এর সম্পর্ক গড়ে উঠে সেটা টেরই পাওয়া যায় না। শেয়ারিং থেকে ঘনিষ্ঠতা, ঘনিষ্ঠতা থেকে জৈবিক আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এই আকাঙ্ক্ষা আবার বিবাহিত জীবনে একঘেয়ে জৈবিক চিত্তকে কিছুটা জাগ্রত করে বৈকি!

অফিসের আট নয় ঘণ্টা জীবনে যে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ঘটবে না এটা বলা যায় না। মানুষের পশু প্রবৃত্তি তাকে যে সেদিকে চালিত করবে এতে কোন সন্দেহ নাই। শিম্পাঞ্জী বা ওরাং ওটাংদের মত মানুষের সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতেও রয়েছে পশু প্রবৃত্তির কিছু সহজাত প্রাকৃতিক নিয়ম। যে কোন সামাজিক দলেই আলফা পুরুষ অথবা আলফা নারী তৈরি হয়ে যায় যারা দলের অন্যান্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। দলের অন্যান্যরা তাদের আধিপত্য স্বীকার করে নেয়। পুরুষেরা মনে করে সকল নারীদের প্রতি তার অধিকার রয়েছে, তাই অন্য পুরুষেরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সহজাতভাবেই প্রচণ্ড ঈর্ষা-কাতর। তদ্রূপ নারীরাও তার পছন্দের পুরুষদের প্রতি একই মনোভাব পোষণ করে থাকে। অফিসেও এই সামাজিক মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকে, কেহ কেহ থাকে আধিপত্য-কারী, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি থাকে নমনীয়তা, আবার কেহ অনুসরণকারী। বলা যায় অধিকাংশ থাকে অনুসরণকারী।

আমি আমাদের বৈচিত্রহীন দাম্পত্য জীবনের বিষয়টি নিয়ে জীবনীর সাথে অনেক আলোচনা করেছি। আলোচনায় এটাই উঠে এসেছে যে ভালোবাসা বা ভালোলাগা শুধুমাত্র দাম্পত্য সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সহজাত প্রবৃত্তির কারণে অনেকের সাথেই ভালোলাগা থেকে মানসিক বা জৈবিক সম্পর্ক হতে পারে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ আমাদেরকে মানসিকভাবে অপরাধী করে তোলে। আমরা পরস্পরের কাছে সংকুচিত হয়ে থাকি। দাম্পত্য সম্পর্কে সৎ থাকতে হলে ঈর্ষা কাটিয়ে পরস্পরের গোপনীয়তা শেয়ার করা উচিত। উভয়েই স্বীকার করলাম আমাদের কিছু গোপন ভালোলাগা রয়েছে। যখন উভয়ে উভয়ের গোপন ঘটনাগুলো শেয়ার করলাম তখন দেখলাম আমাদের মানসিক পর্দা অনাকটা সরে গেছে। আমরা উভয়ে ভাল বন্ধু হয়ে উঠলাম এবং দেখলাম আমাদের একঘেয়ে সম্পর্ক আবার বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটনা বলার ছিল। ঘটনাগুলো শেয়ার করতে গিয়ে আমরা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। এই রোমাঞ্চের রেশ আমাদের মৃত প্রায় জৈবিক অনুভূতিতে পুনরায় শিহরণ জাগাচ্ছিল।

বিবাহিত জীবনে প্রচলিত ধারণা হোল ভালোবাসা বা ভালোলাগা শেয়ার করা যাবে না। স্বামী স্ত্রী পরস্পর বিশ্বস্ত থাকতে হবে। অনেকটা দাস মালিকের সম্পর্কের মত। যেন স্বামী স্ত্রী পরস্পরের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কোন বস্তুগত বিষয়। মানুষ হিসেবে যার কোন ব্যক্তি সত্ত্বা নেই। নেই কোন একান্ত ভালোলাগা, ভালোবাসা, পছন্দ অপছন্দের বিষয়। কিন্তু ভালোলাগা হোল বিচিত্র-গামী। একটি ভালোলাগা আর একটি ভালোলাগা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় না। বরং বিবাহিত জীবনে এসে ভালোলাগাগুলো কাটছাঁট করে ফেললে মানুষ মানসিক ভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পরে। হাড়িয়ে ফেলে জীবনের বৈচিত্র্য। তাই সহজেই বিবাহিত জীবন হয়ে যায় একঘেয়ে।

সম্পর্কের শুরু থেকেই আমরা পরস্পরের ব্যক্তিসত্তার সন্মান করেছি। ভাল মন্দ মিলিয়েই মানুষ। ভাল মন্দকে মেনে নিয়েই আমাদের ভালোবাসা বিকশিত হয়েছে। এবার বাকী রইল ভালোলাগার শেয়ারিং। এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হোল ঈর্ষাকে জয় করা। পরস্পরের গোপন ভালোলাগার কাহিনী শেয়ার করে আমরা ঈর্ষাকে পরাভূত করতে পেরেছিলাম।
একবার সুযোগ এলো বাস্তবতার নিরিখে সেটা যাচাই করার। জীবনীর সেই ভালোলাগার মানুষটিকে নিয়ে আমরা কুষ্টিয়া ভ্রমণে বেড়িয়ে পরেছিলাম। শিশির জানত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা। তাই তার মধ্যে কোন অশ্বস্থি ছিল না। গাড়িতে জীবনী আমাদের মাঝখানে বসেছিল। সেই দীর্ঘ যাত্রা সত্যি রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল। বহুদিন পর জীবনী কিশোরীর উচ্ছলতা নিয়ে জেগে উঠেছিল। আমরা একটা রিসোর্টে তিন দিন ছিলাম। জীবনী তার প্রতিটি রোমাঞ্চকর ঘটনা আমার সাথে শেয়ার করেছে। প্রকৃত বন্ধুর মত তার খুশিতে আমিও খুশী হয়ে উঠছিলাম। অনেকের কাছে এটা একটা বিকৃতি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে তা মনে হয়নি। সমাজের চোখে কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা বিকৃতি সেটা বুঝে উঠা বেশ কঠিন। বিবাহের নামে একটি অপরিচিত মানুষকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া কি বিকৃতি নয়?

মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির বাইরে কোন কিছু করতে পারে না। সহজাত প্রবৃত্তির বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়াই বিকৃতি। যেমন যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে জোড় পূর্বক সম্ভোগ। কিন্তু অনেক সমাজে এটা নিয়মসিদ্ধ। সহজাত প্রবৃত্তিতে নারীরা একমাত্র পছন্দের পুরুষের সাথেই সম্ভোগ করে থাকে। পুরুষেরা জোড় না খাটিয়ে নারীকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করার চেষ্টা করে। সমস্ত পশু ও পক্ষী জগতই এই নিয়ম মেনে চলে। একমাত্র মানুষেরাই বিবাহের নামে নারীদের ধর্ষণ করে থাকে। পশু জগতে স্ব জাতিকে মেরে ফেলার কোন নিয়ম নেই। কিন্তু মনুষ্য জগতে স্বজাতিকে মেরে ফেলার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। এটাই বিকৃতি।
একেক সমাজে নৈতিকতার মাপকাঠি একেক রকম। কিন্তু নৈতিকতার সার্বজনীন মাপকাঠি কি? সেটা হোল প্রাকৃতিক নিয়মে যে নৈতিকতা নিহিত রয়েছে সেই নৈতিকতা। প্রাকৃতিক নৈতিকতা ছিল বলেই বিবর্তনের ধারায় লক্ষ লক্ষ বছর শুধু মানুষ নয়, সমগ্র জীব জগত টিকে আছে। সভ্যতার বয়স তো মাত্র চার হাজার বছর। প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করার ফলে ইতিমধ্যেই মানুষ প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, পড়ছে। এখন আমি যদি এই প্রাকৃতিক নৈতিকতাকেই আমার নৈতিকতার মাপকাঠি মেনে নেই তাহলে সমাজ আমাকে সমাজচ্যুত করবে। সমাজের এই অসহিষ্ণুতাই বিকৃতি।

হঠাৎ প্লাটফর্মে যাত্রীদের কোলাহল ও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করে পেছনে তাকিয়ে দেখি ট্রেন আসছে। কুয়াসার চাদর ভেদ করে প্রথমে ইঞ্জিন ও পরে একে একে বগিগুলোর আবির্ভাব দেখে মনে হচ্ছিল এক রহস্যময় গুহা থেকে ট্রেনটির আগমন ঘটেছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি রত যাত্রীদেরও কেমন রহস্যময় লাগছিল। আমি জানাগুলো লক্ষ্য করতে থাকি ফারিয়াকে দেখা যায় কিনা। একসময় কুয়াশা ভেদ করে ফারিয়ার হাস্যোজ্জল মুখটি দেখা গেল, সে হাত নেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ছবিতে দেখা ফারিয়ার মোটা জোড়া ভ্রু, মাঝখানে বড় লাল টিপ, মুখের বিস্তৃত হাসি ও দ্যুতিময় চোখ দেখেই আমি চিনতে পারলাম। ফারিয়াও ছবিতে দেখা আমাকে দেখেই চিনেছে। আমি বগিতে চড়ে ফারিয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। পাশাপাশি দু'টো লম্বা সিটের একটিতে ফারিয়া ও তার ছয় বছরের ছেলে বসা, আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছে। পাশে বসতেই মুচকি হেসে বলল-- এসেছ তাহলে? আমি--- দেখতেই পাচ্ছ! সামনের সিটে এক পরিবার বসে আছে। ফারিয়া অসমাপ্ত কথোপোথনের সূত্র ধরে তাদের সাথে মেতে উঠল। আমি তার স্বতঃস্ফূর্ততায় চমৎকৃত হলাম। আমার সেখানে কিছু করার ছিল না। তাই তার ছেলেকে নিয়ে একপাশের করিডোরে চলে এলাম। সেখানে জানালা দিয়ে চলমান গ্রামের দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। উচ্ছ্বসিত লিটন আমার মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক ফাঁকে আমি জীবনীকে আমার অভিযাত্রার আপডেট জানিয়ে দিলাম।

ট্রেনটি যমুনা পেরিয়ে একসময় উল্লাপাড়া ষ্টেশনে এসে থামল। আমরা একটা রিকসা ভেনে চেপে ফারিয়ার মায়ের বাড়ী এসে পৌঁছলাম। সেখানে লিটনকে তার নানীর কাছে সপে দিয়ে আমরা সোজা রবীন্দ্র কাছারি বাড়ীতে হাজির হলাম। এখানে এসে ফারিয়া কিশোরীর মত চপল হয়ে উঠল। এ যেন তার নিজের বাড়ী, আমাকে ঘুরে ঘুরে সবকিছু চেনাতে লাগল। এই তালগাছটা, এই কাঁঠাল গাছটা, এই চত্বর, এই গোলাপ ফুলের ঝাড় সব কিছুর সাথেই যেন তার শৈশব স্মৃতি মিশে আছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী। কাচারি বাড়ির দোতালার একটি গবাক্ষের ওপাশে বসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেন তার গল্পের মৃন্ময়ীকে রচনা করে চলেছেন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে তার জোড়া ভ্রুর নাচন, বড় বড় দ্যুতিময় দুটি চোখ আর মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেখানে বহুদিনের আবদ্ধ বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস উছলে উঠছিল। অস্তিত্ববাদী মৃন্ময়ী যেন তার নিজেকে ফিরে পেয়েছে। সেখানে আমি এক নিমিত্ত মাত্র। রবীন্দ্রনাথের তরু-গুচ্ছ যেন কাচারি বাড়ীর প্রাচীন বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। স্বভাবগত ভাবেই ফারিয়া চপল। কিছুটা বয়সী স্বামীর সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সমাজ সংসারের চাপে তার চপলতাকে চাপা দিতে হয়েছে। আজ নিয়মের বাইরে এসে সে যেন তার আমিত্বকে খুঁজে পেয়েছে। আমি গল্প শুনার ফাঁকে ফাঁকে জীবনীকে আপডেট দিচ্ছিলাম। সে ভীষণ আগ্রহী হয়ে কাচারি বাড়ীর গল্প শুনছিল।

সেখান থেকে ফারিয়া আমাকে মখদুম শাহ মাজার শরীফে নিয়ে গেল। করতোয়া নদীর পাড়েই মাজার শরীফ। সেখানে ভক্তদের অনেক ভীর। ভীর এড়িয়ে আমরা ঘাটে এলাম। সেখানে অনেক গয়না নৌকা যাত্রীর অপেক্ষা করছে। নদী ও নৌকা দেখে ফারিয়ার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ফিস ফিস করে বলল-- নৌকায় ঘুরব। আমরা বৈঠা টানা নৌকায় চড়ে বসলাম।
আহ, এই সেই করতোয়া। যার সৌন্দর্যে কবিগুরু মোহিত হয়েছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে লিখেছেন,
-- "আমি যে-সকল দৃশ্য এবং লোক এবং ঘটনা কল্পনা করছি তারই চারিদিকে এই রৌদ্র-বৃষ্টি নদী স্রোতে এবং নদীতীরের শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এই ছায়া-বেষ্টিত গ্রাম, এই জলধারাপ্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে এবং সৌন্দর্যে সজীব করে তুলছে- আমার নিজের মনের কল্পনা আমার নিজের কাছে বেশ রমণীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু পাঠকরা এর অর্ধেক জিনিষও পাবে না। তারা কেবল কাটা শস্য পায়, কিন্তু শস্যক্ষেত্রের আকাশ এবং বাতাস, শিশির এবং শ্যামলতা, সবুজ এবং সোনালি এবং নীল সে-সমস্তই বাদ দিয়ে পায়। আমার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে যদি এই মেঘমুক্ত বর্ষাকালের স্নিগ্ধ রৌদ্ররঞ্জিত ছোটো নদীটি এবং নদীর তীরটি, এই গাছের ছায়া এবং গ্রামের শান্তিটি, এমনি অখণ্ডভাবে তুলে দিতে পারতুম তা হলে গল্পটি কেমন সুমিষ্ট সজীব হয়ে দেখা দিত! তাহলে সবাই তার মর্মের সত্যটুকু কেমন অতি সহজেই বুঝতে পারত!"
আমি বুঝতে পারছিলাম, কারণ নদীর মাতাল হাওয়া আমার গায়ে শিহরণ জাগাচ্ছিল। এর নদীপারের শরবন, জেলেদের তোলা জাল, হাসেদের তর তর করে ভেসে যাওয়া, ওই দূরের গাছ গাছালি, দূরের গাঁ, তার কুড়ে ঘর, ছনের চাল বেয়ে রান্নাঘরের ধোঁয়া, এই প্রকৃতি, এই মায়া দুজনকে আচ্ছন্ন করে রাখছিল। আমাদের মুখে কোন কথা ছিল না। বর্ষার নদী পাশের ধান ক্ষেতে উপচে উঠেছে, প্রতিটি গাঁয়ের চরণ ছুঁয়ে, স্নান রত গৃহ বধূদের বসন স্বচ্ছ করে, বাঁশ ঝারের ছায়া মাড়িয়ে আরও ভিতরে কাদা মাটির পাড়ে ছোপাত ছোপাত শব্দ আমাদের হৃদয়ের ছন্দকে আদিম করে তুলছিল। এরই মাঝে আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মাঝি একটা বিচ্ছিন্ন ঝোপের কাছে নৌকা বেধে অপেক্ষা করতে লাগল। আমরা দুজন ছইয়ের ভিতরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগলাম। জগত সংসারের সমস্ত কোলাহল, সমস্ত নিয়ম নীতি সংকুচিত হয়ে ছইয়ের ক্ষুদ্র পরিসরে বৃষ্টির শব্দে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে শুধু অনুভব ছাড়া আর কিছু নেই। ফারিয়া আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। বৃষ্টির ছাঁটের সূক্ষ্ম জলকণা মুক্তোর দানা হয়ে ফারিয়ার চোখে মুখে, চুলে, ঘাড়ে চিক চিক করছে। তার মসৃণ কোমল ত্বক ছইয়ের আবছা আলো ছায়ায় অদ্ভুত দ্যুতি নিয়ে ফুটে উঠেছে। আমি হাতের তালুর উলটো পিঠ দিয়ে তার গাল, চিবুক, ঘাড় বুলিয়ে দিলাম। জল অথবা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘাড়ের পশম ফুলে ফুলে উঠছিল। ফারিয়া কিশোরীর মত খিল খিল করে হেসে উঠল।

স্পর্শের মধ্যে এক জাদুকরী শক্তি আছে। স্পর্শ দুজন মানুষের দূরত্বকে দূরীভূত করে। সমাজে আমরা নিজেদের চারিদিকে একটা দূরত্বের বলয় তৈরি করে রাখি। আমরা কারো হৃদয় স্পর্শ করতে পারি না। যেন মানুষের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতাই স্বাভাবিক। অথচ সমাজবদ্ধতা বোধ তৈরি হয়েছে স্পর্শ থেকেই। আদিম মানুষেরা গুহায় জড়াজড়ি করে বসে থেকে নিজেদের মধ্যে একাত্মতা অনুভব করত। শিম্পাঞ্জী বা ওরাং ওটাং-রা প্রায়শই নিজেদের জড়িয়ে ধরে। এই একাত্মবোধ সকলকে আশ্বস্থ রাখে, একাকীত্ব দূর করে। আধুনিক সমাজে আমরা এই অস্ত্রটি হাড়িয়ে ফেলেছি। একাকীত্বের বলয় বজায় রাখাই যেন আমাদের ব্যক্তিত্বের চাবিকাঠি। ফারিয়া আমার হাতের তালু দিয়ে তার গাল চেপে ধরে রাখল। গুনগুন করে গেয়ে উঠল রবি ঠাকুরের গান--
এমন ঘনঘোর বরিষায় –
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,

নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।

সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব –
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।

ফারিয়া হঠাৎ উঠে বসে আমার হাত ধরে ছইয়ের বাইরে নিয়ে এলো। বৃষ্টির ধারা কিছুটা কমেছে। যে দিকে চোখ যায় সফেদ জলধারা। গলুইয়ের নীচে মাঝি পলিথিন পেঁচিয়ে জবুথুবু বসে আছে। যেখানে নৌকা বাঁধা ছিল সেখান থেকে শরবনে সিঁথি কেটে একটা সরু আল উপরে উঠে গাছ গাছালির আড়ালে হাড়িয়ে গেছে। ফারিয়া নৌকা থেকে নেমে সেই সরু পথে উপরে উঠে গেল। জায়গাটা একটা ছোট দ্বীপের মত। চারিদিকে গাছ গাছালি লতা গুল্ম দিয়ে ঘেরা ঘাসে ঢাকা চাতাল। বৃষ্টির রুপালি ধারার নীচে সবুজাভ আভায় আবৃত এক ছোট্ট পৃথিবীতে এক মায়াময় রমণী প্রকৃতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। উর্ধ্বপানে বাহু জোড়া তুলে ঘুরছে, নাচছে, ভাসছে-- আমিও তার কাছে এসে নিজেকে প্রকৃতির সাথে বিলীন করে দিলাম। এতো প্রকৃতি বন্দনা, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ। সকল স্বর্গীয় ভালোবাসা, মানবতা, ধর্ম, নৈতিকতার উৎস মূলে আত্মার নিবেদন, মদমত্ত ঘূর্ণি। স্বর্গীয় জলধারা মাথার কেশদাম বেয়ে দেহের সকল কৃত্রিম আবরণ তুচ্ছ স্বচ্ছ অদৃশ্য করে ছন্দায়িত আভরণ উন্মুক্ত করে তুলছে। হে মানব মানবী নগ্ন হও! খুলে ফেল সভ্যতার কৃত্রিম যত গ্লানি, ভাষার যত আদর্শ সংজ্ঞা, যত ভাল মানুষীর মুখোশ। তুমি স্বামী নও, স্ত্রী নও, পিতা নও, মাতা নও, তুমি ভাল মানুষ নও---- তুমি হোমো সেপিয়ান। তুমি দু'পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছ পৃথিবীকে জয় করবে বলে, ধ্বংস করার জন্য নয়। তুমি ছিলে প্রকৃতির কোলে আদম ও ইভ। একটা অপ্রাকৃতিক নীতি তোমাদের পাপী করে দিয়েছে। পাপ ঢাকতে গিয়ে লজ্জা তোমাদের গ্রাস করেছে। একের পর এক নীতি লঙ্ঘনের পাপে তোমরা জর্জরিত। গ্লানির পর গ্লানির ক্লেদাক্ত পোষাকে তোমরা নিজেদের ঢেকে রেখেছ। তোমরা তোমাদের নিজের সত্ত্বাকেই হারিয়ে ফেলেছ। এই তুমি আসলে আসল তুমি নও। তুমি অন্তত একজনের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার, নগ্ন হওয়ার আকুতিতে ভুগছ! একাকীত্বে ভুগছ। নিঃসঙ্গতায় ভুগছ! তোমার তুমিকে প্রকাশ করতে পারছ না স্ত্রীর কাছে, স্ত্রী পারছে না স্বামীর কাছে, মানুষ পারছে না সমাজের কাছে। প্রকৃতি তোমাকে নগ্ন করে পাঠিয়েছে, তুমি ছিলে নির্মল নিষ্পাপ, সুন্দর। ক্রমে তুমি প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গেলে, তোমার কদর্যতা ঢেকে রাখলে মুখোশের আড়ালে।

এক সময় বৃষ্টি থেমে গেল, সিক্ত বসনা দুই মানব মানবী স্বর্গ থেকে নেমে এলো নৌকায়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে সিক্ত বসন বদলে নিলাম। ফিরতি পথে দুজনেই নির্বাক, কি এক মোহে আচ্ছন্ন হাতে হাত রেখে বসে রইলাম। সন্ধ্যার নীরবতার মাঝে বৈঠার বিষণ্ণ ছপ ছপ শব্দে এক সময় রহস্যময় নৌকাটি ঘাটে এসে ভিড়ল।

পরদিন ঢাকা চলে যাব তাই বাস স্ট্যান্ডের পাশের এক হোটেলে রুম বুক করে নিলাম। ফারিয়া রাতে তার মায়ের বাসায় ফিরে যাবে, সকালে এলে দুজনে এক সাথে ঢাকায় ফিরব। ছেলে লিটন ছুটিটা নানীর সাথেই কাটাবে। কাউন্টারে ফরমালিটিস সেরে দুজনেই রুমে এলাম। মাঝারী একটা রুম, সংলগ্ন বাথরুম, মফস্বল টাউনে যেরকম হয় আর কি। দুজনেই খাটে এসে বসলাম।
আমি-- কেমন কাটল সারাদিন?
খুব খুউব ভাল। অনেকদিন পর আমি যেন মুক্তির স্বাদ পেয়েছি।--- ফারিয়ার কণ্ঠে আবেগের সুর। স্বনামধন্য কলেজের বাংলার শিক্ষয়ত্রী্র ভাব গাম্ভীর্যের লেশমাত্র সেই সুরে ছিল না।
-- তোমাকে এত আপন লাগছে যে যেতে মন চাইছে না!
আমারও মন চাইছিল না-- থেকে যাও তাহলে?
ফারিয়া মুচকি হাসল। দুজনেই জানি এটা সম্ভব নয়।

--আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি। ফারিয়া উঠে বাথরুমে চলে গেল।

আমিও উঠে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখলাম বেশ অবিন্যস্ত চেহারা। হাত দিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে অপেক্ষা করছি। বাথরুমে ফারিয়া গুন গুন স্বরে কোন সুর ভাজছে। একটু পরেই দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। শাড়িটা বেশ পরিপাটি করে নিয়েছে। আঁচল কাঁধের উপর আলতো করে টানা। ঘাড় গলায় তখনও জলের সিক্ত বিন্দু। ভেজা ব্লাউজটা নৌকায় বদলাতে পারেনি, সেটা খুলে নিয়েছে। এক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর কি জানি হোল দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। শরীরের ভিতর রক্তের মাতম, দুটি আত্মার একাত্ম হওয়ার আকুল প্রচেষ্টা, চুমোয় চুমোয় সিক্ত হয়ে উঠল গলা, গাল, কপাল, ঠোঁট। ঝরের ঝাপটায় আচল খসে পড়েছে, হৃদয়ের স্পন্দনে বক্ষ বন্ধনী ভেদ করে বিস্ফোরিত দুটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা!
ফারিয়া সরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার জোড়া ভুরুর নীচে বুজে থাকা চোখের পাপড়ি তির তির করে কাঁপছে। এলায়িত শরীরের বক্রতা, খাঁজে, ভাজে মদির মাদকতা বর্ণনার অতীত। আমি পাশে বসে প্রকৃতির এই অপরূপ সুধা স্পর্ধিত নয়নে শুষে নিচ্ছিলাম। এই সুধা, এই সমর্পণ, এই অনুভব সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। আমি পরম যত্নে ঋগ্বেদের ঊষা বন্দনার মত তার জোড়া ভুরুর মাঝখানে একটা চুমো এঁকে দিলাম। আমি ফিস ফিস করে বললাম-- ফারিয়া উঠো! তোমার দেরী হয়ে যাবে। আমি তোমার নগ্নতা গ্রহণ করলাম। কিন্তু আমি তোমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাই না!
ফারিয়া সংবিদ ফিরে পেয়ে চোখ তোলে মুচকি হেসে বলল-- হে চল।

আমি ফারিয়াকে টুকটুকিতে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আঁধারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি রুমে ফিরে এসে মোবাইলটা চার্জে দিলাম। সারাদিন গ্রাম ও নদীর অনেক ছবি তুলেছি। সিগন্যাল দুর্বল ছিল বলে জীবনীর সাথে তেমন কথা বলতে পারিনি। এখানেও সিগন্যাল দুর্বল, কথা কেটে কেটে যাচ্ছিল। আমি সারাদিনের ঘটনা বর্ণনা করার সময় সে ভাল করে শুনতে পারছিল না। তার কণ্ঠে তীব্র অভিমান ও উদ্বেগের সুর। আমি হোটেলের গল্প বলার সময় আবার চার্জ ফুরিয়ে গেল। আমি ফারিয়াকে বিদায় দেয়ার শেষটুকু আর বলতে পারিনি। পনের মিনিট চার্জ দিয়ে আবার কল করতে গিয়ে দেখি কল আর যাচ্ছে না।

পরদিন সকালে ফারিয়া এলে দশটা এগারোটার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাসে চেপে বসলাম। দীর্ঘ যাত্রায় পাশাপাশি বসে কত কথা যে হোল। স্পর্শ আমাদের মানসিক অর্গল খুলে দিয়েছিল।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভাল মন্দ আছে। প্রতিটি মন্দের পিছনে রয়েছে লুকায়িত ইতিহাস। দীর্ঘদিন চাপা পরে থাকা আবেগ, বঞ্চনা হয়তোবা একদিন বক্র পথে প্রকাশিত হয়ে পরে। চপলমতি ফারিয়ার একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্র যা হয় বাবা জোড় করে আর একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু ফারিয়া কিছুতেই প্রাক্তন প্রেমিককে ভুলতে পারেনি। এই সেদিন পর্যন্তও তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ ছিল। পরিশেষে প্রেমিকটি এই সম্পর্কের অসারতা বুঝতে পেরে এর পরিসমাপ্তি চায়। ফারিয়ার আকুতি মিনতি উপেক্ষা করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এই কয়দিন ফারিয়া ভীষণ মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তার দরকার ছিল মানসিক চাপ থেকে মুক্তি। নিজেকে প্রকাশ করার বা চাপ উগড়ে দেয়ার কোন স্থান। প্রেমের প্রাকৃতিক পরিসমাপ্তি অনেক সমাজেই সম্ভব হয়ে উঠে না। কিন্তু এর গোপন পরিণতি অনেক ক্ষেত্রে গোপনই থেকে যায়। সারা পথ নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ফারিয়া যেন নতুন জীবনে ফিরে পেল।

ঢাকায় পৌঁছুতে রাত হয়ে গেল। দুজন দুজনকে বিদায় জানালাম। ফারিয়া বার বার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল বাসায় পৌঁছেই যেন তাকে ফোন করে জানাই। সে চিন্তায় থাকবে আমি তাকে অশ্বত্ব করলাম।

বাসায় ফিরে দেখি জীবনী আমার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছে। আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম আমার অভিযানের গল্প বলব বলে। কিন্তু তাকে কেমন যেন নিঃস্পৃহ দেখাল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট অভিমান, ক্ষোভ ও রাত জাগার ছাপ। গতকাল রাত থেকে তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। উদ্বেগ ও অজানা আশঙ্কায় রাতে তার ঘুম আসছিল না। শেষে ঘুমের টেবলেট খেয়ে শুয়েছে। পরিমাণটা হয়তো একটু বেশিই হয়েছে। এখনও কথা স্পষ্ট হচ্ছিল না। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম--- তুমি নিতে পারনি!
তার কণ্ঠে বন্ধুত্বের ফাঁক গলে ঈর্ষার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আমি বহু কষ্টে সে রাতে তাকে শান্ত করলাম। আমার গল্প বলা আর হয়ে উঠলো না। আমি বিভ্রান্তিতে পরে গেলাম, সে কি আমার বন্ধু না স্ত্রী! সারারাত জীবনীকে সামলাতে গিয়ে আমার পৌঁছার সংবাদ ফারিয়াকে আর জানাতে পারিনি

খুব ভোরে বেল বাঁজার শব্দে খুব অবাক হলাম, এ সময়ে কে হতে পারে? দরজা খুলেই দেখি ফারিয়া! ভীষণ উদ্ভ্রান্ত চেহারা। আমি পিছনে দরজা ভিজিয়ে সামনে এসে বললাম-- তুমি! আমার কণ্ঠে একরাশ বিস্ময়।
--- তুমি আমাকে কল করনি! তুমি ঠিক ভাবে পৌঁছলে কিনা এই চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। বার বার ফোন করলেও তুমি ধরনি। বহু খোঁজা খুঁজি করে তোমার ঠিকানা পেয়েছি।

আমি এক মিনিট কোন কথা বলতে পারিনি। জীবনী শুনতে পাবে বলে আমি কথাও বলতে পারছিলাম না। তাকে বহু কষ্টে শান্ত করেছিলাম। এখনা এতো ভোরে ফারিয়াকে দেখলে সে হয়তো আরও বিভ্রান্ত হবে। আমি প্রবেশ দ্বার থেকেই ফারিয়াকে এক প্রকার জোড় করেই ফিরিয়ে দিলাম। তার বড় বড় চোখ দুটি টল টল জলে ভরে গেল। সেখানে গতকালের উচ্ছ্বাস ছিল না। কি এক কষ্ট নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

সম্পর্কের সমীকরণ আমি আর মিলাতে পারলাম না। ফারিয়ার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।

মন্তব্য ৩৪ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (৩৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৩৭

মিরোরডডল বলেছেন:





polyamory relationship এর ওপর কিছু ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম, ফিচার পড়েছিলাম সেটার রিফ্লেকশন পেলাম এই লেখাটায়।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখাটা ধরে রেখেছে।
ব্যতিক্রম এই লেখাটা খুব ভালো লেগেছে বুনো।

যদিও এখানে শেষে দেখা গেলো This form of relationship did not work for them.
জীবনী সম্মতি দিলেও শেষ পর্যন্ত নিতে পারেনি।

ইউজ্যালি দুজনে সেইম পেইজে না থাকলে কঠিন হয়ে যায় মেইনটেইন করা।


১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৫২

বুনোগান বলেছেন: দুজনে সেইম পেইজেই ছিল, অন্তত থিউরিটিক্যালি। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তিকে কাটানো বে মুশকিল।

২| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৩৮

মিরোরডডল বলেছেন:




এই ছবিটাও কি বুনোর করা?



১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৫৪

বুনোগান বলেছেন: জ্বী, ডেলের সহায়তায়।

৩| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:০৫

মিরোরডডল বলেছেন:




গল্পের নায়ক, হোটেল রুমে ফারিয়ার কাছ থেকে সেই অবস্থায় যেভাবে সরে এসেছিলো, its really tough job, hard to do.

তার এই নীতিগত দিকটার কারণেই ফারিয়া আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছে মনে হলো।

ফারিয়া বাসা পর্যন্ত চলে আসা this seems bit awkward.

৪| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:২২

মিরোরডডল বলেছেন:




এরকম লেখা আরো চাই বুনোর কাছে।
থ্যাংকস বুনো।

৫| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৩১

রাজীব নুর বলেছেন: গল্পটা ভালো লাগেনি। স্যরি।

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৩০

বুনোগান বলেছেন: বুঝতে পেরেছি, ভাল না লাগাদের সংখ্যাই বেশী।

৬| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫২

প্রামানিক বলেছেন: পোষ্টের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ

৭| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:৪০

শেরজা তপন বলেছেন: দুর্দান্ত! আমি বিমোহিত হলাম আপনার গল্পের গভীরতা ও দর্শনে!
আমার ধারনা ছিল না আপনি এত চমৎকার লিখেন।

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৪২

বুনোগান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। এটা আমার প্রথম গল্প লেখার অপ-প্রয়াস। আমি এখনও নিশ্চিত না এটা কোন গল্প হয়েছে কিনা! আম্পনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম।

৮| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৩

কামাল১৮ বলেছেন: সবার আগে মনে রাখতে হবে মানুষ সামাজিক জীব।সমাজ যতটা গ্রহন করতে পারে তার মধ্যেই আমাদের থাকতে হবে।তার মধ্যে থেকেই সমাজকে পরিবর্তনের জন্য তৈরি করতে হবে।
বহু বছর পর হয়তো এমন সমাজ হবে।তার জন্য সমাজকে তৈরি করতে হবে।এখন রাষ্ট্র ও সমাজ দ্বারা আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত।ভাষার ব্যাখ্যাটি খুবই যুক্তিপূণ।গল্পের ভাষা উঁচু মানের।

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:১৩

বুনোগান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার পর্যবেক্ষনের জন্য। মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিগত সামাজিক জীব। এই সহজাত প্রবৃত্তির উপর বিভিন্ন রঙ চড়িয়ে সভ্যতা হয়েছে। এই সভ্যতা প্রকৃতি বিরোধী! তথাকথিত সভ্যতা এনেছে সমাজের আলফা শ্রেণী। সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই সাধারণ মানুষ তাদের অনুসরণ করছে মাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র শাসকদেরই হাতিয়ার। এর পরিবর্তন কে করবে? আমি খুশী যে গল্পটি আপনার ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। এটা নিছক গল্প নয়।

৯| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৫৩

শ্রাবণধারা বলেছেন: আপনার এই গল্পটি কিন্তু আমার পড়তে পড়তে ভালো লাগলো। অথচ প্রথমে যখন পড়া শুরু করেছিলাম তখন মনে হচ্ছিল অতি বিরক্ত লাগবে।

কেন বিরক্ত লাগবে তার কারণ আপনি জানেন। আপনি আমাদের অবচেতনের বিবাহ সম্পর্কের নৈতিক বোধের ধারনাটি ধরে সজোরে টান দিয়েছেন। টান দিয়ে সেখানেই থেমে থাকেন নি আবার বক্তব্যও হাজির করেছেন। দুঃখের বিষয় আপনার যুক্তিবোধে তেমন কোন ঘাটতি নেই যেটা নিয়ে আপনার কড়া সমালোচনা করতে পারি। :)

আপনার লেখাটির আমাকে হেনরি মিলারের উপন্যাস "Tropic of Cancer" এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। একেবারে বিরক্ত হতে হতেও যেটা শেষ পর্যন্ত ভালো লেগে যায়।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৬

বুনোগান বলেছেন: ধন্যবাদ শেষ পর্যন্ত যে ভাল লাগল। সামালোচনা করলে আরো ভাল লাগত। আমি কিন্তু পাঠকদের কাছ থেকে সমালোচনা আশা করছিলাম। কিন্তু কেউ করছে না। আলোচনা সমালোচনায় নিজের যুক্তিকে যাচাই করতে পারতাম।

১০| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৪৯

ক্রেটোস বলেছেন: আপনার এই গল্পটি পড়বার আগে আপনার আরেকটি লিখা পড়েছিলাম যেখানে আপনি দাম্পত্যিক ঈর্ষাকে উদ্দেশ্য করে একটা গল্প লিখেছিলেন। এই গল্পটি পড়ে মনে হলো আপনি সেই সারটুকুকে উপস্থাপন করলেন আবার তবে এর শেষ অন্যভাবে করেছেন। তাই আপনার এই সার নিয়েই বলি। বিকৃতি নিয়ে যা বললেন তাতে কিন্তু আপনার বলা বিকৃতিকে সুকৃতি করে দেয় না। লিখাটার ঐ অংশটা এমন যে আমিও পাপ করছি তুমিও পাপ করছো সুতরাং আমার এই পাপকে পাপ বলো না। কিন্তু আপনার বলা এই নিয়মটাকে বিকৃতি না বলতে চাইলে তো এর সুকৃতিসম্পর্কিত বিষয়টিকে তুলে আনতে হবে। আপনি তা আনেননি। নিরপেক্ষভাবে দেখলে আপনি কিন্তু দেখাতে পারেননি আপনি যা বলছেন তা বিকৃতি নয়।
আপনার এই গল্পটি পড়বার পর আমি আমার সহমানুষীকে এই নিয়ে আলোচনা করেছি। সে আবার আমার এক ছোটভাইয়ের দর্শনের বিরাট ভক্ত। তাই তার মত হলো যে যদি একান্ত বলে কোন প্রেম না থাকে তবে তো বলতে হয় প্রেম একদম খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন একটি আবেগ। প্রেম তখন হয়ে যাবে কেবল নিজের সাময়িক একটি তাড়না অনেকটা যৌনতার মত যার উদ্দেশ্য পুলকতা কোন পরম উদ্দেশ্য এর নেই। তাহলে প্রেমকে তো আমরা মানবিকতার বড় কিছু বলা যায় না। আমার মতও আমার সহমানুষীর মতো।
আরেকটি বিষয় হলো আপনি কী নৈতিকতাকে একদম নিজের স্বার্থের মানদণ্ডে বিচার করলেন না? যেটা আবহমানকাল ধরে সবাই করে এসেছে এতে করেই দ্রোহের সূচনা হয়েছে নৈতিকতা নিয়ে এত এত আলোচনা হয়েছে। আপনি কিন্তু সমাজকে নৈতিকাতার যে বেসাতি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন নিজেই আবার অনুশীলন করেছেন। আপনার রচনাভঙ্গি দারুণ। আশাকরি আমার এই সমালোচনাকে ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। শুভকামনা।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:২২

বুনোগান বলেছেন: গল্পে যেটা বলা হয়েছে, নৈতিকতা সমাজ ভেদে ভিন্ন। এক সমাজের কোন কোন রীতি অন্য সমাজের কাছে বিকৃতি। তাই এক সমাজের রীতিনীতি দিয়ে অন্য সমাজকে বিচার করা যায় না। তাহলে ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করার মাপকাঠি কি? সেটা হোল প্রকৃতি যে রীতিনীতি অনুসরণ করে সেটা। এর উপর বিভিন্ন বিকৃতি ঘটিয়েই বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন নৈতিকতা পাপ পুণ্য তৈরি করেছে।
দুই, প্রেম হোল মানুষেরই তৈরি বিমূর্ত ধারণা। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রেম হোল জৈবিক তাড়নায় মিলনের আকাঙ্ক্ষা। মিলনের পর যে প্রেম কমে যেতে থাকে। দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি হোল প্রাকৃতিক নিয়মের পারিবারিক বন্ধনে তথা সামাজিক বন্ধনে থাকার তাড়নার বর্ধিত রূপ। এই প্রথার দ্বারা মানুষের বহু-গামী স্বভাবকে বিভিন্ন মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। কিন্তু এতে প্রেম হাড়িয়ে যায়, দাম্পত্য জীবন পরিণত হয় একটা অভ্যাসে। দাম্পত্য জীবনে প্রেমের রোমাঞ্চ আনতে হলে ইঁতি উঁতি প্রেম/ভালোলাগা গোপন না করে পরস্পরের কাছে প্রকাশ করার সততা থাকতে হবে এবং এভাবে নিজের মন থেকে যৌন জেলাসি কমিয়ে আনতে হবে।
পরিশেষে আপনার সমালোচনা আমার ভাল লেগেছে।

১১| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ২:২১

শ্রাবণধারা বলেছেন: লেখক বলেছেন: সামালোচনা করলে আরো ভাল লাগত। আমি কিন্তু পাঠকদের কাছ থেকে সমালোচনা আশা করছিলাম। কিন্তু কেউ করছে না। আলোচনা সমালোচনায় নিজের যুক্তিকে যাচাই করতে পারতাম।

আপনার গল্পের দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে এই দুটি কথা যদি ধরি "মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিগত সামাজিক জীব। এই সহজাত প্রবৃত্তির উপর বিভিন্ন রঙ চড়িয়ে সভ্যতা হয়েছে। এই সভ্যতা প্রকৃতি বিরোধী! তথাকথিত সভ্যতা এনেছে সমাজের আলফা শ্রেণী।" প্রশ্ন হলো প্রকৃতিবাদী সভ্যতা কোনটা? "polyamory" জাতীয় কিছু? নিশ্চিত ভাবেই নয়। আপনি যেটাকে প্রকৃতিবাদী সভ্যতা বলছেন সেটা আসলে প্রকৃতিবাদী নয়, সেটা হলো যাকে বলা চলে অলস পেটমোটা লোকদের সভ্যতা। যেখানে মানুষের অনেক অবসর আছে, অলস মস্তিষ্ক আছে এবং ফেসবুকে পরিচয় হওয়া বান্ধবীর সাথে দেখা করা বা ঘোরাঘুরি করার মত যথেষ্ট তেলও আছে।

আপনার গল্পের প্রক্বতিবাদ যদি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "হাঁসুলী বাঁকের উপকথা" এর মাটিঘেষা, প্রতিদিন জীবনসংগ্রামে রত মানুষগুলোর মত হত তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু আপনার প্রকৃতিবাদ কিছুটা D. H. Lawrence এর Lady Chatterley's Lover উপন্যাসের বা "সূর্য" গল্পের প্রকৃতিবাদের মত যেখানে চরিত্রগুলো সভ্যতার আরাম আয়েস ভোগ করে ঠিকই কিন্তু সামাজিক চুক্তিগুলোর ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:০২

বুনোগান বলেছেন: গল্পে প্রকৃতিবাদী সভ্যতা বলা হয়নি, বলা হয়েছে প্রাকৃতিক সমাজের কথা যা মূলত বহু-গামী যৌনতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। পেটমোটা কেন কোন মানুষই প্রাকৃতিক বহু-গামী তাড়না থেকে মুক্ত নয়। বহু সমাজ/ধর্ম এই তাড়নাকেও বিভিন্ন মাত্রায় মেনে নিয়েছে। এখানে পেটমোটারা হোল হিপোক্রেট যারা ভদ্রতার মুখোস এঁটে যৌনতা করছে।
Lady Chatterley's Lover এর নায়ক একজন খেঁটে খাওয়া মানুষ। নায়িকা ব্যর্থ বিবাহের জালে আটকে পরা বঞ্চিত এক নারী। তারা সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই প্রেমে পড়েছিল।
গল্পে "সামাজিক চুক্তিগুলোর ব্যাপারে বিদ্রোহী " হওয়ার কোন প্রবণতা নাই। এখানে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও সামাজিক নৈতিকতার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে সেটাই দেখানো হয়েছে। আর ইংগিত দেয়া হয়েছে যৌন হিংসা থেকে মুক্ত হতে পারলে দাম্পত্য সম্পর্ক আরও নিবিড় হতে পারে।
আপনার সমালোচনা ভাল লেগেছে।

১২| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৭

শ্রাবণধারা বলেছেন: লেখক বলেছেন: আপনার সমালোচনা ভাল লেগেছে। আপনার সমালোচনার প্রতুত্তরও আমার ভালো লাগলো।

আমার বিশ্বাস এই যে মানুষ জন্ম অন্য প্রানীর মত প্রাকৃতিক হলেও তার সীমা প্রাকৃতিকের মধ্যে নির্ধারিত নয়। আমাদের সমস্ত চিন্তার মধ্যে শুধু আহার-নিদ্রা-যৌনতা ছাড়াও অজস্র বিমূর্ত চিন্তা আছে। যে কারনে আপনার সাথে আমার এই মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য সেটাও সেই বিমূর্ত চিন্তার অংশ।

নৈতিকতাকে আমি বৃহৎ অর্থে সামাজিক চুক্তি বলেছি। সামাজিক চুক্তি সমাজে মানুষের একত্রে বসবাস করার নৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করার চুক্তি। ভিক্টোৈয়ান সময়ে মানুষ যেভাবে "মন" কে প্রাধান্য দিয়েছিল লরেন্সের গল্প উপন্যাসগুলো সেখানে আপনার এই গল্পটির মতই "স্পর্শ অনুভূতি" এবং "শারীরিক ঘনিষ্ঠতার" উপর প্রাধান্য দেয়।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৪৮

বুনোগান বলেছেন: "আমাদের সমস্ত চিন্তার মধ্যে শুধু আহার-নিদ্রা-যৌনতা ছাড়াও অজস্র বিমূর্ত চিন্তা আছে।"-- আপনি সঠিক কথাই বলেছেন। ভাষা আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ বস্তুজগতের সবকিছুকে বিমূর্ত ভাবের জগতে পরিবর্তন করে নিয়েছে। এখন মানুষ সব বস্তু জগতকেই বিচার করে বিমূর্ত ভাবের সংজ্ঞা দ্বারা। যার যার সমাজের মৌখিক ভাষায় যে সঞ্চিত বিমূর্ত জ্ঞান রয়েছে তার দ্বারাই সেই সমাজের মানুষেরা পরিচালিত হয়। তবে সেইসব বিমূর্তায়ন সহজাত প্রবৃত্তির শিকড়কে কেটে ফেলতে পারে না, কারণ সেটাই তার চিন্তা জগতের এবং তাড়ণাগত সক্রিয়তার ভিত্তি।
সামাজিক চুক্তি, নৈতিকতা কে কোনটা গ্রহণ করবে সেটা সে যে সমাজে বাস করে তার উপর নির্ভরশীল। তাই অন্যের অনুসৃত নৈতিকতাকে ঘৃণা করা যায় না।
এখানে যৌনতা মূল কথা নয়। মূল কথা মানুষকে ভালোবাসা। এখন কোন নৈতিকতা মেনে নিলে আমরা সবাইকে ভালবাসতে পারব?
তিন লক্ষ বছরের মানুষের ইতিহাসে নিউলিথিক যুগ পর্যন্ত মানুষের নৈতিকতা ছিল প্রাকৃতিক। মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়নি, ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে। মাত্র পাঁচ ছয় হাজার বছর হোল সভ্য জগতের নৈতিকতা মানুষ অনুসরণ করছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানুষের যে কোন সক্রিয়তা মানুষকে বিলোপের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে!

১৩| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৮

ক্রেটোস বলেছেন: বুনোগান, সমাজে ভেদে রীতির প্রভেদ থাকতে পারে কিন্তু নৈতিকতার কতটুকু পার্থক্য আসলে আছে? কিছু ব্যতিক্রম আছে ঠিক তবে সেইসব ব্যতিক্রমকে প্রাধান্য দিলে আমরা তো স্বাভাবিকতাকেই অস্বীকার করব। আমি বা আপনি দুজনের কেউই আসলে সমাজ বিচার করছি না। আমার বক্তব্য ছিল কেবলমাত্র বিকৃতি নিয়ে যা বললেন তাই। এবং আপনি নিজেও যে সুকৃতির বয়ান দিচ্ছেন না তা। আপনার জবাবে আমি কিন্তু উত্তর পেলাম না আপনি অনেকটা ভেগোলজিতেই কথাগুলো বললেন। তবুও বলি প্রকৃতির রীতিনীতি আসলে কী? এর সংজ্ঞায়ন কী হবে? মানুষ কী জীবজগতের মধ্যে একমাত্র প্রাণী নয় যে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের বৌদ্ধিক চেতনা দিয়ে নিজেই প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছে। নিজেই নিজের জগত তৈরী করেছে। যার জন্য আজকের সভ্যতা। সেখানে আমরা প্রকৃতির নিয়ম নামের প্রচ্ছন্ন এক বাদকে পুঁজি করে যাই বলি না কেন সেটাকে কী করে সুকৃতি বলতে পারি?


আপনি স্বীকার করলেন প্রেম এক বিমূর্ত ধারণা। বিমূর্ত ধারণার কিন্তু কোন বস্তুগত অবয়ব নেই এটি পুরোটাই চেতনাগত। সেখানে এই যে চেতনার এক উপলব্ধি এটা যে একেবারেই একটি নিরেট অভিজ্ঞতা কিংবা ভ্রম নয় তা আজও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাওয়াটা আমি মনে করি নিজের ইন্দ্রিয়কে প্রাধান্য দেবার একটি অজুহাত মাত্র। আমি বলেছি যে প্রেম মানবিকতাতে কোন বড় ভূমিকা রাখে না। সেখানে এই প্রেমকে কেন্দ্র করে এতটা রীতিকে অস্বীকার করাটাও ঠিক অবিপজ্জনক নয়।


ঈর্ষা ব্যাপারটাও আসলে একটা আপেক্ষিক বিষয়। একান্ত আপন ধারণার থেকেও ঈর্ষা জন্মাতে পারে। পৃথিবীর যত মায়া ও মমত্ববোধ তার পেছনে একান্ত আপন ধারণাটাই আছে। তাই এই একান্ত আপনকে অস্বীকার করে যদি এগিয়ে যাই আমরা কী বলতে পারি আদৌ আমরা কোন বিমূর্ত আবেগের পেছনে ঘুরছি? নাকি মরীচীকার পেছনে আমরা ছুটে আমরা আমাদের বর্তমানকে অস্বীকার করছি।

আপনার আলোচনা খুব ভালো লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল আপনার প্রতি।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:২৭

বুনোগান বলেছেন: আলোচনা সমালোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করবে তাই আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
প্রথমেই বলে রাখি মনুষ্য সমাজে হাজারো মত, পথ, ও দর্শন রয়েছে এবং যার যার সমাজের দর্শন, আচার রীতি নীতি তার তার কাছে সঠিক ও স্বাভাবিক। কোন সমাজের জনসংখ্যা যত নগণ্যই হোক না কেন তার কাছে তার সমাজের নৈতিকতা কোন বৃহৎ সমাজের মানুষের নৈতিকতার গুরুত্বের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই সমাজের কিছু আচরণ বৃহৎ সমাজের কাছে বিকৃতি মনে হতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলি নেপালের তিব্বতীয় কিছু সমাজে নারীরা একসাথে কয়েকজন স্বামী রাখতে পারে ও সহবাস করতে পারে। তার সন্তানদের নির্দিষ্ট কোন পিতৃ পরিচয় নাই। ফিলিপাইনের কিছু সমাজে বিবাহের পূর্বে যুবতিদের গ্রামের যুবকদের সাথে যৌন মিলনের প্রথা রয়েছে। সেখান থেকে যুবতীরাই যে কোন একজনকে পছন্দ করে বিয়ে করে। চীনে কিছু মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজে নারীদের কোন নির্দিষ্ট স্বামী নাই। তারা তাদের মাঠে কাজ করা পুরুষদের থেকে পছন্দ অনুযায়ী যৌন সঙ্গী ডেকে নেয়। তাদের সন্তানদের পরিচয়ও মাতা থেকে। কোন কোন মুসলিম সমাজে একসাথে চারটি নারীকে বিয়ে করতে পারে। খৃষ্টান ও হিন্দু ধর্মালম্বিদের কাছে এই সবগুলোই বিকৃতি। আবার কিছু গোঁরা হিন্দু সমাজে বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে পারে না। অন্য সমাজের চোখে এই প্রথাও স্বাভাবিক নয়।
তাহলে বিকৃতি অথবা স্বাভাবিক কোনটি? এটা বিচার করতে হলে আপনাকে সকল ধর্ম ও মতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সেটা কি? যেমন যৌনতা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এটা সকল সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে। এটা সকলের কাছে স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মিয় গুরুদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ থাকার ফলে তাদের মধ্যে প্রায়ই সমকামিতা দেখা যায়। ফলে আচরণের বিকৃতি ঘটে। আবার প্রকৃতিতে যৌন আচরণ অবাধ নয়। সেখানে স্ত্রীর মধ্যে যখন যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় তখনি কেবল পুরুষেরা যৌন কর্মে লিপ্ত হয়। কিন্তু মনুষ্য সমাজে বিবাহিত জীবনেও এই নিয়ম মানা হয় না। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম বিরোধী বিকৃতি। প্রকৃতিতে কোন জীবই শিশুদের সাথে যৌন কর্ম করে না। কিন্তু অনেক মনুষ্য সমাজেই শিশুদের বিয়ে দেয়া হয়। এটাও প্রকৃতি বিরোধী বিকৃতি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। বিবাহ প্রথা একটা ট্যাবু। এর সাথে মানুষের বিচিত্র সব বিশ্বাস জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস এক জিনিষ আর বিবর্তনের ধারায় যে প্রাকৃতিক নিয়ম গড়ে উঠেছে, সেটা আর এক জিনিষ। এই সব ট্যাবুর কারণে অনেক সমাজে জনসংখ্যা বিলোপ পেয়ে যাচ্ছে।
আমি আপনার সমাজ থেকে পাওয়া মূল্যবোধকে অবশ্যই সন্মান করি। এখানে গল্পের নায়কের দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে আমি কিছু আলোকপাত করলাম মাত্র।

১৪| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৬

রানার ব্লগ বলেছেন: আর দশটা গল্পের মতো গল্প টা নয় তাই প্রথমে খানিক টা এলোমেলো লাগছিলো কিন্তু শেষে এসে গল্পের সমাপ্তি ভাল লেগেছে ।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:০৭

বুনোগান বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ রানার ভাই।

১৫| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:২৮

ক্রেটোস বলেছেন: বুনোগান, নৈতিকতার কিছুটা ব্যতিক্রম যে কোন কোন নৃগোষ্ঠির মধ্যে নেই তা তো অস্বীকার করছি না। একটি ব্যতিক্রমের যতটাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকুক না কেন তা স্বাভাবিকতাকে সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। এটা কিন্তু আমার কথা নয় দর্শন ও বিজ্ঞানের কথা। ব্যতিক্রমকে প্রাধান্য কিন্তু এই বিজ্ঞানই দেয়নি। আমরা এই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কালেক্টিভিজমের পূর্ণ ব্যহার দেখি। তাই ব্যতিক্রমকে টেনে এনে পুরো প্রশ্নবিদ্ধ করাটা কোনভাবেই যৌক্তিক না।


আপনি যে সমাজগুলোর কথা বললেন তারা কিন্তু মানুষ যে সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে নিজের বৌদ্ধিক চেতনাকে গুরুত্ব দিয়ে তার থেকে অনেক দূরে। এটা কিন্তু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গত দিক থেক বেশ তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ এর গুরুত্ব কেবল সেই সীমানার মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু সীমার বাইরে গিয়ে একে অন্য পরিসীমার মধ্যে আনাটা একেবারেই অহেতুক। কারণটা ঐ একই ব্যতিক্রমকে দিয়ে স্বাভাবিককে বিচার।


এখন ব্যতিক্রমকে কেন্দ্র করে আমরা যদি স্বাভাবিকতা ও বিকৃতিকে বুঝতে চাই তবে তার স্বরূপ দাঁড়াবে ব্যতিক্রমকে কেন্দ্র করে, ব্যতিক্রমের সাদৃশ্য। এখানে কিন্তু নিরপেক্ষ কোন স্থানে আমরা দাঁড়াতে পারবো না।


বুনোগান আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে উঠেছে। তাই প্রকৃতির আর কোন নিয়ম কিন্তু এইক্ষেত্রে খাটবে না। মানব যৌনতা কিন্তু কেবল প্রজননের জন্য নয়। প্রাঋতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌনতা কেবল প্রজননকেন্দ্রিক। তো আসুন আমরাও যৌনতাকে প্রজননকেন্দ্রিক করে সীমাবদ্ধ করে দিই। নারী ও পুরুষের যৌনতায় মস্তিষ্কের যে সকল উপাদান কাজ করে এবং যে জটিল অবস্থার ও কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তা এগোয় তা কিন্তু প্রকৃতির আ কোথাও আমরা দেখতে পাই না। তো যেখানে মানুষ একদম প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন অনেকটাই তাকে আবার প্রকৃতি দিয়ে বিচার করাটা কোনদিক থেকে সঠিক? মানুষ যে সভ্যতার কোলে নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তা কিন্তু আর কোথাও নেই। পশুদের মধ্যে এবং প্রকৃতির আর কোথাও এমন পরিবারভাবনা নেই। অজাচার প্রকৃতির একটি বৈশিষ্ট্য তো একে কী মানবের ওপর চাপানো যায়? প্রকৃতির নিয়ম তো তবে মানুষকে মানুষের সংজ্ঞায়ন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। হ্যাঁ প্রকৃতিতে কোন জীব শিশুদের সাথে যৌনকর্ম করে না এর কারণ ওদের যৌনতা মানুষের মত নয়। তো প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিলে আমরা কেন আমাদের যৌনতাকে তাদের মত সীমাবদ্ধ করবো না বলুন তো! মানব যৌনতা এতটাই জটিল যে এর কারণে অনেক যৌন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এটা স্বীকার করি। কিন্তু তাই বলে দুটো ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিষয়কে অ্যানালজিক্যাল প্রসেসে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটার কোন মানে হয়না।


মানুষের বিকাশ যেভাবে হয়েছে তাতে বিয়ে কোন টাবু নয়। আর আপনার কথায় টাবু ধরতে গেলে আমাদের এমন কিছুকেও টাবু ধরতে হবে যেখানে আমাদের মানব অস্তিত্বই টিকবে না।

বিবর্তনীয় ধারাও কিন্তু প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। এখনও মানব মনের বিকাশ ও জটিলতর কার্যক্রমের কোন হদিস আমরা পাচ্ছি না। তাই একটি কিছুটা দৃশ্যমান বস্তুকে অনুসরণ করে আমরা সত্যিই কোন পথ পাবো না।

শুভকামনা রইল বুনোগান। আলোচনার প্রতি এমন সুন্দর মনোভাবের জন্য ধন্যবাদ।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:০৯

বুনোগান বলেছেন: ভাই ক্রেটোস, মনুষ্য সমাজ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে আপনার আর আমার পর্যবেক্ষণের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নাই। পার্থক্য শুধু 'মানদণ্ড' নিয়ে। আর বিবর্তন সম্পর্কেও আপনার আর আমার ভিন্ন ধারণা রয়েছে। আপনার কথা ধরেই বলছি "এখনও মানব মনের বিকাশ ও জটিলতর কার্যক্রমের কোন হদিস আমরা পাচ্ছি না।" সুতরাং মানব মন দ্বারা তৈরি 'মানদণ্ড' এখনও বিকাশমান। এর দ্বারা সার্বজনিন বিচার কার্য চলে না। কিন্তু প্রবৃত্তিগত 'মানব আচরণ' স্বতসিদ্ধ। এটা থাকবেই। কোন সমাজ এর কতটুকু পরিবর্তন করে গ্রহণ করবে সেটা সেই সমাজের বিমূর্ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে।
শুভকামনা।

১৬| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৪৯

ক্রেটোস বলেছেন: না বুনোগান, আপনার আর আমার পর্যবেক্ষণে অনেকটাই পার্থক্য আছে। যেটা আমাদের এই আলোচনাতেই বোঝা যায়। সে হোক, প্রবৃত্তি ব্যাপারটাও কিন্তু মননের একটা প্রকৃতি। তাই এই প্রবৃত্তিগত সকল আচরণ কিন্তু মনন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটা মনোদার্শনিকরাই বলে থাকেন। তাই আপনি এটাকে আলাদাভাবে স্বতঃসিদ্ধ বলতে পারেন না। আর যদি বলেন তবে কিন্তু স্বাভাবিকতাকে যে স্বতঃসিদ্ধ মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাকেও মানতে হবে। আসলে স্বতঃসিদ্ধ তো তাই যা কিছুকে যাঁচাই ছাড়াই মেনে নেয়া হয় সত্য বলে।

এবার বলি কোন সমাজ কতটুকু পরিবর্তন করে গ্রহণ করবে সেই সমাজের বিমূর্ত জ্ঞানের উপর যদি নির্ভর করে তবে তো এই আলোচনার কোন দরকার নেই তাই না? যদি আমরা স্বতন্ত্র্যতাকেই প্রাধান্য দিই তবে কেন আমরা প্রকৃতির আইন দেখতে যাবো? আর কেনইবা নৈতিকতার একটি নিরপেক্ষ সংজ্ঞা দাঁড় করাবো? একটু সাংঘর্ষিক হয়ে গেল না?

শুভকামনা।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:২০

বুনোগান বলেছেন: প্রথমত মানুষ সহ সকল পশুদের প্রবৃত্তিগত আচরণ রয়েছে। পশুরা মনন থেকে আচরণ করে না। তাদের আচরণ সহজাত প্রবৃত্তিগত। মানুষ পশু প্রবৃত্তিকে মনন দিয়ে বদলে ফেলতে পারে। যেমন দুগ্ধপোষ্য প্রাণী তার সন্তানদের দুধ খেতে দেয় তার সহজাত মাতৃত্ববোধ থেকে। সে কখনোই তার শিশুকে স্তনদান থেকে বিরত রাখে না। এটা করে মনন থেকে চিন্তা করে নয়, প্রবৃত্তি থেকে। মানুষও মাতৃত্ববোধ থেকে শিশুকে স্তনদান করে। কিন্তু অনেক মা'ই তার শিশুকে স্তনদান থেকে বঞ্চিত রাখে। এটা করে মনন থেকে। কারণ সে মনে করে দুধ পান করালে তার স্তনের সৌষ্ঠব নষ্ট হয়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণ মননগত চিন্তা। এবং প্রবৃত্তিগত দিক থেকে বিকৃতি।
দ্বিতিয়ত প্রবৃত্তিগত আচরণ স্বতঃসিদ্ধ। কারণ এই আচরণ পশু সহ সকল মানুষের মধ্যে আছে।
তৃতীয়ত মানুষের মত পার্থক্যের কারণেই আলোচনা চলে আসে।
চতুর্থত আমরা সবাই স্বতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেই না। কোন কোন মতবাদ দেয়।
পঞ্চমত নৈতিকাতার নিরপেক্ষ সংজ্ঞা প্রাকৃতিক নিয়মেই আছে। মানুষের কোন মতামতই নৈতিকতার নিরপেক্ষ সংজ্ঞা দিতে আগ্রহী নয় বা দিলেও সেটার অনেক পয়েন্টই মানে না।
শুভকামনা। আপনার আলোচনায় অনেক উপকৃত হলাম।

১৭| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৪২

ক্রেটোস বলেছেন: বুনোগান আপনি আমার কথাটা হয়তো বোঝেননি। প্রবৃত্তির ব্যাপারটা মননগত। এটা বলতে চাইছি অনেকটা মৌলিকভাবে। যেমন মানুষের এই যে স্তন্যদানে কিন্তু মমত্ববোধের একটি স্বতন্ত্র্য অবস্থা থাকে। এটা পশুদের অবস্থা থেকে ভিন্ন। যেমন স্তন্যদানের সময় মা নিজেই কিন্তু মমত্ববোধের এক শীর্ষ অনুভূতি পায় যা তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। এমনকি এই উপলব্ধি তাকে তাড়িত করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে। যেটা পশুদের থাকে না। মানুষ "না" বলতে পারে এটা ঠিক কিন্তু এই না বলতে পারাটা কিন্তু প্রবৃত্তিগত দিক থেকে বিকৃতি নয়। কারণ মানুষের প্রবৃত্তি কিন্তু মননকেন্দ্রিক। যেহেতু মনন তার প্রবৃত্তির কেন্দ্র তাই একে কেন্দ্র করে যা উদ্ভব তাকে আমরা বিকৃতি বলতে পারি কী করে? আগে থেকেই বলে এসেছি মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট তবুও আপনি সেই বিচ্ছিন্নতাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

প্রবৃত্তিগত আচরণ সবার মধ্যে থাকলেও সেটা পশু জগত থেকে মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা।

আপনি বলছেন নৈতিকতার নিরপেক্ষ সংজ্ঞা প্রকৃতিতে আছে। কোথায় আছে বুনোগান? প্রকৃতিতে অজাচার আছে, প্রকৃতিতে হিংস্রতা আছে, প্রকৃতিতে অমানবিকতার সমস্ত ছড়াছড়ি আছে। তবুও যদি আমরা বলি প্রকৃতিতে নৈতিকতার নিরপেক্ষ সংজ্ঞা আছে তবে কী আমরা সেইসব অনৈতিকতাকেই সমর্থন করছি না? প্রকৃতিতে কোন নৈতিকতার সংজ্ঞায়ন নেই থাকলে অন্তত প্রকৃতির সন্তানদের এমন বিরূপ হতে দেখা যেত না। এবং আবার নতুন করে মানুষকে মানুষ হতে হতো না।

বলতেই হচ্ছে বুনোগান আপনি সত্যিই কোন সমাধানে আসতে পারছেন না। আপনি একই খাদেই বারবার ঘুরছেন এবং আপনার মতামত মোটেও সুসংগঠিত না। কোন সমাধানে আপনি পৌঁছাতে পারছেন না।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৩৫

বুনোগান বলেছেন: সুচিন্তিত আলোচণার জন্য ধন্যবাদ। আমরা মানুষ বলেই আমাদের মতের মধ্যে চিন্তাগত পার্থক্য থাকে। কিন্তু আমেরিকার কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে বাংলাদেশের কুকুর সেই ভাষা বুঝতে পারে। কারণ তাদের ভাষা প্রবৃত্তিগত!

১৮| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫০

ক্রেটোস বলেছেন: হা হা হা, আপনার এই কথা থেকেই কী বোঝা যায় না মানুষ আসলেই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন? হা হা হা হা হা, শুভকামনা অবিরাম।

১৯| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৭

বিজন রয় বলেছেন: বাহ! আলোচনা জমে উঠেছে।

যেমন গল্প তেমন আলোচনা।

চলুক।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:০০

বুনোগান বলেছেন: বিজন রায়, এবার আপনি চালান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.