![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরেতুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
পিচঢালা সরু পথের পাশেই একটি খাল। রিকশায় পথ পেরোতে পেরোতে আমরা সেই খালটি দেখি। আকারে আয়তনে এর চেয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য খালের দেখা দেশের বহু স্থানেই মেলে, কিন্তু এই খালের বিশেষত্ব অন্যত্র। বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই খালটি আড়িয়াল খাঁ এবং সন্ধ্যা নদীর আপাত বিভেদপূর্ণ জলধারার মাঝে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছে, পরিস্থিতি প্রতিকূল জেনেও চেষ্টা করেছে দুটি বিপরীতমুখী প্রবহমানতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের। প্রতিকূল যে কোনো পরিস্থিতিতে ঐক্য গড়ার কিংবা যেকোনো ধরনের বৈপরীত্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টাটাই আসল! আজ থেকে অনেক দিন আগে, ১৯৫০ সালে, ঠিক এই খালটির মতোই সুকঠিন এক চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন আগরপুরের আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ। সাম্প্রদায়িক বিভেদের আগুন থেকে অসহায় মানুষের প্রাণ রক্ষার চেষ্টায় বিসর্জন দিয়েছিলেন নিজের প্রাণ।
১৯০৮ সালে আগরপুরের বিখ্যাত মিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ। পটুয়াখালী লতিফ সেমিনারি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর। কিন্তু শিক্ষাজীবন সুসম্পন্ন হওয়ার আগেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন আলতাফ উদ্দিন, জড়িয়ে পড়লেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বরিশালে বেশ তীব্র ছিল আন্দোলনের প্রকৃতি। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো। শুধু তা-ই নয়, আন্দোলনের ব্যাপকতা স্তিমিত করতে সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির আশ্রয় নিল ইংরেজ প্রশাসন। প্রশাসনের কূটকৌশলে দীর্ঘ যুগ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি হলো সহিংস বিরোধ। শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার রক্তাক্ত অধ্যায়। বিনষ্ট হলো শান্তি। এভাবেই তিরিশ দশকের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে চল্লিশের দশকে পদার্পণ করল উপমহাদেশ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। কিন্তু শান্তি কি ফিরল আমাদের এই ব-দ্বীপাঞ্চলে? বন্ধ হলো কি সাম্প্রদায়িক হানাহানি? না। হলো না। ১৯৫০ সালে, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পাদে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সামান্য এক গুজবকে পুঁজি করে বৃহত্তর বরিশালের বিভিন্ন স্থানে শুরু করল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গার আগুনে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষের সহায়-সম্বল তো পুড়লই, ভস্মীভূত হলো সহস্রাধিক তাজা প্রাণও।
আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ তখন মানবিক গুণসমৃদ্ধ পরিণত বয়স্ক যুবা। সক্রিয়ভাবে মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন তিনি। কিন্তু হীন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল চিরকালই জোরালো। সুতরাং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের নব এ উদ্যোগে বিচলিত হলেন আলতাফ উদ্দিন। সিদ্ধান্ত নিলেন আগরপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কিছুতেই দাঙ্গা সংগঠিত হতে দেবেন না তিনি। আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন শরিকলের আলাউদ্দিন মিয়া, নলচিড়ার মনু মিয়াসহ আরও অনেক উদারমনা মুসলমান মহাপ্রাণ। তাঁরা একত্রিত হয়ে গঠন করলেন দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। দাঙ্গাকারীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এলাকার প্রবেশপথগুলোয় সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করলেন নবগঠিত এই কমিটির সদস্যরা। কিন্তু রাতদিন পাহারা সত্ত্বেও ১৮ ফেব্রুয়ারি আগরপুরে পা রাখল দাঙ্গাকারীরা। আতঙ্কিত হিন্দু সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ আশ্রয় নিল পার্শ্ববর্তী গ্রাম ব্রাহ্মণদিয়ার কবিরাজ বাড়িতে। সকাল ১০টা তখন। মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষগুলোকে আগলে আছেন আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ। হাতে বন্দুক তাঁর। এমন সময় দাঙ্গাকারীদের দেখা গেল কবিরাজ বাড়ির দিকে এগোতে। দূর থেকেই আলতাফ উদ্দিন চিত্কার করলেন। দাঙ্গাকারীদের ফিরে যেতে বললেন উচ্চস্বরে। কিন্তু দাঙ্গাকারীরা উল্টো আলতাফ উদ্দিনকে এ স্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিল। আলতাফ উদ্দিন হাসলেন, তারপর বললেন, জীবন থাকতে এ স্থান ত্যাগ তো করবেনই না তিনি, দেবেন না প্রাণভয়ে ভীত হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও কোনো ক্ষতি হতেও। এ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হলো দুই পক্ষে। তর্কাতর্কি থেকে জন্ম নিল তুমুল উত্তেজনা, সৃষ্টি হলো দারুণ হট্টগোল। এই হট্টগোলের মধ্যেই দাঙ্গাকারীরা অতর্কিতে আক্রমণ করল আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদকে। ধারাল অস্ত্র দিয়ে একের পর এক আঘাত করল সজোরে। আঘাতে আঘাতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। মৃত্যুতে বিলীন হলো আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদের প্রাণসত্তা।
আলতাফ উদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে গেল দাঙ্গা পরিস্থিতি। অসাম্প্রদায়িক মানুষ প্রতিবাদমুখর হলো। প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলল তারা। দাঙ্গাকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল যে যার মতো। শুধু আগরপুরেই নয়, আলতাফ উদ্দিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দাঙ্গা থেমে গেল সমগ্র বরিশালে। শোকের ছায়া নেমে এল সর্বত্র। কেমন ছিল সেই শোকের প্রকৃতি? তীব্র? তীক্ষ? ভাবতে ভাবতে অনেকটা পথ পেরিয়ে আগরপুর বাজারে পৌঁছালাম আমরা। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত একটা মাঠ বাজারের পাশেই। কাছেই একটা স্কুলের প্রধান ফটক। ফটকের উপরিভাগে লেখা ‘আগরপুর আলতাফ মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করি আমরা, আক্ষেপে বিনষ্ট করি অন্তরের সুখ। কারণ, দিন যতই অতিক্রান্ত হচ্ছে, ততই যেন এ দেশ থেকে কমে যাচ্ছে শহীদ আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদের মতো মানবিক গুণসমৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা।
ছবি: শহীদ আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদের পারিবারিক সংগ্রহ
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:২৬
দীপংকর চন্দ বলেছেন: ক্ষমাপ্রার্থনা প্রথমেই উত্তর প্রদানে দীর্ঘ বিলম্বের জন্য।
কৃতজ্ঞতা পাঠে।
অনেক শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
২| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৫৬
আহমেদ জী এস বলেছেন: দীপংকর চন্দ ,
সমকালীন দুঃখজনক ঘটনা প্রবাহের সমান্তরালে সম্প্রীতির এক ছোট্ট অনুচ্ছেদ । দুটি বিপরীতমুখী প্রবহমানতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি ছোট্ট সেতু ।
হায়...যদি এর একটুও বুঝতো কেউ !!!!!!!!!!!!!!
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৩৪
দীপংকর চন্দ বলেছেন: কেউ বুঝুক আর না-ই বুঝুক, 'অরণ্যে রোদন' বলে একটা বাগধারা যে আছে, সেটা ভুলে যেন না যাই, তেমন একটা চর্চায় থাকা আর কি!!! হা হা হা হা
গভীর মন্তব্য বরাবরের মতো।
শ্রদ্ধা জানবেন।
ক্ষমাপ্রার্থনা উত্তর প্রদানে দীর্ঘ বিলম্বের জন্য।
অনেক শুভকামনা।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।
৩| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:২৯
সুমন কর বলেছেন: আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ সম্পর্কে জানা ছিল না। আপনার এ পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম। চমৎকার শেয়ার। ধন্যবাদ।
কবে যে আবার অসাম্প্রদায়িকের জয় হবে !!!
+।
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৪১
দীপংকর চন্দ বলেছেন: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের অন্তিম অভিলক্ষ্য।
কিছু কথা তো অন্তত বলে যাবার চেষ্টা করি। 'কি হবে, না হবে'- সে ভাবনা তোলা থাক আগামীর জন্য।
অনেক শুভকামনা।
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন উত্তর প্রদানের দীর্ঘ বিলম্ব।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
৪| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:২০
হাসান মাহবুব বলেছেন: এখনও ধর্মান্ধরা আছে, তবে আলতাফ উদ্দিনরা নেই। এটাই পার্থক্য। এভাবেই মহৎপ্রাণেরা ইতিহাস বদলে দেন। বিনম্র শ্রদ্ধা তার জন্যে।
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৪৬
দীপংকর চন্দ বলেছেন: আশা অটুট থাক অন্তরে। হয়তো 'সময়' সৃষ্টি করবে আবার আলতাফ উদ্দিন মোহাম্মদ-এর মতো মানুষদের। বদলে যাবে আবার ইতিহাসের গতিধারা।
অনেক শুভকামনা প্রিয় কথাসাহিত্যিক।
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন উত্তর প্রদানের দীর্ঘ বিলম্ব।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
৫| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:২৬
আলোরিকা বলেছেন: 'আক্ষেপে বিনষ্ট করি অন্তরের সুখ '-----------কি লাভ , কে বুঝবে এই মহৎ প্রাণ সম্পর্কে জানা ছিল না । ধীরে ধীরে অন্ধকার সব কিছুই গ্রাস করে নিচ্ছে । ভাল থাকুন দাদাভাইয়া ।
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৫১
দীপংকর চন্দ বলেছেন: আশা। 'ভাবিতে গেলে আশাতেই সংসার।'
ক্ষমাপ্রার্থনা উত্তর প্রদানে দীর্ঘ বিলম্বের জন্য।
অনেক অনেক ভালো থাকবেন।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৫৩
নীলপরি বলেছেন: পড়ে এবং জেনে ভালো লাগলো । পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ ।