![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঈদের গান, ইতিহাস এবং নজরুলের ইসলামী সংগীত
চাষা হাবিব
পবিত্র রমজানে এক মাস রোজা পালন শেষে ঈদের আনন্দ যেন প্রত্যেক মুসলিমদের প্রত্যাশিত আনন্দের এক অন্যতম খোরাক। চিত্র বিনোদনেরও অন্যতম ইভেন্ট বটে। এ মাসকে ঘিরে এবং মাস শেষে ঈদকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাংগালী সাংস্কৃতির এক অন্যতম সংয়োজনা, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাজার কোটি টাকার বানিজ্যিক স্বার্থও।ভা্রত উপমহাদেশে ইসলামী সংগীত বিশেষ করে বাংলা ভাষায় কাজী নজরুলের যে অবদান তা পরিমাপ যোগ্য নয়। আজ রোজা এবং ঈদ মানেই নজরেুলের গজল এবং হামদ নাত যেন প্রত্যেকটি টেলিভিশন এবং রেডিও মাধ্যমে না বাজলে চলেই না। কিংবা আজোও আমরা নজরুলের গানের সমকক্ষ কোন আবেদন ময়ী সংগীতের জন্ম দিতে পারি নি।
যাই হোক বাংলাদেশের আকাশে ঈদের চাঁদ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই সর্বত্র যে গানটি বেজে ওঠে তা হলো-
"ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।”
এই ঐতিহাসিক গানটির রচনায় রয়েছে এক চমদপ্রদ ইতিহাস। চলুন এবার সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক।
সংগীতের আকাশে সময়টা তখন শ্যামা সঙ্গীতের।সর্বত্র শ্যামা সংগীত জেনো জেঁকে বসেছে। কাজী নজরুল ইসলাম দেদারসে শ্যামা সঙ্গীত রচনা করছেন। তেমনি একদিন কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা সঙ্গীতের রেকর্ডিং শেষে বাড়ি ফিরছেন। সেসময় যাত্রাপথে তাঁর পথ আগলে ধরেন বাংলার সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন। তিনি এসেছেন কবির নিকট একটি বিশেষ কাজ নিয়ে। আব্বাস উদ্দীন আজ কবির কাছে এসেছেন একটা বিশেষ আবদার নিয়ে। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত কাজী নজরুলকে তিনি এগুতে দিবেন না এই তার মনোবৃত্তি। নজরুল যদিও তখন খুবই ক্লান্ত এবং কিছুটা ব্যস্তও বটে।তিনিও তাড়াতাড়ি সরতে চাচ্ছিলেন।
যদিও কবির সাথে আব্বাস উদ্দীনের অন্যরকম খাতির এবং অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল, তথাপিও কবির সঙ্গে একধরনের ভয় বা মানসিক দূরত্ব তাঁর ছিল। আব্বাস উদ্দীন কবি নজরুলকে সম্মান করতেন, সমীহ করে চলতেন। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকতেন। আব্বাস উদ্দীনকে সামনে পেয়ে নজরুল বললেন, “বলে ফেলো তোমার কি আবদার, তাড়াততাড়ি বলো।
আব্বাস উদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, “কাজীদা, একটা কথা অনেকদিন ধরেই আপনাকে বলবো বলবো বলে ভাবছি, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই বললেই চলে। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তবে তা হবে বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য বিশেষ পাওয়া হবে। আর আপনিও মুসলমানদের নয়নমনি হবেন। আপনি জানেন বাংগালী মুসলমানদের মধ্যে আপনাকে নিয়ে একধরনের নাক ছিটকানো ভাব আছে। ইসলামী সংগীত হয়তো আপনাকে তাদের কাছে অন্যভাবে চিহ্নিত করবে। তাহলে হয়তো মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনারও জয়গান হবে।নজরুলও কথাটি গুরুত্ব সহকারে শুনলেন। কিছু তেমন একটা বললেন না। শুধু বললেন দেখো ভগবতী বাবুকে মানাতে পারো কিনা।
এ সময়ে বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিলো শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পীও হিন্দু নাম ধারণ করেন। যেমন তৎকালীণ বিখ্যাত শিল্পী মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হিন্দু নাম ধারণ করে হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না বলেই তারা এমনটি করেন বলে জানা যায়।অবশ্য কাজী নজরুল ইসলাম নাম না পাল্টিয়েই অনেক শ্যামা সঙ্গীত লেখেন, সুর দেন এবং কখনো কখনো নিজেই তা গান। স্বনামেই হয়ে উঠেন বিখ্যাত।
তৎকালীণ গানের বাজারের যখন এই অবস্থা তখন আব্বাস উদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী উত্তর দেবেন? বিষয়টি বেশ ভাবনার। কারন ‘ইসলাম’ শব্দটার সাথে তো তাঁরও তো কতো আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, কুর’আন শিখেছেন, লোটের গানে গান গেয়েছেন, এমনকি তাঁর নিজের নামের সাথেও তো ‘ইসলাম’ আছে।তিনি ভাবলেন আব্বাস উদ্দীনকে কি বলবেন।
যাই হোক, আব্বাস উদ্দীনকে তো এই মুহূর্তে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলা যাচ্ছে না। কারন স্রোতের বিপরীতে সুর মেলানো চট্টিখানি কথা না। আবেগে গা ভাসালে চলবে না। গান রেকর্ড করতে হলে তো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য আবার ভগবতী বাবুর কাছে যেতে হবে। ভগবতী বাবু হলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ। তার উপরই সব বর্তায়, তিনি এ কাজে বিনিয়োগ করবেন কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই, নজরুল আব্বাস উদ্দীনকে বললেন, “আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা।” আব্বাস উদ্দীন মনে মনে ভাবলেন, এইতো, কাজীদার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলাম, এখন ভগবতী বাবুকে কিভাবে রাজী করাতে হয় সেটাও এখন দেখবেন। যেভাবেই হোক ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে হবে।
মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এবার আব্বাস উদ্দীন গ্রামোফোনের রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে বলা যায় অনুরোধ করলেন। কিন্তু, ভগবতী বাবু কোনমতেই ঝুঁকি নিতে রাজী না। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে এই তাঁর আশঙ্কা। আব্বাস উদ্দীন খান যতোই তাঁকে অনুরোধ করছেন, ততোই তিনি বেঁকে বসছেন। ঐদিকে আব্বাস উদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এতো বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না। অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। এভাবে দীর্ঘ ছয়মাস চললো অনুরোধ প্রয়াস। এ যেন পাথরে ফুল ফুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা! আর একজন সুর স্রষ্টার বিনীত আবদার।
এভাবে চলতে চলতে একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাস উদ্দীন আবার বললেন, “একবার এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?” ভগবতী বাবু আর কতো ‘না’ বলবেন। এবার হেসে বললেন, “নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।” আব্বাস উদ্দীনের খুশিতে চোখে পানি আসার উপক্রম! যাক, সবাই রাজী। এবার একটা গান নিয়ে আসতে হবে।
আব্বাস উদ্দীন জানতেন, কাজী নজরুল ইসলাম চা আর পান খুব পছন্দ করেন। তাই একদিন আব্বাস উদ্দীন এক ঠোঙা পান আর প্যাকেট ভর্তি চা নিয়ে নজরুলের রুমে গেলেন। এক খিলি পান মুখে দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম একখানা খাতা আর কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর তখন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাস উদ্দীন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো সময় যেন থমকে আছে। সময় কাটানোর জন্য আব্বাস উদ্দীন পায়চারী করতে লাগলেন। কি হতে চলছে এই তার ভাবনা।
এভাবে প্রায় আধা ঘন্টা কেটে গেলো। বন্ধ দরজা খুলে কাজী নজরুল ইসলাম বের হলেন। বাইরে এসে পানের পিক ফেলে আব্বাস উদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন।এই নেন আপনার গান।এই কাগজ তাঁর আধ ঘন্টার সাধনা। আর আব্বাস উদ্দীন খানের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল। আব্বাস উদ্দীন কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেনঃ-
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।”
আব্বাস উদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করছে।তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, অবশেষে তিনি তা পেলেন। এই একটা গানের জন্য কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়।তিনি কি জানতেন, তাঁর হাতে বন্দী গানটি একদিন বাংলার ইথারে ইথারে পৌঁছে যাবে? ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে টিভিতে ভেজে উঠবে- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...? বলা যায় বাংগালীদের ঈদের জাতীয় সংগীত হবে। এভাবেই একটি কালজয়ী গানের জন্ম হলো।
গান লেখার দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেলো। আব্বাস উদ্দীন খান জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তাঁর মুখস্তও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কিনা এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানিও শঙ্কায় আছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কিভাবে সুর দিতে হবে তিনি তা আব্বাস উদ্দীনকে দেখিয়ে দিলেন। সুর নির্মানের সময় হারমোনিয়ামের উপর আব্বাস উদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই। সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে বের হলো-
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...”।
হয়ে গেল গানের যাবতীয় কাজ। এবার ঈদে এ গানের এ্যালবাম বাজারে আসবে। এরপরেই আপাতত সবাই ঈদের ছুটিতে যে যার বাড়িতে।
রমজানের রোজার পর ঈদ এলো। আব্বাস উদ্দীন গ্রামের বাড়িতে ঈদ কাটাতে চলে গেলেন। কখন কলকাতায় যাবেন এই চিন্তায় তাঁর তর সইছে না। গানের কী অবস্থা তিনি জানেন না।তখন তো আর আজকের মত মিডিয়া কিংবা ফেসবুক ছিল না যে সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাওয়া যাযে।তিনি তাড়াতাড়ি ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। ঈদের ছুটির পর আব্বাস উদ্দীন প্রথমবারের মতো অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যতো এগুচ্ছেন, বুকটা ততো তার ধক ধক করছে। অফিসে গিয়ে কী দেখবেন? গানটা কি ফ্লপ হয়েছে? নাকি হিট হয়েছে- এ চিন্তায় তিনি অস্থির। গানটা যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর জীবনেও ইসলামি গানের কথা ভগবতী বাবুকে বলতে পারবেন না। ভগবতী বাবু কেন, কোনো গ্রামোফোন কোম্পানি আর রিস্ক নিতে রাজী হবে না। সুযোগ একবারই আসে। এরকম নানা ভাবনায় আব্বাস উদ্দীন শঙ্কিত। আব্বাস উদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক হঠাৎ গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এই যুবক গানটি কোথায় শুনলো? নাকি আব্বাস উদ্দীন খান ভুল শুনছেন? বলা যায় তিনি চমকে উঠলেন।না তো, তিনি আবারো শুনলেন যুবকটি ঐ গানই গাচ্ছে। এবার তাঁর মনের মধ্যে এক হীম শীতল বাতাস বয়ে গেলো। অফিস ফিরে বিকেলে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে এবার তিনি দ্বিগুণ অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে। তার মধ্য থেকে একটা ছেলে গেয়ে উঠলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এবার তিনি বুঝলেন তার পরিশ্রম স্বাথক হয়েছে। আব্বাস উদ্দীন এতো আনন্দ একা সইতে পারলেন না। তাঁর সুখব্যথা হচ্ছে। ছুটে চললেন কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। গিয়ে দেখলেন কাজী নজরুল ইসলাম দাবা খেলছেন। তিনি দাবা খেলা শুরু করলে দুনিয়া ভুলে যান। আশে পাশে কী হচ্ছে তার কোনো খেয়াল থাকে না। অথচ আজ আব্বাস উদ্দীনের গলার স্বর শুনার সাথে সাথে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল উচ্চস্বরে বললেন, “আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে! বলে বোঝানো যাবে না।
অল্প কয়দিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। ভগবতী বাবুও দারুণ খুশি। একসময় তিনি ইসলামি সঙ্গীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলছেন, “এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও না!” শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ। বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সঙ্গীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে হিন্দু শিল্পীদেরও।
একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সঙ্গীত গাবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। ধীরেন দাস হয়ে যান গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে যান সোনা মিয়া, হরিমতি হয়ে যান সাকিনা বেগম, সীতা দেবী হয়ে যান দুলি বিবি, ঊষারাণী হয়ে যান রওশন আরা বেগম। তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত গেয়েছেন। যেমনঃ অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষাল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
বলা হয়, কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গান লেখার সহজাত প্রতিভা ছিলো। খাতা কলম দিয়ে যদি কেউ বলতো, একটা গান লিখুন, তিনি সঙ্গে সেঙ্গেই তা লিখে ফেলতেন।
এর পরের ঘটনা, একদিন আব্বাস উদ্দীন কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে গেলেন। নজরুল তখন কী একটা লেখার কাজে যেন ব্যস্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীনকে হাতের ইশারায় বসতে বলে আবার লেখা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে জহরের আযান মসজিদ থেকে ভেসে আসলো। আব্বাস উদ্দীন বললেন, কাজী দা “আমি নামাজ পড়বো। আর শুনুন কাজীদা, আপনার কাছে আজ একটা গজলের জন্য এসেছি।” কবি আব্বাস উদ্দীনকে একটা পরিস্কার জায়নামাজ দিয়ে বললেন, “আগে নামাজটা পড়ে নিন।” আব্বাস উদ্দীন নামাজ পড়তে লাগলেন আর কাজী নজরুল ইসলাম খাতার মধ্যে কলম চালাতে শুরু করলেন।
আব্বাস উদ্দীনের নামাজ শেষ হলে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন আপনার গজল!” হাতে কাগজটি নিয়ে তো আব্বাস উদ্দীনের চক্ষু চড়কগাছ। এই অল্প সময়ের মধ্যে কাজী দা গজল লিখে ফেলছেন? তা-ও আবার তাঁর নামাজ পড়ার দৃশ্যপট নিয়ে?
“হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ,
দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।”
কাজী নজরুল ইসলাম বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর রচিত নাতে রাসূলের জন্য। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনেক গজল বা গান রচনা করেছেন, যা আজো হৃদয়ে দোলা দেয়, স্নিগ্ধ হয়ে যায় চৈতন্যের চোরাগলি।এমনিই কয়েকটি গজরের উল্লেখ করা হলো-
1. ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়…
2. মুহাম্মদ নাম জপেছিলি, বুলবুলি তুই আগে,
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান, এমন মধুর লাগে…
3. আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ
আমার বুকে হেঁটে যেতেন, নূরনবী হজরত…
4. হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে যায়।
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা।’
কাজী নজরুল ইসলামের এ সমস্ত ইসলামী গান আজ শুধ গজল হয়ে থাকেনি হয়ে ওঠেছে মুসলিম মানসের প্রতিভাত স্বরুপ। হয়ে ওঠেছে আরাধনার এক মূতমান হৃদস্পন্দন। পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা । গানগুলো রচনার প্রায় নব্বই বছর হয়ে গেলেও আবেদন যেন একটুও কমেনি বরং বেড়েই চলছে উত্তরোত্তর।। আজও মানুষ গুনগুনিয়ে গানগুলো গায়।
বাংলায় ইসলামি গানের যে নবজাগরণ কাজী নজরুল ইসলাম নজরুল সূচনা করিয়ে যে পথ দেখিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই পথের পথিক হয়েছেন জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক এবং হাল আমলের অনেকেই। আজও নজরুল বাংগালী মুসলিমদের নয়নমনি।যদিও কাজী নজরুল ইসলামের মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন মোল্লারা প্রায় তুলে থাকেন।তথাপিও কাজী নজরুলের অমর সৃষ্টি দিয়েই আজও আমরা ঈদ উৎযাপন করি আমাদের জাতীয় কবির অমর সৃষ্টি আজীবন বাংগালী মুসলিম মানসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
(সংক্ষেপিত...)
গ্রন্থসূত্রঃ
1. আব্বাসউদ্দীনের আত্মজীবনী-দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা।
2. নজরুল সাহিত্য; বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত।
3. শামস আরেফিন; যুগান্তর, 'নজরুল এবং ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে,
4. আদিল মাহমুদ; যুগান্তর, 'হামদ-নাতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন নজরুল',
5. বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম, Roar Media।
6. Risingbd, সুরের আকাশে উজ্জল নক্ষত্র আব্বাসউদ্দীন।
7. মানবতাবাদী নজরুল থেকে ইসলামি কবি বিলকুল, সিলেট টুডে, টুয়েন্টি-ফোর।
8. চাষা হাবিব;প্রবন্ধ;ঈদের গান, ইতিহাস এবং নজরুলের ইসলামী সংগীত।
চাষা হাবিব
কবি.গবেষক এবং উন্নয়নকমী।
©somewhere in net ltd.