![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Dipak Ray, Kalirhat, Krishnagar, Nadia, WB, India, Ph. 9775179985 Mail. [email protected]আমি লিখি, লেখার চেষ্টা করি। যা বিশ্বাস করি না, তা লিখি না। শিক্ষকতা আমার পেশা, লেখালেখি-সাংবাদিকতা নেশা। আমার লেখার সমালোচনা হলে, আমি সমৃদ্ধ হই।
ব্রতচারী আন্দোলনের জনক গুরুসদয় দত্তের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের বঙ্গপ্রদেশের, অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার কুশিয়ারা নদীর তীরের বীরশ্রী গ্রামের জমিদার রামকৃষ্ণ দত্তের পরিবারে। তার মায়ের নাম ছিল আনন্দময়ী দত্ত। রামকৃষ্ণ ও আনন্দময়ীর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুসদয় ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন বাংলার প্রকৃতিপ্রেমিক। ছেলেবেলায় বন্ধুদের সাথে নৌকা চালানো, ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা গ্রামীন ক্রীড়ায় ছিলেন তিনি পারদর্শী। পাশাপাশি পড়াশুনোতেও ছিল তার অসীম আগ্রহ।
১০ ই মে ১৮৮২ সালে যখন তার জন্ম হয়েছিল, তখন এদেশে ছিল ব্রিটিশ শাসন। বীরশ্রী গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তারক নাথ রায়ের সাহচর্যে তিনি পড়াশোনায় একের পর এক সাফল্য অর্জন করেন। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার মাতৃবিয়োগের যন্ত্রনায় এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনি প্রথম হতে পারেননি। সেই অতৃপ্তির কারনে এফ এ পরীক্ষায় তিনি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন এবং প্রথম হন। ১৯০১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি ভলান্টিয়ার ইনচার্জ হয়ে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তার ভালো ফলাফলের কারনে শ্রীহট্ট সম্মিলনী তাকে ১৯০৩ সালে ইংলন্ডে পাঠায়। সেখানে তিনি আইসিএস ও ব্যারিষ্টারী পড়েন। ১৯০৫ সালে দেশে ফিরে বিহারে মহকুমা শাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। কিন্তু তার ইংলন্ডে যাওয়াকে সেই সময়ের হিন্দু সমাজ ভালো চোখে নেয়নি। ফলে অচিরেই জাতিচ্যুত হবার ভয়ে তিনি ব্রাক্ষ্ম ধর্ম গ্রহন করেন। পরের বছর তিনি সরোজনলিনী দেবীকে বিবাহ করেন। সরোজনলিনী দেবী কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে না পড়লেও দেশী ও বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিতা ছিলেন। সেই আমলে তিনি ঘোড়ায় চড়া, টেনিস খেলা, বেহালা বাজানো, শিকার করা ও স্বদেশী সঙ্গীত শিক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৯০৯ সালে তাদের একমাত্র পুত্র বীরেন্দ্রসদয়ের জন্ম হয়।
১৯১১ সালে স্ত্রীর প্রেরনায় গুরুসদয় দত্ত বিহার থেক বাংলায় বিচারবিভাগের কাজে যুক্ত হন। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা ও বরিশাল জেলার বিচারবিভাগে কাজ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে তাকে বদলি করা হয় বীরভূম জেলার কালেক্টর হিসাবে। সেখান থেকে ১৯১৯ সালে সপরিবারে তিনি চলে যান জাপানে। সকখান থেকে ফিরে ১৯২১ সালে বাকুড়ার জেলাশাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। তারা দুজনে মিলে সমবায় প্রথায় চাষাবাদ, স্বদেশী মেলা ও মহিলা সমিতি গঠন করে সমাজ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। ১৯২৫ সালে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি “সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি” গঠন করেন। ১৯২৬ সালে আবার হাওড়া জেলার জেলাশাসক হিসাবে কাজে নিযুক্ত হন। সেখানেই ‘গ্রামের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার প্রচলন করেন। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ”হাওড়া জেলা কৃষি ও হিতকারী সমিতি”। এরপরে ১৯২৮ সালে হাওড়াতে লিলুয়ার রেলশ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলিচালনার তিনি তীব্র নিন্দা করেন। তার এই কাজে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সমালোচনা হয়। তাই তাকে হাওড়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯২৯ সালে তিনি রোমে এক কৃষি সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশে ফিরে মৈমনসিংহ জেলার জেলাশাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। সেই বছরেই আবার তিনি ইংলন্ডে যান। সেখানে ইংলন্ডের লোকগীতি ও লোকনৃত্য রক্ষা সমিতির অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন। ফিরে এসে গঠন করেন ”মৈমনসিংহ লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি”। সেইসময় মহাত্মা গান্ধীর লবন আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল মৈমনসিংহে। কিন্তু সেই আন্দোলনে তিনি কোন লাঠি বা গুলি চালানোর নির্দেশ না দেবার ফলে ব্রিটিশ সরকার তাকে মৈমনসিংহ থেকে বীরভূমে বদলি করে দেয়।
নতুন করে আবার বীরভূমে এসে তিনি ”লিজ ক্লাব এমেচার মিউজিক্যাল সোসাইটি” গঠন করে লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির খোজে মনোনিবেশ করেন। শুরু করলেন বিভিন্ন গান লেখা। বিলুপ্ত রায়বেশে নাচকে তিনি পুনরাবিস্কার করেন এই সময়। ১৯৩১ সালে গঠন করেন ”বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি”। ১৯৩২ সালে সেই সমিতির পক্ষ থেকে একটি লোকনৃত্য প্রশিক্ষন শিবিরের আয়োজন করেন। সেখানেই ৬ ই ফেব্রুয়ারী তিনি ‘ব্রতচারী’ প্রবর্তনের ঘোষনা করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য হন। সেই বছর দিল্লীতে তিনি সমিতির নাম বদলিয়ে ”সর্বভারতীয় লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি” গঠন করেন। ১৯৩৪ সালে আবার নাম বদলিয়ে ”বাংলার ব্রতচারী সমিতি” গঠন করে সেটি সরকারীভাবে নথিভূক্ত করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ইংলন্ডে লোকনৃত্য উৎসবে যান। ১৯৩৭ সালে তিনি একটি বড় দল নিয়ে হায়দ্রাবাদে মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বসুর উপস্থিতিতে একটি ব্রতচারী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৪০ সালে কলকাতার জোকা গ্রামে ১০১ বিঘা জমিতে ‘ব্রতচারী গ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ১৯৪১ সালের ২৫ শে জুন তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন।
সারাজীবন কর্মবীর এই মেধাবী মানুষটি বাংলা, বাংলার দেশীয় সম্পদ, বাংলার দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। লিখেছে অসংখ্য লেখা। তার লেখা ভজার বাশী, চাদের বুড়ী, পাগলামির পুথি, গ্রামের ডাকের ক-খ-গ, ব্রতচারী সখা, ব্রতচারী পরিচয়, পটুয়া সঙ্গীত, বাংলার বীর যোদ্ধা রায়বেশে, ব্রতচারী সিন্থেসিস, ফোক ড্যান্সেস অফ বেঙ্গল বাংলার এক অমুল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। তার সংগৃহীত আড়াই হাজার লোসশিল্প ব্রতচারী গ্রামে ‘গুরুসদয় মিউজিয়ামে’ সংরক্ষিত আছে। তার ব্রতচারী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে বাংলার ব্রতচারী সমিতি ছাড়াও ব্রতচারী কেন্দ্রীয় নায়ক মন্ডলী, বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতি ইত্যাদি নানা সংগঠন এখনো দুই বাংলায় ব্রতচারী প্রশিক্ষন দিয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশের খেলাঘর আসর, সুকান্ত সংসদ, ভারতের কিশোর বাহিনী ইত্যাদি সংগঠন ও বিভিন্ন বিদ্যালয় ব্রতচারী শেখানোর কাজে লিপ্ত আছে। তার ৭১ তম প্রয়ান দিবসে বাংলার এই প্রনম্য মানুষটিকে তাই শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।
©somewhere in net ltd.