নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুদেব চক্র বর্তী

জন্ম ১৯৮৭ সালে সিরাজগঞ্জে। পৈতৃক নিবাস মাগুরাতে। বর্তমানে ঢাকাতে অবস্থান করছি। লেখালেখি করি। এছাড়া- যুক্ত ছিলাম সাংবাদিকতা, গান, থিয়েটার, উপস্থাপনার সাথে। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মি ছিলাম। প্রকাশিত গ্রন্থ-‘সংশয়ী প্রার্থনা’।

সুদেব চক্র বর্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাণের স্ফুরণ, দোলা জাগানো ‍এবং রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যের বয়ান- ম্যানগ্রোভ মন

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৫

প্রাণ আহা প্রাণ! স্পন্দিত প্রান্তর

ম্যানগ্রোভ এক প্রাণময় পৃথিবী । রাজু আহমেদ মামুন-এর ‘ম্যানগ্রোভ মন’ কাব্যের দ্বিতীয় কবিতাটিতে রয়েছে প্রাণের সেই স্ফুরণ। সৃষ্টির উল্লাস। জন্তু থেকে মানুষ- এই সৃষ্টির উল্লাসে কাতর । বৈজ্ঞানিক তথ্যানুযায়ী- পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ভূমিতে প্রাণের প্রাচুর্যতা বা ঘনত্ব যতটুকু- ম্যানগ্রোভ স্যালাইন ওয়াটারে প্রাণের ঘনত্ব তার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। আবার পৃথিবীর যত ম্যানগ্রোভ অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রধান। বলা বাহুল্য, এই প্রকৃতি এতটাই শক্তিশালী, প্রাণময়, স্পন্দিত যে- মামুন-এর এই কবিতাটি না পড়লে উপলব্ধি করা কঠিন। প্রতিটি লাইনে ম্যানগ্রোভ পরিবেশের উত্তাল হাওয়া যেন রমন ঝড়ে প্রবাহিত। সঙ্গমমুখর । এই হাওয়া বন থেকে ছড়িয়ে পড়ে লোকালয় অবধি, মানুষের কাছে। এই কবিতাতে কবি যে চরিত্রগুলো এনেছেন তাতে ফুটে উঠেছে ম্যানগ্রোভ মনের প্রতীতি । বাঘার সুখজৌলুস, রতিকাতর হরিণী, প্রণয়কামী তরুন হরিণ,সঙ্গমে ফুঁসতে থাকা সাপ, সুখ ছোঁয়ায় রাত জাগা মোয়ালের পো কিংবা নতুন বউ, বুনো খাল প্রভৃতি বিষয় একত্রে যেন এক মূর্ত ম্যানগ্রোভ ।

কবিতা:
ম্যানগ্রোভ মন ২

সঙ্গমমুখর জংলী ঘ্রাণ খেলে যাবে উত্তাল হাওয়ায় হাওয়ায়
রাত বা দিনের কোন প্রহরে বাঘিনী মিলনকাতর হবে গহীন প্রান্তরে
জ্বলে উঠবে বাঘার সুখজৌলুস। রতিকাতর হরিণীর গন্ধে
আস্ফালনে ছুটে আসবে প্রথম প্রণয়কামী তরুণ হরিণ
জড়াজড়ি করে দুটি সাপ ফুঁসতে থাকবে সুখ যন্ত্রণায়
জীবন সমুদ্র থেকে উঠবে প্রাণের জোয়ার, বুনো খালের জলের মতো
সে হাওয়া পৌঁছে যাবে লোকালয়ে। কোনো মোয়ালের পো
নতুন বউয়ের সাথে জাগবে সারারাত সুখ সুখ ছোঁয়ায় ...

বাতাসের দোলনায় লাগে দোলা

গেওয়া ফুল মানেই সুন্দরবন, প্রাণশক্তিতে ভরা বিশাল ম্যানগ্রোভ জগতের এক উপাদান। গেওয়া ফুলের উগ্র গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে মধুপোকা, কুক পক্ষী। আর সেই দোলা লাগে প্রকৃতিতে, জাগিয়ে দেয় প্রাণীর মন। এমনই দোলা আর প্রাণকে জাগানোর চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে ‘ম্যানগ্রোভ মন’ কাব্যের তৃতীয় কবিতায়। কবি অকাতরে বইয়ে দিয়েছেন প্রাণ স্ফুরণের গান,প্রাণের প্রবাহমানতা। পুরো কবিতাটির ভেতরে জন্মের চিৎকার, জননের চিৎকার। জীবনের যে রি-প্রোডাক্টিভ সিস্টেম তা দুই রকম। এক. অযৌন এবং দুই. যৌন। প্রাণীজগতে দৃশ্যমান নয় এমন অনেক প্রাণী আছে, যাদের জন্ম অযৌন প্রক্রিয়ায় ঘটে। যেমন-ব্যাকটেরিয়া। অথচ এই অনুজীবগুলোও ফুড চেইন-এর সার্ফেস লেভেলে অবস্থান করে। এমনকি অনেক উদ্ভিদও আছে এরকম। ‘নুন পোড়া রোদ’ ঝাঁঝালো দুপুরের ম্যানগ্রোভ বনে কবি শুনতে পান জন্মের চিৎকার,জীবনের চিৎকার ।যেন বাতাসের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে সমুদ্রের লবন হাওয়, যে হাওয়ায় প্রাণ সৃষ্টির দোলা জাগে শিশ্নে, জরায়ুতে। আর মানুষের অগোচরে জন্মাতে থাকে ‘অর্থহীন চিত্রে বিচিত্র সুন্দর’। বাংলা কবিতায় ‘অর্থহীন চিত্রে বিচিত্র সুন্দর’- এ ধরণের প্রয়োগ বিরল ।

কবিতা:
ম্যানগ্রোভ মন ৩

নুন পোড়া রোদ পাগল দুপুর বাতাসের দোলনায়
গেওয়া ফুলের গন্ধমাতাল মধুপোকা কুক পক্ষীর ডাক
বাতাসের দোলনায়।

দোলা ধরে ছোটে প্রাণ, বাঁচে প্রাণ, মরে প্রাণ-প্রাণান্তে
দোলা বহু বহু দোলা আরো আরো দোলা
দোলা অগণন।

পাগল দুপুর ম্যানগ্রোভ মন- জাগে দোলা, জাগে প্রাণে রক্তে
জাগে শিশ্নে, জরায়ুতে জননে জন্মে
জাগে বিপুল বিচিত্র শুরুর চিৎকারে শেষের চিৎকারে
যৌনে অযৌনে বিপুল, বিপুল দোলায় জাগে
অর্থহীন চিত্রে বিচিত্র সুন্দর।


এক রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যের বয়ান

‘ম্যানগ্রোভ মন’ কাব্যের চতুর্থ কবিতাটিতে পাঠক কেবল কবিতার লাইন ধরে ধরে ভেতরে ঢুকতে থাকবে। কারণ এখানে কবি ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশে এক রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যের বয়ান দিচ্ছেন। বিশ্বসংসারে প্রতিটি প্রাণীই জীবনকে আস্বাদন করতে চায়। টিকে থাকতে চায়। কিন্তু পৃথিবীতে প্রতিটি জীবকে টিকে থাকতে হয় লড়াই করে। জীবনের এই নিরন্তর সংগ্রাম আছে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমেও। কবি সেই চিত্র তুলে ধরেছেন। মৌচাক ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়া বিষাদ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী কিংবা বানরের চিৎকার সবই এই টিকে থাকার দৌড়ের অংশ। এই দৌড় চলমান। কারণ জৈবিক ক্ষুধার কারণে এই ছুটে চলা, এই অব্যাহত সংগ্রাম। এখানে যে তৃষ্ণাছবি ফুটে ওঠে কবির ভাষায় তা- গলগলে তাজা রক্ত। মূলত বেঁচে থাকার শক্তি যে এই রক্তেই। তাই রক্তই যেন চাহিদা। গোলবনের সীমানা ছাড়িয়ে এই দৌড় জীবনের সমান। কবির ভাষায়, ‘যেন প্রান্তর ছেড়ে নক্ষত্রপুঞ্জ পাড়ি দিয়ে/বাহিত হবে অনন্তের মাঠে অনন্তকাল।’ মানে জীবনের এই দৌড় বা ছুটে চলার গতি তা নক্ষত্রপুঞ্জকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার মত। শিকারির পেছনে শিকারি। অজগরও খুলে নিচ্ছে শরীরের প্যাঁচ। আবার “জলের তলায় হাঙর কুমির খেলা করে ভেটকি কোরাল” ্এরকম সৃজনশীল বাক্য বাংলা কবিতায় বিরল।
এ তো গেল প্রাণীদের টিকে থাকার সংগ্রামের কথা। এদিকে জলযানে বসে আছে এক শিকারি মাতাল। এই শিকারি মাতাল সভ্য মানুষ। তার হাতে অস্ত্র, বন্ধ্যা রাত্রি, থমকে যাওয়া কাল। আজ যখন বিশ্বের অহংকার, এই জনপদের ফুসফুস ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মুখে তখন কবি রাজু আহমেদ মামুন-এর এই কবিতাটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নানান দৃষ্টিকোন থেকে ।

কবিতা:
ম্যানগ্রোভ মন ৪

মৌচাক ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাদ, ধোঁয়ার কু-লী
ভনভন আওয়াজ, বলগা বাতাসে কেওড়া পাতার শিস
বানরের চিৎকার
হঠাৎ নড়ে ওঠা গোলবন ছেড়ে ছুটন্ত ক্ষুধা
দৌড়- দৌড়- দৌড় জীবনের সমান দৌড়
যেন প্রান্তর ছেড়ে নক্ষত্রপুঞ্জ পাড়ি দিয়ে
বাহিত হবে অনন্তের মাঠে অনন্তকাল।

ছুটছে ক্ষুধা কাঁপিয়ে ভূতল
ছুটছে ক্ষুধা জ্বালিয়ে জীবন
তৃষ্ণাছবি- গলগলে তাজা রক্ত!

গীলা লতার আড়ালে নড়ছে ঝরাপাতা, প্রাচীন সরীসৃপ
খুলে নিচ্ছে শরীরের প্যাঁচ, প্যাঁচানো খালের শরীরে
পোয়াতি শূকরীর মতো ফুলছে জল, জলের তলায়
হাঙর কুমির খেলা করে ভেটকি কোরাল।

জলযানে বসে আছে এক শিকারী মাতাল

মাতালের হাতে বারুদের গন্ধ, বন্ধ্যা রাত্রি
থমকে যাওয়া কাল।



একটি বিভীষিকাময় রাতের ছবি

ম্যানগ্রোভ বনের প্রতিটি পদক্ষেপে যেমনি আছে সৌন্দর্য, যেমনি আছে প্রাণের স্ফুরণ তেমনি আছে আর্তনাদ কিংবা মৃত্যুর গল্পও। ‘ম্যানগ্রোভ মন’ সিরিজের পঞ্চম কবিতায় ধরা পড়ে এই বিভীষিকাময় চিত্রকল্প। বিশেষ করে এই প্রতিবেশের রাতগুলো যে কত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তা কবি স্পষ্ট করেছেন। অমাবস্যার রাতে জল বাড়লে বুকঠেলে ডাঙায় উঠে আসে কুমির,ঘন বৃষ্টিতে অন্ধকারে পথ হারায় নিশাচর। প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর প্রহর গোনে হরিণের দল। বাতাসে ছড়ায় আর্তনাদ। কিন্তু বৃষ্টির শব্দে সে আর্তনাদ বেশি দূর পৌঁছায় না। ফলে হাহাকারগুলো হয়ে ওঠে বোবা কিংবা শব্দহীন। ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশের ‘হরিণ সকাল’ তাই বিধ্বস্থ হয়ে যায়। ‘বিধ্বস্থ হরিণ সকাল’ উপমাটি কবিতার ভেতরে যে বিভীষিকা রয়েছে তা আরও নান্দনিক করে তোলে। তবে জীবন থেমে থাকে না। ‘ তবু হ্রস্ব হ্রদের বাকে খেলা করে জীবনের নতুন সংরাগ/ জমে থাকে জমে ওঠে কুমির সঙ্গম’ এই লাইন দিয়ে কবি সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। এখানে ‘সংরাগ’ শব্দটি নতুন। একজন কবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তিনি নতুন শব্দের জন্ম দেন। কবি রাজু আহমেদ মামুন এখানে সেই কাজটিই করেছেন। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে এই যে নতুন শব্দের সংযোজন তার জন্য ‘ম্যানগ্রোভ মন’ কাব্যটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে।

কবিতা:
ম্যানগ্রোভ মন ৫

বানডাকা অমাবস্যার জল যখন দাঁড়িয়ে পড়ে
কুমির ভরা রাত বুক ঠেলে উঠে আসে বাদার ডাঙায়
বিপুল অন্ধকারে ঘন বর্ষণে থমকে যায় নিশাচর
হরিণের কম্পমান প্রহর, বেঘোরে মৃত্যুর রাত
বৃষ্টির গায়ে গায়ে মিলিয়ে যায় আর্তনাদ, মৃত্যু
ফেলে যায় বিধ্বস্ত হরিণ সকাল আর বোবা হাহাকার

তবু হ্রস্ব হ্রদের বাঁকে খেলা করে জীবনের নতুন সংরাগ
জমে থাকে জমে ওঠে কুমির সঙ্গম।

( কবি রাজু ‍আহমেদ মামুন ‍এর ‘ম্যানগ্রোভ মন’ কাব্যগ্রন্থটি ‍এবার বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পাওয়া যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী ‍উদ্যানে ‘কাগজ প্রকাশন’ ‍এর স্টলে। স্টল নং ৪২০)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.