নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শব্দকবিতা : শব্দেই দৃশ্য, শব্দেই অনুভূতি [email protected]

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

গতানুগতিক দুঃখ

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৪৩


সন্ধ্যা হলেই সারা বাড়ি ভরে লুকোচুরি খেলার ধুম পড়ে যেতো। পিয়ারীবুবু আমার ছোট্ট শরীরের সবটুকু তার বুকের ভেতর লেপ্টে পেলব হাতে আমার চোখ বাঁধতেন। পোলাপানেরা দৌড়ে কোনাকাঞ্চিতে লুকিয়ে চিকন ও লম্বা ‘টুউউউ’ শব্দ করলে বুবু আমাকে কোল থেকে ঠেলে দিয়ে বলতেন— ‘যা, ছু‌’। হাওয়ার বেগে ভোঁ ভোঁ ছুটে গিয়ে যে কাউকে ছুঁয়ে ফেললেই সে ‘গাভি’।
পিয়ারীবুবুর বিয়ে হয়ে গেলে অনেকদিন অমন মজা করে লুকোচুরি খেলা হলো না। পিয়ারীবুবুর বিরহে আমার খুব কান্না পেতো।
যুদ্ধের সময়ে পাখিবুবুরা গ্রামে চলে এলেন। আমাদের তখন কী অস্থির সময়; কিছু বুঝি, অনেকখানিই বুঝি না।
কিছুদিন পর আবারো আমাদের সন্ধ্যাগুলো মুখর হলো। আঁধার নামলেই তড়িঘড়ি জড়ো হই। পিয়ারীবুবুদের সেই ঘরের দাওয়ায়, যেখানে বুবু আমাকে খুব ঘনিষ্ঠ করে কোলে চেপে বসতেন, সেখানে এখন পাখিবুবু বসেন। বুবুর কাছে দৌড়ে ছুটে যাই ‘গাভি’ হবো বলে; কিন্তু তাঁর কৃপানজরে পড়ি না, ‘গাভি’ও হতে পারি না; ‘গাভি’ হতে কোনো গর্ব নেই, সবচেয়ে নিঃস্ব, অপারগ ও ছাপোষা পোলাপানই ‘গাভি’ হবার যোগ্যতা রাখে। ‘গাভি’ হবার যন্ত্রণা, কষ্ট ও বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি; ‘গাভি’র কোনো আনন্দ নেই; ‘গাভি’কে সবাই খাবলে-খামচে ঘা করে দেয়; আমি পিয়ারীবুবুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে একদৌড়ে সবাইকে তাড়া করেও কাউকে ছুঁতে পারি নি; আমি সারাজীবন খামচিখাওয়া ‘গাভি’ই হতে চেয়েছি।
একদিন ‘গাভি’ হবার বাসনায় পাখিবুবুর কোলে বসতে উদ্যত হতেই বুবু ভর্ৎসনা করে বলে উঠলেন, ‘বুইড়া পোলা...., যা সর্‌।’
পিয়ারীবুবুর জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। পাখিবুবুর জন্যও গোপনে গোপনে কেঁদেছি অনেকদিন। আমি ‘বুড়ো’ হতে হতে অনেক বড়ো হয়ে গেছি, বুবুরা আমাকে মনে রাখেন নি; আমিও তাঁদের ঠিকানা জানি না।
যে মেয়েটি আমাকে জীবনে প্রথম ফুল দিয়েছিল, আর অপূর্ব কিছু হাসি, ভাঙা কয়েকটি শব্দে একটা চিঠি, আর বলেছিল আমাকে তার ভালো লাগে, আমি তাকে সুদীর্ঘ কিছু চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলাম। অনেক অনেক দিন পর ধলেশ্বরী নদীর তীর ধরে ধু-ধু দূরে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে মনে হয়েছিল— ওর নামই হতে পারে আফরোজা।
পারুল আপা একদিন অ্যালবাম ঘেঁটে আমার সবচেয়ে ফুটফুটে ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটা আমি নিলাম। ঘরে ঝুলিয়ে রাখবো, বুঝলি খোকা?’ আর আদর করে আমার নাক টিপেছিলেন। আমি তিনদিন চুরি করে পারুল আপার ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার বুক আজও পুড়ে যায়। পারুল আপা আমায় ফাঁকি দিয়েছিলেন।
আরো একটা ঘটনা জীবনে প্রথম ঘটলো, এই সেদিন, এই অর্ধ প্রৌঢ়ে এসে। মহীয়সী বললেন, ‘আপনি চিরকালই আমার মন জুড়ে থাকবেন।’ ... তারপর তিনিও তাঁর কথা রাখতে পারেন নি।


নূরপুর মাঠে পৌষসংক্রান্তির মেলা। সারা বছরের সমস্ত সাধ জমা করে রাখি, কবে আসবে পৌষসংক্রান্তির দিন। তুমুল ঘোড়দৌড়, পাগলা ষাঁড়ের তেঁজ, মুরলি-চানাচুর— কী যে নেশা।
মেলার দিন ভোর হতেই অস্থির হয়ে উঠি। পাড়ার সাথিরা মিলে জটলা করি, সময় কাটে না কখন বিকেল হবে।
আবুল, নুরু, জসিম, আরো অনেকে। আমি দুপুর হতে না হতেই প্রস্তুত হয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করি।
‘নু, যাবি না?’ আমি, আবুল আর নুরুকে তাড়া দিই।
নুরুদের গরুগুলো তখনো চকের ক্ষেতে ঘাস খায়; আবুলেরও দেরি হয়ে যায় কী কারণে জানি না। আমি ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দুয়ারে অস্থির পায়চারি।
আবুল আর নুরু, ... ওরা কখন আমাকে ফেলে মেলায় চলে যায়, আমাকে ডাকেও না।


ছোটো খালা আমাকে খুব আদর করতো ছোট্টবেলায়। প্রতিবারই আমাদের বাড়িতে আসবার কালে কোঁচড়ভর্তি মোয়া আর রঙ্গিন নেবুনচুষ নিয়ে আসতো আমার জন্য। নানাবাড়িতে গেলে সারাদিন আমাকে নিয়েই মেতে থাকতো ছোটো খালা। আমি ছোটো খালার কলজের টুকরো ছিলাম।
ছোটো খালার বিয়ে হয়ে গেলে বেশি সময় আমি খালাদের বাসায়ই থাকতাম। খালা আমাকে কত আদর করতো!
আমার খালাতো ভাইবোনেরা বড়ো হতে হতে খালার আদর কমতে থাকলো না।
একদিন খালা আমাকে খুব কষ্ট দিল। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে গেলো। খালা তা বুঝলো না বলে আমার বুক ফেটে যেতে থাকলো। খালু সেদিন বাজার থেকে অনেক বড়ো একটা ইলিশ মাছ এনেছিল। ডিমে ইলিশটার পেট ভর্তি ছিল। ডিম আমার অনেক ভালো লাগে। সব ভাইবোন মিলে খেতে বসলাম। খালা দু টুকরো ডিম দু খালাতো ভাইবোনের পাতে তুলে দিয়ে আমাকে দিল পিঠের কাঁটাঅলা মাছটা। আমি মনে মনে খুব কেঁদেছিলাম। আমি তো খালার হাতের ডিমের টুকরো চাই নি, খালা আমার কথা আর আগের মতো ভাবে না— কেবল এটাই আমার বুকে তোলপাড় ঢেউ তুলতে লাগলো।
এরপর খালার আদর ভুলে যেতে থাকলাম।


গালিমপুরে আমার এক ধর্মবোন থাকতো। পাখির মতো তার কণ্ঠে ‘ভাইয়া’ ডাকটি কী যে ভালো লাগতো! আমার জন্য সে জান দিত।
একদিন বিকেলে না বলে-কয়ে হীরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি মহাধুমধাম। হীরার ছেলের মুসলমানি। অনেক আত্মীয়স্বজন। আমাকে দেখে হীরা যে বেজার হলো তা নয়, তবে আন্দাজ করলাম সে বিব্রত হয়েছে; এমন একটা উপলক্ষ্যে আমাকে দাওয়াত করে নি, হয়ত সেজন্য।
খেতে বসে আমাকে দেখে কেউ একজন ‘এই কুটুমকে ঠিক চিনতে পারলাম না’ বললে হীরা শুকনো স্বরে যখন জানালো, ‘উনাদের বাড়ি পদ্মার পাড়ে’, আমি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সে এখনই বলবে, ‘উনি আমার অতি প্রিয় বড়ো ভাইয়া’। আমি আরো ভাবছিলাম, এই বুঝি হীরা অন্তত ‘ভাইয়া’টুকু সম্বোধনে ডেকে উঠে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, আমি এ বাড়িতে অতি সম্মানীয় একজন, নিদেনপক্ষে অপ্রত্যাশিত কেউ নই।
ধর্মবোনের কথাও আমাকে ভুলে যেতে হয়েছে।

২৮ এপ্রিল ২০১০


* 'কালের চিহ্ন', গল্পগ্রন্থ, একুশে বইমেলা ২০১৬

কালের চিহ্ন ডাউনলোড লিংক

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: এটা কি পুরো গল্প না। অংশবিশেষ?

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:২৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: এটা এখানেই শেষ। কিন্তু দুঃখগুলো গতানুগতিক, এবং প্রতিনিয়ত ঘটতেই থাকে :(

২| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:২৩

প্রিন্স হ্যামলেট বলেছেন: আপনি তো দেখি বেশ দুঃখওয়ালা মানুষ । অনেকটা কবি হেলাল হাফিজের মত

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৫৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: এটা একটা ছোটোগল্প। একজন মানুষের জীবনে অনের রকম অনেক দুঃখ থাকে। এ নায়কের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু বিশেষ দুঃখের কথা এখানে বলা হয়েছে।

প্রতিটা গল্পের পেছনে একেকটা পটভূমি আছে, এবং সেই পটভূমি হলো স্বয়ং এই ব্লগ।

আমার ছোটোবোনকে খাইয়ে-পরিয়ে, অনেক আদর-যত্নে, বড়ো করলাম। ও আমার জান, আমার প্রাণ। আমাকে ছাড়া ও কিছু বোঝে না। ওর জন্য আমি কলজে ছিঁড়ে বাঘের মুখে ছুঁড়ে ফেলতে পারি। --- এসএসসি পরীক্ষায় ও দারুণ রেজাল্ট করলো। সাংবাদিকরা যখন গতানুগতিক প্রশ্ন করলো, তোমার এ কৃতিত্বের পেছনে সবচাইতে কার অবদান বেশি? ও তখন সবার নাম বললো, একে একে গড়গড় করে বলে গেলো সবার নাম।--- একটা নাম বাদে---

এটাও একটা গল্প।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৩| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:০৩

প্রিন্স হ্যামলেট বলেছেন: আমিও গল্পের নায়ককে মিন করেছিলাম।

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৪৩

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: দারুণ :)

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৪

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ ;)

৫| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫০

মাহের ইসলাম বলেছেন: অত্যন্ত প্রাঞ্জল লেখার গাঁথুনি।
খুব ভালো লেগেছে।

'চক' শব্দটি শুনে জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের গ্রাম কি টাঙ্গাইল বাঁ গাজিপুরের এদিকে ?

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: না ভাই, আমার বাড়ি দোহার। দোহার, সাভার, ধামরাই, গাজীপুর- পার্থক্য খুব কম, এবং মিলও অনেক বেশি।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৬| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৮:৫১

হাবিব বলেছেন: খলিল ভাই, এবারের বই মেলায় আপনার কোন বই বেরুচ্ছে?

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: না ভাই, এবারের বইমেলায়, গতমেলায়, তার আগের মেলায়ও আমার কোনো বই বের হয় নি। আগামীতে কবে বের হবে জানি না। বই বের করা খুব ঝামেলা :(

৭| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:১৫

সৌরভ সাফওয়ান বলেছেন: বাস্তব গল্প

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৯

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ সৌরভ সাফওয়ান।

৮| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:১৬

সোহানী বলেছেন: মনে হয় এ দুখী গল্প আগে পড়েছিলাম।

তারপর আপনার দু:খে আবারো না হয় দুখী হলাম। এরকম হাজারো দু:খ বয়ে বেড়ায় সবাই, আমি আপনি বা অন্য কেউ.......।

অনেক ভালেঅ থাকেন সোনাবীজ ভাই।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৩৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আপনার আগেও পড়ারই কথা ;) আমি যেমন এক বস্তু একাধিকবার পোস্ট করি, আপনার পদধূলি নিয়মিত পড়ে আমার ব্লগে। কাজেই রিপিট হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নাহ

ধন্যবাদ আপু আবারও পড়ার জন্য।

৯| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৩

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: কারো কারো জীবনটাই এরকম না পাওয়া ভালবাসায় পরিপূর্ণ; বুকের ভেতরের না পাওয়ার হাহাকারগুলো গুমরে মরে নিভৃতে। অনেক অনেক ভাল লাগলো। ++++

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৩৬

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: খুব সুন্দর বলেছেন। আমার তো মনে হয়, না-পাওয়াদের দলটা অনেক বড়ো ও ভারী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.