![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বৃথা আসি, বৃথা যাই / কিছুই উদ্দেশ্য নাই
হোসাইন জাকিরের সঙ্গে পরিচয় হয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায়। রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করে কিছু দিন নিয়মিত ভাল স্টোরি দিয়ে প্রথম মাসের বেতন তুলে কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যায় ও।
মাস তিনেক পর আবার ফিরে এসে সহৃদয় সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর মন গলিয়ে আবার জয়েন করে এবং ধুন্ধুমার রিপোর্টিং করতে শুরু করে। খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক প্রশংসা পায় জাকির এবং সহকর্মীরা তাকে অসম্ভব পরিশ্রমী, সাহসী, সৎ, বুদ্ধিমান, সাদাসিদা মনের মানুষ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে।
জাকিরের কর্মকাণ্ডে গুণমুগ্ধ হয়ে বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টা করি। ও খুব সহজে আমার সঙ্গে চা-সিগারেট খেতে ও খাওয়াতে শুরু করে। খুব দ্রুত আমরা দুজন তুই হই। নিউজ রুম থেকে ক্যান্টিনে নামার সময় জাকির আমাকে “ফয়সল চা খাইবিনি আয়” বলে ডেকে নিয়ে যায়। পান চাবাতে চাবাতে কথা বলে জাকির। কানে অনেক আন্তরিক হয়ে লাগে। চা খেত পান গালের এক দিকে সরিয়ে রেখে। আমার ভাল লাগতো। জাকিরের জড়তাহীন উচ্চস্বরের কথা শুনলে বন্ধুত্বের ভরসা জাগত।
একদিন সকাল সকাল অফিসে এসে ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়ে দেখি লু্ঙ্গি পরা জাকির গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে ক্যান্টিনে ঢুকছে। গামছাটা ক্যান্টিনের ভেতর দিকে অন্ধকার খুপরির ভেতর একটা রশিতে ঝুলিয়ে নিচু হয়ে একটা ব্যাগ থেকে জামা-প্যান্ট বের করে দ্রুত বের করে পরে নিল। ক্যান্টিনের মালিক জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ছোট ভাই সোহেল তার পকেট থেকে চিরুনি বের করে দিল। জাকির তড়িঘড়ি করে চুল আঁচড়ে বললো “দে তাড়াতাড়ি দে, বাইরাইতে হইব।”
সোহেল প্লেট ও তিন বাটির একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করে দেয়। সব কিছু দেখে মনে হলো নিয়মিত ও এখানে গোসল করে। ক্যান্টিনটা ছোট ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ডে। সিঁড়িঘরে। চা, সিগারেট, বিস্কুট, বার্গার ইত্যাদি থাকতো। ক্যান্টিন থেকে দূরে কোনায় পানির কল আছে একটা। মানবজমিনের অফিস। দুই হাজার সালে বাংলা মোটরে ওয়ালসো টাওয়ারে ছিল।
জাকির প্লেটে ভাত, আলু ভর্তা, ডাল নিয়ে বললো, “ফয়সল খাবি?” আমি “খাবো না” বলে কোত্থেকে খাবার আনে জিজ্ঞেস করলে জানালো, “দশ টাকা করে। তিন বেলা ত্রিশ টাকা। রান্না খুব ভাল। তুই খাইলে ব্যবস্থা করে দিব।” আমি বললাম, “দুপুর থেকেই ব্যবস্থা করে দে তাহলে।”
চা খেতে খেতে খেতে কোনায় ডেকে ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি পরিবাগ বস্তিতে উঠছি। ভাড়া খুব কম। তুইও ওঠ। এক রুম। এক হাজার টাকা ভাড়া।” আমি বললাম, “তোর রুমে থাকতে পারুম না? আমি অর্ধেক দিলাম। পাশশো?”
জাকির রাজি হয়ে যায়। সেই সন্ধ্যায়ই আমি জাকিরের সঙ্গে পরিবাগ বস্তির ভাণ্ডারি চাচার কাঠের ঘরের দোতলার রুমে উঠে যাই। এবং, বেতন কম পেলেও পরবর্তী কয়েক মাস ঢাকায় দু’জনে প্রায় বড়লোকদের মতোই স্বাধীন আনন্দময় সময় কাটাই।
মাস তিনেক পর হঠাৎ করে ও উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমি কিছুদিন একা একা থেকে পরিবাগ থেকে চলে যাই। কয়েক মাস পর জাকিরের রিপোর্ট দেখি আজকের কাগজে। ফ্রন্ট পেইজে অনুসন্ধান শিরোনামে স্পট রিপোর্টিং করত বেশি। পরে দেখা হওয়ার পর যখন জিজ্ঞেস করেছি বলেছিল, “এটার জন্য বেতনের বাইরে বিল দেয়। কনভেন্সও।”
আমাদের ঘরে দিনে অসহ্য গরম থাকতো। টিনের চাল। রাতে কাঠের পাটাতন থেকে শ’য়ে শ’য়ে ছারপোকা বের হয়ে কামড়াতে শুরু করত। খাবারের ব্যবস্থা করেছিল বাড়িওয়ালার কাছ থেকেই। দুজনের বাটি আসত। বাড়িওয়ালার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই জাকিরকে অনেক মান্য করত ও ঘরের মানুষ জ্ঞান করত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত মারফতি গান হত আমাদের নিচতলার রুমে।
চট দিয়ে ঘেরা কমন বাথরুম ও চিকন লোহার সিঁড়ির পাশেই ভাণ্ডারি চাচার সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা। গানের দিনে জাকিরকে সেখানে উপস্থিত থাকতে পিড়াপিড়ি করত সবাই মিলে। বস্তির লোকজনের শালিস করতে দেখতাম কখনো। খুব ভাল লাগতো আমার। এক বৃহস্পতিবার চাচার ছোট ছেলে গাইছিল, “জীবন রে আরে ও জীবন ছাইড়া না যাইস মোরে, তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে আদর করবো কে জীবন রে।” জাকির বলেছিল, এই ছেলেটা অনেক বড় গায়ক হবে বড় হলে। আমরা দোতলা থেকে উপুর হয়ে শুয়ে গানের আসর দেখতাম।
প্রথম রাতে ভাত খেতে খেতে জাকির বলেছিল, “ঢাকায় ফ্ল্যাট না কেনা পর্যন্ত এই বস্তিতেই থাকমু। বাড়ির জমি, গাছড়া দরকার হলে বেইচচা দিমু। বৌ-বাচ্চা ছাড়া থাকন অনেক কষ্ট।” যুক্তিটা আমার অনেক পছন্দ হয়। আমিও সিদ্ধান্ত জানাই, “ঢাকায় ফ্ল্যাট না কেনা পর্যন্ত এখানেই থাকব।”
জানলাম জাকির বিয়ে করেছে। একটা সন্তান আছে। ওদের কথা বেশি মনে হলে চাকরি-বাকরি ছেড়ে যেখানে তখন থাকে সেখান থেকেই চট্টগ্রাম রওনা দেয়। আরো জানলাম, ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফার ভাতিজা।
খাবার শেষে বললো, “চল, শাহবাগ থেকে চা খাইয়া আই। উরুশ মারার চকও নিতো অইবো।”
প্রায় নিয়মিত শাহবাগে চা খেয়ে অনেক রাত করি। রমনার চারপাশের রাস্তায় চক্কর মেরে আবার শাহবাগে চা খাই। ডিম, ডাল, পরোটা খাই। ঘুম আসলে দোতলায় উঠে বিছানার চারপাশের তক্তায় বিষ মেশানো চক টানতাম দুজন মনযোগ দিয়ে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে উদ্যম নিয়ে দিন শুরু করতে দেখতাম জাকিরকে।
উপার্জন বাড়ানোর জন্য অভিনব কিছু ব্যবসা-বুদ্ধি বের করেছিল ও। শাহবাগের দশ-পনেরোজন পরিচিত টোকাইকে টাকা দিয়ে ধানমণ্ডি লেকে ফুলের ব্যবসা করিয়েছিল কিছুদিন। লাভ অর্ধেক অর্ধেক। এককালীন ২০ টাকা থেকে ১শ টাকা দিয়েছিল প্রত্যেককে। ব্যবসায়িক পার্টনারদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। একজন ছিল কো-অর্ডিনেটর। রাতে শাহবাগ গেলে এক কোনায় গিয়ে ওর সাথে হিসেব করে নিত। একদিন এক’শ টাকার বেশি লাভ হওয়ায় বেশি চা খেয়েছিলাম। পরে নিজে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
পরে ব্যক্তিগত যোগাযোগ কমে গেলেও দুজনের পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে পরস্পরের জন্য কুশল পাঠাতাম। দূরে আছি মনে হয় নি। বন্ধুত্বে ঘাটতি চলছে তাও মনে হতো না।
ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর সময় সহকর্মী সোমা ইসলাম ফোনে জানান হোসাইন জাকির অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ক্যান্সার হয়েছে। দুজনের তারুণ্যদুষ্ট অনেক আনন্দময় সময়ের কথা মনে পড়ে। ওর হাসির ঝলকভরা মুখ আর সব সাহসী সব কর্মকাণ্ডের কথা মনে পড়ে। মনে ভরসা হয়, এমন জীবনীশক্তিভরা মানুষ সহজে হারবে না। সুস্থ হয়ে উঠবে ও।
অনলাইনে ও কয়েকটা পত্রিকার খবরে দেখি চিকিৎসার টাকা লাগবে। ও এখনো মনিপুরি পাড়ার ভাড়া বাসায়। তার মানে, পরিশ্রমের জেরে ২০০৪, ২০০৬, ৭, ৯ সালে রিপোর্টার্স ইউনিটির সেরা পুরস্কার, ২০১১ সালে ইউনিসেফ পুরস্কার পেলেও যথারীতি বস্তিতে ওঠার সঞ্চয় পরিকল্পনা কাজে লাগে নি।
স্ত্রী ছাড়াও ঘরে ১৪ বছরের মেয়ে নিলয়, ১১ বছরের ছেলে আকাশ ও দেড় বছরের ছেলে স্বপ্ন।
পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে মানবজমিন, আজকের কাগজে কৃতিত্বময় কাজের পর জাকির যুগান্তর পত্রিকায় বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। চীফ রিপোর্টার হয়েছেন আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায়। প্রকাশিতব্য আজকের পত্রিকায় চীফ রিপোর্টার হিসেবে নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। সুস্থ হয়ে ফিরে কাজ শুরু করার পর আরো অনেক বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ করবেন নিশ্চয়ই।
বন্ধুর এমন অসুস্থতায় আমার অনেক মন খারাপ হয়েছে। ওর অনেক বন্ধু আছে আরো। নবাব আসকারি জুট মিলের পাশের মধুর দোকানের বৃদ্ধ চাচা ওকে বিনা পয়সায় মধু খাইয়ে আনন্দ পেতেন। শাহবাগ মোড়ের এক পুলিশ সার্জেন্ট ওর কাঁধে হাত রেখে গল্প করতেন। বিচিত্র শ্রেণী পেশার মানুষ ঘনিষ্ট ওর। তাদের সবার নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে। জুনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরন করত জাকির। সিনিয়র সাংবাদিক ও সব শ্রদ্ধেয় সম্পাদকগণের স্নেহ অর্জনের দৃষ্টান্ত অনেক বার প্রকাশ হয়েছে।
ভরসা হয়, এত মানুষের ভালোবাসা অর্জন যে করেছে, আর্থিক সঙ্কটে বিনা বা যথাযথ চিকিৎসার দুঃসময় তার থাকবে না। সবাই তার জন্য উদ্বিগ্ন হবে। বিপদের দিনে কেউ হাত বাড়িয়ে দিলে মুহূর্তেই বিপদ দূর হয় এবং মন আনন্দে ভরে যায়, সবাই জানি।
* শিরোনামের কবিতার লাইন কবি নির্মলেন্দু গুণ
সাম্প্রতিকের লিংক
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৮
বদিউজ্জামান মিলন বলেছেন: জাকির ভাইকে আমি পেয়েছিলাম আজকের কাগজে কাগজে। বড় ভাই আমাকে পান খাওয়ার অফার দিতেন। আমি খেতাম না। উনি একটা দুর্দান্ত রিপোর্ট করেছিলেন যা এখনও আমার মনে দাগ কেটে আছে। হেডিং ছিল: মরা মুরগি কোথায় যায়? মরা মুরগি রান্না করে মানুষকে খাওয়াতো একদল মানুষ নামের জানোয়ার। এটা ছিল দুর্দান্ত এক রিপোর্ট। জাকির ভাই দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরবেন, এটাই চাই।